বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি
সে প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। তখনো শীতের সকাল এমন ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হত না বরং হিম মাখা যুবক রোদে ঝকঝক করত চতুর্দিক। গ্রামের প্রাচীন বটতলায় আজ প্রামাণিকরা (নাপিত) এসেছে। আজ মঙ্গলবার অর্থাৎ হাটবার।
প্রামাণিকরা নিজেদের বাক্স নিয়ে বসে। দল বেঁধে লোকজন ক্ষৌরকর্ম সারে। গাজীবাবাও সেই কাজ সারতে এসেছেন। অবশ্য বাবা বলা যায় না। বালক থেকে যুবকে উন্নীত হয়েছেন মাত্র। শিশুর সারল্য মাখা মানুষটা যেন সবার পরিচিত, আপনজন। তাই সবাই ভাই বলেই ডাকে। আর এই ডাকে তিনি দিব্যি সাড়া দেন।
সবে প্রামাণিক তার কাজ শুরু করেছে, এমন সময় দু-বার কেঁপে উঠলেন গাজীবাবা-ভাই খাঁ গাজী। আর তারপরেই প্রামাণিক দেখল তিনি থরথর করে কাঁপছেন আর দরদরিয়ে ঘামছেন। এদিকে তাঁর চক্ষু মুদিত। দেহ ঠান্ডা, যেন প্রাণ নেই। হৈ হৈ পড়ে গেল। লোকজন এসে জমা হয়ে গেল সেই প্রাঙ্গণে। কিন্তু কেউ তাঁকে নাড়া দেয়ার সাহস করতে পারল না। এইভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েক মুহূর্ত।
অন্যদিকে এক সম্পূর্ণ অন্য দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছিল কিছু দূরের নদীতটে। বর্ধমানের জমিদারের পুত্র ধান ও অন্যান্য ভোট নিয়ে নৌকাযোগে কোথাও গমন করেছিলেন। তাঁর বৃহৎ কোশাকুশিগুলো এই অঞ্চলে এসে নদীর চড়ায় আটকে গিয়েছিল। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টার পর তাঁরা হতোদ্যম হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।
সেই সময় প্রামাণিকের হস্তে নিজেকে সমর্পণ করে ক্ষৌরকর্মে বসেছিলেন গাজীবাবা। এতটুকুও সময়ও তিনি ঈশ্বর সাধনার থেকে বিচ্যুত হতে চান না। আর ঠিক সেই সময়ে তাঁর কানে আসে মাঝিদের করুণ আকুতি। স্থূল দেহ প্রামাণিকের সামনে রেখে, সূক্ষ্ম দেহে তিনি চলে যান সেই নদীতটে। উদ্ধার করেন সেই নৌকা। দীর্ঘ পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে তাঁর দেহ। একই সঙ্গে দু-দিকের মানুষ পরিলক্ষিত করে এই আশ্চর্য। জয় জয়কার পড়ে যায় ভাই খাঁ গাজীর।
তারপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। বর্ধমানের জমিদারের কানে যায় সেই কাহিনি। তিনি নিজে গাজীবাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। দেড় শত বিঘা জমির পত্র এবং মিষ্টি তাঁর পায়ে অর্পণ করে তিনি আশ্রম তৈরি করতে বলেন।
সেই থেকে শুরু। বন্ধ্যা নারী থেকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মুমূর্ষু রুগী থেকে বিকলাঙ্গ সন্তান-সবাই বাবার স্পর্শে সুস্থতায় ফিরল। ভাই খাঁ গাজী সবার৷ মুসলমান, হিন্দু সবাই তাঁর ভাই। আপন ভাই সফেজ খাঁ তাঁর বাম হস্ত তো হিন্দু ভাই গোপাল খাঁ তাঁর ডান হস্ত।
এমনই এক মাঘী প্রথমায় উদয়নারায়ণপুরের সিংটি গ্রামের প্রান্তরে তিনি তাঁর ভাইদের নিয়ে এসে এক মিলনোৎসব করেছিলেন। গ্রামের সাধারণ আপামর মানুষের মিলনোৎসব। বাহুল্য ছিল না তাতে। শুধু ছিল মিলনের উত্তাপ। খাবারের আয়োজন ছিল অতি সামান্য। সদ্য মাঠ থেকে তুলে আনা নতুন আলুর দম আর মুড়ি। তাই খেয়েই মানুষ জয় জয়কার করল ভাই খাঁ গাজীর। চিরস্থায়ী হয়ে গেল সেই মেলা। আজও সেই মেলা বসে। আশেপাশের গ্রামের মানুষ হাঁড়ি, কড়া, নিজেদের ক্ষেতের আলু নিয়ে এসে ভিড় করেন সেই মেলায়। রান্না হয়, হয় খাওয়াদাওয়া। আলুর দম, মুড়ির আদানপ্রদানে মজবুত হয় সৌহার্দ্যের বাঁধন। এ যেন এক অদ্ভুত মিলনোৎসব যেখানে হৃদ্যতার উনুনে ভ্রাতৃত্বের তাপে রান্না হয় মনুষ্যত্ব।
—————————————-
* দেও লিখতে গিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করতে হয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া, চাপা পড়ে যাওয়া দেবদেবীদের নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে উঠে এসেছিল এরকম কত কাহিনি, কত হারিয়ে যাওয়া সংস্কার। সেদিন Silpa Datta ম্যাডামের ছবি দেখে ইস্তক লোভ হচ্ছিল কথাগুলি বলার জন্য। পড়া বা সংস্কৃতি দুটোর একটিও আমার নয়, অতএব যত ছড়ায় তত লাভ। সাহস করে চেয়েছিলাম ছবিগুলো, অনুমতি দিয়েছিলেন। আধুনিকতার ঘোড়দৌড়ের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া এক জিরেনকাঠি নলেনগুড়ের মতো মিঠে, সুগন্ধি সংস্কার।
* আলুর দম মেলা কিন্তু এই একটি নয়, আরো আছে৷ তাদের কাহিনিও বলব কখনো। সে এক অদ্ভুত সংস্কার।
হারিয়ে যাবার আগে
আজকাল মাঝে মাঝে একটা ধূসর স্বপ্ন আসে। ধূসর বলছি বটে, কিন্তু মরা শ্যাওলার মরচে রঙের ভাবটাই বেশি। হয়তো খানিক সোঁদালিও হবে…
একখানা আস্ত কালো পেঁচা উড়ে আসে রোজ স্বপ্নের ভেতর। থুতনির ঠিক ওপরটায় নখ গেড়ে বসে। তার ধারালো নখের স্পর্শে জ্বালা করে ওঠে ঠোঁট, মাড়ির ঢিলগুলো। পালকের ভেতর থেকে পচা আঁশটে গন্ধ ঝাপটা মারে নাকে। বিরক্ত লাগে। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাই, কিন্তু ততক্ষণে সে বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে আমার ধুকপুকে ইঁদুরটাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনেছে। চিৎকার করতে চাই, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। বোবার মতো চেয়ে থাকি নির্নিমেষ। হৃৎপিণ্ডটা মুখে নিয়ে সে উড়ে যায়। খাটের ছত্রিতে বসে আয়েশ করে খুঁটে খুঁটে খায় সেটাকে। কখনো ঠোঁট ডুবিয়ে অলিন্দ থেকে তুলে আনে স্বপ্নের ডেলাগুলো। কখনো-বা ঠোঁটের আগায় নুডুলস-এর মতো সুড়ুৎ করে সাপটে নেয় ‘বেঁচে থাকা’ নামের জট পাকানো গ্রন্থিগুলো।
নখ দিয়ে আংলে আংলে ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে আনে। কিন্তু পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। আশ্চর্য! এইটা তো টাটকা ছিল। আমি জানি আমার জীবন্মৃত শবে একমাত্র এইটুকুই যা স্পন্দিত হত। পেঁচাটা কর্কশ চিৎকার দিয়ে ওঠে। যেন বলতে চায়, ‘তোর ভালোবাসারা, অনুভূতিরা সবাই তিতো।’
এইবার আমি চুপ থাকি না। বলতে যাই। লোকের কাছে ভিক্ষা না-ই চাইতে পারি, তা বলে ভালোবাসা মিথ্যা হবে! কিন্তু পারি না, পেঁচাটা ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে ছিঁড়ে নেয় আমার কথা বলার জিভটা। আমার দেখার চোখটা। হাত এলিয়ে যায়, আঙুল বেয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ে কলমটা। একরাশ কালিময় প্রশ্ন ছিটিয়ে ভেঙে যায় নিব… তলিয়ে যাই রেড়ির তেলের গদগদে তরলে। চড়বড় করে জল পড়ার মতো শব্দ করে নিভে যায় দীপ।
…হারিয়ে যাই, আমি হারিয়ে যাই। মিশে যাই প্রদীপ নেভা কটুগন্ধী ধোঁয়ার আড়ালে।
অলঙ্করণ: লেখক