বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা
মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা
দাদু খানিকটা গম্ভীরভাবেই বলল, “তোমরা ভাবো আমরা দু-চারটে বড়ি দিয়ে কাজ সারি। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছ, এই বড়িগুলো তৈরি হয় কী থেকে?”
রুনুদা গলায় একটু ধন্দ মাখিয়ে বলল, “গাছের শিকড় দিয়ে জ্বরের ওষুধ হয় শুনেছি।”
দাদু নিঃশ্বাস ছাড়লেন, “হুম। কতকটা তাই বটে, তবে শুধু গাছের শিকড় দিয়ে হয় না, আরও অন্য উপাদানাদি লাগে। কিন্তু পূর্বপুরুষের দেখানো বিদ্যাটাই আসল। পূর্বপুরুষদের এই আদি বিদ্যেটা হেলাফেলা নয়, এটা তোমরা সবসময় মনে রাখবে। আমি যখন বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে গাছখানা লাগিয়ে গিয়েছিলুম, ছাগল যাতে মুড়োতে না পারে সেজন্য বেড়া লাগিয়ে গিয়েছিলাম। তখন তার নিশ্চয়ই কারণ আছে! আর আমি তোমার দাদাদের, জ্যাঠাদের বলে গিয়েছিলাম কারণটা কী। তবুও তারা করেনি। তাহলে পুটুকে আর এত কষ্ট পেতে হত না।”
ব্যাপারখানা এই, তিন-চারদিন হল পুটুর দাঁতের ব্যথায় ঘুমাতে পারে না। বিশেষ করে রাত্রিবেলা হলে এমন কাঁদে বেচারি যে আমাদের বাড়ির আর কারোরই ঘুম হয় না। রসুন-তেল, লবঙ্গ কিছু দিয়েই কিছু হয় না। বড়মা সারারাত তাকে কোলে করে নিয়ে বসে থাকেন। দু-একবার হাট থেকে আব্দুল সন্নাওলা (সন্না-চিমটা)-কে এনে চেষ্টাও করা হয়েছে। কিন্তু সে কষের ভেতরের দিকের দাঁত। সহজে দেখাই যায় না। ছেলেমানুষ, ভালো করে জিহ্বা বের করতে পারে না। কিছুই পারা যায়নি। দাদুও বাড়ি নেই যে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। রাঢ়ের প্রান্তে সেই তালবদরায় দাদু বদলি হয়েছেন। দাদু বলতে বুঝলেন তো, সেই যে গো শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান। আমাদের ডাক্তার দাদু। যার গল্প তোমরা ‘দেও’-তে পড়েছ।
যেমন বললাম, দাদু এবার রাঢ়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি হয়েছিলেন। কর্মযোগে কলকাতা যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তালবদরা থেকে স্থলপথে এসে মেদিনীপুরের ঘাট থেকে কোশা নিয়েছিলেন। বিদ্যা নদীতে পড়তেই তাঁর সরকারি কোশা (নৌকা)-খানাকে আমাদের গ্রামের সুতি নদীতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেছন। উদ্দেশ্য ছিল আজ রাতটা কাটিয়ে, সবাইকে দেখে আবার কাল সক্কাল সক্কাল রওনা হবেন। এসে দেখেন এই হাল। তাড়াতাড়ি হাত-পা ধুয়ে, সেই গাছের গোড়ায় জল দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে একটি ডাল ভেঙে নিলেন। ঝরঝর করে গড়িয়ে এল আঠা। সেই আঠা ডালের ডগায় করে নিয়ে ছুটলেন পুঁটের দিকে। চোয়ালটা চেপে ধরে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে লাগিয়ে দিলেন সেই আঠা৷ বললেন, “বেশি না, তিনদিনের মাথায় যদি না হালদার বাগানের ডাঁসা পেয়ারা পুঁটে খেয়েছে তো আমার নাম শ্রীশ নয়। তোমরা জানো না এ-গাছের গুণাগুণ।”
বুঝলুম একখান গল্প আসছে। আমরাও চেপে ধরলাম। তবে দাদুর তাড়া ছিল। কাল আবার বিষ্যুদবার, দুপুরের আগে রওনা হবেন। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হত। তায় সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তি। ও, তোমরা বুঝি ভাবছ, নৌকায় আবার কীসের ক্লান্তি! জেনে রাখো, নৌকায় সবচাইতে বেশি ক্লান্তি হয়। ক্রমাগত দোল খেতে খেতে ঘুম পায়, কিন্তু ঘুম সহজে আসবে না। নৌকা এমনই এক যান।
যাই হোক, তারপর বলেছিলেন এ-গাছের ইতিহাস।
“এ-গাছ হল শ্বেত বাগ অর্থাৎ জঙ্গুলে ভেরেণ্ডা। চরক মতে এরণ্ড। আমরা একে জঙ্গলে গাছ বলে চিনলেও এর আলাদা আভিজাত্য আছে রাঢ় মহলে। মকরসংক্রান্তির দিনে ভেরেণ্ডা ডালের পূজা হয়। নাম ‘ভেজা বিঁধা’। সাঁওতালদের পূর্বপুরুষরা এসে অধিষ্ঠান করেন ভেরেণ্ডা গাছের উপর। এই ভেরেণ্ডা গাছ তখন এক মাধ্যম। তিন পুরুষের আশীর্বাদ তার শাখে শাখে। গাছের মাথায় একদলা নরম গোবর দিয়ে স্থাপন করা হয় একটি গাঁদা ফুল, তারপর মাঝি, জগমাঝি, গোড়েৎ মাঝি, পারানিক, নায়ক প্রভৃতি উচ্চপদস্থরা তির ছুড়ে পূজার শুরু করেন। তারপর একে একে স্নান করে এসে প্রতিযোগীরা তিনটি করে তির ছোড়ে তিনজন ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষের উদ্দেশে। অর্থাৎ এও একরকম তর্পণ। মানে যেমনটা বিদ্যা নদীতে মহালয়ার দিন হয় তোমরা দেখেছে তো।
“তো বড়কা মাঝি বা প্রধানের মতে সেই ভেরেণ্ডা ডাল তখন সর্বরোগহর। যে প্রতিযোগী তিনটি তিরই সঠিক লাগাতে পারে সে ভাগ্যবান। তার পূর্বপুরুষের সম্পূর্ণ কৃপা তার মাথার উপর বর্ষিত হচ্ছে। সে তার পূর্বপুরুষের ইচ্ছা, রীতি-রেওয়াজ পূর্ণ মর্যাদা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে। তখন তাকে নতুন জামাকাপড় আর ওই ভেরেণ্ডার ডালটি দেওয়া হয় গৃহে পুঁতবার জন্য। এই ভেরেণ্ডা ডাল বাগ-ভেরেণ্ডা বৃক্ষ হয়ে (বাগ : জঙ্গল/ঝাড় অর্থে) আশীর্বাদ হয়ে অবস্থান করেন। এ এক প্রাচীন রীতি। জড়কা-রা নামক দেবতার দৈববাণী হয়েছিল। সেও এক দারুণ গল্প।
“সাঁওতাল পরগনায় কলেরার সময় দীর্ঘদিন থাকার সময় আমি ওদের কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। ওদের রোগব্যাধিতে আমিও ওদেরই একজন হয়ে ওদের সেবা করেছিলাম। ওদের মতো এত সহজ-সরল মানুষ খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়, বুঝলে দাদুরা? ওদের মধ্যে আমাদের মতো বর্ণভেদ নেই। পাহান নিজে আমাকে ওদের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দিয়েছিলেন। আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম আর সৌভাগ্যের কথা এই যে সেই প্রতিযোগিতায় আমি এই উপহার পাই। তারপর সেই ডাল এনেই আমাদের এখানে বসানো।”
“তার মানে দাদু, তুমি তির ছুড়তে পারো! তার থেকে বড়ো কথা আমাদের জ্বরজারি, পেটে ব্যথা সবই কি এতে সেরে যাবে! তোমার মিক্সচার, বড়ি আর লাগবেই না!”
দাদু মুচকি হেসে বললেন, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আপাতত চরক সংহিতা বলছে, ভেরণ্ডের নির্যাস দন্তশূলের শূল। অতএব…”
অলংকরণ : ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য (আমারই ‘দেও’ বই থেকে নেওয়ার বৃক্ষ-পূজনের অলংকরণ)
অন্তরীণ দিন আর স্ক্রিবলিং
শীতের কামড় একটু নরম হলে আমরা যেতুম দেশের বাড়ি। ঠাকুমা বলতেন ফোকলা বুড়ির মতো দাঁতভাঙা শীত, কামড় নেই। লটঘট বেঁধে শনিবার ভোর ভোর রওনা হতুম।
প্রথমে আসত শরবত আর নাড়ু পালা। কিন্তু আসল মজাটি লুকিয়ে থাকত পুকুরপাড়ে। জামাকাপড় ছেড়ে দুটি নাকেমুখে গুঁজেই ছুটতুম সেথায়। সেখানে তখন মহা হুল্লোড়। রাত থেকে কির্লোস্কার চলেছে। প্রথম প্রস্থ মাছ ধরা হয়ে গেছে। ভেটকি, কাতলার দল উঠে গেছে ডাঙায়। বিন্তি জাল ঝেড়ে ঢিবি করা হয়েছে চুনো আর চিংড়ির ঝাড়। যতই জল নামে, আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয় পাঁকাল মাছের রাজপাট। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! একটু করে জল নামে আর পাঁকের ভেতর থেকে মুখ তোলে একটা একটা করে পাঁকাল মাছ। ঠাকুরদাদা বলতেন, ‘দাদুভাই, এরা হল জলের শিয়াল। দেখো না, কেমন মুখ উঁচু করে ডাকছে।’
উঠানে বিশাল চাঁদোয়া খাটিয়ে মাছের দলকে চূড় করে রাখা হত। ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে সবাই মাছ কাটতে বসতেন। হরেক মাছ, হরেক পন্থা। চিংড়ি কাটতে যাওয়ার আগে দেখতাম পাকা তেঁতুল হাতে মাখিয়ে নিয়ে বসতেন জেঠিমা। আবার পাঁকাল নিধনের আগে মসমসে ছাই নিয়ে বসতেন ছোটো কাকি।
তারপর বেলা গড়িয়ে এলে আসত খাওয়াদাওয়ার পালা। ইয়া বারান্দায় লম্বা কাপড় পেতে খাওয়ার বন্দোবস্ত হত। প্রথমে পাতে পড়ত বেলপাতা দিয়ে জ্বাল দেয়া গাওয়া ঘি। তারপর আসত পেঁয়াজ আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাঁতলানো মুসুরির ডাল। সঙ্গে মুচমুচে করে ভেজে নেওয়া চুনোমাছ, পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর পোয়াটাক সর্ষের তেল দিয়ে মাখা।
এরপর জগৎ-চচ্চড়ি। এতে যে কী থাকত না সেটাই জানতে কৌতূহল হত। চিচিঙ্গা, মূলা থেকে শুরু করে কুমড়োর ডাঁটা সবাই মিলেমিশে যেত অনায়াসে। ভাজা মশলা আর চিংড়ির পাকে এ একেবারে সাক্ষাৎ অমৃত।
এরপর আসত বারোয়ারি মাছের পালা। প্রথমে আসত গাছের বেগুন দিয়ে কাতলার ঝোল, তাতে আবার থ্যাবড়া মশলা বড়ি। ভেটকিটাকে মজানো হত ফুলকপি আর চালকুমড়োর বড়ি দিয়ে। ওদিকে ক্ষেতে তখন টমেটো উঠতে লেগেছে। কাঁচা টমেটো আর চুনো মাছের সোহাগে হত রসা। লালচে, টকটক, ঝাল ঝাল। চিতি কাঁকড়াগুলোও তেঁতুলে জারিয়ে টসটসে হয়ে থাকত পাতে পড়ার অপেক্ষায়।
আজও উঠান আছে। তবে শান বাঁধিয়ে চকচকে যে বুক পেতে আমাদের শৈশবের মুহূর্তদের ধরত, সেই বুক পেতে এখন গোটা দুই তিন চার-চাকা আর দুই-চাকা ধরে। সেই পুকুরটা আজও আছে, তবে ভাড়া করা লোকে মাছ ধরে। আর সেই বারান্দা… সবচাইতে অন্যায় হয়েছে তার সঙ্গে। যে যার মতো কেটেকুটে দরজা বের করে নিয়েছে।
ছবি : ইন্টারনেট থেকে দেখে নকলনবিশি