ভ্রমণ ওভার টু অসলো-৪-টিনা সরকার-বসন্ত২০২১

পর্ব ১পর্ব ২ পর্ব ৩

অসলোতে আসার পরে যখনই গল্প করতে বসেছি তোমাদের সঙ্গে, কিছু কিছু শব্দ কথাপ্রসঙ্গে বার বার উঠে এসেছে। কোনোটা আমি অল্প জানতাম, আবার কোনোটা জানতামই না। যখনই কেউ প্রশ্ন করেছেন, আমি উত্তর হয়তো দিয়েছি, কিন্তু নিজের সন্তুষ্টি হয়নি। কিছুটা সময় নিয়ে এই বিষয়গুলোকে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করেছি, বারংবার পড়েছি, স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি।

ফিয়র্ড

বিশাল বিশাল হিমবাহের সঙ্গে মূলত মেরু অঞ্চলের ভূখণ্ডের ঘর্ষণের ফলে খাত তৈরি হয়। পরবর্তীকালে হিমবাহ গলে গেলে সেখানে সমুদ্রের লোনা জল প্রবেশ করে। একেই ফিয়র্ড বলে। বরফের দ্বারা ক্ষয় হয় বলেই ফিয়র্ডগুলো এত্ত গভীর। এই ফিয়র্ডগুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিখ্যাত ‘নরওয়েজিয়ান স্যামন’ মাছের আঁতুড়ঘর হল এই জলভাগগুলো। স্যামন মাছ ইলিশের মতো, নোনা জলের মাছ। কিন্তু ডিম পাড়ে মিঠে জলে এসে। তবে তারা আর লোনা জলে ফিরে যেতে পারে না ইলিশের মতো। এখানেই তাদের মৃত্যু হয়। সমুদ্রের সঙ্গে ফিয়র্ডের সরাসরি যোগ থাকে।

আমার বাসস্থানের অনতিদূরে ফিয়র্ড আছে। আদপে খাঁড়ির বিস্তৃত জলরাশি—সময় পেলেই চলে যাই এখানে। দুর্দান্ত ভিউ! পাড় থেকে কয়েকটি খুব মোটা মোটা ওক কাঠের তক্তা লম্বালম্বিভাবে জলের উপরে পাতা আছে। কাঠের পাটাতনের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হবে, জলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছি বুঝি-বা! সামনে দিগন্তরেখায় আকাশ আর সাগর মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। বড়ো মাপের জাহাজ পাড়ের কাছাকাছি এসে যায়, এতটাই গভীরতা এর। পাটাতনের উপর সুন্দর বসার জায়গা—সাধারণত প্রেমিক যুগলের জন্যই অলিখিতভাবে সংরক্ষিত থাকে। কোনো যুগল যদি আগেই সেখানে থাকেন, তো আর কেউই ওখানে গিয়ে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে না। আমাদের ঢাকুরিয়া লেকের মতো প্রতি দু-ইঞ্চি দূরত্বে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে প্রাইভেসির দফারফা করার মানুষজন কম এখানে।

অরোরা-বোরিয়ালিস

এই নামটার সঙ্গে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। মূলত শীতকালে উত্তরমেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে রাতের আঁধারে এক অদ্ভুত সবুজ আলোর নাচন দেখা যায়। সেটাই নর্দান লাইটস বা অরোরা-বোরিয়ালিস। নরওয়েজিয়ান রূপকথায় অরোরা হল ঈশ্বরসৃষ্ট সেতু।

জানা গেল, সৌর ঝড়ের ফলে বায়ুমণ্ডলের এক স্তরে (থার্মোস্ফিয়ারে) থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে অন্য স্তর (ম্যাগনেটোস্ফিয়ার) থেকে আসা চার্জড ইলেকট্রন ও প্রোটন কণার সংঘর্ষ হয়। তখন মূলত অক্সিজেন পরমাণুগুলো আয়নিত হয়। পরমাণুগুলো ইলেকট্রন কণাগুলো থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এবং সেই শক্তি নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখে। পরে যখন এই আভ্যন্তরীণ সঞ্চিত শক্তি, আলোকশক্তি রূপে বিকিরিত হয়, তখনই অরোরার দেখা মেলে।

ছোটোবেলায় বিজ্ঞান বইতে সবাই পড়েছি, তাপশক্তি থেকে আলোকশক্তিতে রূপান্তর… ওই একই ব্যাপার। যখন অক্সিজেন পরমাণু আয়নিত হয়, তখন লাল-সবুজ আলো দেখা যায় আর নাইট্রোজেন পরমাণু আয়নিত হলে নীল আলো দেখতে পাই। মেরু অঞ্চলে ধরিত্রী মাতার চৌম্বকীয় আকর্ষণ বেশি এবং বিক্ষিপ্ত ইলেকট্রন কণা এখানকার আকাশে বেশি থাকে, তাই এই অঞ্চলে ‘আলোর নাচন’ও বেশি।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে অর্থাৎ, অরোরা দিনের বেলাতেও থাকে, সূর্যের আলোয় দেখা যায় না। তাই তো শীতের সুদীর্ঘ রাতে এদের আনাগোনা।

(কেউ যদি অন্যরকম কিছু জানেন, তাহলে কমেন্টে জানাবেন, জানার পরিধি বাড়বে)

অসলোতে আসার আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল এই অপার্থিব দৃশ্য যদি দেখতে পারি তাহলে এ জীবন ধন্য হয়। কিন্তু বিধি বাম। এবারে হল না। জানি না আর হবে কি না। অনেকগুলো বিষয় একত্রিত হলে তবেই হয়তো সম্ভব। অন্তত ৬৫’ উত্তর অক্ষাংশে থাকতে পারলে দেখার সম্ভাবনা প্রবল হয়। অসলো, হেলসিঙ্কি বা স্টকহোম সবক’টিই ৬০’ অর্থাৎ সুমেরু বৃত্তের আশেপাশে। অর্থাৎ, বোরিয়ালিস দেখতে হলে আরো উত্তরে যেতে হত। যাওয়া সম্ভব হয়নি। এইসব ট্যুরগুলো বহু আগে থেকে বুক করা হয়ে যায়। আজ মনে হল, আর কাল চলে গেলাম, সেটা কখনোই সম্ভব নয়। গাইড ছাড়া নিজেরা কেউ যায়ও না। ওই মারাত্মক ঠান্ডায় আমি হয়তো পারতাম না, এই মাইনাস বারোতেই হাড় কেঁপে যাচ্ছে। সর্বোপরি কবে যে ‘লেডি অরোরা’ দেখা দেবে তার কোনো পূর্বাভাস হয় না। বন্ধুদের থেকে জানা গেল, টানা দশদিন অপেক্ষা করেও বোরিয়ালিস দেখতে পাননি, এমন সংখ্যক মানুষও নিতান্ত কম নেই। মোটামুটি পরপর তিন-চারদিন যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, তাহলে দেখতে পাবার সম্ভাবনা প্রবল। দুজন বন্ধু কপালজোরে এবার ২২শে ডিসেম্বর ট্রমসোতে গিয়ে মেরুপ্রভা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। জানলাম, ওরা গত জুলাইতে বুকিং করে রেখেছিল। সেই ছবিই আমি কভার ফোটো করেছি। আমাকে বহু মানুষ প্রশ্ন করেছেন অরোরা দেখতে পেলাম কি না। উত্তর, না, পাইনি। শুধুমাত্র একদিন অসলোর আকাশ হালকা সবুজ আলোয় ভরে গিয়েছিল। হয়তো এটাই ছিল আমার সান্ত্বনা পুরস্কার।

নোবেল পুরস্কার

অসলোতে থাকাকালিন নোবেল জয়ীদের নাম ঘোষণা হল। অনেকেই বললেন, কাছেই স্টকহোম, ওই সময় ঘুরে এসো। মজা করে বললেও কথাটা আমার মনে ধরেছিল। কিন্তু আমাদের যে কাজের প্রয়োজনে ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, তার দিনক্ষণ ছিল অন্য। ফলে আর কলা বেচতে গিয়ে রথ দেখা হয়নি।

একদিন একা একা ঘুরতে গিয়ে একটা বড়ো বাড়ির দিকে নজর পড়ল। সামনে অনেক লোকজন, বাড়িটার উপরে দেখলাম লেখা—নোবেল পিস সেন্টার। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লাম এবং এক চমকপ্রদ তথ্য জানা গেল। নোবেল শান্তি পুরস্কারটি দেওয়া হয় অসলো থেকে প্রতিবছর ১০ই ডিসেম্বর। আর বাকি নোবেল পুরস্কারগুলো স্টকহোম থেকে।

নরওয়ে যেহেতু খুব শান্তিপূর্ণ দেশ, তাই এই সম্মান দেবার জন্য তারা উপযুক্ত। ৯ই ডিসেম্বর সমস্ত নোবেল জয়ীদের নিয়ে প্রেস মিট হয় নরওয়েজিয়ান নোবেল সেন্টারে। নরওয়ে আগে সুইডেন ইউনিয়নের মধ্যেই ছিল, তাই দুই দেশ মিলেমিশে এই আয়োজন করে।

অসলো সিটি হল, যেখানে মূল অনুষ্ঠানটি হয়, ঘুরে দেখলাম। বিহ্বল হয়ে গেছি দেখে। রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার—দেওয়ালে দেওয়ালে ম্যুরাল, ওক কাঠের ফার্নিচার, বিশাল বিশাল অয়েল পেন্টিং, ঝাড়বাতি এবং যাঁরা যাঁরা এ যাবৎকাল পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁদের ছবি, পোস্ট কার্ড আর কাজের বিবরণ। এই তালিকায় নিজের দেশের মাদার টেরেজা আর কৈলাস সত্যার্থীকে দেখে কী যে গর্ব হল, কী বলব! আবেগে, আতিশয্যে চোখে জল আমার। অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে, কিছু স্মারক আর পোস্ট কার্ড কিনলাম। তারপর একজন গর্বিত ভারতীয় দীপ্ত মনে, মাথা উঁচু করে বাড়ি ফিরল।

একটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য বিষয়, অসলো সিটি হলের মাথায় একটা ঘড়ি লাগানো আছে। তাতে আমাদের রাশিচক্রের প্রতিটি চিহ্ন বসানো। সম্ভবত ব্রোঞ্জের উপর ঢালাই করা। দেখে খুবই অবাক হয়েছি। অতীতের সবদেশ হয়তো একই সূত্রে বাঁধা ছিল, তারই প্রকাশ এটি।

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s