বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা,আমাদের বৈশাখী, চুবড়ি মেলা, দগ্ধ দিনের দেখা,
মা-খুড়িরা এ তোমাদিগের জীবনরাম,
পচা ভাদ্দরের দুই কাম,
রোদ খাওয়ানো আর শিলপাটা সরঞ্জাম,
আইসেছি তাই জীবনরাম,
ছেনি-হাতুড়ি জল পাটাসা হরেক নাম,
মীন- মকর-মঞ্জরী সবাকার তিনটাকা দাম।
ভাদ্দরের একখানি মোক্ষম পালা ছিল শিল-কাটার পালা। জানি আপনারা ভাবছেন শিল-কাটা আবার পালা হয় নাকি! কিন্তু আমাদের যাদের শৈশবটা গ্রামে-গঞ্জে কিংবা মফস্বলে কেটেছে তারাই জানি শিলকাটা আমাদের কাছে অপেক্ষার, কত মজার একটি মুহূর্ত। কত স্মৃতি যে রয়ে গেছে, তা কেবল আমরাই জানি।
ভাদ্র মাসে আমাদের দিনকয়েকের জন্য বাড়ি আসার সুযোগ হতো আর এই সময়টাই হলো আমাদের শিল-পাটার কুটোনোর সময়। গাঁ-গঞ্জে এই সময়ে বাড়িতে বাড়িতে শিল কোটার ধুম লেগে যেত।
সারাবছর যে শিল-পাটা আমাদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াত এই সময়টা ছিল তার প্রসাধনের সময়। ঘরে ঘরে তাকে মনের মত করে সাজানো হতো। কেউ বা তুলতো মীনের মুখ, কেউবা মস্ত সূর্যমুখি, তো কেউ চাঁবালি বা পটমঞ্জরি। হরেক নকশা উঠত ফুটে শিলের বুকে। নোড়ার জন্য কেবল জলের দাগ।
যাক গে যাক, বুঝিয়ে বলি না হলে তোমরা বুঝতে পারবে না। যে পাথর খণ্ডের উপরে রেখে মশলা পেষা হয় সেটি হলো শিল আর যে প্রস্তরখন্ড হাত দিয়ে ধরে মশলা করা হয় অর্থাৎ যার দ্বারা পেষণ করা হয় সেটি হলো নোড়া। বারংবার বিবিধ মশলা পেষণের ফলে শিল এবং নোড়া দুই-ই মসৃণ হয়ে আসে। সেই জন্য বিশেষ করে ভাদ্র মাসে শিল-কাটা অর্থাৎ গাত্র অমসৃণ করানো হয়।
শিলনোড়ার সঙ্গে মননের এক অদ্ভুত আত্মিক যোগ। শিলনোড়া রাঁধার সামগ্রী অর্থাৎ শিলনোড়ার যোগ জিহবা হয়ে সোজা মস্তিষ্কে। তাই শিলনোড়ার আদর অনেকখানি। দুপুরে যখন শিল কাটাওয়ালার ছেনির আঘাতে আগুনের ফুলকি উঠত, আর আমরা অবাক হয়ে ভাবতুম এই সেই স্ফুলিঙ্গ যা দিয়ে শুরু হয়েছিল সভ্যতার!
ঠকঠক এক অদ্ভুত সুর তোলা ছন্দ। আমরা তাল মিলিয়ে আউড়াতুম-
খোকনরাম কেবলরাম
খোকনরাম কেবলরাম
সেই আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এক মানুষের জীবিকা, গ্রামের মানুষের দায়-দরকার, রসনাতৃপ্তি আরো কত কিছু। শিল কাটার দিনগুলো উৎসবের চেহারা নিত, যেদিন একসঙ্গে এই দু-তিন বাড়ি শিলকাটা বরাত জুটত। আড্ডায় গল্পে মুখরিত হয়ে উঠত উঠোনের প্রাঙ্গণ।
আজ মিক্সার গ্রাইন্ডারের ক্যারে ক্যারে আওয়াজে বিরক্ত লাগে না কারণ সে কাজটা মুহূর্তে করে দেয় কিন্তু সে গল্প-আড্ডাগুলো, এই ছড়াগুলো অজানা হয়ে যাবে দ্রুত।
————-
জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘দেখি বাংলার মুখ’ থেকে মুদ্রিত। বইটি অর্ডার দিতে পারবেন এইখানে। দেশের ফ্রি ডেলিভারি।