বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে
আজকে দুটো মজার প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। প্রথম প্রশ্ন, এমন দুটি উদ্ভিদের নাম কী যারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারে?
উত্তর: ভলভক্স এবং ক্ল্যামাইডোমোনাস। এরা দুজনেই এককোষী অর্থাৎ ইউনি সেলুলার উদ্ভিদ। দুজনের শরীরেই ছোটো ছোটো শুঁড়ের মতো ফ্ল্যাজেলা রয়েছে। ফ্ল্যাজেলা নাড়িয়ে তারা জলের মধ্যে দিব্যি ঘোরাঘুরি করে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এমন দুটি প্রাণীর নাম কী যারা মোটেই নড়তে চড়তে পারে না?
উত্তর: প্রবাল এবং স্পঞ্জ। এদের যেখানে জন্ম সেখানেই মৃত্যু। একদম নো নড়নচড়ন! আশ্চর্য, তাই না!
এই আশ্চর্য প্রাণী প্রবাল বা কোরালদের গল্পই আজ শোনাব তোমাদের। ডিসকভারি চ্যানেলের দৌলতে কোরাল রিফের ছবি নিশ্চয় তোমরা সবাই দেখেছ। ‘কোরাল রিফ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘প্রবাল প্রাচীর’, কিন্তু আমার মনে হয় প্রাচীর নয়, প্রবাল দ্বীপ বলা উচিত। এ-কথা বলছি কারণ, প্রাচীর শব্দটি শুনলে মনে হয় নিষ্প্রাণ ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপ; কিন্তু প্রবাল তো নিষ্প্রাণ নয়। তারা জীবিত প্রাণ। আমরা যেমন গ্রামে বা শহরে সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে বাস করি, তেমনি প্রবালও সমুদ্রের অগভীর অংশে নিজেদের কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। এমনকি সেই কলোনির নিজস্ব ইকোসিস্টেম অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র অবধি রয়েছে। প্রায় হাজার খানেক প্রজাতির জলচর প্রাণীরা বসবাস করে সেখানে। আর প্রবাল কলোনির সৌন্দর্য্যের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সে যেন সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য রূপকথার জগৎ। নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না। অদ্ভুত সুন্দর, মায়াবী, স্বপ্নের মতো রঙিন প্রবালের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে সামুদ্রিক মাছেরা। সে দৃশ্য দেখলে মনে হয় প্রকৃতি-মা নিজের হাতে জলছবি এঁকে রেখেছেন।
আগেই বলেছি যে প্রবাল প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও চলাফেরা করতে অক্ষম। শিশু প্রবাল অর্থাৎ পলিপ সমুদ্রের নীচে শক্ত পাথুরে তলের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে রাখে। এরপর তারা নিজেদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট নিঃসরণ করে ধীরে ধীরে বহিঃকঙ্কাল বা এক্সোস্কেলিটন তৈরি করে। পলিপের মৃত্যুর পরও এই বহিঃকঙ্কালটি রয়ে যায় এবং এই শক্ত এক্সোস্কেলিটনের ওপর আবার নতুন পলিপ বেড়ে ওঠে। এমনি করেই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একেকটি প্রবাল কলোনি গড়ে ওঠে।
এমনিতে কোরালদের রঙ কিন্তু জুঁই ফুলের মতো ধবধবে সাদা। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা যে লাল, সবুজ, কমলা, বেগুনি রঙের কোরাল দেখি তার জন্য দায়ী হল একধরনের খুদে সমুদ্র শৈবাল। পোশাকি ভাষায় এদের জুওজ্যানথালি (Zooxanthellae) বলা হয়। প্রবাল ও শৈবালের এমন সহাবস্থানকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় সিমবায়োসিস অথবা মিথোজীবিতা। এভাবে একসঙ্গে বসবাসের ফলে দুইপক্ষই সুবিধে পায়। প্রবালের থেকে শৈবাল পায় আশ্রয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং পরিবর্তে তারা প্রবালদের দেয় অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য। এছাড়াও জুওজ্যানথালি ক্ষতিকারক সূর্যরশ্মির প্রভাব থেকে প্রবালের বহিঃকঙ্কালকে রক্ষা করে।
কোরাল কলোনিতে বসবাস করে নানান রকমের সামুদ্রিক প্রাণীরা। এদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ক্লাউন ফিশ, প্যারট ফিশ, স্পঞ্জ, অক্টোপাস বা স্টার ফিশের মতো মজাদার প্রাণীরা। আবার ভয়ানক হাঙর বা শার্কও থাকে সেখানে। তোমারা যারা ‘ফাইন্ডিং নিমো’ সিনেমাটা দেখেছ তারা আরো ভালো বুঝবে।
সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা খুব বেড়ে গেলে, অথবা খুব কমে গেলে প্রবালদের বন্ধু শৈবাল ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় এবং কোরালদের ঝলমলে রঙ বদলে যায় ধবধবে সাদায়। কী বিশ্রী ব্যাপার ভাবো তো! ঝলমলে জলরঙে আঁকা ছবি থেকে সব রঙ শুষে নিলে যেমন হয়, প্রবাল দ্বীপের অবস্থাও ক্রমে ক্রমে দাঁড়াচ্ছে ঠিক তেমনি। এই ঘটনাকে বলা হয় কোরাল ব্লিচিং (Coral bleaching )। তাপমাত্রার পরিবর্তন ছাড়া জলদূষণের ফলেও ব্লিচিং ঘটতে পারে। ব্লিচিং-এর ফলে মাইলের পর মাইল জুড়ে প্রবাল দ্বীপ নষ্ট হয়ে যায় এবং তার সঙ্গেই খাদ্যের অভাবে ধ্বংস হয় অন্যান্য বহু জলচর প্রজাতির প্রাণী। এই কারণে প্রাণীবিজ্ঞানীদেরও চিন্তার শেষ নেই। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলদূষণের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে এবং তারই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবাল দ্বীপগুলি।
কোরাল রিফ দেখতে পাওয়া যায় ট্রপিকাল বা ক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশে, সমুদ্রের অগভীর অংশে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ফিজি, পাপুয়া-নিউগিনিতে পৃথিবীর বিখ্যাত প্রবাল দ্বীপগুলি পাওয়া গিয়েছে। তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে প্রত্যেকটি দ্বীপই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা এখন থেকে মনোযোগ না দিলে আগামী দুশো বছরের মধ্যে পৃথিবীর কোনো প্রবাল দ্বীপ জীবিত থাকবে না। রামধনু রঙে রাঙানো প্রবালদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে তাদের মৃতপ্রায় কঙ্কাল! তাই বলছি, এখনো সময় আছে, খুব সাবধান। দূষণের দৈত্যকে রোধ করতেই হবে, নইলে ভবিষ্যতের পৃথিবী কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর