নক নক নক !বরফঢাকা বারান্দার কাচের দরজায় জোর ঠুকঠুকুনি! মা রান্নাঘর থেকেই উচ্চস্বরে হেঁকে বলে ওঠেন,“ওরে ও ঠুমরি, দেখে যা-তোর নতুন বন্ধু এসেছে রে …!”
ওই দেখ -দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন ঠুমরির নতুন বন্ধুটি! আর ঠুমরিও এবার তড়বড়িয়ে দৌড়েছে এক ব্যাগ ভর্তি মার্শমেলো নিয়ে। এই হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও গায়ের লোমগুলি ফুলিয়ে এই এত্তোখানি করে দুই হাত বাড়িয়ে দরজার বাইরে কুট্টিকুট্টি চোখে তাকিয়ে আছেন ‘স্কুইলি’,এক ফুলো ল্যাজের হুমদো কাঠবেড়ালি। তার পছন্দমতো ট্রিট পেয়ে এবার মহানন্দে তিনি খানিক চাকুমচুকুম চোয়ালের ব্যায়াম করলেন আর তারপর খানিক পুঁটলি করে মুখে তুলে নিয়ে লেজ উঁচিয়ে একছুট্টে বারান্দালাগোয়া ব্ল্যাকবেরি গাছটার মগডালে। সেখানে তার খড়কুটোর নিশ্চিন্ত বাসা।
কাঠবেড়ালির বাসা এই প্রথম দেখল ঠুমরি … কোলকাতায় কাঠবেড়ালি শব্দটার সঙ্গে দুএকবার পরিচিত হয়েছে বটে,কিন্তু কংক্রিটের সেই কঠিন শহরে এই নাদুসনুদুস প্রাণীটাকে দেখার সৌভাগ্য ওর হয়নি কখনো!প্রাণীটাকে আ-কার , এ-কার আর দীর্ঘ ঈ-কারের আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে ফোর-ডি হয়ে নাচানাচি করতে দেখার অভিজ্ঞতাও তার এই প্রথম! যদিও মাঝে মাঝেই ঠুমরির আদিখ্যেতা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠলে মা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, “কেন,‘আইস এজ’ মুভিতে বুঝি কাঠবেড়ালি দেখিস নি তুই?”
ঠুমরি তখন তার চকচকে চোখে ছটফটানি ছড়িয়ে বলে-“বা রে,সে তো সিনেমার পর্দায়! চোখের সামনে তো আর নয়!”
তোমাদের অবশ্য এই ফাঁকে চুপি চুপি বলে রাখি – ঠুমরির এই নতুন বন্ধুটির সঙ্গে কিন্তু এই ক’দিনে ওর বন্ধুত্ব জমে একেবারে আইসক্রিম হয়ে গেছে। আর হবে নাই বা কেন-আরে বাবা আইসক্রিমের রাজত্বেই তো দিনরাত কাটছে তার এখন!
আইসক্রিমের পরত জমার আগে অবশ্য রঙচঙে একটা শরত তার সাতরঙা তুলির টানে ক্ষণিকের জন্যে রাঙিয়ে দিয়েছিল ঠুমরির চারপাশের সব আটপৌরে মাঠঘাটজঙ্গল! হিমেল হাওয়ার শিরশিরানি সবুজ গাছের পাতায় ছুঁইয়ে দিয়েছিল বার্ধক্যের রঙ। স্কুলে মিস সিলবার বলছিলেন, “বিজ্ঞান এই ‘ফল কালারে’র ফিনোমেননকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে জানো? শীতবরফে ডুবে যাওয়ার আগে এই সমস্ত পর্ণমোচী গাছের দল এক স্বল্পস্থায়ী রঙের উৎসবে মাতিয়ে দিয়ে যায় শরতকে! উত্তর গোলার্ধে সাধারণত অক্টোবর মাস নাগাদ আর দক্ষিণ গোলার্ধে এপ্রিল থেকে মে নাগাদ এই ‘ফল কালার’ এর সিলসিলা শুরু হয়ে যায়। আসলে কী বলতো, দিন যত হিমেল হতে থাকে,বাতাস হতে থাকে নীরস, গাছেরাও ওয়ার্নিং পেয়ে তাদের রান্নাঘরে শিকল তুলে দেয়, ক্লোরোফিল তৈরি করা বন্ধ হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময়েই… সবুজপাতার আড়ালে এতদিন লুকিয়ে থাকা ক্যারটিনস ও জ্যান্থোফিল এইবার বুক ফুলিয়ে পাতার সবুজ মুছতে মুছতে উঁকি মারে রঙিন চোখে। লাল অ্যান্থোসায়ানিনের বিকাশ ঘটে-যার ফলেই পাতার সবুজ বদলে গিয়ে লাল,হলুদ,বাদামি কিংবা পার্পল রঙে ছুপিয়ে নেয় নিজেদের। এ যেন এখানকার ক্ষণস্থায়ী গ্রীষ্মের চোখ ঝলসানো বিদায় অনুষ্ঠান।
“জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখ—কীভাবে বার্চের হলুদ পাতায় ঠিকরে উঠেছে বুড়ো ওকের তামাটে গাম্ভীর্য কিম্বা ডগউডের লালপাতার নাচনকে ছাপিয়ে উঠেছে ম্যাপলের চেরিলাল,কমলার উজ্জ্বলতা। আর এভাবেই ধীরে ধীরে প্রাণরসহীন পাতার শিরা উপশিরাগুলির গতিও স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকে। শুরু হয়ে যায় পাতাঝরার খেলা!”
সেই সময়টা স্কুলফেরত জানালায় ঘুম ঘুম বিকেলে নিঝুম বসে খেয়াল করে গেছে ঠুমরি-কীভাবে পুরোটা শরতকাল জুড়ে একটু একটু করে সংগ্রহ করে আনা একএকটা একর্ন অর্থাৎ ওক গাছের ফল নানা জায়গায় মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গুঁজে রেখেছে স্কুইলি আর ওর বন্ধুরা! শরতকালটা বোধ হয় ব্যস্ততম মাস স্কুইলিদের কাছে। ঠুমরিদের অ্যাপার্টমেন্টের নানা দুর্গম জায়গায় মাটি খুঁড়ে নিজেদের সংগ্রহ করা একর্ন লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল ওরা। এবার শীতের নিষ্প্রাণ বরফের দুনিয়ায় সেগুলিই ওদের ভরসা। অন্তত সামারটাইম আসা না পর্যন্ত ! তবে রোজ মুখ বদলের উদ্দেশ্যে একবার করে এসে ঠুমরির দরজায় তার কড়া নেড়ে যাওয়া চাইই চাই –বারে, রোজ ডালভাত খেতে বুঝি কারোর ভালো লাগে?
তবে স্কুইলিকে দেখলেই মাঝে মাঝে ঠুমরির মনের মধ্যে এক অদ্ভুত,দমকা মনখারাপের বাষ্প বুড়বুড়িয়ে ওঠে। আহারে…ঠুমরির তো তাও মোটা জার্কিন আছে, কোট আছে,গ্লাভস আছে,টুপি আছে,স্নো শু আছে। ঘরে হিটার আছে,কলে গরম জল আছে। কিন্তু এই সব প্রাণীগুলোর তো কিচ্ছু নেই…কী করে এরা এই ঠান্ডাতেও বেঁচে থাকে?
মা হেসে বলেছেন, “কষ্ট তো হয়ই,তবে প্রকৃতিও ওদের নানারকম সুযোগসুবিধে দিয়ে রেখেছে। ওই যে দেখছ ওদের গায়ের ফুলো লোমের বাহার! তা কিন্তু এই ঠান্ডাতেও ওদের শরীর গরম রাখে।”
ঠুমরির পড়ার ঘরের গ্রিলহীন অবাধ জানালায় চৌকোনো আকাশটা উঁকি মেরে যায় অকপটে!কনকনে শীতে কোটরের উষ্ণতায় সেঁধিয়ে যাওয়া চিপমাঙ্ক, স্কাঙ্ক –এইসব প্রাণীগুলির মতই এই চারদেয়ালের নিশ্চিত আরাম ছেড়ে বাইরের হিমশীতল দুনিয়াটায় ওর বেরোতেই ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই বরফঠান্ডাতেও ওদের স্কুল হয়ে চলেছে পুরোদমে। মাসের পর মাস এই বরফের মরুভূমিতে সাদাটে, বেরঙা প্রকৃতির শীতল আস্ফালন ওকে যেন এবার একটু ক্লান্তই করে তুলেছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই যে সেই সবুজ মাঠের অবুঝ ঢেউ–আহা –সে কী গত জন্মের কাহিনী নাকি স্বপ্ন?
কিন্তু আজ হঠাৎই কখন যেন ঘুম ভেঙে উঠে ঠুমরি দেখে একঘেঁয়ে,একরঙা বরফের একচোখোমিকে আর পাত্তা না দিয়ে শীতসোহাগী বাতাসের মতিগতি বদলে গেছে। বরফের একচেটিয়া স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কুচি কুচি ক্ষোভ জমা হতে শুরু করেছে শিরাওঠা গাছেদের মিছিলে। আর কী অদ্ভুতভাবে,বরফসাদা যে গাছগুলিকে দেখে ওর মনে হত নিতান্ত মৃতশরীরের কাঠামো ছাড়া কিছুই নয়, সেই সব গাছেদের শুকনো ডালপালার ফাঁকেফাঁকেই দেখে রঙিন জীবন ছলকে উঠতে শুরু করেছে!
ওর প্রিয় এই নিঝুম জানালাটার ঠিক ওপারে, অসুস্থ-শীর্ণ রোগীর মত একটি গাছের ডাল আজ হঠাৎই ভরে এসেছে দুধেআলতা ফুলের নিটোল কুঁড়িতে, শীতবিদায়ের খবর নিয়ে এপ্রিলের মাদকতায় পাঁপড়ি মেলে উন্মুখ ফুলগুলি দেখে কেন জানি না ওর কোলকাতায় স্কুলের চৌহদ্দিতে বেড়ে ওঠা লালচোখো অশোক,পলাশের কথা মনে পড়ে যায়…ঠিক এমনই বসন্তের আগমনে শত অবহেলার ধুলো গায়ে মেখেও কেমন ফুলের ভারে ডালি সাজিয়ে সেজে থাকে ওরা নিরলস!
আজ বিকেলে মায়ের সঙ্গে এক ঝলক হাঁটতে বেরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার ভিক্টোরিয়াকে ও জিজ্ঞাসা করেছিল সে ফুলটার নাম জানে কিনা। সে শ্রাগ করে মিষ্টি হেসেছিল—উঁহু,তার জানা নেই! স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্র্যাশ বিনের পিছনে একটুকরো জমি জুড়ে রয়েছে একধরনের ঝাঁকালো ঝোপ। তার শুকনো খড়ি ওঠা ডালেও দেখেছে ঠুমরি হলুদ ফুলের কুঁড়ি এসেছে ঝেঁপে!শুধু ফুল আর ফুল! অথচ অবাক কান্ড দেখ, পাতাদের কিন্তু এখনো অবধি কোন খবরই নেই!
গতকাল এক সহপাঠীর কাছে ফুলদুটির নাম প্রথম শুনল ও-ম্যাগনোলিয়া আর ফরসাইথিয়া। অবশ্য এই গোলাপী আর হলুদ ফুলের বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে আরো কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে ওর জন্যে তা ঠুমরি কল্পনাও করেনি । এক চনমনে শুক্রবারের সন্ধ্যায় অফিস থেকে ঘরে ফিরেই বাবা ঘোষণা করলেন- “দোড়গোড়ায় যে বসন্ত এসে দাঁড়িয়ে! চল ঠুমরি,ঘুরে আসি কোথাও! আর এবার আমরা পাড়ি দেব কোথায় বলতো? আরে, সেই যে সেই ঐতিহাসিক ওয়াশিংটন ডিসি! রাজধানীর বসন্ত উৎসবে থুড়ি ‘ন্যাশনাল চেরি ব্লুজম ফেস্টিভ্যালে’ গিয়ে ভাগ বসাতে হবে না?”
********
অবশেষে শীতঅবসরের জেলখানা ভেঙে ফেলে হইহই করে সকালের চনমনে ব্যস্ততা আর বাসন্তী খুশিতে ডানা মেলে একদিন ওরা এসে পৌঁছল ফিলাডেলফিয়ার বাসস্ট্যান্ডে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্তি উপচে পড়ছে সকলের চোখেমুখে। গ্রে হাউন্ডের ঝাঁ চকচকে বাসটা যে কোলকাতার বাসগুলোর মতই একঘন্টা লেটে এসে পৌঁছবে স্ট্যান্ডে তাও কি ছাই কেউ ভেবেছিল?
অনেকক্ষণ ছটফটে অপেক্ষার শেষে খানিকটা চিটচিটে বিরক্তি আর অনেকটা ফুরফুরে ফুর্তি পকেটে পুরে, ওয়াশিংটন ডিসির বসন্ত দুপুরে ঠুমরিদের বাস যখন এসে থামল রাজধানীর রাজঅলিন্দে, ঝলমলে সূর্য তখন দুপুরের খাবার সাঙ্গ করে রাঙা মুখে পান চিবোচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসির ‘ইউনিয়ন স্টেশানে’র কাছেই ঠুমরিদের হোটেল, স্টেশানের ফুড কোর্টটি যেন সুবিশাল পৃথিবীর একটুকরো মিনিয়েচার মডেল! পিৎজা, বার্গার,চাইনিজ,জাপানিজ,ইন্ডিয়ান,আমেরিকান – কী নেই ? সব ধরনের খাবারেরই ঢালাও পসরা সাজানো,সেখান থেকেই এক প্লেট করে ‘লোমেইন উইথ সেস্মি চিকেন’ দিয়ে চিনে লাঞ্চ সেরে,জলের বোতলের উদরপূর্তি করে ঠুমরিরা রওনা দিল রাজধানী আবিষ্কারের উন্মাদনায়। হোটেলের কাছ থেকেই ক্যাব (এদেশে ট্যাক্সিকে ক্যাব বলা হয়ে থাকে ) নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা হোয়াইট হাউসের উদ্দেশ্যে ।
পথে চকোলেট খাবে বলে একটু নখরাঝখরা শুরু করেছিল বটে ঠুমরি , কিন্তু! বাব্বা ও… মায়ের বাংলা বকুনিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় যে ক্যাবের চালক,মুখে ফিচকে হাসি, মুখ দেখেই বোঝা গেল যে ইনি প্রতিবেশী বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি। পথে যেতে যেতেই বাবা গল্প জুড়ে দিলেন লোকটার সাথে। আর মা ইতিহাসের পাতা খুলে বসলেন ঠুমরির কাছে –
“জানিস, ঠুমরি, ১৭৯০ সালে আমেরিকার সংবিধানবলে স্থাপিত, দেশের আত্মা এই ওয়াশিংটন ডিসি তার বুক দিয়ে আগলে রেখেছে ‘সংবিধান’,’বিল অফ রাইটস’ সমেত নানা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথিপত্র। পোটোম্যাক রিভার ও ইস্টার্ন ব্রাঞ্চের সংযোগস্থলে এই শহর পত্তনের জন্য স্থান নির্বাচন করেছিলেন কে বলতো? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ শক্তির আগ্রাসন ‘হোয়াইট হাউস’সমেত শহরের অধিকাংশ অঞ্চলেই অগ্নিসঞ্চার করেছিল যা ইতিহাসে ‘বার্নিং অফ ওয়াশিংটন’নামেই সুপরিচিত। রাজধানীতে ফিরে আসার পর তাই সরকারের প্রধান কাজই ছিল অসংখ্য সরকারী ও পাবলিক বিল্ডিং নতুন করে নির্মাণ করা। ১৯০১ সালে ম্যাকমিলান প্ল্যানের মাধ্যমে শহরের কেন্দ্রস্থলের পুননির্মাণ ;অজস্র মিউজিয়াম,মনুমেন্ট স্থাপন, ‘ন্যাশনাল মল ‘প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বহুজাতিক ,সার্বজনীন শহরটির সৌন্দর্যায়নের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।”
গল্প শেষ হতে না হতেই সাঁই করে ক্যাব এসে ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল হোয়াইট হাউসের দোড়গোড়ায়। হাউসের দক্ষিণ প্রান্তে লোহার সুকঠিন গ্রিলবেষ্টনীর মাঝে সবুজ ঢালাও সতেজ কার্পেট। আর তার মাঝেই শুভ্রতার চমকে চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা হোয়াইট হাউসের হাতের তালুতে তুলে নেওয়ার মত ছোট্ট মডেল! মা বললেন, “উত্তর দিক থেকে হাউসটিকে অনেক কাছ থেকে দেখা যায়,তুলনামূলকভাবে দক্ষিণদিকের দূরত্বটা খানিক যেন বেশিই! কত সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলতো ঠুমরি?”