ভ্রমণ লাটপাঞ্চার– যেখানে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা অলোক গাঙ্গুলী শরৎ ২০১৯

লাটপাঞ্চারঃ যেখানে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা

অলোক গাঙ্গুলী

কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি পথ দিয়ে চলতে চলতে নিজের মন থেকেই কখন যেন গুনগুন করে কন্ঠ থেকে গানের কলি বেরিয়ে এল। একবারে যেন এই নির্জন পথের জন্যেই সুধীন দাসগুপ্ত রচনা করেছিলেন আর আরতি মুখোপাধ্যায় নিজের সুমধুর কন্ঠে সাজিয়ে তুলেছেন যা আজও বিখ্যাত।
‘হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সংকেতে
ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ,
কখনও মেঘে ঢাকা, কখনও আলো মাখা
ভুলেছি ভবিষ্যৎ’
ফেসবুকে ‘সানডে ওয়াচ’ গ্রুপে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ লাটপাঞ্চারের পাখির ছবি পোস্ট করতে থাকে। অদ্ভুত সুন্দর সব হিমালয়ের পাখি। তাই দেখি আর মনে মনে ভাবতে থাকি, ইস! একবার যদি আমিও ওখানে যেতে পারতাম তাহলে সুন্দর সব পাখিদের ছবি তুলে আনতে পারতাম। সে আর হয়ে উঠছিল না। একবার এক বন্ধু আমার পাখির ছবি দেখে মন্তব্য করেছিল, “লাটপাঞ্চার যাও। ওখানে মন খুলে ছবি তোলো আর দেখে নিজে আনন্দ পাও।”
তা তো বটেই। আমি তো ছবি তুলি নিজে আনন্দ পাওয়ার জন্য আর যদি কেউ কিছু জানতে চায় তাহলে যেটুকু জানি অথবা বই দেখে জানানোর চেষ্টা করি মাত্র। তাই হঠাৎ ২০১৮-র শীতে মনে হল, যাই হোক, এবার লাটপাঞ্চার যাবই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কম্পিউটার খুলে যাওয়ার টিকিট কেটে ফেললাম এপ্রিল মাসের জন্য। বলতে গেলে কোনও গাড়িতে সিট খালি নেই। অগত্যা সেই তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসেই সিট রিজার্ভ করলাম। আর তাজ্জব ব্যাপার, ফেরার টিকিট তো নেই। কী আর করি, আকাশপথকেই বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি মনে মনে ভাবি, সকলেই কি আমার মতো করে ভাবছে? অর্থাৎ, লাটপাঞ্চার যাওয়ার কথা সবাই চিন্তা করছে নাকি? পরে ভাবলাম, তা কী করে হয়? ওই রাস্তায় দার্জিলিং, গ্যাংটক সব পড়ে। লাটপাঞ্চার আর ক’জন জানে, কিছু পক্ষীপ্রেমিক ছাড়া? অপেক্ষায় রইলাম ১৪ই এপ্রিলের ২০১৯-এর জন্য।
কিন্তু জানুয়ারি মাসের শেষে এক কাণ্ড ঘটে বসল। নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ১৭তম লোকসভা ভোট গ্রহণের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেন, আর ওই অঞ্চলে নির্বাচনের দিন নির্ধারিত হল ১৮ই এপ্রিল। অর্থাৎ, আমার ফেরার দিন। এখানে অবশ্য জানিয়ে রাখি যে ইতিমধ্যেই আমি ইন্টারনেট দেখে ওখানে এক হোম-স্টেতে থাকার ব্যাবস্থাও করে রেখেছিলাম। হোম-স্টের মালিকের নাম বিকাশ গুরুং। নেট ব্যাঙ্কিং মারফত কিছু টাকা ওকে অগ্রিমও পাঠিয়েছিলাম। এই অবস্থায় কিছুটা চিন্তিত হয়ে আমি আবার বিকাশকে ফোন করি। ও তো হেসেই অস্থির। বলে, “আপনার মতো বহু মানুষ আসছে কলকাতা থেকে, আর ওই একই দিনে ফিরবে তারা। বিভিন্ন হোম-স্টে এখানে আগে থেকেই বুক হয়ে আছে, একদম চিন্তা করবেন না।”
কিছুটা মনোবল ফিরে পেলাম ওর কথায়। আর কোনও চিন্তা নেই। ১৪ই এপ্রিল দুর্গা দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম।
সমস্যা আরও একটা ছিল। তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস রাত দুটো চল্লিশ মিনিটে পৌঁছায় নিউ জলপাইগুড়ি। ওই রাতের অন্ধকারে লাটপাঞ্চার যাই কী করে? ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিকাশকে জানিয়ে রেখেছিলাম গাড়ি পাঠানোর জন্য। ও বলেওছিল যে ওখান থেকে গাড়ি রওনা দেবে ভোরের আলো ফোটার পর। অর্থাৎ সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার আগে গাড়ি নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাবে না। মনে মনে এই প্রথম প্রার্থনা করছিলাম যে ট্রেন যেন লেট করে চলে। কিন্তু এবারই ট্রেন, আর সবসময়ের মতন ভগবানও আমার কোনও প্রার্থনাতে কর্ণপাত করলেন না। গাড়ি একবারে সঠিক সময় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে থামল। আমার পরিবারকে নিয়ে নির্দিষ্ট প্রতীক্ষালয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।
ঘড়িতে ঠিক সাতটা কুড়ি মিনিট। আমার ফোন বেজে উঠল। অজানা নাম্বার থেকে কেউ কল করেছে। ফোন তুলে শুনতে পেলাম একজন আমার নাম বলছে, সে গাড়ি নিয়ে এসেছে লাটপাঞ্চার থেকে। গাড়ির বর্ণনা দিয়ে আমাদের স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসতে বলল। গিয়ে দেখি এক মাঝবয়েসি চালক, নাম রঙবাহাদুর রাই আমাদের নিতে এসেছে। গাড়িতে ওঠামাত্র আবার ফোন, এবার বিকাশ। জেনে নিল যে গাড়ি পৌঁছে গিয়েছে আর আমরা আমাদের গন্তব্যস্থানের জন্য রওনা হয়ে পড়েছি। আমাদের গাড়ি জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে, সালুগাড়ার সেনা ছাউনি পেরিয়ে ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার চেহারা পালটে গেল। মহানন্দা অভয়ারণ্য আরম্ভ হতেই দৃশ্যপটে পরিবর্তন ঘটল। দু’দিকে শাল আর সেগুনের জঙ্গল, আর তারই মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে সেবক রোড ধরে তিস্তার পাড় দিয়ে। মনভোলানো দৃশ্য। চার ঘণ্টা প্রতীক্ষালয়ে অপেক্ষা করার ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে। একটু একটু করে আমরা পাহাড়ের ওপর উঠছি, গাড়ি একের পর এক বাঁক পেরিয়ে চলছে তিস্তার পাড় দিয়ে। একটু পরেই সেবক কালীবাড়ি, আর তারপর বিখ্যাত করোনেশন ব্রিজ তিস্তার ওপর, যেদিকের রাস্তা চলে যায় বাগরাকোটের দিকে, ডুয়ার্স অঞ্চলে। আমরা সোজা চলে এলাম কালীঝোরার দিকে। তারপর বাঁদিকে ঘুরেই খাড়া উঁচু রাস্তা। এখান থেকে লাটপাঞ্চার ১৩ কিমি।
কালীঝোরা থেকে লাটপাঞ্চারের দিকে ঘুরতেই এই প্রথম রঙবাহাদুরের মুখ থেকে কিছু কথা বের হল। সে জানাল যে প্রথম ৭ কিমি রাস্তা বেশ খারাপ, আবার তারপর ৬ কিমি বেশ ভালো। পাহাড়ি রাস্তা, ঢাল বেয়ে গাড়ি দুলে দুলে চলেছে। দুই পাশে শাল আর সেগুন, আরও অজস্র নানারকম নাম না জানা গাছ। গাছের ডালের ফাঁকে ফোকরে পাখি ডেকে চলেছে নানা প্রজাতির। কিছুটা দূরত্ব যাওয়ার পর রঙবাহাদুর এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে কিছু দেখানোর চেষ্টা করল। দেখতে পেলাম, দূরে এক পাহাড়ের ঢালে কিছু গাছের বাগান। ও জানাল, ওটা কমলালেবুর বাগান। জানুয়ারি মাসে ওই গাছগুলি সব হলুদ ফলে ভরে থাকে। ওই পাহাড়ের পরের পাহাড়টাতে দেখতে পেলাম বেশ কিছু ঘরবাড়ি, ওটাই লাটপাঞ্চারের গ্রাম। এখান থেকেই এক মনোরম দৃশ্য, কাছে গেলে না জানি কী হবে! লেপচা ভাষায় লাট মানে হল বেত আর পাঞ্চার মানে জঙ্গল। অর্থাৎ, বেতের জঙ্গল। লাটপাঞ্চার হল গিয়ে মহানন্দা অভয়ারণ্যের উচ্চতম অংশ।
এখানে অবশ্য বলে রাখি, আজকাল কোনও জায়গার বিশদ বিবরণ পাওয়ার জন্য ইন্টারনেটে গুগল যথেষ্ট। সব তথ্যই ওখানে পাওয়া যায়, যেমন বিকাশের হোম-স্টের ব্যাপারে সব খবর আমি নেট থেকেই সংগ্রহ করেছি। তবে একটু জানিয়ে রাখি, এখনও সেরকম পর্যটক এখানে আসে না। ভিড় নেই বললেই চলে। যারা আসে তারা বেশিরভাগ পক্ষীপ্রেমিক আর কিছু বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী, বড়ো বড়ো লেন্স আর দামি ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলের আনাচে-কানাচে বসে আছে। তারা একেবারেই কোনও উপদ্রব পছন্দ করে না যাতে পাখি দেখায় বাধা হয়। আমিও একজন পক্ষীপ্রেমিক বটে, কিন্তু বেশি দামি ক্যামেরা আমার কাছে নেই কারণ আমি তো অন্যদের মতন পেশাদার চিত্রগ্রাহক নই। পাখিদের জীবনযাপন আর ওদের সংরক্ষণের সচেনতা বৃদ্ধি করা আমার একপ্রকারের আসক্তি বলা চলে।
লাটপাঞ্চারের আরেক পরিচয় হল এখানকার সিনকোনা গাছের বাগান। দার্জিলিং, কার্শিয়ঙে যেমন চা-বাগান, তেমন এখানে সিনকোনা গাছের বাগান। এখানকার স্থানীয় মানুষের জীবিকার উৎস। ইংরেজ শাসকেরা প্রথম সিনকোনা চাষ আরম্ভ করেন মংপু থেকে। পরে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সিটং ও লাটপাঞ্চারে। এই সিনকোনা গাছের ছাল থেকে কুইনাইন (Quinine) নির্যাস বের করে ম্যালেরিয়া ও বহু অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করা হয়। সিনকোনার উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে। এই গাছের গুণাগুণ জানা ছিল ওখানকার ইনকা উপজাতিদের। মংপুতে সিনকোনার কারখানা স্থাপিত হয় ১৮৬৪ সালের কাছাকাছি ডাঃ থমাস অ্যান্ডরসন দ্বারা। কবিগুরু একবার তার শিষ্যা মৈত্রীদেবীর আমন্ত্রণে মংপু বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। মৈত্রীদেবী ছিলেন সেই সময় মংপুর স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ডাঃ এম.এম.সেনের স্ত্রী। মংপুর সেই বাড়ি আজও একটি প্রদর্শনশালা হিসাবে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রায় সব মানুষ এই সিনকোনা গাছের ওপরেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
লাটপাঞ্চারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ কখন যেন গাড়ি এসে থামল অপূর্ব এক তিনতলা বাড়ির সামনে। রঙবাহাদুরের গাড়ির ভেঁপুর আওয়াজে সামনে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে এসে উপস্থিত এক দম্পতি।

বলা বাহুল্য, এরাই শ্রী বিকাশ গুরুং এবং ওর স্ত্রী শ্রীমতী বিজেতা গুরুং। আমরা গাড়ি থেকে নামার আগেই তারা আমাদের জিনিসপত্র হাতে নিয়ে বুঝিয়ে দিল যে এখানে আমাদের আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি হবে না। আমাদের ঘর তিনতলার ওপরে। তিনটি আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুন্দর ছিমছাম ঘর, আলো-বাতাসের অভাব নেই, লাগোয়া স্নানের ঘর। আর সবথেকে সুন্দর হল, এই ঘরের সামনে রেলিং ঘেরা খোলা বারান্দা বা চত্বর। একটা বড়ো গোল টেবিল ও তিনটি চেয়ার পাতা। সামনে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য, দূরে বয়ে চলেছে তিস্তা গাজোলডোবার দিকে আর নিচে পাহাড়ের গায়ে লাটপাঞ্চার গ্রাম। আর কী লাগে?
এক কাপ চায়ের সাথে সপরিবারে আড্ডা জমিয়ে মনের কথা মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল, আহা! বাকি জীবনটা যদি এখানে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যেত। পরে অবশ্য প্রকৃতি আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছিল আমার না জেনে কিছু বলে ফেলা। সে কথায় পরে যাওয়ার যাবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মন থেকে একটাই গান বেরিয়ে এসেছিল আমার মুখে, কবিগুরুর লেখা – ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।’ আর ঠিক তাই। লাটপাঞ্চারে বিকাশের হোম-স্টের বারান্দা থেকে দৃশ্য দেখে আমার কিন্তু ভবিষ্যৎ ভুলে এখানেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বাস্তবে ফিরে এলাম। যা হওয়ার নয় তাই ভেবে লাভ কী!
বিকাশ জানাল, এখনকার মতন স্নান সেরে আমরা নিচে গিয়ে দুপুরের আহার করে খানিক বিশ্রাম করে নিতে। অবশ্য আমাকে বলে রাখল যে ক্যামেরা সবসময় হাতের কাছে তৈরি রাখতে, কখন কী নজরে পড়ে যায় ঠিক নেই এখানে। বিকাশের বাড়ির বারান্দা থেকে গাছগুলি একেবারে চোখের সামনে, অর্থাৎ একবারে চোখের দৃষ্টি বরাবর, যাকে ইংরেজিতে বলে আই লেভেল। সুতরাং, এখান থেকে ছবি তোলার আনন্দই আলাদা। বলতে না বলতেই হঠাৎ বিকাশ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল উড়ন্ত এক পাখির দিকে। দেখি এক বিশাল ধনেশপাখি, রুফাস নেকড হর্নবিল (Rufous Necked Hornbill), উড়তে উড়তে সামনের এক গাছের ডালে গিয়ে বসল। এত কাছ থেকে এই ধনেশের দর্শন আমি আগে কখন চিন্তাও করিনি। পাখিটি ওই গাছের ফল সংগ্রহ করতে এসেছে। ওর গলার নিচে একটা ছোটো লাম্প (থলে) মতন আছে। ওতে করে ফল নিয়ে যায় স্ত্রী ধনেশ ও বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। বিকাশ জানাল যে এই সময় স্ত্রী ধনেশ ডিম পাড়ার জন্য গাছের কোটোরে বাসার মধ্যে আছে। এসেই ধনেশের ছবি সংগ্রহ করতে পেরে মনটা বেশ আনন্দে ভরে উঠল।
স্নানাহার সেরে নিয়ে বিকাশের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় দেখি সামনে গাছের ডালে একটা নীল রঙের পাখি বসে। ক্যামেরার লেন্স জুম করে দেখেই বুঝলাম যে এটার বাংলা নাম নীল কটকটিয়া (Verditer Flycatcher)।

ভীষণ সুন্দর পাখি, চোখ সার্থক আর লেন্সবন্দি করতে পেরে আরও খুশি। এর মধ্যেই বিকাশও এসে গিয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিছুটা পথ গিয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে চলে গিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে।
আমরা সেই পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। বিকাশ আমার সামনে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে আর ক্রমশ আমাকে সাবধান করে চলেছে যেহেতু আমি এই পথ চলায় অভ্যস্ত নই। মিনিট দশেক চলার পরেই আমরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। বিকাশ জানে এখানে কী পাখি দেখা যায়, ধনেশ আর লং টেইলড ব্রডবিল (Long Tailed Broadbill), ভারি সুন্দর পাখি। তীব্র এক মিষ্টি ডাক এই পাখির। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করলাম। দেখলাম, বিকাশ এখানকার পাখির ব্যাপারে বেশ সচেতন। ও জানে কখন, কোথায় কী পাখি দেখা যাবে। একজন বিচক্ষণ গাইডের সব গুণাগুণ ওর মধ্য রয়েছে। কিন্তু ও গাইডের কাজ করে না। কেবলমাত্র আমাকে কিছু ছবির শট পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুনতে পেলাম এক জোরালো শিসের শব্দ, কানের পর্দা ভেদ করে যাওয়া। এটাই ব্রডবিল। একটু পরেই তারা উপর থেকে নিচে নেমে এল। অত্যন্ত সুন্দর দেখতে এই পাখি। গায়ের রঙ সবুজ, পাতার সাথে মিশে থাকে। দুই গালে হলুদ ছোপ, মাথা কালো রঙের আর মাথার ওপরটা নীল। ঠোঁটদুটো চওড়া, তাই বোধহয় ইংরেজি নাম ‘ব্রড বিল’। কী সুন্দর সুরেলা শিস ব্রডবিলের! মন ভরে সেদিন ছবি তুলেছিলাম পাহাড়ি এই পাখির।
কিছুটা পথ আরও এগিয়ে চললাম দু’জনে। এবার বেশ ঘন জঙ্গল, ভিতরটা অন্ধকারও। বিকাশের কাছে জেনে নিলাম কোনও বন্যজন্তু, যেমন লেপার্ডের আগমন ঘটবে না তো! ও বলল, লেপার্ড দেখা যায় তবে সূর্যাস্তের পর। কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া গেল।
হঠাৎ একটা গাছে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। ওইদিকে তাকিয়ে দেখি এক পুরুষ হর্নবিল, রুফাস নেকড। সে ওখানে বসে সজোরে গাছর ডালে তার ঠোঁট ঘষে চলেছে। এর মানে কী জানতে চাইলাম বিকাশের কাছে। বিকাশ বলল, এখান থেকে আমাদের যেতে হবে। কারণ, ওর বাসা হয় এই গাছে, নয়তো কাছেই কোথাও। আমাদের উপস্থিতি ওর একদমই পছন্দ নয়। আমরা যাতে ওর বাসা দেখতে না পাই তাই ও আমাদের এখান থেকে বিদায় হতে বলছে। বেশিক্ষণ থাকলে ও হয়তো এখান থেকে উড়ে চলে যাবে আর ফিরবে না আজ। তখন কোটরের মধ্যে থাকা স্ত্রী হর্নবিল আর বাচ্চারা না খেয়ে থাকবে। এই কথা শুনে ভালো লাগল না। তাই ঠিক করলাম আমরাই ফিরে যাব। তবে যাওয়ার আগে ও কিছু পোজ আমাকে অবশ্যই দিয়ে গেল যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে। আর থাকবে আমার আজকের অভিজ্ঞতা হর্নবিলের ব্যবহারের। আমি সত্যিই জানতাম না যে হর্নবিল রেগে গেলে এরকম আচরণ করে থাকে।
প্রত্যেক সফরেই কিছু না কিছু নতুন শেখা যায়। জয়ঢাকে ধনেশপাখি নিয়ে লেখা পাখি দেখা প্রবন্ধে এই তথ্যটা আমি দিতে পারিনি, কারণ আমার জানাই ছিল না। আর হয়তো জানতেও পারতাম না লাটপাঞ্চার না এলে, বিকাশের সাথে দেখা না হলে।
সেদিন ঘরে ফিরে এসে আর কোনও কিছু দেখা নয়, সোজা বিশ্রাম। একটা ছোটো নিদ্রা দিয়ে বিকেলে উঠে বারান্দায় এসে বসলাম সকলে। সামনে আর পাশের পাহাড়গুলো কী অপূর্ব দেখাচ্ছে! অল্প কুয়াশা মতন আছে, তবুও পাহাড়ের দৃশ্য সবসময়ই মনোরম। এর মধ্যেই এসে গেল গরম চা আর সাথে আলুর চপ, একদম গরম। আহা! সে কী অপূর্ব স্বাদ!
আমি আমার ক্যামেরা থেকে সকালের আর দুপুরের তোলা ছবিগুলো আমার ট্যাবে নিয়ে নিলাম। বিকাশকে ডেকে পাঠালাম ছবিগুলি দেখার জন্য। চায়ের আসরে বিকাশও যোগ দিল আর ছবি দেখে তো ও রীতিমতো উদ্দীপ্ত। অনেকক্ষণ আমরা ওখানেই বসে কথা বললাম। অন্ধকার নেমে এল। দূরে তিস্তার দিকে কিছু বসত রয়েছে, সেই আলো রাতের অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। রাতে কী খাদ্য আমাদের পছন্দ তা জেনে নিল বিকাশের স্ত্রী। আর আমরা সেই রাতে নিরামিষ ভোজন করতে ইচ্ছুক জানিয়ে দিলাম। স্রেফ ডাল, আলু ভাজা আর একটা সবজি। বিকাশ জানিয়ে রাখল, পরের দিন সকাল সাড়ে ছ’টায় রঙবাহাদুর চলে আসবে। প্রথমে একটা পাখি দেখার জায়গায় যাব আর পরে সকাল ন’টায় অহলদাড়া ও নামথিং লেক। সেই মতন আমরা রাতের খাওয়ার সেরে নিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলাম।
খুব গাঢ় ঘুম হল সকলের। এক ঘুমেই সকাল। আমাদের হোম-স্টের ঠিক নিচেই রঙবাহাদুরের বাড়ি। ও তখন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করল তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরাও সম্মতি জানালাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে রঙবাহাদুর হাজির। আমরাও যাওয়ার জন্য তৈরি। সকালবেলা দেখি বিকাশ অর্কিডের পরিচর্যা করছে। আমরা ওকে সুপ্রভাত জানিয়ে রওনা দিলাম পাখি দেখার উদ্দেশ্যে।
আকাশ মেঘলা ও অল্প কুয়াশাও ছিল। এই অবস্থায় পাখির ছবি খুব একটা ভালো আসে না। যেখানে গিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে তখন ওখানে আমরা মাত্র তিন জন। পাখি দেখার জন্য অনুকূল পরিবেশ। কোনও হই-হট্টগোল নেই। পাখিরাও সহজে, নির্বিঘ্নে ধরা দেবে। এই ভেবে বসে রইলাম। লাটপাঞ্চারের এই অংশটিও মহানন্দা অভয়ারণ্যের অধীনেই পড়ে। দূর থেকে দেখলাম গাছে কিছু রাজ-ঘুঘু (Emerald Dove) বসে। পুরুষ-পাখির কপাল সাদা আর চোখের ওপর দিয়ে সাদা ডোরা লক্ষ করা যায়। পিঠ ও পাখনা পান্নার মতো উজ্জ্বল সবুজ, লেজ পাটকিলে ও পেট লালচে পাটকিলে। ঠোঁট লালচে ও পা জোড়াও লালচে। কিন্তু আলো ভালো না থাকার জন্য ছবি খুব বেশি ভালো আসেনি।
এরই মধ্যে আরও দুটো গাড়ি এসে হাজির। সবই এখন পক্ষীপ্রেমিক। এটা কী পাখি, ওটা কী পাখি, অনেকের কৌতূহল। ফিসফিস করে কথা বললেও অনেকে মিলে বেশ জোরেই মনে হয়। তার ওপর আবার সমানে ক্যামেরার শাটারের শব্দ। এই অবস্থায় পাখি আসে কী করে? এর মধ্যে একদলের সাথে আসা এক পাখির গাইড, নাম উজ্জ্বল, সে সকলকে সাবধান করল। বেশি কথা বললে পাখি দেখা যাবে না। বাধ্য ছাত্রের মতো সবাই দেখলাম চুপ করে গেল।
এরপর শুরু হল পাখিদের কলরব। এক এক করে ব্রড বিল, আলতাপরি (Scarlet Minivet), নীলশির শিলাদামা (Blue Capped Thrush),

রেখা বুলবুল (Striated Bulbul) প্রভৃতি। আর সবশেষে দেখা মিলল আবার ধনেশের। এবার কিন্তু স্ত্রী ধনেশের, রুফাস নেকড। তফাত কেবল গায়ের রঙের পুরুষের সাথে, পুরোটাই কালো রঙের। ডাক কর্কশ রকমের। একটু অবাক লাগল যে এই সময়টা পাখিদের প্রজননের সময়, বিশেষ করে ধনেশের। তাহলে এই সময় এই স্ত্রী ধনেশটি একা বাইরে কেন? উজ্জ্বলকে প্রশ্ন করলাম। ওর কাছেও এর উত্তর ছিল না। হেসে বলল, ও বোধহয় এখনও সিঙ্গেল।
লাটপাঞ্চারের ভোরে পাখি দেখার এই পর্ব বেশ সফল। এর মধ্যেই আরও কিছু দর্শক এসে উপস্থিত। বুঝলাম আর থেকে লাভ নেই। ফিরে গেলাম হোম-স্টের দিকে সকালের জলখাবার সেরে নিয়ে পরের পর্ব অহলদাড়ার জন্য। এখানকার সবথেকে উঁচু ও সবথেকে সুন্দর স্থান দেখার জন্য। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ৪৫০০ ফুট মতো।
নামথিং পোখরি অথবা লেক আর আহালদাড়া লাটপাঞ্চার থেকে ৫ কিমি দূরত্বে। এই দুই স্থানের বিস্তৃত বিবরণে আর যাব না। গুগল দেখলেই সব জানা যায়। কেবল জানিয়ে রাখি, নামথিং পোখরি একধরনের টিকটিকি জাতীয় প্রাণীর জন্য বিখ্যাত যার ইংরেজি নাম হিমালায়ন স্যালাম্যান্ডার (Himalayan Salamander) যা এখন এক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী আর প্রায় বিলোপ হওয়ার মুখে। এখানকার কর্তৃপক্ষ তাই এই লেককে এখন কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে। পর্যটক ও স্থানীয় মানুষের লেকের ভিতর প্রবেশ কঠিনভাবে বর্জিত। বন দফতরের এক প্রশংসনীয় প্রয়াস।অহলদাড়াতে ৩০০ মিটার মতন হেঁটে উঠতে হয়। ওপরে ওঠার পর এক ৩৬০ ডিগ্রির এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে এখান থেকে দৃষ্টিপাত করলে একদিকে কালিম্পং আর অন্য দিকে সিকিম এবং জানা গিয়েছে যে ভাগ্য সহায় থাকলে জুলুকের সিল্ক রুট পর্যন্ত দেখা যেতে পারে আর তার সাথে অবশ্যই দেখা মিলবে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালার। তবে আমাদের কপাল মন্দ, যেমন কুয়াশা আর তেমন মেঘ, সবকিছুই আবছা। কী আর করা যাবে? ভাগ্যের দোহাই দিয়ে ফিরে এলাম হোম-স্টেতে। দুপুরের আহার সেরে আবার প্রস্তুত হলাম দিনের শেষ ভ্রমণের জন্য। এবার লাটপাঞ্চারে মহানন্দা অভয়ারণ্য দেখার জন্য।
পাহাড়ের পাশ কাটিয়ে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে অভয়ারণ্যের ভিতরে। জনমানবশূন্য এলাকা। মনে হল, আমরা তিনজন ছাড়া আর বোধহয় কেউ নেই। আমাদের গাড়ি একাই ছুটে চলেছে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর দেখি দূরে একটা কালো রঙের ছোটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর চালক আমাদের থামার জন্য ইঙ্গিত করছে। প্রথমে মনে করলাম ও বুঝি কোনও বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। কাছে যাওয়াতে বুঝলাম ও দূরে এক গাছের দিকে ইশারা করছে। অবাক হলাম যে এও পক্ষীদের ব্যাপারে একইরকম সচেতন। ও বলতে পারল যে পাখিটা দেখা যাচ্ছে ওটা এক বিরল প্রজাতির ঈগল পাখি, প্রায় বিলুপ্তির মুখে। ইংরেজি নাম রুফাস বেলিড ঈগল।

সূচনা বেশ ভালো হল, প্রবেশ করা মাত্র এক বিপন্ন জাতির পাখির দেখা পেলাম।
অভয়ারণ্যে প্রবেশ মূল্য মাথাপিছু ৫০ টাকা। ভিতরে দেখা পেলাম আমাদের মতো কলকাতা থেকে আসা এক পরিবারের ও এক ব্যাবসায়ি চিত্রগ্রাহকের। আমাদের সাথে রয়েছে একজন গাইড। এই জঙ্গলে অসংখ্য পাখি। প্রায় ২৪০ প্রজাতির পাখি রয়েছে এই লাটপাঞ্চারে। কিন্তু পাখি দেখার জন্য লাগে অসীম ধৈর্য ও সময়ের।
এক গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ আমার স্ত্রী গাছের ডালে কিছু নড়াচড়া লক্ষ করল। একটা কালো রঙের কোনও জন্তু মনে হল। আমি সাথে সাথে আমার ক্যামেরা চোখে দিয়ে দেখি এক মস্ত বড়ো কাঠবিড়াল। কালো, কেবল গলার কাছে সাদাটে। আমার গাইড দৌড়ে এল। ও বলল, ওটা জায়েন্ট ব্ল্যাক স্কুয়েরেল (Giant Black Squirrel)।

এই ছবিটা আমার লাটপাঞ্চারের পুরস্কার আর সাথে রুফাস বেলিড ঈগলও রইল। আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম এই কারণে যে ওই সময় আমি ছাড়া আর কোনও ছবি শিকারি কাছাকাছি ছিল না। এই দুটি শিকার আমার নিজস্ব, আমার একারই লেন্সবন্দি হয়ে রইল এই দুটি প্রাণী।
হঠাৎ এর মধ্যেই কোথা থেকে মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম। ঝিরঝির করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। এক ছাউনির তলায় আশ্রয় নিলাম। বেশ অনেকক্ষণ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় রইলাম। একটু ধরার পর আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এবার কিন্তু আর হতাশ হতে হয়নি, এক এক করে বেশ কিছু পাখি ধরা দিল। তার মধ্যে রাঙা বউ [(মেরুন ওরিওল) (Maroon Oriole), রাজগাংরা (সুলতান টিট) (Sultan Tit)], কালো বুলবুল (Black Bulbul), রুফাস সিবিয়া (Rufous Sibia) ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে কিন্তু রঙবাহাদুর এসে আমাদের সাবধানবাণী শুনিয়ে গেল। এখনই ঘরে না ফিরলে পরে বিপদ হতে পারে পাহাড়ি রাস্তায়। এই ভেবে আর বিলম্ব না করে আমরা রওনা দিলাম হোম-স্টের দিকে।
ঘরে পৌঁছতেই বিকাশ বলল যে আকাশের রকমফের মোটেই ভালো নয়। আমরা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে নিচের ঘরে গিয়ে বসলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমার ট্যাবে বিকাশ আমার তোলা ছবিগুলো দেখছিল আর বেশ আনন্দ পাচ্ছিল। বিশেষ করে জায়েন্ট স্কুয়েরেলের ও রুফাস বেলিড ঈগলের ছবি দেখে তো ও রীতিমতো খুশিতে আপ্লুত। আমারও খুব ভালো লাগল যে আমার ছবি দেখে কেউ প্রশংসা করল। এরই মধ্যে কখন যেন বৃষ্টি বেশ জোরের সাথেই শুরু হয়ে গেছে। মেঘের গর্জনও বেশ জোরে হয়ে চলেছে। বিকাশ বলে গেল, বেশি দেরি না করে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে ঘরে চলে যেতে। তাই আমরাও রাত আটটার মধ্যে ডিনার সেরে ফেললাম।
যত রাত বাড়ছে তত আবহাওয়া খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে কারেন্টও চলে গেল। বিকাশের ইনভার্টার আছে ঠিকই, কিন্তু তাও বা কতক্ষণ চলবে কে জানে?
রাত দশটা বাজতেই শুরু হল হাওয়া। আর অল্প সময়ের মধ্যেই তা গতি বাড়িয়ে ঝড়ের রূপ ধারণ করল। ওরকম ঝড় বোধহয় আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। চারদিকে নানারকম শব্দ শুনতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে কারও বাড়ির টিনের ছাদ পড়ে গেল। কোথাও গাছ ভেঙে পড়ার আওয়াজ।
রাত সাড়ে বারোটায় সকলে জেগে তখন লাটপাঞ্চারে। একটু পরেই আমাদের দরজায় টোকা। বিকাশ আর ওর স্ত্রী। দু’জনে মিলে আমাদের ডাকতে এসেছে। হোম-স্টেতে সেদিন আমরা একাই অতিথি। ওই ঝড়জলের মধ্যে বিকাশ আর ওর স্ত্রী আমাদের বলল এখনই নিচে নেমে যেতে। আমরাও ওদের কথামতো নিচের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিকাশের ইনভার্টার আর কাজ করছে না। আমরা আমাদের টর্চ জ্বালিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি, কারণ এই অবস্থায় ঘুম আর আসবে না।
সেই রাতেই ঠিক করে নিলাম, কাল সকালেই আমরা লাটপাঞ্চার ত্যাগ করব। এখানে আগমনের প্রথমদিন এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মনে হয়েছিল বাকি জীবনটা ভবিষ্যৎ ভুলে এখানে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়। কিন্তু প্রকৃতি আমাকে বুঝিয়ে ছাড়ল যে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। তোমার শিকড় যেখানে তোমাকে সেখানেই মানাবে। অন্য চিন্তা মাথায় না আনাই ভালো।
সকালের আলো ফুটতেই বাইরে বেরিয়ে বিকাশের কাছে সব হাল জানতে চাইলাম। ও বলল যে পাহাড়ের ওপরদিকে অনেক বাড়ির চালা উড়ে গেছে, তবে গ্রামের সব লোক ইতিমধ্যেই কাজে লেগে গেছে। বিকাশের সাথে ওর তিনতলার ঘরে উঠে দেখি এক সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে। যে খাটে আমার মেয়ে শুয়ে ছিল, ওই বিছানার ওপর জানালার কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। দেখে দু’জনেই প্রায় একসাথে আঁতকে উঠেছি। আমার মনে হল, কাল রাতে ঝড়ের সময় বিকাশ আর ওর স্ত্রী আমাদের কাছে বোধহয় দেবদূত হয়ে এসেছিল যার জন্য এক মস্ত বড়ো বিপদের হাত থেকে আমরা রেহাই পেয়েছি।
এক গাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়ে গেল যে নিচে নামার রাস্তা পরিষ্কার আছে। আমি আমার সিদ্ধান্ত বিকাশকে জানালাম। তাছাড়া পরের দিন এখানে নির্বাচন। গাড়ির কী অবস্থা হবে তাই ভেবে এই ঠিক করলাম। বিকাশ নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়াল। আমরা বেলা এগারোটার মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে রঙবাহাদুরের গাড়িতে মালপত্র তুলে দিলাম। বিকাশ ও বিজেতাকে আমরা বিদায় জানিয়ে লাটপাঞ্চার ত্যাগ করলাম এবারকার মতো। কিন্তু আবার ফিরে আসব এই বিকাশের হোম-স্টেতেই। কারণ, আমি ঘুরে দেখেছি ওর তিনতলার খোলা বারান্দার মতো দৃশ্য আর কোনও হোম-স্টেতে পাব না। ওটাই পাখি দেখার আদর্শ স্থান এবং সবথেকে আদর্শ জায়গায় অবস্থিত ওর হোম-স্টে। তাই বোধহয় ও নাম রেখেছে আদর্শ হোম-স্টে। বিকাশের হোম-স্টের জন্য লগ ইন করতে হবে http://www.adarshhomestaylatpanchar.com। এখানেই সমস্ত তথ্য পাওয়া যাবে।
গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে নিচে নামছে। যাওয়ার সময় যেসব জায়গার ওপর দিয়ে গিয়েছিলাম সেগুলো আবার ভালো করে দেখে নিচ্ছি। রঙবাহাদুর একজায়গায় এসে গাড়ি থামিয়ে দেখাল এক গাছের ডালের মাথার ওপর এক বড়ো ধরনের ঈগল পাখি। একটি ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল (Indian Spotted Eagle)।

যেতে যেতেও লাটপাঞ্চার আমাকে তার শেষ স্মৃতি রেখে দেওয়ার জন্য কিছু উপহার দিয়ে গেল। একজন পক্ষীপ্রেমিক ও প্রকৃতিবাদী হয়ে এই স্থানে দ্বিতীয়বার না এসে পারা যায়? রঙবাহাদুর আমাদের শিলিগুড়িতে হোটেলে নামিয়ে বিদায় নিল।
পরের দিন আমাদের উড়ান বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে বিকেল পাঁচটা কুড়ি মিনিটে। সারাদিন বসে আমরা লাটপাঞ্চারের স্মৃতিরোমন্থন করে গেলাম মধুর এবং ভয়ংকর সেই রাতের, আর ট্যাবে বসে সমস্ত ছবিগুলো বারবার দেখে গেলাম। অতি চমৎকার এই পাহাড়ি গ্রাম আর তার মানুষের কথা জানাতে পেরে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। অবাক লাগে ভেবে যে প্রায় প্রতিটি মানুষই প্রকৃতি সম্বন্ধে কতটা সচেতন। তারা একের বিপদে-আপদে কীরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরবাড়ি সারাই করতে নেমে পড়ল। কর্তৃপক্ষের অপেক্ষায় কেউ কিন্তু বসে থাকল না। তবে হ্যাঁ, বিদ্যুৎ ফিরে আসতে কিছুদিন অন্তত সময় লাগবেই। এরপরেও লাটপাঞ্চার কিন্তু থাকবে লাটপাঞ্চারেই। আরও একটা কথা, সেদিন রাতের ঝড়ের পর আমরা সকলেই চিন্তা করছিলাম হর্নবিলের কথা। একটা উদ্বেগ ছিল যে ওদের বাসাটা ঠিক আছে তো? শিলিগুড়ি পৌঁছানোর পর বিকাশ ফোন করে জানিয়েছিল যে জঙ্গলের সব গাছ ঠিক আছে। একটাও পড়েনি। যাক। চিন্তামুক্ত হলাম। এরপরে যারা আবার আমার আগেই লাটপাঞ্চারে যাবে তারা নিশ্চয়ই হর্নবিলের পুরো পরিবারকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে। বলে রাখি যে লাটপাঞ্চার বেড়াতে যাওয়ার সঠিক সময় হল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস। এই সময় একটু শীত থাকলেও আবহাওয়া ভালো এবং পরিষ্কার থাকে। গাছে কমলালেবু ফলে থাকে আর পাখির আগমন হয় অনেক বেশি। এই সফরে এটা জেনে গেলাম। তাই পরের বার অবশ্যই জানুয়ারির জন্য অপেক্ষা রইল।

জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ লাটপাঞ্চার– যেখানে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা অলোক গাঙ্গুলী শরৎ ২০১৯

Leave a comment