মোতিবিবির আয়না
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
রহমতুল্লা হাকিমের ঘরে দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন ছিল কিডোর। অবশ্য ওর শুধু একার না। সাথে ছিল রিবাই, রায়ান আর দ্যুতিও। আর হ্যাঁ, লোকনাথদাদুও ছিলেন ওদের সাথে।
বয়স প্রায় পঁচানব্বই ছুঁই ছুঁই। শরীরীটা বেঁকে গিয়ে ধনুকের আকার নিয়েছে। হাত দুটো এত সরু যে দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন জলের পাইপ! গলার কাছের চামড়াটা ঝুলে ধুতির মালকোঁচার আকার নিয়েছে! গালের চামড়াটা বোধ হয় কিছুদিনের মধ্যেই খসে মাটিতে পড়ে যাবে। চোখের মণিজোড়াও আর কিছুদিনের মধ্যেই কোটরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। দুই ভুরুর মধ্য থেকে উঠে এসেছে টিয়াপাখির ঠোঁটের মত টিকলো একটা নাক। বলতে বাধা নেই পঁচানব্বইতেও সেটা অক্ষত এবং সুন্দর। তার সাথে আছে দশটাকার কয়েনের আকারের গোল কাচের চশমা। মনে হয় ভদ্রলোক প্রয়োজন মত কাচের ভেতর আর বাইরে, দুদিক থেকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। রহমতচাচার গায়ের রং হিংসে করার মত। একেবারে যেন গোলাপি মুক্তো। মাথার কয়েক গাছা চুল দক্ষিণ থেকে উত্তরে গিয়ে মিলেছে। গালে দাড়ির গোছাটা দুন্দুভির মত নীচে নেমে এসে আবার ওপর দিকে উঠে গেছে।
রহমতুল্লা হাকিমকে চেনে না এমন লোক এ চত্বরে কেউ নেই। এক সময় বিশ্বাস করা হত, রহমতুল্লা হাকিমের এক দাগ ওষুধে যমও পালিয়ে নিস্তার পেতেন। উনি লোকনাথদাদুর বহুদিনের পরিচিত। মজার ব্যাপার, রহমতুল্লা হাকিম যেমন সবার চাচা, তেমন লোকনাথদাদুরও চাচা।
বিরিয়ানি, ফিরনি, গুলাবজামুন, একর পর এক সুস্বাদু খাবারে শরীর আর মন দুইই পাগল হয়ে উঠেছিল কিডোদের। খাওয়া সেরে ওরা সবাই যখন গল্পে মশগুল, ঠিক তখন ঘরের কোণে রাখা একটা আয়নার ওপর নজর আটকে গেল লোকনাথদাদুর। সাথে সাথে কেমন একটা হয়ে গেলেন উনি। কথা বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল। বারে বারে ঢোঁক গিলছিলেন। চোখে ফুটে উঠেছিল ভয় আর উত্তেজনা। কিডো, রিবাই, রায়ান আর দ্যুতি, কারও নজর এড়াল না ব্যাপারটা।
আয়নাটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে লোকনাথদাদু রহমতুল্লা চাচাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আয়নাটা এখনও রেখে দিয়েছেন রহমতচাচা?”
এতবড় আয়না কারও বাড়িতে কখনও দেখেনি কিডো। দেড় মানুষ উঁচু লম্বা। চওড়াতে দুটো মানুষ পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে। তবে এর বেশি আহামরি কিছু নেই আয়নাটাতে। তাহলে ওটা দেখে কেন মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল লোকনাথদাদুর? মাথায় ঢুকল না কিডোর।
লোকনাথদাদুর কথা শুনে দুবার খক খক করে কেশে নিয়ে রহমত চাচা বললেন, “হাঁ বেটা, ওটা ফেলে দেবার সাহস আমার হল না। তবে সেদিনের পর আর কিছু হয়নি।”
“তবু –” কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না লোকনাথদাদু।
“কোনো ভয় নাই বেটা। ওটা এখন শান্ত,” বললেন রহমতচাচা।
রহমতুল্লাচাচার কথায় লোকনাথদাদুর ভয় কাটল বলা যাবে না। তবে হাজার হাজার প্রশ্ন ইতিমধ্যেই কিডোর মনে দানা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছিল। কী আছে ওই আয়নাতে? লোকনাথদাদুর মত সাহসী লোকও কেন এত ভয় পাচ্ছেন? রহমতুল্লা চাচা বললেন, আয়নাটা এখন শান্ত। তারমানে কখনও কি কোনও ভয়াল ব্যাপার ছিল আয়নাটার মধ্যে?
প্রশ্নগুলো লোকনাথদাদুকে করলে পর উনি ফ্যাকাশে মুখে বললেন, ও গল্প না হয় নাই বা শুনলে দাদুভাইরা। কিডোরা অবশ্য ছাড়ার পাত্র নয়। গল্প লোকনাথদাদুকে বলতেই হবে। শেষে বাধ্য হয়ে গল্প বলা শুরু করলেন লোকনাথদাদু–
আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগেকার কথা। রহমতুল্লা চাচার পসার তখন তুঙ্গে। সারা কলকাতা জুড়ে ওঁর ভারী নামডাক। আগের দিন রাত থেকেই লোকে ওঁর চেম্বারের সামনে বসে থাকে রুগী নিয়ে। মাত্র পনের সেকেন্ডের ভিজিটিং টাইম। ব্যাস, তার মধ্যেই রুগীর পায়ের নখ দেখে রোগ নির্ণয় করে দেন রহমতচাচা। সাথে সাথে এক দাগ ওষুধ। ব্যাস, রুগী সুস্থ।
সেদিন ছিল রবিবার। ঘরিতে বিকেল পাঁচটা। রহমতচাচা রোজের মতই রুগী নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক এমনসময় আপাদমস্তক বোরখা ঢাকা এক আগন্তুক এসে উপস্থিত হল রহমতচাচার চেম্বারে।
“কী ব্যাপার? কাকে চাই?” হয়ত আরও কয়েকটা প্রশ্ন করতেন রহমতচাচা। কিন্তু তার মধ্যেই বোরখার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে মাঝবয়সি একটা লোক। আর তার হাতে চকচক করছে মস্ত বড় একটা ছোরা!
“বেশি কথা বললে আল্লার কাছে পারসেল করে দেব,” হাড়হিম করা গলায় বলল লোকটা। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়ে চাচা বললেন, “সে তো বুঝলাম, কিন্তু জনাব, তোমার চাহিদাটা কী?”
“আজ পর্যন্ত আমি সাতাশটা খুন করেছি। আরেকটা খুনের ফরমায়েশ পেয়েছি। কিন্তু আমার এই ডান হাতটা বেমক্কা বেইমানি শুরু করেছে। কেন জানি না, বল পাচ্ছি না হাতে। দাও দেখি এক দাগ ওষুধ।”
কথাগুলো অবলীলায় বলে গেল লোকটা! শুনে গা রি রি করে উঠল রহমতচাচার। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে দু পুরিয়া দিয়েই দিলেন লোকটাকে। অবশ্য টাকার কথা বলার সাহসও পেলেন না। বলা যায় না, নিজেই হয়ত আঠাশ নম্বর শিকার হয়ে যেতে পারেন। সেদিন মাঝরাত। সবাই ঘুমে কাদা। এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল রহমতচাচার। এত রাতে কে? ঘুমের ঘোরেই বাইরে বেরিয়ে এলেন রহমতচাচা। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে কাউকে পেলেন না। অবাক হয়ে চোখটা কচলে নজরটা এধার ওধার ঘুরিয়ে এবার আবিষ্কার করলেন খবরের কাগজে মোড়া কী যেন একটা দাঁড় করানো রয়েছে ওঁর দরজার পাশে। জিনিসটার আকারটাও বিশাল। খুলব কি খুলব না করে শেষ পর্যন্ত মনে সাহস এনে কাগজের মোড়কটা খুলে সেটার মধ্যে আপাদমস্তক নিজেকে পেয়ে চমকে উঠলেন রহমতচাচা। কারণ ওঁর সামনে তখন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা আয়না! পাশে একটা চিরকুট সাঁটা। চড়াত করে কাগজটা খুলে নিয়ে আবিষ্কার করলেন তাতে লেখা রয়েছে কয়েকটা কথা। “আমি সুস্থ আছি। আঠাশ নম্বর খুনটা করেছি। উনত্রিশ নম্বরের অর্ডারটা পেয়েছি। আমার তরফ থেকে একটা ছোটো উপহার।’’
চিরকুটটা পড়ে বুক কেঁপে উঠল রহমতচাচার। শেষ পর্যন্ত তিনি একটা খুনিকে সাহায্য করলেন! সেদিন সারারাত আর ঘুমোতে পারলেন না রহমতচাচা। পরদিনই ছুটলেন লোকনাথদাদুর বাড়ি।
“আমি বিরাট গুনাহ করে ফেলেছি বেটা।”
“কেন? কী করলেন? একে তো অসময়ে চেম্বার ফেলে চলে এসেছেন, তার ওপর এইসব কথা বলছেন,” রহমতচাচার কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বললেন লোকনাথদাদু। তারপর সব শুনে বললেন, “কই, চলুন তো দেখি আয়নাটা।”
রহমতচাচার সাথে লোকনাথদাদু ওঁর বাড়ি এসে দুজনে মিলে ভালো করে দেখতে লাগলেন আয়নাটাকে। কাঠের ফ্রেমে কাজের কায়দা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আয়নাটা বহু পুরনো। কিন্তু কী আশ্চর্য, কাচের ওপর একটাও দাগ নেই! এবার ফ্রেমের নিচের দিকে ডানদিকে নজর আটকে গেল রহমতচাচার। উর্দুতে কিছু একটা লেখা রয়েছে। যেটার বাংলা করলে দাঁড়ায় – “মোতিবিবি, ১২১৪’’।
সেটা পড়ে রহমতচাচা বললেন, “হায় আল্লা, এই আয়না তো মোতিবিবি নামে কোনও এক জনানার। আয়নাটার বয়স প্রায় আটশো বছর!”
“বলেন কী চাচা?” চোখ কপালে উঠে গেল লোকনাথদাদুর। এত পুরোনো একটা জিনিস হাতের সামনে? অবিশ্বাস্য! কিছুতেই ওটাকে ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না দুজন। কাঁপা কাঁপা হাতে আয়নাটাকে ছুঁতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে লাগল দুজনের। মনে হচ্ছিল যেন মহম্মদ ঘোরির আমলে পৌঁছে গেছেন। মসৃণ কাচটার গায়ে হাত বোলাতে দারুণ লাগছিল। যেন ভেলভেটের আস্তরণ। মনটা হঠাৎ করে ভীষণ খুশি খুশি হয়ে উঠল ওদের। কী যে শান্তি লাগছিল বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক এমন সময় কড়াং করে একটা ঝটকা। যেন হাজার ভোলটের একটা শক। সারা শরীরের শিরাউপশিরাতে ছড়িয়ে পরল রেশটা। সাথে সাথে ছিটকে সরে এলেন দুজনে। সারা শরীর কাঁপছিল ওদের। আবিষ্কার করলেন কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমে গেছে।
দুজন দুজনের দিকে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু কারও কাছেই এর কোন উত্তর নেই। হাজার কৌতূহল নিয়ে আয়নাটার দিকে চেয়ে রইলেন দুজনে।
“ওতে কারেন্ট এল কী করে?” লোকনাথদাদুর কথা শেষ হতে না হতেই বাড়ির সব কটা আলো নিভে গেল। লোডশেডিং।
“ওঃ, কলকাতা শহরে এই এক জ্বালা। যখন তখন লোডশেডিং। হায় আল্লা, কখন আলো আসে কে জানে?” রহমতচাচা মাথা দোলাচ্ছিলেন। মোমবাতি আনার জন্য পা বাড়ালেন তিনি, কিন্তু সাথেসাথেই আলো চলে এল।
“আশ্চর্য! এত তাড়াতাড়ি?”
লোকনাথদাদুর কথা শুনে মুচকি হেসে রহমতচাচা বললেন, “ভালই তো হল হে, কিন্তু তুমি তো দেখছি তাতেও বিরক্ত।”
“না না, তা না। আসলে হঠাৎ করে কারেন্ট খেয়ে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম,”বললেন লোকনাথদাদু।
আয়না পর্বটা এবার মন থেকে ঝেরে ফেললেন দুজনে। যে প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই, তা নিয়ে জলঘোলা করে কোনও লাভ নেই।
“চল, ময়নার দোকান থেকে এক কাপ করে চা মেরে আসি।” রহমতচাচার কথায় সাথে সাথে একবারে রাজি হয়ে গেলেন লোকনাথদাদু। বিকেল থেকে মেজাজটা ঝিম মেরে ছিল। একটু আড্ডা দিলে হয়ত হালকা হয়ে যাবে।
বাইরে বেরিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক লাগছিল। আয়নার ব্যাপারটা মনে উঁকি মারছিল বটে, তবে সেটাকে তেমন আমল দিলেন না লোকনাথদাদু। দুজনে ময়নার দোকানের সামনে গিয়ে দেখলেন ময়না দোকানের শাটার তুলছে। রহমতচাচা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী জনাব, এখন সন্ধেবেলা দোকান খুলছ?”
ময়না একবার রহমতচাচার দিকে তাকাল। উনি ফের বললেন, “একটু আগেই তো দেখলাম দোকান খোলা? বন্ধ করে কোথাও গেছিলে নাকি?”
ময়না তখন বলল, “সারাদিনই তো খোলা থাকে, দুপুরেও ঘুমবো না নাকি?”
“মানে?” ময়নার কথা শুনে অবাক হয়ে লোকনাথদাদু বললেন, “তোমার দোকান তো দুপুরে খোলাই থাকে। সেই সকাল ছটা থেকে রাত দশটা।”
“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠে ময়না বলল, সারাদিন দোকান খুলে রাখলে লোক আসবে? আর মাঝরাতে বন্ধ করে রাখলে লোকে কী খাবে? হাওয়া? কত লোক মাঝরাতে এখানে পাঁউরুটি আলুর দম খায় জানেন?”
“মাঝরাতে পাউরুটি!?” কিছুই বুঝতে পারলেন না লোকনাথদাদু। রহমতচাচা তখন ওঁকে চাপা গলায় বললেন, “চেপে যাও, মনে হয় অসময়ে পেটে কিছু পড়েছে। চল, চা খাই আর পালাই।” এবার গলা হাঁকিয়ে ময়নাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার লেবু চা হতে কতক্ষণ লাগবে?”
প্রসঙ্গ বদল হতে মনে হয় খুশি হল ময়না। হেসে বলল, “এই তো, বানান করে আপনার নাম বলার আগেই হয়ে যাবে চাচা।”
ময়নার দোকানের আট ফুট বাই এক ফুটের টেবিলটাতে জমিয়ে বসে আড্ডা শুরু হল রহমতচাচা আর লোকনাথদাদুর। সময়টা মার্চের প্রথম সপ্তাহ। গরম এখনও পড়েনি। ঠাণ্ডাটাও যায় যায়। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেবার এটা মোক্ষম সময়। দুজনে গল্পে মেতে উঠেছেন। এমন সময় একটা বিশেষ বিষয়ে লোকনাথদাদুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন রহমতচাচা।
“একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছ লোকনাথ?”
“কী বলুন তো?”
“আমরা এখানে কতক্ষণ বসে?”
ঘড়ি দেখে লোকনাথদাদু বললেন, “এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট হবে। কেন বলুন তো?”
“আমরা এখানে এসেছি ছটা নাগাদ। তখন রাস্তায় এত লোক দেখেছিলে? এখন প্রায় পৌঁনে সাতটা। এর মধ্যে রাস্তায় লোক কত বেড়ে গেছে দেখেছ?”
পথ চলতি লোকজনের দিকে তাকিয়ে লোকনাথদাদু একবার দেখে নিয়ে মাথাটা দুবার সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন চাচা।”
রহমতচাচা তখন বললেন, “সন্ধেবেলা রাস্তায় লোকজন চলাচল করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু –”
ময়না মনে হয় ওঁদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিল। বলল, “আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল। লোকজনের তো কাজ আছে। সবাইকে তো কাজে বেরোতে হয়, তাই না চাচা?”
“ধুৎ!” ময়নার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে লোকনাথদাদু বললেন, “সন্ধেবেলা লোকে কাজে বেরোবে? মানুষ কি নিশাচর হয়ে গেছে?”
রহমতচাচা পাশ থেকে ময়নার চায়ের প্রশংসা করে বললেন, “যাই বল ভাই, চা’টা কিন্তু হয়েছে খাসা। এই জন্যই তোমার দোকানে আসি বেটা। তারপর লোকনাথদাদুকে বললেন, “জানো লোকনাথ, আগামী শনিবার আমার বেটাজান বোম্বাই থেকে ফিরছে।”
“তাই নাকি? এ তো দারুণ খবর। শনিবার কত তারিখ?”
“আজ বুধ, পাঁচ তারিখ। তাহলে শনিবার –”
“দু তারিখ,” সাথে সাথে ময়না পাশ থেকে কড় গুনে বলে দিল।
“কী?” ময়নার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে লোকনাথদাদু বললেন, “আজ পাঁচ তারিখ হলে সামনের শনিবার দু তারিখ হয়? ব্যাটা মর্কট কোথাকার! তখন থেকে ভুল বকছে। এবার রহমতচাচার দিকে ফিরে বললেন, আগামী শনিবার আটই মার্চ পড়ছে চাচা।”
“হ্যাঁ, আট তারিখেই আমার ছেলে ফিরবে। চিঠিতেও তাই লিখেছে।”
ময়না তখন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “আজ্ঞে আজ পাঁচ হলে শনিবার কী করে আট হয়? দুই’ই তো হচ্ছে?”
লোকনাথদাদু মনে হয় এবার ময়নাকে মেরেই দিতেন। রহমতচাচা ওঁকে সামলালেন। চা পর্ব শেষ করে দুজনে এবার সান্ধ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এক পা দু পা করে দুজনে কিছুটা পথ এগিয়েছেন, এমন সময় নজরে এল সাইকেল করে খবরের কাগজ দিতে বেরিয়েছে লকাই। অবাক হয়ে রহমতচাচা ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কীরে, সন্ধেবেলা কাগজ দিচ্ছিস যে?”
প্রশ্নটা শুনে লকাই একটা রহস্যময় বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তাহলে কি সকালে দেব?”
উত্তরটা হজম হতে না হতেই লোকনাথদাদুর নজর গেল রাস্তার ধারে আশেপাশের বাড়িগুলোর ওপর। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দু-একজন তখন হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙছে। বেশ কয়েক জন বয়স্ক লোকের মুখে রয়েছে নিমের দাঁতন। কেউ কেউ আবার রাস্তার ধারের কলগুলোতে স্নান করার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। জিনিসগুলো অদ্ভুত ঠেকল বটে, তবে এবারেও সেগুলোকে তেমন পাত্তা দিলেন না দুজনে। আরও দু পা এগিয়েছেন, এবার পাড়ার মোড়ে দেখা হল সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা হরনাথের সাথে।
“কী হে হরনাথ, কেমন আছ?” জিজ্ঞাসা করলেন লোকনাথদাদু।
হরনাথ হেসে বলল, “ভালো লোকনাথদা। চললে কোথায় এই সময়? অফিস যাবে না?”
“যাব না কী রে? আজ যাইনি। এখন আর কী যাব? আমাদের নাইট নেই রে।”
“ও, তোমাদের রোজ ডে শিফট?” চোখ বড় বড় হয়ে গেল হরনাথের।
“রোজ ডে মানে? তোর কি রোজ নাইট?”
“হ্যাঁ,” লোকনাথদাদুর প্রশ্নটা শুনে কেন জানি বেশ অবাক হল হরনাথ।
“সেকী রে! এতে তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে? রোজ রাতে না ঘুমিয়ে –”
“তা কেন? তাহলে তো দুনিয়াশুদ্ধু সবারই শরীর খারাপ হয়ে যেত। সবাই তো নাইটেই ডিউটি করে লোকনাথদা। কজন আর তোমার মত দুর্ভাগা যার কিনা রোজ ডে ডিউটি?” এবার মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে হরনাথ বলল, “ইসস, রোজ দুপুরে না ঘুমিয়ে কাজ করতে হয়। তোমার খুব কষ্ট তাই না?”
হরনাথের কথা শুনে রহমতচাচাও অবাক। বললেন, “কী পাগলের প্রলাপ করছ বলত?”
হরনাথ তখন বলল, “কীসের পাগলের প্রলাপ চাচা? ঠিকই তো বললাম।
লোকনাথদাদু তখন বললেন, “ছাড় ওসব কথা। তা এখন চললি কোথায়? কাজ থেকে ফিরলি?”
“আরে গেলাম কখন যে ফিরব? এই তো সবে যাচ্ছি।”
“মানে?”
মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল রহমতচাচা আর লোকনাথদাদু, দুজনেই তখন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন। প্রবল বিস্ময়ে মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
খানিক বাদে সামলে নিয়ে বললেন, “তাহলে এই যে দেখলাম সকাল আটটার সময় অফিস যাচ্ছিলি?”
“সকাল বেলা কাজে যাব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? সেই সময় আমি অফিস থেকে ফিরি।” বলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠল হরনাথ। এই রে, আটটা পাঁচ! আমাকে এবার যেতে হবে। সাড়ে নটার মধ্যে হাজিরা না দিতে পারলে আমার কপালে দুঃখ আছে। নতুন চাকরি। দুদিনেই “অতীত’’ কালে চলে যাবে।
রুদ্ধশ্বাসে পড়িমরি করে দৌড় লাগাল হরনাথ। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না লোকনাথদাদু আর রহমতচাচা।
“কী হচ্ছে বলুন দেখি?”
“কিছুই বুঝতে পারছি না লোকনাথ।”
দুজনের কপালেই তখন চিন্তার ভাঁজ। “আচ্ছা, ঘড়ি কি উল্টো চলছে?” হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন রহমতচাচা। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে লোকনাথদাদু বললেন, “কই না তো? এখন তো আটটা বেজে দশ।”
তাহলে? পৃথিবী কি উল্টো ঘুরছে? সময়টা শুনে যেন চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল রহমতচাচার।
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে আরও দু পা এগিয়েছেন। এমন সময় দেখা হল বারীনের সাথে। বারীন এনাদের দুজনকে খুব শ্রদ্ধা করে। ও পাড়ার মোড়ে কচুরি বিক্রি করে। ওর কচুরি ভবানীপুর অঞ্চলে খুবই বিখ্যাত। একবার বিবিধ ভারতীতে ওর বানানো কচুরির কথা বলেছিল। রহমতচাচা আর লোকনাথদাদু, দুজনকে একসাথে দেখতে পেয়ে প্রণাম ঠুকে বারীন বলল, “চললেন কোথায় কত্তারা দুজনে একসাথে? তাও এই সন্ধে সন্ধে?”
বারীনের প্রশ্নটা অদ্ভুত ঠেকল লোকনাথদাদুর কানে। মনে হল সকাল সকাল কথাটাকেই বারীন নকল করে সন্ধে সন্ধে বলছে। কিন্তু কেন? তবু কৌতূহল চেপে উনি বারীনকে বললেন, “এই একটু হাঁটতে। তুমি?”
“আমি আর কোথায়? দোকান খুলব।” হেসে বলল বারীন।
“এত দেরিতে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন রহমতচাচা।
“হ্যাঁ। আজ সন্ধের খদ্দেরগুলো মার গেল। দেখি ভোর পাঁচটার সময় কত বিক্রি হয়?”
আবার কথার হেঁয়ালী! লোকনাথদাদু আর রহমতচাচা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। বারীন এবার বলল, “আপনারা গায়ে গরম জামা গায়ে দেননি কেন? শীত কিন্তু বাড়ছে।” বারীনের কথা শুনে রহমতচাচা হেসে বললেন, “শীত আসতে এখনো এক বছর দেরি বারীন। এই তো সবে গেল।”
“গেল কী বলছেন?” রহমতচাচার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বারীন বলল, “আজ মাত্র মার্চের পাঁচ। এখনো ফেব্রুয়ারি, জানুয়ারি বাকি। ডিসেম্বর তো পড়েই আছে। তারপর না হয় নভেম্বরে একটু কমবে।”
“কী যা তা বকছিস?” এবার বারীনকে একটা ধমক দিয়ে রহমতচাচা বললেন, “মার্চের পর ফেব্রুয়ারি? ক্যালেন্ডার কি উল্টো চলছে? আমাদের সাথে ফিচলেমো হচ্ছে?”
“ছিঃ ছিঃ, এমন সাহস আমার?” জিভ কেটে বারীন বলল, “কিন্তু মার্চের পর ফেব্রুয়ারি না এসে কি এপ্রিল আসবে? আপনিই বলুন চাচা।”
কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে বুঝতে পারলেন লোকনাথদাদু। আর কথা বাড়ালেন না বারীনের সাথে। ও চলে যেতে দুজনে আবার হাঁটা শুরু করলেন। কয়েক মুহূর্ত চলার পর রহমতচাচা মুখ খুললেন।
“কী হচ্ছে বলতো জনাব?”
অস্থির হয়ে ঘন ঘন মাথা নেড়ে লোকনাথদাদু বললেন, “কিছুই বুঝতে পারছি না চাচা। ” “সব কেমন উল্টো হচ্ছে নজর করেছ?”
“হ্যাঁ,” মাথা ঝোঁকালেন লোকনাথদাদু।
“কেন এমন হচ্ছে বল তো?”
“জানি না চাচা,” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন লোকনাথদাদু।
“আমরা কি স্বপ্ন দেখছি?”
“না চাচা।”
“তাহলে?”
“অলৌকিক কিছু ঘটছে আমাদের সাথে।”
“সে কী!” চমকে উঠলেন রহমতচাচা। ফ্যাসফ্যাসে শোনাল ওঁর গলা। বললেন, “তাহলে উপায়?বলতে পারব না,” একটা ঢোঁক গিলে উত্তর দিলেন লোকনাথদাদু।
রহমতচাচা তখন ভয়ার্ত গলায় বললেন, “ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না বেটা। ওরা সবাই আমাদের সাথে মজাক করছে না তো?”
“সবাই এক সাথে মজা করবে কেন চাচা?”
দুজনে কথায় ব্যাস্ত, এমন সময় পাড়ার ছেলে বিভুকে দেখা গেল স্কুল ব্যাগ কাঁধে বাড়ির কাজের লোকের হাত ধরে স্কুলের দিকে চলেছে। সেটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এক লোকনাথদাদুর মুখ থেকে।
“বিভুর চাচা পার্টির লিডার না?” জিজ্ঞাসা করলেন রহমতচাচা।
“হ্যাঁ,” বললেন লোকনাথদাদু।
“কী যেন নাম লোকটার?”
“ললিতমোহন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ললিতমোহন। খুব হম্বিতম্বি করছিল সেদিন।”
দুজনে ললিতমোহনের কীর্তিকলাপ নিয়ে আলোচনা করতে করতে সামনের একটা সরু গলিতে ঢুকলেন। এমন সময় কোথা থেকে উদয় হলেন ললিতমোহন স্বয়ং। রাস্তার দুর্বল আলোতেও ওঁরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন ললিতমোহনের মুখটা। ভদ্রলোক এদিকেই আসছেন। সাথে সাথে প্রসঙ্গ বদল করলেন দুজনে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল ওঁদের চোখের সামনে। ললিতমোহন আরও দু পা এগিয়েছেন, এমন সময় দুজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াল ওঁর। আচমকা লোকদুটোকে দেখে মুখটা পাংশু হয়ে গেল ওঁর। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই এবার লোকগুলোর মধ্যে একজন পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুড়ুম গুড়ুম করে পর পর ছটা গুলিই দেগে দিল ললিত মোহনের বুকে!
চোখের সামনে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাবে কল্পনাও করতে পারেন নি রহমতচাচা বা লোকনাথদাদুর মধ্যে কেউ। ললিতমোহন তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। রাস্তাটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। তড়িঘড়ি ওঁর দিকে ছুটে গেলেন ওঁরা দুজনে। ষণ্ডা লোকগুলোও এর মধ্যে হাওয়া। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন দুজনে।
হঠাৎ সম্বিত ফিরল লোকনাথদাদুর, “চাচা, ললিতমোহন মার্ডার হয়েছিলেন গত মাসে! এই সময়! ঠিক এই জায়গায়!”
কথাটা শুনে রহমতচাচার শরীরটা কেঁপে উঠল। ভয়ে তখন দাঁতে দাঁত লেগে যাবার জোগাড়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলেন, হায় আল্লা, এও কী করে সম্ভব!”
দুজনেরই মাথা ঘুরতে শুরু করল এবার। আর বুঝতে বাকি রইল না কোন এক জটিল ভূতুরে প্যাঁচে জড়িয়ে পরেছেন দুজনেই। দরদরিয়ে তখন ঘাম ঝরছে দুজনের শরীর থেকে। আর একমুহূর্ত জায়গাটাতে থাকা নিরাপদ বোধ করলেন না ওঁরা। ডাইনে-বাঁয়ে না তাকিয়ে এবার সোজা ছুটতে শুরু করলেন দুজনে। প্রায় পনের মিনিট এক টানা ছোটার পর একটা ফার্নিচারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিলেন দুজনে। গলাও শুকিয়ে গেছে। একটু জল খাবার দরকার। সামনে এই ফার্নিচারের দোকানটা ছাড়া আর কোন দোকানও নেই আশেপাশে। অগত্যা সেটাতেই ঢুকে পড়লেন দুজন। এক অনুরধেই জল মিলল। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় লোকনাথদাদুর চোখ আটকে গেল সামনে রাখা একটা আলমারিতে লাগানো আয়নাটার ওপর।
আলমারির কাচে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছিলেন লোকনাথদাদু। কিন্তু কেমন যেন আলাদা। পুরো আকৃতিটাই যেন উল্টে গেছে। চুলের সিঁথিটা বাঁদিকে। অথচ উনি ডানদিকে সিঁথি করেন। বাঁহাতের ঘড়ি ডানহাতে চলে গেছে। জামার বুকপকেট বাঁদিকের বদলে দেখা যাচ্ছে ডানদিকে। সাথে সাথে সব কিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল ওঁর কাছে। আন্দাজ করতে পারলেন কেন সব কিছু উল্টো হচ্ছে। কেন হরনাথ সকালের বদলে রাতে অফিস যাচ্ছে। বুঝতে পারলেন ময়নার সারা রাত দোকান খুলে রাখার পেছনে রহস্যটা কী? অথবা রবিন কেন বলছিল মার্চের পর ফেব্রুয়ারি আসবে। আর কেনই বা বিভু সকালের বদলে রাতে স্কুল যাচ্ছিল। আর কেনই বা হয়ে যাওয়া খুনটা আবার ওনাদের চোখের সামনে ঘটল। আসলে ওনারা সময়ের উলটোদিকে চলছেন! এককথায় সময়ের বিচারে ওনারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন! আর এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এই সব ঘটে চলেছে মোতিবিবির ওই আয়নাটার জন্যই। ওনারা অজান্তেই ঢুকে পরেছেন আয়নার জগতে যেখানে কিনা সব কিছুই বাস্তব জগতের উল্টো!
কথাটা রহমতচাচাকে জানাতে চোখ কপালে উঠে গেল ভদ্রলোকের। বললেন, “কিছু একটা করা দরকার।”
“আর অপেক্ষা নয়। এখুনি চলুন,” বললেন লোকনাথদাদু।
রহমতচাচাকে সাথে নিয়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চললেন লোকনাথদাদু। সোজা গিয়ে ঢুকলেন রহমতচাচার ঘরে। এগিয়ে গেলেন আয়নাটার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সেটার দিকে। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছিল দুজনের। সাহসে কুলোচ্ছিল না ওটার সামনে যাওয়ার। শেষে মনে জোর এনে আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেলেন লোকনাথদাদু।
“যেও না বেটা, ওটা খতরনাক আছে।”
রহমতচাচার কোনও হুঁশিয়ারিই কানে নিলেন না লোকনাথদাদু। খপ করে ধরলেন রহমতচাচার হাতটা। “কী করছ বেটা?” আঁতকে উঠলেন রহমতচাচা। দাদু তাতে কান না দিয়ে হঠাৎ ওঁকে আয়নার কাচের ওপর ধাক্কা মারলেন। সাথে সাথে নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন আয়নাটার ওপর। আবার একটা ঝটকা! আবার ছিটকে পরলেন দুজনে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়েছেন সবে, এমনসময় আবার লোডশেডিং। ঘন অন্ধকারের মধ্যে চোখজোড়া সইয়ে নিতে না নিতেই লাইট চলে এল।
সাথে সাথে ছুটে বাড়ির বাইরে গেলেন দুজনে। ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা। নজরে এল ময়না ওর দোকানের ঝাঁপি ফেলছে। বেশ কয়েকটা বাড়ির লাইট নিভে গেছে এর মধ্যে। রাস্তায় লোকজনও তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। এমন সময় হরনাথকে দেখা গেল সে তার ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটাকে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। লোকনাথদাদুর সাথে চোখাচোখি হতে ও বলল, “সারাদিন ভীষণ খাটুনি গেছে লোকনাথদা, আর পারছি না।”
কথাটা শুনে এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দুজনে।
***********
গল্প শেষ করে বেশ কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলেন লোকনাথদাদু। এবার রহমতচাচার উদ্দেশ্যে বললেন, “আয়নাটা এখনো কেন ঘরে রেখেছেন চাচা?”
খক খক করে দুবার কেশে নিয়ে রহমতচাচা বললেন, “ওটা আমার জন্য খুব পয়মন্ত গো লোকনাথ। ওই দিনের পর থেকে আমার পসার দ্বিগুণ হয়েছে। আমার ছেলেও জীবনে অনেক উন্নতি করেছে। কোন বিপদ আমাকে ছুঁতে পারেনি।”
শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লোকনাথদাদু। বললেন, “ভাল হলেই ভাল।”
রহমতচাচা এবার উঠে আয়নাটার সামনে গিয়ে বললেন, “এটার সেই ভয়ানক শক্তিটা আর নেই। বলে ডান হাতটা আয়নাটার কাচে বেশ কয়েকবার ঘষে নিয়ে বললেন, আজ আমি পচানব্বই বছরের ইনসান। আর তোমার বয়স কত?”
একটা ঢোঁক গিলে লোকনাথদাদু বললেন, “পয়ষট্টি।”
রহমতচাচা তখন হেসে বললেন, “আজ মাসের পাঁচ তারিখ। কাল নিশ্চয় ছয়?”
এবার হাসি ফুটল লোকনাথদাদুর মুখে। মুচকি হেসে মাথাটা দুবার মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকালেন লোকনাথদাদু।
ফেরার আগে কিডো একবার সাহস করে আয়নাটার কাচে হাত বুলিয়েছিল। তার আগে ও অবশ্য ঘড়ি আর ক্যালেন্ডার দুটোই দেখে নিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে পাড়ায় টিটুদার সাথে দেখা হতে জিজ্ঞাসা করল, “কাল কত তারিখ?”
টিটুদার উত্তরটা ছিল “ছয়’’। তবু স্বস্তি পায় নি ও। বাড়ি গিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা কি সন্ধেবেলা কেক আনতে বেরোবে? শুনে মা বললেন, “কেক তো তোমার বাবা সকালেই এনেছেন। আবার বিকেলে আনবেন কেন? কাল বরঞ্চ স্কুল যাবার আগে একটু খেয়ে যেও। আজ দুপুরে বিরিয়ানি খেয়েছ। তাই এখন আর দিলাম না। শরীর খারাপ হতে পারে।”
ছবিঃ শিবশংকর ভট্টাচার্য