বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা,আমাদের বৈশাখী, চুবড়ি মেলা, দগ্ধ দিনের দেখা,শিল কাটা, নকশী কাঁথার বাইশা
মাছধরা বিষয়টি যত সোজা ভাবা যায় অত সোজা কিন্তু নয়। পল্লী গ্রামে মাছ ধরা নিয়ে রীতিমতো যাকে বলে রূপকথা আছে, চিরায়ত জালের বাইরে আছে অদ্ভুত সব প্রক্রিয়া আর প্রয়োগ। সদ্য বাল্যকালের স্মৃতি সেসব, অনেকটা ঝাপসা তবুও ছেঁকে তুলতে চেষ্টা করি।
চিংড়ি
গলদা চিংড়ি ধরা সবচাইতে সহজ কাজ। বলেছিলাম না, পালা বা খুঁটির কথা… পালায় জলের মধ্যে স্থির হয়ে গলদা চিংড়ি ভেসে থাকে, যেন সমাধি নিয়েছে। আস্তে করে নেমে গিয়ে চুপটি করে জল থেকে এক হাতে তুলে আনা যায় ব্যাটাদের। ছটছট করে ল্যাজার ছাটা মারে বটে কিন্তু গলদার চমৎকার স্বাদের কাছে ওই মৃদু চাপড়, স্ত্রীর আদুরে মুখঝামটার মতো ভেবে সহ্য নেওয়া যায়। আর কুয়াশা পড়লে তো কোন কথাই নেই। ব্যাটারা মাথাটি জলের ভেতর ঢুকিয়ে লেজটি উঁচু করে ভেসে র’ন যেন প্যাঁচা আর মাছরাঙাদের নিমন্ত্রণ দেয়ার জন্যই এরূপ ভান। তখন শুধু টুকুস করে তুলে নিলেই হলো।
অবশ্য এই সময়ে মানুষের থেকে পেঁচা আর মাছরাঙারাই ভোজসভা বসায়। এরপর আসে হরিণে চিংড়ি। শীতকালে এই চিংড়ি ধরা ভারী সহজ। যখন স্থির হয়ে জমে থাকে কুয়াশা তখন আস্তে করে খেজুর গাছের পাতার ঝুপসি নিয়ে পুকুরের পাড়ের কাছে খোলের মধ্যে অর্ধনিমজ্জিত করে রেখে দাও। তারপর ওই টেনে তুলতে পারলে হয়। ওর মধ্যেই যত রাজ্যের চিংড়ি গিয়ে বেসাতি বসায়।
ন্যাদোশ, বেলে
মাছের দুনিয়ায় এই দুজন হলেন ভাবুক এবং নির্লিপ্ত। জলের তলায় পাঁকের উপর দিয়ে হেঁটে যাও। নরম কিছুতে পা ঠেকলে বুঝবে ওইটে বেলে নয় ন্যাদোশ। খামচা মেরে তুলে আনো, তাতেও আপত্তি নেই। যেন তোমার সেবায় নিবেদিত প্রাণ।
লাফা
এটি জবরদস্ত ব্যবস্থা। মূলত বর্ষার আয়োজন। পুকুর বা বিলের পাশে অল্প করে মাটি কেটে, সামান্য জল দিয়ে কাদা করে রাখা হয়। আর চারপাশে বেড়া দেয়া থাকে। মাছের একটি বৈশিষ্ট্য হলো বর্ষাকালে যখন পুকুরের পাড় ধ্বসে যায়, সেই সময় যেদিক থেকে ধ্বস নামছে তার বিপরীত দিকে লাফাতে থাকে। আর সেই মাছের দল সোজা গিয়ে পড়ে ওই কাদা করা চ্যাটালো জলের মধ্যে। এদিকে তার চারপাশে বেড়া উপরন্তু চ্যাটালো, জল কম। ফলে মাছ আর আগের গতিতে লাফিয়ে বাইরে যেতে পারে না। মাগুর আর শোলের ঝাঁক এসে জমা হতো লাফায়।
কাঁকড়া
বড়ো কাঁকড়া মানে সমুদ্রের কাঁকড়া যাকে বলা হয় তার ধরার পদ্ধতি হলো ‘সুতে।’ এতে সচরাচর টোপ হিসাবে শামুকের নরম মাংস, কুঁচে মাছ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। বঁড়শিতে বেঁধে জলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে একবেলায় মধ্যেই তেনারা এসে হাজির হন। শক্ত করে কামড়ে ধরেন সেই সুতো। তারপর কেবল টেনে তুলে আনা। নিজেদের দাঁড়ায় নিজেরাই আটকান।
ছোটো অর্থাৎ তেলো বা চিতি কাঁকড়ার আবার গুমোর দারুণ। নিমন্ত্রণ না করলে আসেন না। কালি অর্থাৎ ক্যামোফ্লাজ করা হাঁড়িতে শামুক ভেঙে নরম মাংস দিয়ে ডুবিয়ে রাখতে হয় পুকুর পাড়ে। খোলের কাছে আর গলায় মোটা করে কলা বাসকনা দিয়ে হাঁড়ির গলার খাঁজটা বুজিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সহজেই বেয়ে গিয়ে হারিয়ে গিয়ে ঢুকতে পড়তে পারে। তারপর তো হয়েই গেল। হাঁড়ি এমন জিনিস, ঢোকা শক্ত বেরোনো কঠিন।
তবে তোলার সময় সাবধানে, উপরে ঝপ করে তুললে উপরের দিকেরগুলি জলে ভেসে পড়ে যেতে পারে। তাই আলতো জল ফেলে তুলতে হবে।
“জালের গায়ে শর পাটালি,
রদ ঝলমল কানা,
খলখলিয়ে হেসে উঠলি,
গিল্র-বজিরির ঝঁকনা।”
গোলসা ট্যাংরা, কাবাসি ট্যাংরা, গুলি ট্যাংরা, বজুরি ট্যাংরা, আকাশ ট্যাংরা…মোটামুটি পাঁচরকম ট্যাংরার কথা পাওয়া যায়। হালফিলের নোনা ট্যাংরা প্রজাতি বাদ দিলে, এগুলি লুপ্তপ্রায়। অল্পবিস্তর আসে হাটে বাজারে।
সে-সব দিন গেছে, সেদিন ছিপ ফেললেই টপাটপ উঠে আসত লাফান্তে, খলবলে ট্যাংরারা কিম্বা খাপলা জাল টেনে তোলার সময় (আড়াআড়ি) ট্যানজেনশিয়ালি আটকে থাকত ট্যাংরার ঝাঁক। রোদে চিকচিক করত তাদের গায়ের হলুদ, কালো ডোরা।
বাড়ি ফিরে দিদির হাতে কালো জিরে, কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন আর জিরা বাটা দিয়ে ট্যাংরার ঝাল বা বেগুন, বিউলি কলাইয়ের বড়ি দিয়ে ঝোল।
আজ সেই আমোদও নেই। মানুষের সেই সময়ও নেই। এখন বিষ দিয়ে রাতারাতি ঢিবি করা হয় কাঁকড়ার স্তূপ। তারা ছটফটিয়ে উঠে আসে। সার দিয়ে চাষ করা হয় স্বল্পায়ু চিংড়ি। সে-সময়ের মানুষ আর মাছের মধ্যের সেই দুর্দান্ত প্রতিযোগিতা কোথায়? এ শুধুই শিকার।
————-
জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘দেখি বাংলার মুখ’ থেকে মুদ্রিত। বইটি অর্ডার দিতে পারবেন এইখানে। দেশের ফ্রি ডেলিভারি।