সৌম্যকান্তি জানা-র আগের লেখা- ক্লোরোফিল চোর, বঁটিঝাঁপের মেলায়, রঙবদল, অবচেতন মনের আয়না
(এক)
রোববারের এগারোটা পঁয়ত্রিশের কল্যাণী লোকালে লোকজন খুবই কম। লেট্টু জানালার ধারে বসে একমনে কিছু ভাবছিল। লেট্টু সাধারণত এতটা ভাবুক হয় না। কোনো না কোনো বিষয়ে জ্ঞান দিতে সদাই সচেষ্ট থাকে। কেতোর কাছে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক ঠেকছে।
“তোমার কি শরীর খারাপ করছে লেট্টুদা?”
প্রশ্ন শুনেই স্বমেজাজে লেট্টু। “হঠাৎ তোর এমন উদ্ভট সিদ্ধান্তের কারণ? আমাকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে তোর?”
“না মানে, তুমি তো বাসে-ট্রেনে যাওয়ার সময় এতটা চুপ থাকো না, তাই বলছিলাম আর কী।” আমতা আমতা করতে থাকে কেতো।
পাশ থেকে বুবাই কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “চেপে যা।”
লেট্টুর কান খুবই সজাগ। খিঁচিয়ে ওঠে, “কেন, চেপে যাবে কেন? আমার সম্বন্ধে উলটোপালটা ধারণা করলে সে ধারণা ভাঙাতে তো আমাকে বলতেই হবে। এই যে তোরা আজকের পেপারটা দুজনেই পড়লি, বল তো ভাবিয়ে তোলার মতো খবর কোনটা?”
সোল্লাসে বলে ওঠে কেতো, “ধোনি বিশ্বকাপের পর অবসর নেবে, এই খবরটা?”
“ধুর! এটা কোনো খবর হল? সবাই জানে।” কেতোর উৎসাহে জল ঢেলে দিল লেট্টু।
“তাহলে আই লিগে মোহনবাগান আর লাজং এফ.সি-র খেলা।” বিজ্ঞের মতো বলল বুবাই।
“আচ্ছা, তোদের কি খেলার খবর ছাড়া আর কোনো খবরের দিকে চোখ যায় না?” দাঁত কিড়মিড়িয়ে লেট্টু বলে উঠল। “বল তো, আজকের দিনটা মানে আটই মার্চ কেন বিখ্যাত?”
মাথা চুলকোতে লাগল কেতো আর বুবাই।
“ওরে গর্দভ, আটই মার্চ হল বিশ্ব নারী দিবস। তোরা তো খেলা ছাড়া আর কোনো খবর রাখিস না।” রাগে গজগজ করতে লাগল লেট্টু।
“ও, তাহলে তুমি নারী সম্বন্ধে ভাবছিলে?” কথাটা বলেই কেতো বুঝতে পারল বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। আর তাই লেট্টু কিছু বলার আগেই কান ধরে বলে উঠল, “সরি লেট্টুদা, মুখ ফসকে…”
“ওই মুখ তোর পার্মানেন্টলি সিল করে দেব বেয়াদপ।” লেট্টুর স্বর কঠিন, চোখে আগুন। “নির্ভয়ার নাম শুনেছিস? দিল্লিতে বাসের মধ্যে একদল পশু কী নৃশংসভাবে…” কথা শেষ করতে পারে না লেট্টু। “জানিস, দেশে মোট নারীদের মাত্র ১৩ পার্সেন্ট প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার করতে পেরেছে; দেশের মোট মহিলার মাত্র এক পার্সেন্ট কলেজে পা রাখতে পেরেছে? স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরে মেয়েদের এমন দুর্দশা ভাবতে পারিস? ভাবতে পারিস, এই দেশে গত এক বছরে সাড়ে পাঁচ লক্ষ কন্যা শিশুকে স্রেফ ভ্যানিশ করে দেওয়া হয়েছে? আর আমরা কিনা বছর বছর নারী দিবস পালন করছি, লেকচার দিচ্ছি! ছ্যা ছ্যা!”
কেতো আর বুবাই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে লেট্টু কী নিয়ে এত চিন্তা করছিল। আসলে লেট্টু একটু বদমেজাজি হলে কী হবে দেশের ও দশের মঙ্গলের কথাই তার মাথায় বেশিরভাগ সময় ঘুরপাক খায়। কিন্তু লেট্টু তো কী একটা খবরের কথা বলছিল। নারী দিবস নিয়েই হয়তো কোনো খবর হবে।
“লেট্টুদা, পেপারটা আর একবার দাও তো। দেখি তুমি কোন খবরের কথা বলছিলে।” বুবাই হাত বাড়াল।
“একবার তো দেখেছিস। শেষ পাতা ছাড়া আর কোনো পাতার দিকে কি তোদের নজর যায়? নদীয়ার ধানতলা থানার বৃদ্ধা মহিলার খবরটা পড়।”
“ধানতলা থানার কী খবর ভাই?” সামনে বসে থাকা এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে উঠলেন।
লেট্টু, কেতো ও বুবাই মুখ তুলে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রলোকের। রোগাটে গড়ন। গালে কয়েকদিনের না-কাটা দাড়ি। ধূমপান করে করে দুটো ঠোঁট কালো। চশমার কাচের তলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কৌতূহলী একজোড়া চোখ। কাঁধের সাইড ব্যাগটা কোলের উপরে রাখা।
“কেন, আপনার কি ওখানে বাড়ি?” লেট্টু জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ, ধানতলা থানার পুরাতন চাপড়া গ্রামে।”
“তাই? তাহলে তো নিশ্চয়ই গুরুদাসী মণ্ডলকে চেনেন?”
ভদ্রলোক নামটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন। লেট্টু বলে উঠল, “সাতানব্বই বছর বয়স। আপনার গ্রামেই বাড়ি।”
ভদ্রলোকের কিছু মনে পড়েছে বলে মনে হল না। জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ, তা কী হয়েছে গুরুদাসী মণ্ডলের?”
“নিন, খবরটা পড়ুন।” লেট্টু খবরের কাগজের ছয়ের পাতাটা খুলে ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে দেয়।
ভদ্রলোক কিছুটা পড়তেই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি গেল পালটে। “এবার চিনতে পেরেছি। এ তো সজলের মা। একদম সঠিক খবর। উনি সত্যিই কোনোদিন স্কুলে যাননি বা পড়াশোনা করেননি, কিন্তু গড়গড় করে বই পড়তে পারেন। শুনেছি, ওঁর স্মৃতিশক্তিও দারুণ। অনেক ছড়া কবিতা মুখস্থ। বাচ্চাদের নিয়মিত শোনান।”
লেট্টুর সঙ্গে গল্প জমে উঠল ভদ্রলোকের। কথায় কথায় জানা গেল, ভদ্রলোকের রানাঘাট স্টেশনের কাছে একটা ছোটো মনিহারি দোকান আছে। এক ছেলে। কলেজে ভর্তি হয়েও আর পড়েনি। বাপ-ছেলে দুজনে মিলে দোকান চালায়। আর কাছেপিঠে কোথাও মেলা হলে দোকান দেয়।
কথায় কথায় কখন যে হালিশহর স্টেশনে ট্রেন চলে এসেছে লেট্টুরা বুঝতেই পারেনি। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে হালিশহর স্টেশন। এরপর কাঁচরাপাড়া কারখানা গেট, তারপর কাঁচরাপাড়া স্টেশন। ওখানেই নামবে লেট্টুরা। তারপর যাবে বাগমোড়ে বুবাইয়ের মামাবাড়ি। বুবাইয়ের মামাতো ভাইয়ের অন্নপ্রাশন। লেট্টুদের পুরো টিমকেই নেমন্তন্ন করে এসেছিল বুবাইয়ের দিদা। তবে পিচকু, টুকুন আর মেনাল্ডো আসতে পারেনি।
“আচ্ছা, আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি। আমার নাম প্রত্যয় ধর, ওরফে লেট্টু। আর এরা হল কেতো, বুবাই। আমার ভাই কাম বন্ধু।” নিজেদের পরিচয়টা দেওয়ার সময় লেট্টুর গলায় বেশ গর্ব ঝরে পড়ল।
“আমি সমীর পাল। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব আনন্দ পেলুম। সময়টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল। সময় হলে একদিন আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসো। রানাঘাট স্টেশনে নেমে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে বেরিয়ে যে কাউকে পাল স্টেশনারি বললেই দেখিয়ে দেবে।” ভদ্রলোকের গলায় বেশ আন্তরিকতা।
“নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু আপনি কল্যাণী সীমান্ত লোকালে এলেন কেন? এরপরেই তো রানাঘাটের ট্রেন আছে।” অনেকক্ষণ পরে বুবাই মুখ খুলল।
লেট্টু বুবাইকে সমর্থন করে বলল, “আমিও অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করব বলে ভাবছিলাম।”
“আগামী পরশু থেকে কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতী মায়ের মেলা শুরু হচ্ছে। তাই।”
“তাই নাকি? তাহলে তো সময় করে একবার মেলায় যাওয়া যেতে পারে। কী বলিস বুবাই?” লেট্টুর চোখে-মুখে উৎসাহ।
সমীরবাবু লেট্টুর কথায় আর কোনো উৎসাহ দেখালেন না।
কেতো বলে উঠল, “লেট্টুদা, ট্রেন কাঁচরাপাড়া ঢুকছে।”
(দুই)
ঘোষপাড়া স্টেশনের গোড়া থেকেই শুরু হয়েছে মেলা। বিকেল চারটেতেই লোকের ভিড়ে মেলা জমজমাট। ডানদিকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। মেলা বামদিকে। মেলার রাস্তা ধরে এগোতেই দেখা গেল দু-পাশে নানারকমের দোকান। বাউল আখড়া থেকে ভেসে আসছে বাউল গান। লেট্টু, কেতো আর বুবাইয়ের সঙ্গী হয়েছে বুবাইয়ের মাসতুতো দাদা সানি। সানি বুবাইয়ের থেকে বছর তিনেকের বড়ো। নৈহাটি ঋষি বঙ্কিম কলেজে অর্থনীতি নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। নৈহাটিতেই বাড়ি। সে-ই ওদের মেলার সবকিছু চেনাতে চেনাতে নিয়ে চলেছে। সানিই বলছিল, সতী মায়ের মেলা প্রায় দুশো বছরের পুরোনো মেলা। আউল বা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবরাই এখানে আখড়া তৈরি করেন। নদীয়া ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও আউল সম্প্রদায়ের বহু লোকের এই মেলায় সমাগম হয়। দোলের আগের দিন থেকে শুরু করে সাতদিন ধরে চলে মেলা। আর সতী মা হলেন সরস্বতী দেবী নামে স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা যাঁর শরীরে নাকি ওই আউল সম্প্রদায়ের গুরু আউলচাঁদ মেলা প্রাঙ্গণের একটা পুকুর থেকে কাদা নিয়ে শরীরে লেপে দিয়ে দুশো বছর আগে তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়েছিলেন। আউলচাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেই সরস্বতী দেবীর স্বামী এই মেলার সূচনা করেছিলেন। এখনো ওই পুকুরকে ঘিরেই মেলা কেন্দ্রীভূত হয়। লোকে বলে পুকুরটির নাম হিমসাগর। ওই পুকুরের জল চরণামৃত হিসেবে ভক্তরা পান করে। আর মন্দিরের পাশে আছে একটা শতাব্দীপ্রাচীন ডালিম গাছ। ওই গাছের তলাতেই নাকি আউলচাঁদ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। আর তাই ভক্তরা হিমসাগরে স্নান করে মনস্কামনা পূরণের জন্য ওই গাছের ডালে ডোর বেঁধে দেয়। কাঁচরাপাড়া থেকে কল্যাণী ঘোষপাড়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে আসার সময় সানির মুখ থেকে লেট্টুরা মেলার ইতিহাস শুনে নিয়েছে।
মেলার মধ্যে একটু এগোতেই লেট্টুরা একটা দোকানে জিলিপি ভাজা হতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। লেট্টু, কেতো আর বুবাইয়ের গরম গরম জিলিপি খাওয়ার লোভ বরাবর। মেলায় গেলে ওদের খাওয়া চাই। লেট্টুর প্রস্তাবে সবাই রাজি হতেই ওরা দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসল। মানুষের কোলাহল, বাঁশির প্যাঁ-পোঁ আর একাধিক মাইকে ভেসে আসা নানা শব্দ কানের পক্ষে সত্যিই বেশ যন্ত্রণাদায়ক। পাশের জনের কথাও বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ লেট্টু সবাইকে চুপ করতে বলে কান খাড়া করে কিছু একটা শুনতে লাগল। তারপর সানিকে জিজ্ঞাসা করল, “হাওয়া-বাবাটা কে সানি?”
“হাওয়া-বাবা?” সানিও আকাশ থেকে পড়ল। এমন আজব নাম সে শোনেনি।
“আমি স্পষ্ট শুনলাম, মাইকে কোথায় যেন প্রচার হচ্ছে, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে সুস্থ করতে হলে হাওয়া-বাবার কাছে আসুন।” লেট্টু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।
“তুমি ঠিক শুনেছ? হাওয়া-বাবা?” বুবাইয়ের গলায় অবিশ্বাস।
চোখ পাকিয়ে লেট্টু বলল, “দেখ বুবাই, তুই ভালো করেই জানিস, না শুনে আমি আলফাল কথা বলি না।”
জিলিপি মাপছিল যে মাঝবয়সী লোকটি সে মনে হয় লেট্টুদের কথা শুনতে পেয়েছিল। বলল, “আপনি ঠিকই শুনেছেন ভাই, মেলায় হাওয়া-বাবা এসেছে। গত দু-বছর ধরে আসে। শুনেছি ক্যানসার, টিবি, প্যারালাইসিস অনেক রোগ সারিয়ে দেয়।”
এবার সবাই বেশ উৎসুক হয়ে উঠল। লেট্টু বুবাইয়ের পেটে কনুইয়ের মৃদু গুঁতো দিয়ে বলল, “কী রে, ঠিক শুনেছিলাম তো? তোদের লেট্টুদাকে কখনো আন্ডার এস্টিমেট করবি না, বুঝলি?”
বুবাই আর কেতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই লেট্টু জিলিপি মাপা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, “দাদা, এমন অদ্ভুত নাম কেন?”
“উনি মাটি ছেড়ে শূন্যে হাওয়ায় বসে থাকেন, আর হাওয়া থেকে ওষুধ এনে দেন।”
একথা শুনে সবার চোখ তো ছানাবড়া!
“সত্যি এমনটা সম্ভব? আমার বিশ্বাস হয় না।” কেতো মাথা ঝাঁকাল।
“বিশ্বাস না করলে একবার নিজের চোখেই দেখে আসুন। দেখবেন, লোকে লোকারণ্য।”
“তাহলে চল তো একবার। গিয়েই দেখি হাওয়া-বাবার কাণ্ডকারখানা। ঝটপট জিলিপিগুলো পেটে চালান দে।” লেট্টু খপাখপ জিলিপি খেতে লাগল। দেখাদেখি কেতো, বুবাই, সানিও।
জিলিপি খেয়ে চারজন চলল হাওয়া-বাবাকে দেখতে।
(তিন)
হাওয়া বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে টিকিট কেটে তবেই দেখা করা যায়। টিকিটের দাম জন প্রতি দশ টাকা। একটা কাউন্টার। সামনে দশ-বারোজন দর্শনার্থীর লাইন। চারদিক টিন দিয়ে ঘেরা। ভেতরটা দেখা যায় না।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে ওরা দেখে সামনে একটা মঞ্চ। পর্দা দিয়ে মঞ্চ ঢাকা। মঞ্চের সামনে প্রায় তিরিশটা চেয়ার দু-সারিতে সাজানো। ইতোমধ্যে যারা প্রবেশ করেছে তারা চেয়ারে বসে গেছে। যারা ঢুকছে তাদের দুজন যুবক সুষ্ঠুভাবে বসানোর তদারকি করছে। তাদের একজন লেট্টুদের বসার ব্যবস্থা করে দিল। মঞ্চের দু-পাশে দুটো ছোটো বক্সে হালকা সুরে বাজছে সূর্য প্রণামের স্তোত্র।
কয়েক মিনিট পরেই মাইকে ঘোষণা হল, ‘আপনারা সবাই শান্ত হয়ে বসুন। হাওয়া-বাবা আপনাদের দর্শন দিতে আসছেন। আপনারা জায়গায় বসে থাকবেন। নড়াচড়া করবেন না। বাবা শূন্য থেকে মন্ত্রপূত ভস্ম নিয়ে আসবেন আপনাদের জন্য। সেই ভস্ম আপনারা সেবন করলে আপনাদের সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হবে।’
লেট্টু মনে মনে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। সানি লেট্টুকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, একটা আস্ত শরীর কীভাবে শূন্যে ভাসতে পারে? এনি আইডিয়া?”
“ব্যাপারখানা না দেখা অবধি নো আইডিয়া।” লেট্টু নির্লিপ্তভাবে বলল।
ঠিক তখনই দেখা গেল মঞ্চের পর্দাটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। মঞ্চটা তেমন বড়ো নয়। বড়োজোর দশ ফুট চওড়া, আড়াই-তিন ফুট উঁচু, আর ছয়-সাত ফুট গভীর। মঞ্চের পেছনে ঘন নীল রঙের পর্দা। মঞ্চের আলোও নীলরঙা। মঞ্চের মাঝে চোখ বুজে পদ্মাসনে বসে একজন সাধুবাবা। পরনে সাদা ধুতি আর সাদা ফতুয়া। গলায় গেরুয়া রঙের উত্তরীয়। লম্বা দাড়ি, গোঁফ। মাথায় কাঁধ-ছোঁয়া কালো চুল। গলায় দুটো রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে রক্তিম তিলক। বেশ শান্ত সমাহিত চেহারা সাধুবাবার।
মাইকে ঘোষণা হল, ‘কেউ কথা বলবেন না। হাওয়া-বাবা ধ্যানরত অবস্থায় হাওয়ায় ভাসবেন। আর হাওয়া থেকেই এনে দেবেন মহৌষধ। আপনারা কেউ কথা বললে বা নড়াচড়া করলে বাবার ধ্যানে বিঘ্ন ঘটবে।’
দর্শকাসনের আলো নিভে গেল। সবাই তখন নিশ্চুপ। বুবাই ফিসফিস করে বলল, “লেট্টুদা, জোরে কথা বলে ডিস্টার্ব করে দেব?”
লেট্টু কনুইয়ের গোঁত্তা মেরে বুবাইয়ের দিকে চোখ গোল্লা করে এমনভাবে তাকাল যে বুবাইয়ের বুঝতে বাকি রইল না, বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে।
দেখা গেল, হাওয়া-বাবা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠছেন সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। মুখের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রায় চার ফুট শূন্যে উঠে সত্যিই ভেসে রইল হাওয়া-বাবা। মিনিট খানেক বাদে চোখ বুজেই ডানহাতটা উপরে তুলে দ্রুত কয়েক পাক ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মুঠো করা হাতটা সামনে আনতেই একটি যুবক হাওয়া-বাবার সামনে একটা তামার প্লেট ধরল। হাওয়া-বাবা চোখ না খুলে সেই থালার উপর এক মুঠো ছাই রেখে দিল। তারপর একইভাবে বামহাতের ভেলকিতে হাওয়া-বাবা শূন্য থেকে ছাই এনে দিল।
এবার মাইকে ঘোষণা হল, ‘আপনারা কেউ উঠবেন না। আপনাদের যার যার এই অলৌকিক মহৌষধ প্রয়োজন তাঁরা বলবেন। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকগণ তাঁদের কাছে গিয়ে এই মহৌষধ সামান্য পরিমাণ দেবেন। জলে এই ঔষধ মিশিয়ে তিনদিন সকালে খালি পেটে একমাত্রা করে খাবেন। সব রোগ নিরাময় হবেই।’
ঘোষণা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া-বাবা ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এলেন। তারপর দু-দিক থেকে পর্দা সরে গিয়ে মঞ্চকে ঢেকে দিল। দর্শকাসনের আলো জ্বলে উঠল।
দুজন স্বেচ্ছাসেবক একটা করে তামার প্লেট হাতে নিয়ে এগিয়ে এল দর্শকাসনের দিকে। থালায় ছোটো ছোটো কাগজের পুরিয়া। তার মধ্যে নিশ্চয়ই ওই ছাই আছে। তারা জিজ্ঞাসা করে করে এক-একজনকে ওই পুরিয়া দিতে লাগল। প্রায় সবাই নিল। একজন লেট্টুর কাছে আসতেই হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিল একটা পুরিয়া। হাঁ-হাঁ করে উঠল কেতো। “তুমি ওই ছাইভস্ম নিয়ে কী করবে লেট্টুদা?”
“তোকে খাওয়াবো গর্দভ।” খিঁচিয়ে উঠল লেট্টু।
এই দেখে বুবাই বা কেতো আর কোনো কথা বলল না। বুঝে নিল, লেট্টুর মাথায় কিছু ভাবনা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।
“একটিবার হাওয়া-বাবার সঙ্গে দেখা করা যাবে ভাই?” লেট্টু এক স্বেচ্ছাসেবককে জিজ্ঞাসা করল।
“না না, বাবা কারো সঙ্গে দেখা করেন না, কথাও বলেন না। উনি প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় একঘণ্টার জন্য কথা বলেন। কী সমস্যা আমাকে বলুন।”
“না, মানে তাঁর সঙ্গে একটিবার দেখা করতে পারলে ভালো হত। আমরা তো এখানে থাকি না। আবার কবে দেখা হবে জানি না। তাই বলছিলাম।” লেট্টু বেশ অনুনয় করতে লাগল।
এই অনুরোধের পালা যখন চলছে তখন হঠাৎই বুবাই বলে উঠল, “কেতোকে তো দেখছি না। কোথায় গেল?”
সবাই তখন স্বেচ্ছাসেবককে ছেড়ে কেতোকে খুঁজতে লাগল। ইতোমধ্যে অনেক দর্শকই বেরিয়ে গিয়েছে। তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়নি তো? অচেনা জায়গা। যদি খুঁজে না পায়। ওর কাছে তো ফোনও নেই। কী করা যায় – এ নিয়ে যখন লেট্টু, বুবাই ও সানির মধ্যে আলোচনা শুরু হবে ঠিক তখনই মঞ্চের পাশ থেকে কেতো এসে হাজির। তার চোখ-মুখে তখন প্রবল উচ্ছ্বাস।
“কী হয়েছে রে? কোথায় ছিলি?” লেট্টু ধমকে ওঠে।
লেট্টুর কানের পাশে মুখ এনে কেতো কিছু একটা বলে ওঠে।
“সাব্বাশ! এই না হলে আমার শিষ্য!” কেতোর পিঠ চাপড়ে দেয় লেট্টু।
মিনিট খানেক চার মাথা এক হয়ে কিছু একটা আলোচনা হল। তারপর বুবাই আর কেতো এক স্বেচ্ছাসেবককে হাওয়া-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ফের অনুরোধ করতে শুরু করল। স্বেচ্ছাসেবকটি যতই না বলে ওরা ততই জোরাজুরি করতে থাকে। ক্রমে উত্তেজনা বাড়তে লাগল। চেঁচামেচি শুনে আরো দুজন স্বেচ্ছাসেবক যুবক চলে এল সেখানে।
ইতোমধ্যে এক ফাঁকে লেট্টু চলে এসেছে মঞ্চের পেছনে। স্বেচ্ছাসেবকরা কেতোদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় লেট্টুর দিকে খেয়াল করেনি। লেট্টু যা ভেবেছিল ঠিক তাই। হাওয়া-বাবার আসল কারিকুরি রয়েছে মঞ্চের পিছনেই। এবার লেট্টু পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল মঞ্চের পেছনের সাজঘরে। গোঁফ-দাড়ি ও পরচুলা পাশে খুলে রেখে হাওয়া-বাবা আয়েস করে চা পান করছে!
“সমীরবাবু!” বেশ জোরে হাঁক পাড়ল লেট্টু।
হাওয়া-বাবা এমন করে চমকে উঠল যে কাপ থেকে অনেকটা চা তার ধুতির ওপরে চলকে পড়ল।
“কে? কাকে চান?” সমীর পাল নিজেকে মুহূর্তে সামলে নিয়েছে।
“আপনাকেই চাই সমীর পাল-বাবু।” লেট্টু তখন ঢুকে পড়েছে ছোট্টো সাজঘরে। “তা এটাই আপনার মনিহারি দোকান!”
“কে সমীর পাল? আমার নাম সমীর নয়।” হাওয়া-বাবার গলায় বেশ দৃঢ়তা।
“তাহলে দু-দিন আগে কল্যাণী সীমান্ত লোকালে আপনি আমাদের মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলেন। সমীর মানেও কিন্তু হাওয়া। বেশ ম্যাচিং।”
“সমীর পাল? কল্যাণী সীমান্ত লোকাল?” যেন আকাশ থেকে পড়ার ভান করল সমীর ওরফে হাওয়া-বাবা।
“কেন খামোকা চালাকি করছেন দাদা?” লেট্টু বসে পড়ল একটা চেয়ারে। “তবে আপনার বুদ্ধির তারিফ করতেই হবে।”
“কীসের বুদ্ধি?”
“ওই যে হাওয়ায় ভাসার ব্যাপারটা!” কৌতুক মিশিয়ে লেট্টু উত্তর দেয়। “তবে ব্যাপারটা এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু হাতের খেল দেখিয়ে শূন্য থেকে ছাইপাঁশ এনে তা দিয়ে রোগ সারবে বলে মানুষকে বোকা বানানোটা কিন্তু অপরাধ।”
“আমি শূন্য থেকে মন্ত্রপূত ভস্ম আনি। এতে অনেকের রোগ সেরেছে।” বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দেয় সমীর।
“এই দেখুন, আমার দু-হাতে কিছুই নেই।” লেট্টু হাত দুটো মাথার উপরে একবার ঘুরিয়ে সমীরের সামনে মুঠো খুলে দেখায় দু-হাতের তালুতে দুটো একটাকার কয়েন। “দেখুন, আমিও শূন্য থেকে ছাই আনতে পারব, এতে তেমন কৃতিত্ব নেই। কিন্তু সেই ছাই দিয়ে রোগ সারবে, মানুষকে এই ভাঁওতা দেওয়া অন্যায়।”
“রোগ তো অনেকেরই সেরেছে। প্রমাণ আছে।”
“শুনুন, রোগের কারণ যেমন শারীরিক, তেমন অনেকটা মানসিকও। মানসিক চাপ কমলে কিছু রোগের নিরাময় সম্ভব। আবার অনেকে আগে থেকে ওষুধ খেয়ে চলেছে। তারা অনেকেই আপনার দেওয়া ছাই খেয়েছে, আর তারপর রোগও সেরেছে। তখন তারা ওষুধের পরিবর্তে আপনার ছাইকেই কৃতিত্ব দিয়েছে। আর আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন যে এটা হাতের কৌশলে হাজির করা ছাই। ওই তো সেই ছাই।” লেট্টু সাজঘরের এককোণে একটা গামলায় রাখা ছাইয়ের দিকে আঙুল নির্দেশ করল।
সমীরের মাথাটা তখন ঝুঁকে পড়েছে মাটির দিকে। মুখ ম্রিয়মাণ। হয়তো রোজগার হারানোর চিন্তায়। তার কৌশল ধরা পড়ে গেছে।
লেট্টু সমীরের কাঁধে হাত রেখে উঠে দাঁড়াল। “দাদা, আপনি শূন্যে ভাসার খেলা দেখিয়ে, শূন্য থেকে ছাই এনে রোজগার করুন। আমি আপনার কৌশল কারো কাছে ফাঁস করব না। কিন্তু প্লিজ, মানুষকে রোগ সারানোর নামে ছাই খাওয়াবেন না।”
সমীর পালকে শুভরাত্রি জানিয়ে বেরিয়ে এল লেট্টু।
(চার)
পরের দিন সানির ডাকে ঘুম ভাঙল লেট্টুর। পাশে কেতো তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দুপুরের ট্রেনেই আজ ওরা বাড়ি ফিরে যাবে। তার আগে সকালে একবার কল্যাণী ঘোষপাড়ায় গিয়ে সমীরের সঙ্গে দেখা করে আসবে। ওকে আরেকবার বুঝিয়ে আসবে যে খেলা দেখিয়ে রোজগার করাতে কোনো অপরাধ নেই, কিন্তু রোগ সারাবার নামে মিথ্যে বলা অপরাধ। তাছাড়া আগেরদিন সন্ধ্যায় হাওয়া-বাবার শো দেখতে গিয়ে বাড়ি ফেরার তাড়ায় সতী মায়ের মন্দির, হিমসাগর পুকুর আর বিখ্যাত ডালিম গাছ কিছুই দেখা হয়ে ওঠেনি। সেটাও দেখা দরকার।
চা-বিস্কুট খেয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়ল চারজন। এবার ট্রেনে নয়, ২৭ নম্বর রুটের বাসে চেপে আই.টি.আই. মোড়ে নেমে পৌঁছে গেল মেলায়।
কিন্তু এ কী! হাওয়া-বাবা হাওয়া! পাততাড়ি গুটিয়ে কেটে পড়েছে সমীর। হয়তো লেট্টুকে বিশ্বাস করতে পারেনি। পাছে মেলার লোকেদের কাছে তার শূন্যে ভাসার আর শূন্য থেকে ভস্ম আনার কৌশল ফাঁস করে দেয়!
মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল লেট্টুর।
বাড়ি ফেরার সময় সানি ট্রেনে বসে জিজ্ঞাসা করল, “লেট্টুদা, এবার সমীর পালের শূন্যে ভাসার রহস্যটা তো বলো।”
“শোন তবে। সমীর পাল রোগ সারাবার ভণ্ডামি করলেও লোকটার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হবে। ও একটা শক্তপোক্ত কপিকলের মতো যন্ত্র বানিয়েছে লোহা দিয়ে। অনেকটা মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডের মতো। দুটো রড দিয়ে তৈরি। মাটির সঙ্গে একটা মোটা স্ট্যান্ড শক্তভাবে আটকানো। আর অন্য স্ট্যান্ডটা ইংরেজি জেড-এর মতো। এই স্ট্যান্ডের নীচের বাহুর সঙ্গে আসনের মাপে লোহার একটা পাত লাগানো আছে। আর ওপরের বাহুটা প্রথম স্ট্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা আছে একটা ক্ল্যাম্পের সাহায্যে। ক্ল্যাম্পের সঙ্গে একটা হাতল লাগানো আছে। হাতলটা ঘোরালে জেড আকারের স্ট্যান্ডটা ওপরে ওঠে বা নীচে নামে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল?”
হাঁ হয়ে বুবাই, কেতো আর সানি লেট্টুর কথাগুলো গিলছিল। ওরা মনে মনে যন্ত্রটার ছবি আঁকছিল আর অবাক হয়ে ভাবছিল, লোকটার কী বুদ্ধি!
“এবার বুঝেছি।” বুবাই মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল। “ওই পাতের উপর লোকটা প্রথমে বসেছিল। তারপর কেউ হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওকে ওপরে তুলে দিয়েছিল।”
“কারেক্ট। সমীর পালের ধুতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ওই পাত। ফলে দর্শক বুঝতে পারেনি। পেছনে যে পর্দাটা টাঙানো ছিল তা আসলে মাঝামাঝি কাটা। মাটির সঙ্গে আটকানো স্ট্যান্ডটা ছিল পর্দার পেছনে। পর্দার কাটা অংশ বরাবর জেড আকারের স্ট্যান্ডটা ওপরে উঠেছে আর নীচে নেমেছে। মঞ্চটা ছোটো হওয়ায় আর নীল আলো ও নীল পর্দা মিলে মঞ্চে একটা আবছায়া তৈরি করায় সমীর পাল দর্শকের চোখকে সহজেই ফাঁকি দিতে পেরেছে।”
“কিন্তু লেট্টুদার ভয়ে সমীর পাল, থুড়ি হাওয়া-বাবা দিনের আলো ফোটার আগেই হাওয়া হয়ে গেল!” কেতোর কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ট্রেন তখন কাঁচরাপাড়া স্টেশনে ঢুকছে।