বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা,আমাদের বৈশাখী, চুবড়ি মেলা, দগ্ধ দিনের দেখা,শিল কাটা,
ফাগুনের দুপুরবেলায় যখন ঝিরিঝিরি হাওয়া দেয়া শুরু হত, ঠিক সেই সময় পিসিমা গিয়ে বসতেন তাঁদের সেই শান-বাঁধানো পুকুরপাড়ে। তার আগে নাপিত বউ সেই বাঁধানো শানের চওড়া বসার জায়গা জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিয়ে যেত।
পিসিরা একা বসতেন না, সঙ্গে আরও দু-তিনজন থাকতেন পিসির সঙ্গে গল্প করার জন্য। তবে একদিকের বসার জায়গার গোটাটা দখল করতেন পিসি একা। পরিপাটি করে কাপড়গুলো পেতে সপারিষদ পিসি বসতেন কাঁথা সেলাইয়ে। শুনতে হাসি পায় ঠিকই। কিন্তু পিসেমশাই এই কথাটাই বলতেন। সঙ্গে থাকত একটা ছোট্ট নারকেলের মালায় ‘পাড় তোলা’ সুতোর গুলি, হরেক কিসিমের সূচ, এমব্রয়ডারির চাক আর পানের বাটা। একটা বাটিতে খানিকটা জল আর বারো ভেজালে সংসার সার। মুখ নড়ত আর চলত সেলাই।
প্রথমে বাটির জলে সুতো চুবিয়ে সূচে পরানো হত। তাঁতের শাড়ির পাড় তুলে লাল-নীল-হলুদ হরেক রঙের সুতো, এইভাবে পরিয়ে রাখা হত বিভিন্ন সূচে। তারপর কাপড়ের এক্কেবারে মাপ করে চড়াই পাখির চোখটা কিংবা কার্তিক ঠাকুরের ময়ূরের গলাটা আঁকতে বসতেন পিসি। কখনও বুড়ো শিরিষের ডালে বসে থাকা কেঁয়ে। কখনও রতন দিঘির পদ্ম। অবলীলায় ফুটিয়ে তুলতেন সুতোর নাড়াচাড়ায়। একে কাঁথা কেতাবিতে বলে ‘ফোঁড়াই’। হুম, ঠিক ধরেছেন। আমি নকশিকাঁথার কথা বলছি।
পিসির এক দারুন শখ ছিল ওই নকশিকাঁথা। শুধু পিসি কেন, সেকালে অন্তঃপুরবাসিনীদের খোলা জানালা ছিল এই নকশিকাঁথা। মনের সবটুকু আশা, আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস বন্দি হত সুতোর নকশায়। সংসারের টানাপোড়েন থেকে ভক্তি, বাৎসল্য থেকে প্রেম সব বন্দি হত কাপড়ে।
সেলাই
ফোঁড়াইয়ের পর যখন এগিয়ে চলে বয়ন তখন সেটা সেলাই। কাঁথা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে সচরাচর আমাদের বাংলায় চলমান সেলাই অবলম্বন করা হয়। এছাড়া লহরী (ঢেউ খেলানো), আনারসি খুপরি, বাঁক-মোচড় ইত্যাদি বিস্তর সেলাই আছে, কিন্তু চলমান সেলাই অর্থাৎ একটানা সেলাই করা কাঁথাই বেশি। এর সুবিধা এই যে সেলাই করতে করতে ক্লান্ত হলে সুতো ছেড়ে জিরিয়ে নেওয়া যায়।
প্রকারভেদ
কাঁথার প্রকারভেদও কম নেই। কোনোটা নেহাতই গায়ে দেওয়ার জন্য (লেপ/সুজনি), কোনোটা রুমালের মতো ছোট্ট, কোনোটা আবার আরশি, চিরুনি ঢেকে রাখার জন্য (আরশিলতা), কোনোটা বাসন-কোসন রাখা বা ঢাকার জন্য (গাত্রি/ দস্তরখান), কোনোটা আবার নেহাতই আসন।
নকশা
নকশার ক্ষেত্রেও কলকা থেকে শুরু করে পাহাড়-পর্বত, পায়ের ছাপ, রনুল্কা, পাঞ্জা, প্রাণী, স্বস্তিক (সু অস্তি), চাকা, চন্দ্র সূর্য―কী নেই! তবে এর সবচেয়ে অভিনব ও তাত্ত্বিক হল জীবন বৃক্ষ নকশা। এই নকশা এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা। সেলাই থেকে সেলাই আবর্তিত হতে থাকে অর্থাৎ ফ্যামিলি ট্রি বা জীবন বৃক্ষের সৃষ্টির বহমানতাকেই নির্দেশিত করে বলে মনে করা হয়। ভাবলে অবাক লাগে, কিন্তু এই নকশাটি সিন্ধু সভ্যতার আমলের। অবশ্য জীবন তো বহমান। তাই তো পরে বৌদ্ধদের দ্বারা এই নকশারই নাম হয় জীবন বৃক্ষ বা বোধিবৃক্ষ নকশা।
পাড়
কাঁথার আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হল পাড়। পাড়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় শাড়ির পাড় তুলে বসিয়ে দেয়া হয় সেলাই করে। আর যদি তা না হয় তাহলে জানবেন, পাড়ের নকশা কাঁথার সবচাইতে সুচারু কাজ। মূলভাগ নিয়ত (টানা সেলাই) ও অনিয়ত (বিচ্ছিন্ন সেলাই) আর তাদের গর্ভে বিচিত্র এক ভাবজগৎ।
কখনও ঢেউ বা বরফি, কখনও ইঞ্জিনিয়ারিং হেরিংবোন, কখনও শামুক, কখনও ধানের শিষ তো কখনও বিছে বা বেকি, মালা কিংবা বাইশা। কখনও খেজুর ছড়ি তো কখনও মটরলতা। ভাবতে পারছেন সৃজন থেকে বংশগতি কিংবা নেহাতই সময় চালা আল্পনা সব ধরে নিত এই কাঁথার পাড়।
কখনো-কখনো একটা গোটা কাঁথায় একজন মানুষের গোটা জীবনকাহিনি লেখা হয়ে যেত। কখনও লেখা হত পালা গান। কখনও লেখা হত রূপাই-সাজুর মতো সুখ-দুঃখের চরিত।
আজকের দিনে নকশিকাঁথা ক্রমশ হারিয়ে আসছে। আসলে অন্তঃপুরবাসিনীদের বন্দিদশা অনেকখানি কাটিয়ে দিয়েছে কেবল কানেকশন, 4G নেট আর স্মার্ট ফোন। মনের খোরাক পাচ্ছেন তাঁরা। সেই ছোট্ট চৌখুপি জানালাটা অনেক অনেক চওড়া হয়ে খিলানওয়ালা সিংহদরজা গেছে আজ। তাই হয়তো নকশিকাঁথারা আজ তোরঙ্গের এককোণে ন্যাপথালিনের গন্ধ মেখে পড়ে আছে লুপ্ত হবার আশায়।
————-
জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘দেখি বাংলার মুখ’ থেকে মুদ্রিত। বইটি অর্ডার দিতে পারবেন এইখানে। দেশের ফ্রি ডেলিভারি।