ভ্রমণ-দোলনচম্পার ঘোরাঘুরি-সুপর্ণা দেব শরৎ ২০২১


hamzaসুপর্ণা দেবের আগের ভ্রমণ- ক্যানবেরা ক্যানভাস, রোদ্দুরের চিঠিডিডগেরিডুর সুর, গ্রাফিত্তি ইতালিয়া : মুরানো বুরানো, ডালাঘোড়া আর এমিলের গল্প , লম্বা সাদা মেঘের গল্প(মাওরিদের দেশে)
অন্যান্য লেখা- অরোর তিনখানা গল্প, গল্প শোনে বাদশা। জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সুপর্ণা দেব-এর বই হামজানামা অর্ডার করতে মলাটের ছবিতে ক্লিক করুন–>

bhromonsuparnaheader

বিল্টুদাদু যদি পাদমেকং ন গচ্ছামি হয় তাহলে ইবনদাদু হলো চরৈবেতি।

বিল্টুদাদু বাড়ির বাইরে এক পা-ও বাড়াতে চায় না আর ইবনদাদুর পায়ে চরকি বাঁধা। ইবনদাদু চরে বেড়ায়।  এখন তোমরা ভাবছ এতো সংস্কৃত আমি জানলাম কী করে? কোত্থেকে আবার? বিল্টুদাদুর কাছ থেকে।  আমি হলুম দোলনচম্পা।  দাদুর কাছেই বড়ো হয়েছি। দাদু, আমি আর বড়ো ঠাকুমা মানে দাদুর মা, আমরা একসঙ্গে থাকি।  গ্রামে। এখানে গাছগাছালির মধ্যে আমাদের মাটির বাড়ি।  বিল্টুদাদুর বানানো। সারা দেওয়ালে ছবি আঁকা।  উঠোনে আলপনা, তুলসিমঞ্চে আলপনা।  নকশাকাটা পিলসুজ।

দাদুর মাথা খুব সাফ।  বড়ো ঠাকুমা ভেবেছিল দাদু কেউকেটা হবে।  ডাক্তার উকিল জজ ।  এইসব।

ওরা এ কালে জনাই না জিরাট কোথাকার একটা জমিদার ছিল। ওদের কাছে খুব সুন্দর সুন্দর পুরোনো আমলের  জিনিসপত্র আছে।  আমি কোত্থেকে এসেছি? জানি না।  জন্ম থেকেই ওদেরই চিনি শুধু।

যা বলছিলাম, বড়ো ঠাকুমার সব আশায়  জল ঢেলে দাদু নাকি বলেছিল, “না। আমি আর্টিস্ট হব।  ছবি আঁকব।”

বড়ো ঠাকুমা রেগেমেগে বলেছিল, “তাই হ গে যা।  মোটা চশমা পরে কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে চলবি আর খুকুখুকু কাশবি। ”

সত্যি কিন্তু, সব মিলে গেল।  শীতকাল এলেই পিপুল তুলসী আর মধু, আর দাদুর খুকুখকু কাশি, এই দেখেই তো বড়ো হলাম।  দাদু ছবি আঁকে, পট আঁকে, পোড়া মাটির জিনিস বানায়, মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে নকশা ড্রয়িং করে নিয়ে আসে। আঁকা শেখায়। রঙ তুলি, গাদা গাদা বই, আতর জমানো, বাগান করা আর ভালো ভালো  মিষ্টি খাওয়া, এই হলো দাদুর শখ। বড়ো ঠাকুমার কাছে বকুনি খাবারও খুব শখ! বলতে ভুলে গেছি আমরা তিনজন ছাড়াও বাড়িতে আছে আমাদের হীরামন টিয়া।  খুব ঝগরুটে! দাদু আমাকে বেশি ভালোবাসে সেটা ওর  সহ্য হয় না।

বাড়ির পেছনে ধান খেতের পরেই ঘন বাঁশ ঝাড়।  ঠিক সন্ধে হবার আগে পশ্চিম আকাশ যখন লালে লাল হয়ে ওঠে, বড়ো ঠাকুমা পিদিম জ্বালানোর তোড়জোড় করে, দাদু হাত মুখ ধুয়ে কর্পূর আর ধুনো জ্বালাবে বলে সব গুছোতে থাকে ঠিক সেই সময়ে আমাদের বাড়ির মাধবীলতার ঝাড় ঠেলে একটা হাঁক শোনা যায়, “জনাব বিল্টু একটু দাঁড়ান একটু দাঁড়ান, ভালো গুগগুল এনেছি আপনার জন্য। এইটা জ্বালান আজ। ”

বিল্টুদাদুও তড়িঘড়ি করে দৌড়ে এসে বলে, “আসুন আসুন ইবনবাবু, হঠাৎ করে এলেন! কী সৌভাগ্য!”

আমি দেখলাম কী, ইয়া লম্বা জোব্বা পরা মাথায় পাগড়ি তামাটে রঙ নাকটা খাড়া একটা লোক মিটিমিটি হাসছে আর বলছে, “কেন জনাব বিল্টু, খবর পাননি? জোনাকিরা কিছু বলেনি?”

আমি তো আরো  অবাক! অনেক জোনাকি জ্বলে সন্ধেবেলা! তারা আবার দাদুকে খবর দেয় নাকি?

দাদু বলল, “এ হে হে হে,  নাকের ডগায় কয়েকটা কাল  ঘুরঘুর করছিল বটে! আমি আবার মা লক্ষ্মীর পটটা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলুম কি না! ঠিক বুঝতে পারিনি! আসুন আসুন।”

কাজেই আমাদের বাড়িতে আরো একজনের আনাগোনা আছে। আমি তাকে ইবনদাদু বলে ডাকি। বিল্টুদাদু শিখিয়ে দিয়েছে উনি মস্ত লোক ।পুরো পৃথিবীটা ঘুরেছেন! অনেক অনেক দিন ধরে। সে আজকের কথা নয়। অনেক অনেককাল পুরোনো! ইবনদাদু এরকমভাবে হঠাৎ করে আসে সন্ধের মুখে! আর গল্পগাছা করে, বড়োঠাকুমার হাতের কুমড়ো ফুলের বড়া, মোচা ঘন্ট, লাউ পাতায় ইলিশ মাছ আর পায়েস খেয়ে জোব্বার মধ্যে নারকেল নাড়ু ভরে নিয়ে চলে যায়। তখন আমি আর দাদু আলপথ ধরে বাঁশবাগানের মুখে ওকে ছেড়ে দি।  দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ইবনদাদু কোথায় থাকে, বল না! দাদু বলেছিল, “বহু বহু দূর। বড়ো হয়ে জানতে পারবি।  এখনি সব জেনে গেলে তো কোনও মজাই  থাকবে না। ”

সেবারে ইবনদাদু বলল, “জনাব বিল্টু আপনি মোটেই ঘর ছেড়ে বেরুতে চান না।  এবারে চলুন আপনাকে সমরখন্দ নিয়ে যাই।” ।

বিল্টুদাদু তো মোটেই রাজি হয় না। শেষে ইবনদাদু বলল “আরে জনাব, কত ডিজাইন দেখতে পাবেন। কত কতরকমের রঙ দেখবেন! এই যে নীল রঙ, এটাই দেখবেন কত ধরনের নীল। তারপর আপনার জেল্লাদার  পাথরের শখ, মশলার শখ, নকশার শখ সব আমি মিটিয়ে দেব।”

দুগগা দুগগা বলে সব হয়ে গিয়েছিল জানো? করোনার জন্য দাদু আর বাড়ি থেকে বেরুতেই পারল না। ইবনদাদুর সঙ্গে কী একটা জায়গায় দাদুর দেখা করার কথা, সেখানে দাদু যেতেই পারল না।

ইবনদাদু যে কীভাবে আসে কীভাবে যায়, আমি তো অতশত জানি না। জানতেও চাই না।  ইবনদাদু সন্ধের মুখে এলো একদিন! বড়ো ঠাকুমার শাঁখ বাজছে তখন।

হাত পা ছড়িয়ে বসে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে চা খেতে খেতে  বিল্টুদাদু বলল, “যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন দিনকাল খুব খারাপ। আমি বলি কি আপনি চলুন আমার সঙ্গে, এই কাছেপিঠে আমাদের বাংলায়, অনেক নতুন নতুন জায়গা দেখাব। আপনি অবশ্য বাংলায় অনেকদিন আগে ঘুরে গেছেন কিন্তু এবারে আমার সঙ্গে চলুন, দেখুন চিনতে পারেন কি না! আপনি তো পৃথিবী চষে ফেলেছেন এবারে আমার ঘরের আশেপাশেই চোখ মেলে দেখে নেওয়া যাক, কী বলেন ইবনবাবু?”

ইবনদাদু বলল, “বেশ তো তাই হোক। আপনাদের দেশ গাঁ দেখি আরেকবার।  এই ছোট্ট দোলন আর আপনার তোতা, এদেরও সঙ্গে নিই। শুধু মায়ের একটু কষ্ট হবে। বাড়িতে একা হয়ে যাবেন। ”

শুনে বড়ো ঠাকুমা মালপোয়া ভাজা ছেড়ে এসে বলে কী, “না না কিচ্ছু কষ্ট হবে না, যাও তো বাছা, এদের একটু ঘরের বাইরে নিয়ে যাও তো, দুদিন একটু বিশ্রাম করে নি!  ঝালাপালা করে দেয় তিনটে মিলে!”

বৃষ্টি আসছে, তাই সবাই আমরা ঘরে ঢুকে কোথায় কোথায় ঘুরব বেড়াব সেই আলোচনা শুরু হল। হীরামন তো আহ্লাদে ফরর ফরর করে ইবনদাদুর পাগড়ির ওপরে পাক খেতে লাগল!

bhromonsuparnabalagar

আমরা প্রথমে এলাম একটা গ্রামে। আমাদের গাঁয়ের কদম ড্রাইভারের গাড়ি করে।  তার তো করোনার সময় হাতে কাজ নেই। তাই দাদুর কথায় সে একপায়ে খাড়া। আমাদের নিয়ে সেইই ঘোরাবে।

ঠকাস ঠক, ঠকাস ঠক, ঠকাস ঠক ঠক ঠক ঠক। এই হল সেই গ্রামের সুর। এ হলো নৌকো বানানোর সুর। এই গ্রামে নৌকো বানানো হয়। দেখেছ তোমরা এই গ্রাম?  গ্রামের নাম বলাগড়, হুগলী জেলা। কত বড়ো বড়ো নৌকো, ডিঙি সব তৈরি হচ্ছে।

বিল্টুদাদু বলল, “ইবনবাবু  এই হল মনপবনের নাও এর দেশ। এমন নৌকো দেখেছেন তো আগে। মনে পড়ছে কিছু?”

ইবনদাদুর ঘাড়ে হীরামন। চারিদিকে ঘন বাঁশ ঝাড়।  ইবনদাদু বলল, “মনে নেই আবার? আমার ভ্রমণকাহিনিতে গুছিয়ে লেখা আছে সব কথা। বাংলা মানেই নদী নৌকো গাছপালা, সবুজ আর সবুজ। আহা! বিল্টুদাদু বলল, “আপনি কী লিখেছিলেন আমি বলছি,আমার বেশ মনে আছে।  দোলন চম্পা, তুইও শোন। তবে যে বাংলা আপনি দেখেছিলেন সেটা  হল এখন বাংলাদেশ।”

ইবনদাদু বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ সোনারগাঁও, মস্ত বড়ো বন্দর।”

বিল্টুদাদু বলল, “এই জায়গাটাও পুরোনো আমলে একটা বড়ো বন্দর ছিল। তাছাড়া আপনি প্রচুর ধান দেখেছিলেন। সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত। ভেড়া মুরগি পায়রা সুতির কাপড়, কী মনে পড়ছে? আপনি হলেন ইবন বতুতা। কত দেশ ঘুরেছেন!”

দেখলাম ইবনদাদুর মুখটা দুষ্টুমি আর খুশিতে চিকচিক করছে। বলল, “প্রচুর ভালো ভালো জিনিসে ভরা কিন্তু ওই যে,ওইটা…”

বিল্টুদাদু থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার খুব গরম লাগত, তাই না? ঘাম প্যাচপেচে। তাই মোটেও খুশি হতে পারেননি।  বলুন তাই না?”

ইবনদাদু বলল, “সে আর বলতে! এখনো তো ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে যাচ্ছি। এরকম ভ্যাপসা জল হাওয়া আর কোথাও দেখিনি!”

ঘাম মুছতে মুছতে নৌকো বানানো দেখি আমরা।

কয়েকশ বছর আগের সেই রমরমা শিল্পটি এখন টিকে বর্তে আছে কেবল। শাল সেগুন কোথায় পাবে?  বাবলাই ভরসা। বড়ো বড়ো গজাল ঠোকা হচ্ছে। বাঁশঝাড়ে মন পবনের নাও তৈরি হচ্ছে। ভেসে ভেসে সমুদ্রে মিশবে আমাদের নৌকো বাওয়া নদীগুলি ।

সেই কোন কালে সপ্তগ্রাম ছিল এখানে। ব্যস্ত বন্দর। এখন হুগলী নদী বয়ে যায়। সপ্তগ্রামে ডিঙা ভাসাতো ওরা।

বলাগড়ের কাছে গুপ্তিপাড়া আর কালনা।  সেই মন্দিরগুলো দেখে আমি তো অবাক।  পোড়ামাটির কী সুন্দর সব কাজ। পোড়ামাটির তোতা, টিয়া! দেখে হীরামন কী উত্তেজিত। ক্যাঁকক্যাঁক করে বলল, “আমাদের আদর চিরকালের বুঝলি দোলনচম্পা!”

bhromonsuparnaGuptipara

শুধু পোড়ামাটি না, গুপ্তিপাড়ার মন্দিরে দেওয়ালের গায়ে অপূর্ব সুন্দর ছবি আঁকা।  দাদু বলল, “এগুলোকে বলে  ফ্রেস্কো। ”

ইবনদাদু খোশমেজাজে ঘুরে ঘুরে দেখছে। বিল্টুদাদু বসে পড়েছে খাতা-পেন্সিল নিয়ে স্কেচ করতে। হীরামন উড়ে উড়ে ঘুরছে। আর আমি? মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির নকশায় যা যা দেখেছি তা দিয়ে দিব্যি একটা গপ্পো বানাচ্ছি।  তোমরা পড়লেই বুঝতে পারবে সেখানে কী রকম সব দুর্দান্ত নকশা, আর টেরাকোটা  আমি দেখেছি।  

উলু উলু উলু উলু, ডিঙা ভাসল। ডিঙা ভাসল।  কী তার পালের বাহার, ইয়া চওড়া পাটাতন,গলুই।  ছলাত ছলাত জলে যতদূর দেখা যায় ডিঙা দেখতে থাকল রাঙাবউ।  রাঙাবউ-এর হাতে মকরমুখী বালা। রোদ্দুর লেগে ঝকঝক করে।  ঝকঝক করে ওঠে মাছের আঁশ।  ডিঙার সামনে মকরের বাহারি মুখ।  মাথায় পতাকা।

গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের দরজায় কী বিশাল দু’মুখো মকরের লম্বা শরীর! মন্দির যখন সাজানো হয়, রাজার শিল্পী কারিগরের দল মকরমুখী নৌকার পট বানায়। পোড়ামাটির সেই সব কাজ, দ্যাখো কেমন সুন্দর ছিল এককালে!

bhromonsuparnaKalna

আর দেখেছ মৎস্যকন্যার রূপ? টেরাকোটায় আটকে আছে। গহিন রাতে মাঝ দরিয়ায় মৎস্যকন্যা হুশ করে জেগে  উঠে নাবিককে পথ ভোলাতে আসে।  নাকি সুরে গান গায়।  নাবিক, সওদাগরের সঙ্গে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে আঁধার রাতে রাঙাবউকে এসব গল্প শোনায় নাবিক। মাছের পেটে মৎস্য কুমার। সে আবার শিঙা বাজায়! জলের ধারে কত গল্প জমে ওঠে।  মৎস্যকন্যা মৎস্যকন্যা! তোমায় যে ভুলতে পারি না। তাই মাঝদরিয়া থেকে ফিরে তার গল্প করি আর রাজার কারিগর সেই সব গল্প শুনে শুনে  পড়শি ছেলেমেয়েদের পাশে তাকেও বসিয়ে দেয় টেরাকোটার টালিতে! কী অদ্ভুত না! যেন ওই যে গুলঞ্চ গাছ, মিত্র মুস্তাফিদের ভাঙা বাড়ির পাঁচিল, ওই যে ঘাট, ওই যে জল, ওইখানে ও ঘাই মেরে ওঠে রাত গভীর হলে! সে-ও যে ভুলতে পারেনি নাবিক ছেলেটিকে।

আর কী আছে জানো? সেপাই সামন্ত, গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়ে, সাপুড়ে, ঘোড়া, পাখি, তিরন্দাজ, দোলায় দুলছে কেউ, বেহালা বাজায় কেউ। বুড়িপিসি হামানদিস্তায় কী যেন ছেঁচেই যাচ্ছে এখোনো।

bhromonsuparnakalna2

কতরকমের ড্রেস! কতরকমের চুলের বাহার, বকাসুর বধ পালা, আবার ইয়াবড়ো এক পাখি, দাঁড়িয়ে আছে মেয়ের সঙ্গে।

bhromonsuparnakalna3

“হ্যাঁ গো দাদু, এত রকমের কী করে বানালো গো!”

দাদু বলে, “বুঝলি না? পুরোনো দিনে এটা তো মস্ত বড়ো ব্যাবসার জায়গা ছিল, বড়ো বড়ো নৌকো, নানা  দেশের লোক, নানা রকমারি জিনিস আসত যেত।  কত জায়গা ঘুরে এসে সকলে আজব আজব গল্প শোনাত। সেইগুলো সব ছবি হয়ে আটকে আছে মন্দিরের দেওয়ালে।  চুপচাপ বসে থাক।  গল্প শুনতে পাবি ঠিক!”

একটা হদ্দ গ্রামে এসেছি। ধানের গোলা, ধান ঝাড়াই মারাই। ইবনদাদু বলছে, “মনে হচ্ছে যেন কালই এসেছিলুম।  সব এক রকম লাগছে। ”

জায়গাটার নাম বেশ খটোমটো।  ইতন্ডা। জেলা বীরভূম। এখানেও ভারী সুন্দর সব মন্দির দেখলাম। মন্দিরগুলো তো অপূর্ব। একটা কালী মন্দিরের গায়ে রাশি রাশি যুদ্ধের ছবি।  জোড়বাংলা মন্দির। সেই পোড়ামাটির ফলকে ইবনদাদুর মত জোব্বা পরা লোকও আছে! সাহেবও আছে।  আর সারা দেওয়াল জুড়ে পোড়া মাটির ফলকে শুধু মারামারি, কাটাকাটি! 

দাদু বলল, “দেখে নে এই ছবিগুলো। এই জায়গাটায় ডাকাতের উৎপাত ছিল।  এই যে সাহেবদের দেখছিস, এরা পর্তুগিজ। সেই সময়ে পর্তুগিজরা এইখানে গিজগিজ করত। ওরাও খুব ডাকাতে টাইপের। আমাদের ডাকাতরা কালী পুজো করত।  কে জানে পর্তুগিজ ডাকাতরাও হয়তো করত। ”

bhromonsuparnaitanda 1 (2)

এরপর দাদু আমাদের নিয়ে চলল গ্রামের পথে। সেখানে একটা জমিদার বাড়ির মত দেখতে পুরনো বাড়ির সামনে এসে সবাই দাঁড়ালাম।  দাদুরা জিরাট না জনাই কোথাকার একটা জমিদার ছিল না? আমি তাই ভাবলাম দাদুর কুটুমবাড়ি বোধহয়! এখুনি ভেতরে ডেকে নিয়ে যাবে আমাদের, লেবুর শরবত দেবে তারপর লুচি হালুয়া খাওয়াবে।  আমও কেটে দিতে পারে! ওমা! দাদু বলে কি না, “ইবনবাবু দেখুন তাকিয়ে ভালো করে, এটা একটা মন্দির! শ্রীধর মন্দির। ”

ইবনদাদু বলল “আরে! তাজ্জব কি বাত! এমন মন্দির আমি তো কখনো দেখিনি। ”

আমারো তাই মনে হচ্ছে। একটা দোতলা সুন্দর বাড়ি। ভাঙা-টাঙা আছে। কিন্তু বেশ দেখতে। দেয়ালের কী সুন্দর নকশা তোলা! দাদু বলল, “ওগুলোকে বলে পঙ্খের কাজ! আজকাল নাকি দেখাই যায় না। আর এমন মন্দির আরেকটা আছে কী না সন্দেহ! দোতলা বাড়ির মত। যেন বড়োলোকের বাড়ি। ”

bhromonsuparnaitanda 1 (1)

দাদু বলল, “ইবনবাবু এই মন্দিরে ইওরোপের স্টাইল আছে। গথিক।  ফ্রান্সের স্টাইলও আছে। ”

ইবনদাদু বলল, “এই ব্যাপারটা আমার আবার ভালো জানা নেই। কিন্তু মন্দিরটা দেখে আমার আশ্চর্য লাগছে জনাব বিল্টু। আমি এমনটা দেখিনি এই দেশে। ”

বিল্টুদাদু বলল, “আরো শুনুন, এই যে হদ্দ গ্রামে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এ এককালে বিরাট রমরমা বাণিজ্যের জায়গা ছিল। বড়ো বড়ো ব্যাবসায়ীদের হাতে অগাধ পয়সা। ততদিনে ইওরোপের সদাগরেরাও বেশ আসা যাওয়া শুরু করেছে। কাজেই হাতে পয়সা আছে যখন নতুন নতুন স্টাইলে ঘর দোর বানানো যাক। এই আর কী!”

সেই সব দালান  মন্দির নকশা সব দেখে বেরিয়ে আমরা মিষ্টি খেলাম ।শিঙারা খেলাম। ইবনদাদুকে বলা হল এটা হল সম্বুশক, যা উনি নানান দেশে খেয়ে বেড়িয়েছেন এককালে।

পরের দিন আবার বেরুব আমরা।  বেড়ানোর শেষ দিন।  

bhromonsuparnadhanyakuriya1

ধান্যকুড়িয়া। ওই টাকি বারাসাত যাবার পথে, প্রাসাদ ভরা গ্রাম।  ইবনদাদু হেসে ফেলল।  বলল, “ধান ছাড়া যে আর কিছুই নেই জনাব বিল্টু। পুরোটাই ধানের দেশ। ”

বিল্টুদাদু বলল, “মজা তো ওইখানেই। ”

“কী রকম?”

“এই যে এতো বিশাল বিশাল প্রাসাদের মত বাড়ি দেখছেন এই গ্রামে, সবই ওই ব্যবসায়ের পয়সায়। গায়েন, বল্লভ আর শাহু। এদের রাজবাড়ির মত বাড়ি দেখে আমার তো চোখ ট্যারা হয়ে গেছে।”

ইবনদাদু বলল, “সব ব্যবসায়ের টাকায়?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। বাণিজ্যে বাস করে লক্ষ্মী। আবার সেই লক্ষ্মী আসে জমি থেকে। আখ, ধান, গুড়, পাট সব চাষের সওদা। ”

ইবনদাদু বলল, “চাষবাস তো এখনো আছে। কিন্তু এই প্রকান্ড ব্যাবসা আপনাদের এখানে তো আর নেই!”  

বিল্টুদাদু বলল, “তাইতো আপনাকে এসব জায়গা দেখাতে নিয়ে এলাম, ইবনবাবু। আপনি নিজে আমাদের বাংলায় ফসল আর ব্যাবসার রমরমা দেখেছেন। এই প্রকান্ড বাড়িগুলো সেই ফেলে আসা দিনেরই গল্প বলে। এক কালে ব্যাবসায় আমরা কত এগিয়ে ছিলাম!”

“সত্যি বলছি তোমাদের ওই প্রকান্ড বাড়িগুলোর বড়ো বড়ো থাম  দেওয়া দালান দেখে মনে হচ্ছিল থামের আড়াল থেকে একটা টুকটুকে রাজকন্যা বেরিয়ে এসে আমাকে বলবে, “চল দোলন এক্কাদোক্কা খেলি। ওটা তোমার টিয়া বুঝি? আমাকে দেবে? আমি সোনার খাঁচা বানিয়ে দেব। ” অমনি হীরামন বলে উঠবে ঠোঁট বাঁকিয়ে, “ইশ কত শখ! আমি কখনোই খাঁচায় বন্ধ থাকি না। ”

bhromonsuparnadhanyakuria 2

কী সুন্দর নহবতখানা!  দাদু বলল, “ওখানে বসে বাজনদারেরা বাজনা বাজাত। ”

তারপর আরো দেখলাম জানো! জঙ্গলের মধ্যে দুর্গের মত বাড়ি। সেই বাড়ির কী পেল্লাই গেট! সেই গেটের ওপরে সিংহের সঙ্গে লড়াই করছে একটা সাহেব।

bhromonsuparnadhanyakuriya

আর দুর্গপ্রাসাদটা দেখে আমার মনে হচ্ছিল ডাইনি বুড়ি রাজকন্যাকে বন্দী করে রেখেছে।  দাদু আমাকে যেসব বিদেশি গল্পের বই এনে দেয় ওখানে এমন ছবি দেখেছি।

আমাদের বেড়ানো শেষ। আমরা কাল বাড়ি ফিরে যাব। সন্ধেবেলা ইবনদাদু এবং বিল্টুদাদু বলে কী, “দোলনচম্পা, বল তো কী রকম বেড়ালি! বড়ো ঠাকুমাকে গিয়ে কী কী বলবি?”

আমি বললাম, “বলাগড় গুপ্তিপাড়া  কালনায় দেখলাম নৌকো বানানো। সুন্দর সুন্দর মন্দিরে টেরাকোটার ফলকে কত রকমের মূর্তি। কতরকমের নকশা।  সেখানে ছবি দেখে দেখে আমি একটা গল্পই বানিয়ে ফেললাম।

“দেখলাম আনন্দময়ী মায়ের মন্দির। কালীমন্দির।  কৃষ্ণের মন্দির।

“তারপর গেলাম ইতন্ডা। দেখলাম জোড়বাংলা মন্দিরে কত কত যুদ্ধের ছবি।  দোতলা বাড়ির মত মন্দির। আমি আগে কখনো দেখিনি। মন্দির ভরে আছে পঙ্খের কাজ। দাদু বলেছে এসব এখন আর হয় না।  

“শেষে এলাম ধান্যকুরিয়া। সেখানে রাজবাড়ির মত বাড়ি দেখে আমি একেবারে হাঁ হয়ে গেছি। এখানে আমিও কেমন যেন গল্পের ঘোরে ছিলাম।  

“আমি তো জানতামই না আমাদের বাড়ির কাছাকাছি এমন সব জায়গা আছে যেগুলো কদম কাকুর গাড়িতে করেই ঘোরা যায়।  আর হ্যাঁ, হীরামন দেখেছি অনেক। পাথরের, টেরাকোটার, দেওয়ালে আঁকা।

“তবে হ্যাঁ, ইবনদাদুর একটু কষ্ট হয়েছে। খুব ঘাম হচ্ছিল তো! একটু ঠান্ডা পড়লে এই জায়গাগুলো খুব ভালো করে মজা করে দেখা যাবে।

“আমরা কত দূরে দূরে বেড়াতে যেতে চাই কিন্তু নিজেদের জায়গাতেই এতো সুন্দর সব গল্প, ইতিহাস, ছবি লুকিয়ে আছে, আমাদের তা জানা দরকার।”

আমি তো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম।

ইবনদাদু বিল্টুদাদু আর হীরামন সক্কলে একসঙ্গে বলে উঠল, “সাবাশ!”  

জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ-দোলনচম্পার ঘোরাঘুরি-সুপর্ণা দেব শরৎ ২০২১

  1. আহা , কী মন ভাল করা লেখা, সেইসঙ্গে বাঙলায় ভ্রমণ

    Like

Leave a comment