সৌম্যকান্তি জানা-র আগের লেখা- ক্লোরোফিল চোর, বঁটিঝাঁপের মেলায়
জৈষ্ঠ্য মাসের ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। মৌলালি যুবকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একটা সভা শেষে লেট্টু আর বুবাই ফিরছিল ট্রেন ধরার জন্য। একে রোববার, তায় দুপুর। রাস্তায় লোকজন বেশ কম। এন.আর.এস মেডিক্যাল কলেজের কাছে এসে লেট্টু কব্জির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে দুটো বেজে সাতাশ হয়েছে। বাড়ি ফেরার ট্রেন চারটে কুড়িতে। এই দু-ঘণ্টা কী করবে তারা? শিয়ালদায় এমনিতেই বসার জায়গা নেই। পাখাগুলো ঘুরে যায় কিন্তু হাওয়া গায়ে লাগে না। এতটা সময় এই গরমে ফালতু শিয়ালদায় বসে থাকার চেয়ে কোথাও একটা যাওয়া ভালো। কোথায় যাওয়া যায় বুবাইকে বলতেই সে লাফিয়ে ওঠে।
“সিনেমা দেখতে যাবে লেট্টুদা?”
“তুই কি পাগল? দু-ঘণ্টার কম সময়ে সিনেমা দেখা যায়? তাছাড়া একটার শো শুরু হয়ে গেছে। এখন দেখলে চারটের শো দেখতে হবে। তাহলে আবার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“না না লেট্টুদা, রাত হয়ে গেলে বাবা-মা খুব চিন্তা করবে।”
“সে তো করবেই। তাহলে কোথায় যাওয়া যায় বল তো?”
“কলেজ স্ট্রিট যাবে?”
“দেব এক গাঁট্টা, জানিস? আজ কী বার খেয়াল আছে?”
“ও হ্যাঁ, রোববার সব দোকান বন্ধ থাকে। কিন্তু ওখানে যে একটা সুইমিং পুল আছে সেখানে গিয়ে বসা তো যায়! ওটা তো খোলা থাকে।”
“হুম, তা থাকে। তবে তাই চল।”
কথা বলতে বলতে ওরা শিয়ালদা ফ্লাই-ওভারের তলায় টানেলের মধ্যে চলে এল। হঠাৎই দেখে বাঁদিকে টানেলের দেয়ালের কাছে সাত-আটজন লোকের একটা জটলা। কী ব্যাপার বোঝার জন্য লেট্টু একটু উঁকি দিতেই চক্ষু চড়কগাছ! থমকে গেল লেট্টু। বুবাই হাঁটার গতিতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। লেট্টু দাঁড়িয়ে গেছে দেখেই পিছিয়ে এল।
“কী গো লেট্টুদা? দাঁড়ালে কেন?”
লেট্টু কোনো কথা না বলে বুবাইকে শুধু হাতের ইশারায় থামতে বলে লোকগুলোর ঘাড়ের উপর দিয়ে কী হচ্ছে দেখতে লাগল। আর ওর দেখাদেখি বুবাইও লোকগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কী হচ্ছে ওখানে।
একটা মাঝবয়সী লোক আসনের উপর হাঁটু মুড়ে বসে আছে। পরনে মলিন গেরুয়া পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির মতো করে পরা মলিন গেরুয়া ধুতি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, আর কপালে সিঁদুর দিয়ে আঁকা লম্বা তিলক। গালে তার কাঁচা-পাকা দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা তেল জবজবে চুল পেছনের দিকে পেতে আঁচড়ানো। দেখে সস্তার জ্যোতিষী বলেই মালুম। তার ডানদিকে সস্তার ফ্রেমে বাঁধানো কালী ঠাকুরের একটা ফটো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। তাতে লাল জবা ফুলের একটা মালা ঝোলানো। ফটোর সামনে একটা ছোটো রেকাবিতে কয়েকটা দশ টাকা ও একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। আর ধূপদানিতে আধপোড়া একটা ধূপ তখনো জ্বলছে। ডান হাঁটুর সামনে একটা ছোটো অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স। তার গায়ে সিঁদুর দিয়ে ‘ওঁ’ লেখা। পাশেই রাখা একটা কমন্ডলু। তাতে পিতলের একটা কোষা রাখা। একেবারে সামনে কাঠের একটা ছোটো জলচৌকি। তার উপরে কলাই করা সাদা ডিশের উপর একটা কাঁসার গ্লাস উলটে রাখা। তার উপরে ডানহাতের তালু রেখে হাঁটু মুড়ে বসে আছে একটি মধ্যবয়সী লোক। তার উসকোখুসকো চুল। গালভরা খোঁচা দাড়ি। চোখ কোটরাগত। মলিন পোশাক। আর এই ঘটনা বিস্ময়ভরা চোখে প্রত্যক্ষ করছে আরো সাত-আটজন লোক।
লেট্টু আর বুবাই কাণ্ডটা একমনে দেখছিল। জ্যোতিষী কমন্ডলু থেকে কোষায় সামান্য জল নিয়ে চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড বিড়বিড় করে তারপর সেই জল গ্লাসের উপরে হাত রেখে বসা লোকটার তালুতে ঢেলে দিল। সবার দৃষ্টি তখন লোকটার হাতের দিকে।
জ্যোতিষী বলে উঠল, “না, এই পাথর স্যুট করবে না।”
লোকটি গ্লাসের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল। দেখা গেল গ্লাসের উপর একটা গেরুয়া রঙের পাথর রাখা ছিল, আর তার ওপরেই লোকটির হাত রাখা ছিল।
জ্যোতিষী ধীরেসুস্থে পাথরটি নিয়ে ডানদিকে রাখা একটা ছোটো কাপড়ের থলির মধ্যে রেখে আবার তার মধ্যে থেকে সবুজ রঙের একটা পাথর বের করে গ্লাসের উপর রাখল। সামনের লোকটি আবার একইভাবে তার হাত রাখল পাথরটির উপর। জ্যোতিষী একইভাবে কোষায় সামান্য জল নিয়ে তার হাতের তালুতে ঢেলে দিল। তারপর আবারও বলল, “এটাও স্যুট করবে না।”
তারপর একইভাবে পাথরটা নিয়ে থলির মধ্যে রেখে এবার নীলরঙা একটা পাথর বের করে গ্লাসের উপর রাখল। লোকটি হাত রাখল। জ্যোতিষী জল ঢালল। এবার আশ্চর্য কাণ্ড! লোকটির হাতের তালুতে থাকা জল ধীরে ধীরে গোলাপি রঙ ধারণ করল।
সবার চোখে তখন চূড়ান্ত বিস্ময়। সবার মুখে গুঞ্জন। জ্যোতিষী তখন বিড়বিড় করে তার দু-হাত কপালে ঠেকাল। তারপর মুখে পরম তৃপ্তি মাখিয়ে বলল, “বাবা, এটাই তোমার শরীরে স্যুট করবে। তোমার শনির দশা কেটে যাবে।”
লোকটির চোখেমুখে তখন যেন সব-পেয়েছির আনন্দ।
“বাবা, আমার বউ ভালো হয়ে যাবে?”
“একদম! মা কালী তোমার সহায় হবে।”
“দেনা সব শোধ করতে পারব বাবা?”
“অবশ্যই। তোমার দোকান এবার খুব ভালো চলবে। এই পাথরের আংটি ধারণ করলে শনির দশা কাটবে, রাহু কাছে আসতে পারবে না। বৃহস্পতি কাছে আসবে। সব বিপদ কেটে যাবে। কোনো চিন্তা নেই।”
“বাবা, এই পাথরের দাম কত?”
“দাম তো অনেক। কিন্তু আমি বাইরের এক সাধুবাবার কাছ থেকে খুব কম দামে সংগ্রহ করি বলে তোমাদের মঙ্গলের জন্য সেই দামেই দিয়ে দিই। আর তারপর মা কালীকে প্রণাম করে মনে খুশি রেখে যতটা প্রণামী দেবে দিও।”
“কত দাম বাবা?” লোকটির গলায় উদ্বেগ। যা দাম জ্যোতিষী বলবে তা তার পকেটে আছে তো?
“বেশি না, তিনশো এক টাকা দিও।”
শুনেই লোকটির মুখ যেন শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকে গেল।
“আমি পারবো না বাবা। একটু কম করো।”
“দেখো, এ হল মা কালীর আশীর্বাদ। এ নিয়ে দরদাম করতে নেই।”
“আমার কাছে অত নেই বাবা।” লোকটির বিরস বদন।
“আচ্ছা, কত পারবে? তোমার জন্য না-হয় আমার একটু লস হবে। তুমি মা কালীর আশীর্বাদ পেয়েছ। সবাই কি পায়?”
“দুশো পারব বাবা।”
“আচ্ছা, তাই দাও। আর মাকে প্রণাম করে যা পারো প্রণামী দেবে।” জ্যোতিষী গ্লাসের উপর থেকে পাথরটা নিয়ে একটা কাগজের টুকরোতে মুড়তে মুড়তে বলল, “এটা ডানহাতের মধ্যমায় বা বাম বাহুতে ধারণ করবে। কোনোদিন খুলবে না।”
“ঠিক আছে বাবা।”
লোকটি জামার বুক পকেট থেকে একটা ছোটো পকেট ডায়েরি বের করে তার ভাঁজ থেকে দুটো একশো টাকার নোট আর একটা দশ টাকার নোট বার করল। তারপর একশো টাকার নোট দুটো দিল জ্যোতিষীর হাতে। জ্যোতিষী নোট দুটো কপালে ঠেকিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেটে রেখে দিল। এর মাঝে লোকটি রেকাবিতে দশ টাকার নোটটা রেখে জোড়হাত কপালে ঠেকিয়েছে।
কাগজমোড়া পাথরটা জ্যোতিষীর হাত থেকে নিয়ে একবার কপালে ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটি। জ্যোতিষী হাঁক দিল, “আর কে কে নিজের ভাগ্য ফেরাবেন আসুন। গ্রহশান্তির জন্য ঈশ্বরের দেওয়া পাথর শরীরে ধারণ করুন, আর নিজের ভাগ্য ফেরান।”
বুবাই হঠাৎই ফুট কাটল, “তা আপনি নিজের ভাগ্য আগে না ফিরিয়ে এভাবে ফুটপাতে বসে কষ্ট করে পাথর বেচছেন কেন?”
লেট্টু বুবাইয়ের এই ফুট কাটায় একটু বিরক্তই হল। বুবাইয়ের হাতে চিমটি কেটে চুপ করার ইঙ্গিত দিল।
জ্যোতিষী বলল, “ঠিকই বলেছ বাবা। তবে আমি অল্পেই খুশি। মানুষের মঙ্গলের জন্য পাথর দিই। সব মানুষের তো আর শো-রুমে গিয়ে কেনার সামর্থ্য নেই। বাবা, ফুটপাতে যে পাথর আমি তিনশো টাকায় দিই, জুয়েলার্সের শো-রুমে সেটাই তিরিশ হাজার। মানুষের মঙ্গল হলেই আমি খুশি।”
বুবাই আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, লেট্টুর কনুইয়ের আলতো গুঁতোয় থেমে গেল।
“আমার ভাগ্যটা একবার ফেরাবেন বাবা? খুব বিপদে আছি!” লেট্টু ভিড়ের পেছন থেকে বলে উঠল।
বুবাই তো অবাক! বলে কী লেট্টু! তার তো এসবে আদৌ বিশ্বাস নেই বলেই জানে। তবে লেট্টুকে এ নিয়ে প্রশ্ন না করাই ভালো, কারণ সে জানে, এই অবস্থায় যত প্রশ্ন করবে ততই তার সাজার পরিমাণ বাড়বে।
জ্যোতিষী তো বটেই, উপস্থিত অন্য লোকেরাও লেট্টুর মুখের দিকে তাকাল। লোকেরা একটু সরে গিয়ে লেট্টুকে সামনে আসার জন্য জায়গা করে দিল। লেট্টু হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল জ্যোতিষীর সামনে।
“কী সমস্যা?” জ্যোতিষীর দৃষ্টি লেট্টুর চোখের উপর স্থির।
“সমস্যা অনেক বাবা। আমি বি.এস.সি পরীক্ষায় দু-বার ফেল করে গেছি বাবা। এবার লাস্ট চান্স। পাশ যদি না করতে পারি, বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে! কোথাও মুখ দেখাতে পারব না!”
লেট্টুর কথাগুলো যে নিখাদ ঢপ তা বুবাই ভালোমতন জানে। লেট্টু এখন বি.এস.সি থার্ড ইয়ার। কিন্তু এখন কথা বলা তো দূর, হাসাও যাবে না। লেট্টুর মনে কিছু না কিছু একটা মতলব আছে। কিছু মন্তব্য করলে তা ভেস্তে যেতে পারে। অনেক কষ্টে বুবাই হাসি চাপল।
“চিন্তা করিস না। আমি মায়ের আশীর্বাদের রত্ন-পাথর তোকে দেব। সব সমস্যা মিটে যাবে। তুই পাশ করে যাবি।” জ্যোতিষীর কনফিডেন্ট উত্তর।
“সত্যি বাবা?”
“অবশ্যই। দেখি তোর ডানহাত।”
লেট্টু হাতটা এগিয়ে দিতে জ্যোতিষী গভীরভাবে কিছুক্ষণ থেকে গম্ভীর স্বরে বলল, “বুধ সরে গেছে। মঙ্গলও নেই। রাহু প্রকট। তবে চিন্তা নেই।”
জ্যোতিষী লেট্টুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে থলি থেকে একটা লালরঙা পাথর বার করে গ্লাসের উপর রাখল। তারপর বলল, “ডানহাতটা সোজা করে এই পাথরের উপর রাখ।”
এরপর সেই একই কায়দা। জলের রঙের কোনো পরিবর্তন হল না। তারপর হলুদরঙা একটা পাথর রেখে জল ঢালল। কোনো পরিবর্তন হল না। তারপর সবুজরঙা পাথর রেখে লেট্টুর হাতে কোষা থেকে একটু জল ঢালতেই জলের রঙ হয়ে গেল গোলাপি। সমবেত লোকেদের মধ্যে আবার গুঞ্জন শুরু হল।
“এটাই স্যুট করবে তোর দেহে। তোর আর কোনো চিন্তা নেই।”
“না বাবা, তবুও একটা চিন্তা আমার আছে, সত্যি এটা কাজ করবে তো?”
“একশোভাগ কাজ করবে। গ্যারান্টি। এটা কেবল তোর শরীরেই ফিট করবে।”
“তবুও। আর একজনকে দিয়ে পরীক্ষাটা করান না বাবা। চিন্তামুক্ত হই।”
“তুই-ই বল কাকে দিয়ে পরীক্ষা করাতে চাস।” জ্যোতিষীর মুখ যেন কিছুটা কঠিন।
এই কথাটার অপেক্ষায় যেন ছিল লেট্টু। ঘাড় ঘুরিয়ে লোক খোঁজার অভিনয় করে বুবাইয়ের দিকে আঙুল তুলে বলল, “বাবা, এই ছেলেটাকে দিয়ে একবার পরীক্ষা করান না!”
“ঠিক আছে। এই খোকা, সামনে এসো তো! বোসো এখানে।”
লেট্টু একটু সরে গিয়ে বুবাইকে বসার জায়গা করে দিল। এমন নিখুঁত অভিনয় করছে লেট্টু যেন বুবাইকে সে চেনেই না। বুবাইও লেট্টুকে না চেনার ভান করল।
একইভাবে পাথরের ওপরে বুবাই হাত রাখল। তারপর জ্যোতিষী তার তালুতে জল ঢালল। কী আশ্চর্য জলের রঙ পালটাল না।
“কী, বিশ্বাস হল তো? আমাদের অবিশ্বাস করিস না বাবা! অবিশ্বাস করলে রত্ন-পাথর পরেও কোনো উপকার হয় না।” আত্মবিশ্বাস যেন চুইয়ে পড়ছে জ্যোতিষীর গলায়।
লেট্টু খানিকক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর স্বরে বলল, “আমার হাত রেখে আমি আরেকবার দেখতে চাই। পাথরটা নেওয়ার আগে সত্যি স্যুট করছে কি না ভালো করে যাচাই করে নিতে চাই। আপত্তি নেই তো বাবা?”
জ্যোতিষী মুখ ব্যাজার করে বলল, “এখনো অবিশ্বাস? বেশ, আরেকবার পরীক্ষা কর।”
“বাবা, এবার আপনি নন, আমার হাতের তালুতে জল দেবে এই ছেলেটা।” লেট্টু আঙুল তুলে বুবাইকে দেখাল।
একথা শুনেই জ্যোতিষী খাড়া হয়ে বসে ফুঁসে উঠল, “কেন? দেবতার মন্ত্রপূত জল অন্য কেউ ঢাললে হবে না। আর আমি ছাড়া অন্য কেউ জল দিলে কিছু বোঝাও যাবে না।”
“কেন বাবা? আপনি যেমন মন্ত্র পড়েছিলেন তেমনই পড়বেন। জল এই ছেলেটা ঢালুক।” লেট্টু বেশ দৃঢ় কণ্ঠ।
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে এক-দুজন বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ছেলেটা জল ঢালুক না, কী হয় দেখি!”
“না, তা হয় না!” জ্যোতিষীর গলায় যেন চাপা উদ্বেগ ধরা পড়ল।
লেট্টু জ্যোতিষীর কথাকে পাত্তা না দিয়ে বুবাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, “ওহে ভাই, তুমি একটু জল কমন্ডলু থেকে নিয়ে আমার এখানে ঢালো তো।”
বুবাই কোষাতে হাত দিতে যেতেই জ্যোতিষী চেঁচিয়ে উঠল, “খবরদার! হাত দিবি না!”
কিন্তু বুবাই জ্যোতিষীর কোনো কথায় আমল দিল না। কোষা থেকে দ্রুত একটু জল তুলে ঢেলে দিল লেট্টুর তালুর উপর। না, জলের রঙের কোনো পরিবর্তন হল না।
“কী হল বাবা? রঙ পালটাল না কেন? পাথর তাহলে ঠিক নেই?” লেট্টুর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।
“এটা মোটেই ভালো করছিস না তোরা। পাথর নিবি না তো নিবি না। এসব কী?” রাগে গরগর করতে লাগল জ্যোতিষী।
“পাথর নেব তো বাবা! ঠিকঠাক যাচাই করে নিতে হবে তো! আবার পরীক্ষা শুরু করুন বাবা।”
“কোনো পরীক্ষা করব না। তুই চলে যা এখান থেকে।”
“পাথর না নিয়ে আমি এখান থেকে যাব না বাবা।”
“যা! চলে যা!” ক্রোধে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জ্যোতিষী।
ঠিক তখনই লেট্টু দেখে জ্যোতিষীর আসনের ডানদিকে একটা কাগজের টুকরোর ওপরে পাউডারের মতো কিছু একটা গুঁড়ো পদার্থ। এতক্ষণ বসে ছিল বলে দেখা যায়নি। তার ধুতির আড়ালে ছিল ওই সাদা রঙের পদার্থ। লেট্টু হাত বাড়িয়ে খপ করে নিয়ে নিল কাগজ সমেত ওই গুঁড়ো পদার্থ।
জ্যোতিষীর নজরে পড়তেই রীতিমতো মারমুখী হয়ে উঠল জ্যোতিষী, “দে, খবরদার এটা তুই নিবি না।”
“কেন বাবা? এই গুঁড়োতেই কী রঙ বদলের সব রহস্য লুকিয়ে আছে নাকি?” মুচকি হেসে বুবাইয়ের দিকে তাকিয়ে বাম চোখ টিপল লেট্টু। আর তারপরেই দ্রুত কমন্ডলুর জলে গুঁড়োটা ফেলে দিল। মুহূর্তে কমন্ডলুর সব জল হয়ে গেল গোলাপি!
উপস্থিত লোকগুলোর চোখ তখন ছানাবড়া! আর ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে জ্যোতিষী।
“তুমি বাবা ভণ্ড জ্যোতিষী! মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে কেমিক্যাল দিয়ে জলের রঙ পালটাও, আর লোক ঠকিয়ে ফালতু পাথর বিক্রি করো।” কথাগুলো বলেই লেট্টু হাত ধরল বুবাইয়ের। “আর একদণ্ড এখানে নয় রে বুবাই। ওর দলবল থাকতে পারে। এখুনি এসে পড়লে আমাদের দফারফা করে দেবে!”
দ্রুত পা চালাল লেট্টু শিয়ালদা স্টেশনের দিকে।
ট্রেন চলতে শুরু করে দিয়েছে। বুবাই বলল, “এবার তো তুমি জ্যোতিষীর ভণ্ডামির রহস্যটা বলো।”
“বলছি, শোন।” লেট্টু আমলকির প্যাকেটটা ছিঁড়ে দুটো কুচি নিজের মুখে দিয়ে বাকিটা বুবাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল, “পাথর পরে ভাগ্য ফেরে—এ হল চূড়ান্ত ভাঁওতা। জ্যোতিষীরা বলে, নানা রঙের পাথর নাকি সূর্যের আলো থেকে নানা রঙের রশ্মি শোষণ করে শরীরের মধ্যে পাঠায়। আবার নাকি কসমিক রশ্মিও শোষণ করে অদৃশ্য এক রশ্মি তৈরি করে। ওইসব রশ্মি মানুষের শরীরে ঢুকে নাকি নানা রোগ সারিয়ে দেয়। ভাগ্য পালটে দেয়।”
“এরকম বলে নাকি?”
“বলেই তো। আসলে কিছু কুযুক্তি খাড়া না করলে মানুষ মানবে কেন? গাছের পাতা সবুজ দেখায় কেন বল তো?”
“সবুজ রঙ প্রতিফলিত করে দেয় আর সেই রঙের রশ্মি আমাদের চোখে প্রবেশ করে। তাই।” ঝটিতি উত্তর বুবাইয়ের।
“এক্সেলেন্ট!” বুবাইয়ের পিঠ চাপড়ে দেয় লেট্টু। “তাহলে বল, কোনো পাথর লাল, কোনোটা নীল, কোনোটা সবুজ দেখায় কেন? ওই একই কারণে তো?”
“ঠিক তাই। কোনো পাথর লাল, কোনোটা নীল, কোনোটা সবুজ আলো প্রতিফলিত করে বলে।”
“তাহলে ভেবে দেখ, পাথরের কি রশ্মি শোষণ করা সম্ভব? আবার সেই রশ্মি শরীরের ভেতর চালিয়ে দেওয়া সম্ভব? পাথরের রশ্মি শোষণ বা শরীরে রশ্মি প্রবেশ করানোর কোনো ক্ষমতা পদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারল না, আর জ্যোতিষী বাবাজিরা আবিষ্কার করে ফেলেছে কোনো গবেষণা ছাড়াই! যত্তসব।”
“সে না-হয় হল, কিন্তু রঙ বদলের ব্যাপারটা কী বলো।”
“হ্যাঁ, বলছি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে। চালাকিটা ধরার জন্য জ্যোতিষীটার হাতের দিকে খুব ভালো করে লক্ষ করছিলাম।”
“কী দেখলে?”
“দেখলাম, জল রঙিন হওয়ার আগে জ্যোতিষী তার ডানহাতটা হাঁটুর পাশে নিয়ে গিয়ে ঊরুতে একটু চুলকোনোর অভিনয় করছে, কিন্তু অন্যবার করছে না।”
“সত্যি? দেখিনি তো! কেন?”
“সেটাই তো রহস্য। দিলাম ওকে তাতিয়ে, যাতে ও একসময় উঠে দাঁড়ায়। ও উঠে না দাঁড়ালে ওখানে কী আছে তা দেখব কী করে? ও উঠতেই দেখতে পেলাম কাগজে রাখা সাদা গুঁড়ো জিনিস। আমার বুঝতে বাকি রইল না।”
“কী ওটা লেট্টুদা?”
“কী আবার, ফেনপথ্যালিনের গুঁড়ো। কমন্ডলুতে ছিল চুনজল। চুনজলে ফেনপথ্যালিন মিশলে গোলাপি হয়ে যায়। ফেনপথ্যালিন কেমিক্যাল ইন্ডিকেটর কিনা!” যথার্থ বিজ্ঞের মতো বলল লেট্টু।
মাথা দোলাল বুবাই। “কিন্তু অতগুলো চোখ এড়িয়ে কী করে মেশাচ্ছিল বলো তো?”
“সবার নজর ছিল সামনে হাতের তালুর দিকে। ঠিক সেই সময় জ্যোতিষী বাবাজি ঊরু চুলকানোর অভিনয় করে আঙুলে একটুখানি ফেনপথ্যালিন লাগিয়ে নিচ্ছিল। আর কোষা থেকে জল ঢালার সময় আঙুলটা জলে লাগিয়ে দিচ্ছিল।”
“কী বুদ্ধি তোমার লেট্টু দা!” লেট্টুর জন্য বুবাইয়ের গর্ব আর ধরে না।
“বুদ্ধি আমার কোথায় দেখলি? আমার তো বইতে পড়া বিদ্যে। বুদ্ধি ওই জ্যোতিষীর। বুদ্ধি না থাকলে এত লোককে প্রতিদিন টুপি পরাতে পারে?”
“তা বটে! তবে বইতে পড়া বিদ্যেকে বাস্তবে প্রয়োগ করে ক’জন?”
“ঠিক বলেছিস। করে না বলেই তো বহু ডাক্তার, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, টিচারের আঙুলে বা বাহুতে ঝলমল করে ওইসব পাথর। এদের কী বলে জানিস?”
“পণ্ডিতমূর্খ।” বুবাই হেসে উঠল।
“কারেক্ট!” পিঠ চাপড়ে দিল লেট্টু।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর