গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আরো লেখাঃ দেড়শো বছর আগের এক সূর্যগ্রহণের গল্প, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং ,
তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ ১ম পর্ব, ২য় পর্ব , ৩য় পর্ব , ৪র্থ পর্ব , ৫ম পর্ব, ৬ষ্ঠ পর্ব
পদার্থবিদ্যাতে দ্বিতীয় নোবেলজয়ী নারী: মারিয়া গোপার্ট মায়ার
পদার্থবিজ্ঞানে মহিলা হিসাবে প্রথম নোবেল জিতেছিলেন মেরি কুরি ১৯০৩ সালে; দ্বিতীয় মহিলার জন্য তার পরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ষাট বছর। ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোপার্ট মায়ার নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানেই তাঁর অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৬ সালের ২৮ জুন মারিয়া গোপার্টের জন্ম। মেরির মতোই পোল্যান্ড তাঁর জন্মস্থান হলেও চার বছর বয়সেই তাঁদের পরিবার জার্মানি চলে যান। গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাবা অধ্যাপনা শুরু করেন।
১৯৩০ সালে মারিয়া গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পদার্থবিদ্যাতে ডক্টরেট করেন, তাঁর শিক্ষক ছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ম্যাক্স বর্ন, যিনি পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ম্যাক্স বর্নকেও জার্মানি থেকে ত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে সেই সময় তিনি ইচ্ছুক হলেও তাঁকে চাকরি দেওয়ার জন্য সি ভি রমনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
মারিয়ার ডক্টরেট থিসিসের পরীক্ষক ছিলেন তিনজন, ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্র্যাঙ্ক এবং অ্যাডলফ উইন্ডাউস। তিনজনই আগে বা পরে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন! এই রকম বিখ্যাত বিশেষজ্ঞরা যে থিসিস অনুমোদন করলেন, তাতে কী ছিল? মারিয়া কোনো পরমাণুর একই সঙ্গে দুটি ফোটন কণা শোষণের সম্ভাবনা অঙ্ক কষে বার করেছিলেন। সেই সময় তা ছিল নিছকই তত্ত্বকথা, কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর পরে লেজার আবিষ্কারের পরে সেই সম্ভাবনা মাপা সম্ভব হয়েছে। তাঁর সম্মানে একসঙ্গে দুই ফোটন কণার শোষণের মাত্রাতে ব্যবহার করা একককে তাঁর নামে GM বলা হয়।
১৯৩০ সালের জানুয়ারিতেই মারিয়া বিয়ে করলেন গটিনগেনে কর্মরত মার্কিন বিজ্ঞানী জোসেফ মায়ারকে। বিয়ের পরে যাত্রা করলেন আমেরিকা, সেখানে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে জোসেফ রসায়নের অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলেন। জন হপকিন্সের নিয়ম অনুযায়ী সেখানে কোনো অধ্যাপকের আত্মীয়ের পক্ষে স্থায়ী চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল না। মারিয়া একটা সামান্য কাজ পেলেন, পাশাপাশি গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। তিনি দেখান যে নিউক্লিয়াস থেকে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে একই সঙ্গে দুটি ইলেকট্রন বেরোনো সম্ভব। তাঁর সেই ভবিষ্যৎবাণী বাহান্ন বছর পরে পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়।
মারিয়ার কর্মজীবন খুব সুখের ছিল না, নানা সময় তাঁকে বিনা বেতনে কাজ করে যেতে হয়েছে। জোসেফ মায়ারকেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। মারিয়া মার্কিন পরমাণু বোমা তৈরির মানহাটান প্রকল্পেও কাজ করেছিলেন। এনরিকো ফার্মি ও ইউজিন উইগনারের সংস্পর্শে আসার ফলে তাঁর গবেষণার দিক নির্ধারণে নির্দিষ্ট হয়। আমরা মারিয়ার সমস্ত কাজের আলোচনা না করে শুধু যে কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার কথা শুনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিউক্লিয় বিজ্ঞান দ্রুত পদক্ষেপে এগোতে থাকে। এই সময় বিভিন্ন নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব বিষয়ে কিছু তথ্য বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, যা তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না। পরমাণুর ক্ষেত্রে আমরা জানি যে কিছু কিছু পরমাণু সহজে বিক্রিয়া করতে চায় না, তাদের আমরা নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলি। যেমন হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন ইত্যাদি হলো নিষ্ক্রিয় গ্যাস। বোরের পরমাণু তত্ত্বের কথা আমরা জানি, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্যে বোরের তত্ত্বকে সঠিকভাবে রূপ দিলে আমরা কেন নিষ্ক্রিয় গ্যাসের পরমাণুরা বিক্রিয়াতে অংশ নিতে চায় না, তা বুঝতে পারি। দেখা যায় যে ইলেকট্রনরা মূলত নিউক্লিয়াসের চারদিকে কয়েকটি শেল বা খোলকের মতো অঞ্চলে অবস্থান করে। যখন জানা গেল কিছু নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব বেশি, তখন বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিক ভাবেই পরমাণুর শেল তত্ত্বের অনুরূপ কোনো তত্ত্বের কথা ভাবলেন।
দেখা গেল যে সমস্ত নিউক্লিয়াসের প্রোটন বা নিউট্রনের সংখ্যা কতকগুলো সংখ্যার সঙ্গে সমান, তাদের স্থায়িত্ব বেশি। সেই সংখ্যাগুলো হলো ২, ৮, ২০, ২৮, ৫০, ৮২ এবং ১২৬। এগুলোকে বলে ম্যাজিক সংখ্যা। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও এই সংখ্যাগুলোই কেন ম্যাজিক তা প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। মারিয়া দেখলেন যে নিউক্লিয়াসের কণাগুলো যে বলের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া করে, তাদের একটি নির্দিষ্ট চরিত্র ধরে নিলে এই সংখ্যাগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। একে বলে স্পিন-অরবিট চরিত্র। বিষয়টা অঙ্ক ছাড়া বোঝানো সম্ভব নয়, তাই সেই চেষ্টা করছি না। কিন্তু বিষয়টা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সত্তর বছর পরেও সেই চরিত্র নিয়ে গবেষণা চলছে।
১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারিয়া গবেষণাপত্রটিও প্রকাশের জন্য পাঠান, তা প্রকাশিত হয় জুনে। ইতিমধ্যে জার্মানির তিন বিজ্ঞানী অটো হ্যাক্সেল, জোহানেস ড্যানিয়েল জেনসেন এবং হান্স সুয়েস একই বিষয়ে আলাদা ভাবে কাজ করে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় মারিয়ার আগে, যদিও তাঁরা মারিয়ার দুই মাস পরে সেটি পাঠিয়েছিলেন। এর পরে মারিয়া ও জেনসেন একসঙ্গে গবেষণা করে তাঁদের ধারণাটিকে আরও প্রসারিত করেন। ১৯৬৩ সালে নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইউজিন উইগনার। নিউক্লিয় শেল বিষয়ে গবেষণার স্বীকৃতিতে তাঁর সঙ্গে পুরস্কার ভাগ করে নেন মারিয়া গোপার্ট মায়ার ও জোহানেস ড্যানিয়েল জেনসেন। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মারিয়া গোপার্ট মায়ারের মৃত্যু হয়। এখনো নিউক্লিয়াসের ব্যাখ্যা করার জন্য শেল মডেলের থেকে ভালো কিছু আমরা খুঁজে পাইনি। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি তরুণ মহিলা বিজ্ঞানীদের জন্য মারিয়ার নামে এক পুরস্কার চালু করেছে।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর