রাক্ষস খোক্কসের গল্প তো আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু একটা আস্ত পাহাড় যদি রাক্ষস হয়ে যায়? এমনই এক রাক্ষুসে পাহাড় আছে ছোট্ট দেশ সার্বিয়ায়। ইউরোপের মাঝে নাতিশীতোষ্ণ দেশ সার্বিয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো। যে রাক্ষুসে পাহাড়টার কথা বলছি, তার নাম— হোমোলজে। পাইন, ঝাউ আর ওক গাছের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাওয়া অনুচ্চ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলে দেখা পাওয়া যায় এক অপূর্ব ঝর্ণার— যার নাম ক্রুপাজ স্প্রিং। জঙ্গল ভেদ করে, আলো আঁধারি পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে, তবেই তার দেখা মেলে। পাহাড়ি ঝর্ণার জল এখানে এক মনোরম হ্রদের সৃষ্টি করেছে। নানা রঙের মাছেদের শান্তির বসবাস সেখানে। হ্রদ ছাড়িয়ে সুঁড়িপথ ধরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আর একটু এগোলেই দেখা পাওয়া যায় রাক্ষুসে পাহাড় হোমোলজের হাঁ মুখ- সে এক বিচিত্র গুহা! এই মুখ দিয়েই পাহাড়টা নাকি রাশি রাশি সোনাদানা গিলে ফেলে নিজের পেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছে বেমালুম, যার হদিস আজ অবধি কেউ পায়নি।
সোনাদানা রাখলে চুরি যাবার ভয় আছে তো! তাই এক জিন তাকে দিবারাত্রি পাহারা দেয়। সেই জিনটার নাম টারটার। তবে সেই জিন নাকি বছরে একদিন তার মুখ খুলে প্রবেশের অনুমতি দেয়। সার্বিয়ার মেয়েরা প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট দিনে হ্রদের জলে ডুব দিয়ে টারটারকে খুশি করার চেষ্টা করে। স্থানীয় লোকেরা মনে করে, বছরের সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে টারটার জিন একজন সুন্দরী মেয়েকে বেছে নেয় তার সঙ্গিনী হিসাবে।
ক্রুপাজ ঝর্ণার কাছে পাহাড়ের গায়ে যে গুহা আছে, তা বড়ই বিচিত্র। রূপকথার রঙিন কল্পনার মত তার রহস্যময় চরিত্র। ডুবুরীরা অর্ধেক জলে ডোবা গুহার নিচে ডুব দিয়ে কিছুটা রহস্যের পর্দা ফাঁস করেছে। সুদক্ষ ডুবুরীরা আজ পর্যন্ত গুহার নিচে ১৩২ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যেতে সাহস করেছে। তারপর কী আছে? আছে গহীন অতলান্ত জলরাশি। যেন সেই জলপথের কোনও সীমানা নেই। পৃথিবীর বুকের গভীরে কোথায় সেই গুহার সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে, অনেকেরই জানবার দুর্বার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে দক্ষ ডুবুরীরও সেই পথ পাড়ি দিতে সাহস করে না। আধডোবা গুহার ভিতর ডুব দিয়ে ডুবুরিরা দেখেছে বিরাট বিরাট সব ঘর। যেন জলের নিচে কোনও শিল্পী সুনিপুণ হাতে বানিয়ে রেখেছে এক নয়নাভিরাম প্রাসাদ। সুড়ঙ্গ তৈরি করে যেন কোনও স্থপতি মালায় গেঁথেছে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যাবার রাস্তা।
ক্রুপাজ ঝর্ণার অপার্থিব সৌন্দর্য নানা দেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। রূপকথার সচিত্র বইতে দেখা কল্পনার জগতের সাথে তার বড় মিল! তবে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের মাঝে ক্রুপাজের রহস্যময় গুহা সৃষ্টির কারণ জানতে গেলে একটু বিজ্ঞানের পাতা উল্টে নিতে হবে।
যে সমস্ত পাহাড়ে ডলোমাইট বা লাইমস্টোন পাওয়া যায়, সেখানে গুহা তৈরি হয়। লাইমস্টোনে আছে ক্যালসাইট (ক্যালসিয়াম কার্বোনেট), যা জলে সহজেই গুলে যায়। বৃষ্টি বা ঝর্ণার জলে ক্যালসাইট গুলে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। অন্যান্য পাথর, যারা জলে গুলে যায় না (যেমন বাসাল্ট বা মার্বেল), তারা কিন্তু কঠিন অবলম্বন দিয়ে গুহাকে ভেঙে পড়ার থেকে বাঁচায়। বছরের পর বছর ধরে জলের ধারা একটু একটু করে ক্যালসাইট ধুয়ে ধুয়ে গুহার ভিতরে নানা নির্মাণশৈলী গড়ে তোলে।
অনেক আগে মানুষ যখন বিজ্ঞানের পাঠ পড়েনি, তারা এই অদ্ভুত গুহা দেখে নানা কল্পনার জগত গড়ে তুলেছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুপাজ ঝর্ণা ঘিরে রাক্ষুসে পাহাড়ের গল্প চালু হয়ে যায়। প্রশ্ন হতে পারে – তাহলে হোমোলজে পাহাড়ের ওই সোনা গিলে ফেলার ব্যাপারটা আসলে কী? পণ্ডিতেরা এই নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। তারা বলছেন— মধ্যযুগে আবিসিনিয়ার যোদ্ধারা, রোমানরা, এমনকি গ্রীক রাজা অ্যালেক্সান্ডারও নাকি সার্বিয়ার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেছেন পৃথিবী জয় করবার জন্য। যুদ্ধে জিতে লুট করে আনা সোনাদানা সবাই নাকি লুকিয়ে রাখত সার্বিয়ার এই রহস্য ভরা হোমোলজে পাহাড়ে। হয়ত জঙ্গলে ঢাকা পড়ে থাকা গুহাগুলোতে আলিবাবার গল্পের সেই ডাকাতদের মত তারাও লুকিয়ে রাখত হিরে-জহরত। তবে আজ অবধি হোমোলজে পাহাড়ে অনেক অভিযান করেও হদিস পাওয়া যায়নি কোনও রত্নভাণ্ডারের। আসল রত্ন ভাণ্ডার হল ক্রুপাজ ঝর্ণার অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যার মাঝে গেলে মনে হবে যেন রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি।
বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে