বৈজ্ঞানিকের দপ্তর -বিজ্ঞানের গল্প- অবচেতন মনের আয়না- সৌম্যকান্তি জানা-বর্ষা২০২১

সৌম্যকান্তি জানা-র আগের লেখা- ক্লোরোফিল চোর, বঁটিঝাঁপের মেলায়, রঙবদল

bigganlettuda04

(এক)

ঘোষেদের পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণায় রবিবাসরীয় ঠেকটা সবে জমতে শুরু করেছে। মধ্যমণি যথারীতি লেট্টু। ঠিক সেই সময় মাইকের জোরালো আওয়াজে চাপা পড়ে গেল ওদের কথাবার্তা। গাঁক গাঁক করে মাইক বাজিয়ে  পুকুরের পশ্চিম পাড়ের পাশের রাস্তা দিয়ে চলেছে একটা অটো। মাথায় দুটো চোঙা দু’দিকে মুখ করে বাঁধা। অটোর দু’পাশে ও পেছনে ঝুলছে ভোটপ্রার্থীর ও দলের প্রতীকের ছবি দেওয়া ফ্লেক্স। অটোতে বসে একজন আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে ওই প্রার্থীর জন্য ভোট চাইছে। অটোটা পুকুরের দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় লেট্টুদের কানে অস্বস্তি হচ্ছিল।

বুবাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, “ব্যাটা যাবি তো যা না! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? কান, মাথা সব যেন ঘুরছে।”

লেট্টু অশ্বত্থ গাছে হেলান দিয়ে আপনমনে কিছু ভাবছিল। মেনাল্ডো লেট্টুর দিকে ফিরে বলল, “আচ্ছা লেট্টুদা, পুজোর সময় মাইকে শব্দের মাত্রা ৬৫ ডেসিবেলে বেঁধে দেওয়া হয়। ভোটের প্রচারে কোনও শব্দমাত্রা বাঁধা নেই? ”

মেনাল্ডোর দিকে না তাকিয়েই মুখ খুলল লেট্টু, “শব্দের মাত্রা কোর্টের নির্দেশে বেঁধে দেওয়া আছে। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে দিনে ৫৫ ডেসিবেল, আর রাতে ৪৫ ডেসিবেলে বেঁধে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। সেই ১৯৯৫ সালে। তোরা কেন, আমিও তখন জন্মাইনি।”

কেতো তো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “তাহলে ভোটের প্রচারে এত জোরে মাইক বাজাচ্ছে কেন? ”

– কোর্টের অর্ডারকে ডোন্ট কেয়ার করছে।

-কিন্তু আমরা করলে দোষ! পুচকু বলে উঠল।

– দোষ সবার। পলিটিক্যাল দলের ক্ষমতা আছে কোর্টকে কাঁচকলা দেখানোর। তোর, আমার নেই, তাই। লেট্টু আবারও নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয়।

– তুমি এবার ভোট দেবে লেট্টুদা? টুকুন দাঁত বার করে জিজ্ঞাসা করল।

– নিশ্চয়ই। ভোট দেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার।

– কাকে দেবে?

“ওরে অপোগন্ড। তোকে বলবো কেন?” খিঁচিয়ে ওঠে লেট্টু।

কেতো টুকুনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, “গোপনে ভোট দিতে হয়, কাউকে দেখাতে নেই, বলতে নেই।”

লেট্টু আপন মনে বলে ওঠে, “তবে চোরেদের দলকে আমি কখনওই ভোট দিই না, নিশ্চিত থাকিস।”

“বাবা তো বলে সব দল চোর।” মেনাল্ডো বলল।

“খুব একটা ভুল বলেননি। তবে কোনও দলের নেতা-মন্ত্রীরা পুকুর নয়, নদী-সাগরও চুরি করে, আবার কোনও দলের কেউ কেউ নালা-ডোবা চুরি করে। আমি নালা-ডোবাদের দিকেই থাকব।” লেট্টুর ঠোঁটের কোণে এতক্ষণে একটু হাসি ফুটল।

চুরির কথা শুনে পুচকু হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। জানো লেট্টুদা, “গত পরশু আমার মায়ের হাতের দু’গাছা চুড়ি চুরি হয়ে গেছে।”

“সে কী রে! কী করে হল?” লেট্টু ঘুরে বসল পুচকুর দিকে।

“মা পুকুরঘাটে স্নান করার সময় চুড়িগুলো খুলে ব্রাশ দিয়ে ঘসে পরিষ্কার করেছিল। তারপর ঘাটে রেখে স্নান করে ঘরে চলে আসে। চুড়ি পরতে ভুলে যায়। মা’র চুড়ির কথা মনে পড়ে বিকেলে। ঘাটে গিয়ে দেখে নেই।”

“বাড়িতে বিকেলে বাইরের কে কে এসেছিল?” টুকুন গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিল।

– সেটাই তো প্রশ্ন। কেউ আসেনি।

– তোর বাবা-মা, দিদি আর ঠাকুমা ছাড়া আর কে কে আছে?

– চঞ্চলা মাসি।

– সে কে? কাজের মাসি?

– হ্যাঁ।

– তাহলে তো হিসাব বরাবর! ওই নিয়েছে। বুবাই মাথা দুলিয়ে বলে উঠল।

মুখ খুলল লেট্টু। ওরে অজ-গোয়েন্দা! পুচকুই যে নেয়নি তার প্রমাণ কী? নিশ্চিত না হয়ে, প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায়? সন্দেহ করা যেতেই পারে, কিন্তু দোষী বলা যায় না। বুঝেছিস?

লেট্টুর বকুনি খেয়ে টুকুন আর বুবাইয়ের গোয়েন্দাগিরি করার ইচ্ছেটা কর্পূরের মতো উবে গেল।

– আমি? আমি কেন নেবো? পুচকু চেঁচিয়ে উঠল।

– নিয়েছিস তো বলিনি। গোয়েন্দাগিরি করার সময় শুরুতে সবাইকে সন্দেহ করতে হয়। ফেলুদা পড়িসনি? লেট্টুর গলার স্বর বেশ ঝাঁঝালো। তা এখন কী অবস্থা?

– আমরা সবাই চঞ্চলা মাসিকে চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করছে না।

– চোর কখনও স্বীকার করে? ফুট কাটল কেতো।

– তুই থাম। লেট্টুর ধমক। পুচকুর কথা শুনি।

– আমরা চঞ্চলা মাসির ব্যাগ সার্চ করেছি। কিছুই পাইনি।

– ব্যাগে রাখেনি। অন্য কোথাও রেখেছে। ফের ফুট কাটল বুবাই। তারপর লেট্টুর চোখাচোখি হতেই জিভ বার করে দু’কানে দু’হাত।

পুচকু বলল, আমার মায়ের ছোটোমাসি বলেছে শিরাকোলে নাকি একজন তান্ত্রিক আছে চোর ধরে দেয়।

– তাই নাকি? কীভাবে? লেট্টু এতক্ষণে কৌতূহলী হয়ে উঠল।

– বারো বছরের কম বয়সী একটা ছেলে বা মেয়েকে নাকি নিয়ে যেতে হবে। তান্ত্রিক আয়না-চালান করবে। সেই বাচ্চা ছেলে বা মেয়েটা আয়নায় চোরের ছবি দেখতে পাবে। আগামীকাল মা তান্ত্রিকের কাছে যাবে। একদমে পুচকু কথাগুলো বলে থামল।

– আর কে  যাবে?

– ছোটোদিদা যাবে।

– ওরে গর্দভ, বাচ্চা কে যাবে সে কথা বলছি। খিঁচিয়ে উঠল লেট্টু।

– তা তো ঠিক জানি না। তবে মনে হয় মিনি যাবে।

– কে মিনি?

– আমার কাকুর মেয়ে। ফাইভে পড়ে।

এতক্ষণ গল্প করার ফাঁকে সুয্যিমামা প্রধানপাড়ার নারকেল গাছগুলোর আড়ালে মুখ লুকিয়েছে, আর ভোট প্রচারের অটোটাও বিদায় নিয়েছে।

(দুই)

ধর্মতলাগামী সরকারি পরিবহনের বাসটা শিরাকোল স্টপেজে থামতে একে একে পাঁচজন নেমে এল। পুচকুর মা, ছোটোদিদা, মিনি ছাড়াও ওদের সঙ্গী হয়েছে লেট্টু আর পুচকু। লেট্টু আগেরদিন সন্ধ্যায় পুচকুদের বাড়ি গিয়ে ওদের সঙ্গী হওয়ার জন্য পুচকুর মাকে রাজি করিয়েছে।

শিরাকোলে নেমে ওদের পথপ্রদর্শক হল পুচকুর ছোটোদিদা। তিন রাস্তার মোড় থেকে একটুখানি সামনে এগিয়ে বাঁদিকের গলিতে মিনিট তিনেক হাঁটতেই ওরা পৌঁছে গেল তান্ত্রিকের আস্তানায়। দোতলা পাকা বাড়ি। পাঁচিলের গায়ে বিজ্ঞাপন লেখা – “তান্ত্রিক জ্যোতিষ ও গোল্ড মেডালিস্ট পন্ডিত শ্রী গম্ভীরানন্দ। গ্যারান্টিসহ যে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হয়। সময়ঃ প্রতিদিন সকাল ১০টা হইতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।”। গেটের বাইরে থেকেই দেখা গেল বাড়ির উঠোনের ডানদিকে একটা মন্দির। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই মন্দিরের খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল ভেতরে কালীর মূর্তি। পুচকুর মা ও ছোটোদিদা কালীর মূর্তি দেখেই মন্দিরের দরজার সামনে গিয়ে জুতো খুলে দু’হাত কপালে ঠেকাল। দেখাদেখি মিনিও। কিন্তু লেট্টু আর পুচকু মন্দিরের দিকে না যাওয়ায় ছোটোদিদা বলল, দাদুভাইরা, তোমরা মায়ের সামনে এসে নমস্কার করো। মা তোমাদের সব ইচ্ছে পূর্ণ করবেন।

ছোটোদিদা জানে না যে লেট্টু ঘোরতর নাস্তিক। আর তার সাথে থেকে থেকে পুচকুসহ বাকি চার স্যাঙাৎও নাস্তিক হয়ে উঠেছে। তাই লেট্টু শুনেও না শোনার ভান করল। পুচকু লেট্টুর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, কী করবে লেট্টুদা?

– তুই একবার কপালে না হয় হাত ঠেকিয়েই দে। নইলে ঝামেলা হতে পারে।

লেট্টুর কথায় পুচকু দু’পা এগিয়ে মন্দিরের দিকে ঘুরে জুতো পরেই কপালে হাত ঠেকিয়ে নিল।

– কই দাদুভাই, তুমি এসো। নমস্কার করো। ছোটোদিদা লেট্টুকে ডাকল।

ফাঁপরে পড়ে গেল লেট্টু। ঝামেলা এড়াতে সামান্য মিথ্যের আশ্রয় নিল, আমি তো আপনাদের সাথেই পেছনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে নিয়েছি দিদা। ক্ষতিকর নয় এমন খুচরো মিথ্যে দোষের নয় ভেবে লেট্টু নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।

বাড়িতে ঢোকার দরজার পাশে দেয়ালে কলিংবেলের সুইচে পুচকু চাপ দিতেই বেরিয়ে এল বছর কুড়ির এক তরুণ। সাধারণ ঘরোয়া পোশাক পায়জামা ও গোল গলা টি শার্ট পরা।

– কিছু বলবেন?

ছোটোদিদা বলল, গম্ভীরানন্দবাবু কি আছেন? আজ চেম্বার করবেন?

– হ্যাঁ বাবা আছেন। ওই ঘরে বসুন। আধঘন্টার মধ্যে উনি আসবেন।

বোঝা গেল না তরুণটি তান্ত্রিকের শিষ্য, নাকি সন্তান। সে যাইহোক, সবাই তরুণটির দেখানো ঘরে গিয়ে ঢুকল। তরুণটি পাখা চালিয়ে দিল।

ঘরটা বেশ বড়ো ড্রইংরুমের মতো। ঘরের মধ্যে দুটো কাঠের বেঞ্চ। আর একপাশে কাঠের চৌকিতে কালীর একটা বড়োসড়ো ফটো। ফটোতে প্লাস্টিকের জবাফুলের মালা। ধূপ ও প্রদীপ জ্বলছে। সাজিতে কয়েকটা জবাফুল। ঘরের মাঝে একটা কার্পেট বিছানো। একটা বেঞ্চে পুচকু ও লেট্টু, আর একটা বেঞ্চে বাকিরা গিয়ে বসল।

অপেক্ষা করতে করতে লেট্টুর ঝিমুনি চলে এসেছিল। শিরাকোলে আসার জন্য সকাল সকাল উঠতে হয়েছে বলে ঘুম কম হয়েছে। মিনি আর পুচকুও ঢুলছিল। তবে ছোটোদিদা আর পুচকুর মা চাপা স্বরে কীসব গল্প করছিল।

হঠাৎ ঘরে একজন ঢুকতেই ওদের ঝিমুনি কেটে গেল। গেরুয়া আলখাল্লা ও গেরুয়া ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা একজন ছোকরা। এ তো কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই তরুণ! কপালে সিঁদুরের তিলক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

ছোকরাটি দেয়াল আলমারির পাল্লা খুলে ভেতর থেকে কাঠের একটা ছোটো চৌকি, একটা আয়না আর কয়েকটা কৌটো বার করে কার্পেটের মাঝে বসল। তারপর চৌকি পেতে তার ওপরে জিনিসপত্রগুলো রাখল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘরে ঢুকল গেরুয়া আলখাল্লা ও ধুতি পরা একজন দীর্ঘদেহী ও স্বাস্থ্যবান মাঝবয়সী মানুষ। মাথায় কুচকুচে কালো চুল ব্যাকব্রাশ করে কাঁধ পর্যন্ত বিছানো। কুচকুচে কালো গোঁফ ও দাড়ি। দেখেই বোঝা যায় চুল-দাড়িতে কলপ করা। নাকের ওপরে গোল ফ্রেমের চশমা। কপালে সিঁদুরের লম্বা তিলক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ছোটোদিদা উঠে দাঁড়াতেই দেখাদেখি সবাই উঠে দাঁড়াল। লেট্টুও দাঁড়াল।

– বোসো বোসো। গম্ভীরানন্দের স্বর বেশ গম্ভীর।

গম্ভীরানন্দ কার্পেটের উপর চৌকির সামনে গিয়ে বসল। তারপর আয়নার উপর সিঁদুর মাখিয়ে তার সামনে ধূপ জ্বালাল। সাজি থেকে ফুল নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে আয়নার সামনে রাখল। তারপর প্রণাম করে ঘাড় ঘোরাল পুচকুর মা ও ছোটোদিদার দিকে।

– কী সমস্যা হয়েছে তোমাদের?

ছোটোদিদা বলল, আমার বোনঝির গহনা চুরি হয়ে গেছে বাবা। কয়েকদিন আগে পুকুরঘাটে স্নান করার সময় হাতের চুড়িগাছা খুলে পরিষ্কার করছিল। তারপর স্নান করে ঘরে চলে আসে। চুড়ি পরতে ভুলে যায়। বিকেলে ঘাটে গিয়ে দেখে নেই। 

– আপনাদের মধ্যেই কি কারও গহনা চুরি হয়েছে?

পুচকুর মা বলল, আমার।

– তবে এখানে এসে বোসো মা। গম্ভীরানন্দ পাশে বসতে ইঙ্গিত করল।

পুচকুর মা উঠে গিয়ে বসতে গম্ভীরানন্দ বলল, মা, তুমি মহামায়ার দিকে মুখ করে তোমার মনের সব কথা খুলে বলো। মহামায়া নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবেন।

পুচকুর মা কার্পেটের উপর বসে জোড়হাত করে চোখ বুজে মনের কথা বলতে লাগল।

গম্ভীরানন্দ ছোটোদিদাকে জিজ্ঞাসা করল, দ্বাদশ বর্ষের কমবয়সী কে এসেছে তোমাদের সাথে?

ছোটোদিদা মিনিকে দেখিয়ে বলল, এই যে।

গম্ভীরানন্দ মিনিকে বলল, এখানে উঠে এসো মা।

ইতোমধ্যে পুচকুর মায়ের প্রার্থনা শেষ হয়েছে। গম্ভীরানন্দ পুচকুর মা ও মিনির কপালে সিঁদুরের তিলক এঁকে দিল। তারপর পুচকুর মাকে জিজ্ঞাসা করল, এই মেয়েটি কে হয় তোমার?

– আমার দেওরের মেয়ে।

– কী নাম তোমার?

– মিনি।

– কোন ক্লাসে পড়ো?

– ফাইভ।

– তোমার জ্যাঠাইমার চুড়ি চুরি হয়েছে জানো?

– হ্যাঁ। মিনি বেশ সাবলীলভাবে উত্তর দিল। ভয়ডর ওর বরাবরই কম।

গম্ভীরানন্দ সাজি থেকে কয়েকটা দূর্বা ঘাস আর কয়েকটা ফুল নিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করল। তারপর সেই ফুল ও দূর্বা রাখল মিনির মাথায়।

– তুমি এই আয়নার দিকে ভালো করে দেখো তো, কাকে দেখতে পাচ্ছো। ভালো করে দেখে বলবে। গম্ভীরানন্দ আয়নাটাকে মিনির সামনে এনে রাখল।

মিনি ঝুঁকে পড়ল আয়নার দিকে। সবার চোখ তখন মিনির দিকে। ঘরের মধ্যে পিন পড়ার নিস্তব্ধতা।

– কিছু দেখা যাচ্ছে?

মিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না।

– ভালো করে দেখো। কাউকে না কাউকে দেখতে পাবেই।

মিনি আরও গভীরভাবে আয়নাটা দেখতে লাগল।

– কাকে যেন আবছা আবছা দেখছি।

মিনির কথায় সবাই নড়েচড়ে বসল। পুচকুর মা কিছু বলতে যাচ্ছিল। গম্ভীরানন্দ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে বলল।

– ভালো করে দেখো। কাকে দেখা যাচ্ছে? তোমার চেনা?

– মনে হচ্ছে ঠাকুমা!

মিনির এই কথায় সবাই চমকে উঠল।

– কী উল্টোপাল্টা বলছিস? পুচকুর মা আর কথা চেপে রাখতে পারল না।

গম্ভীরানন্দ বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, আবার তুমি কথা বলছো? এভাবে কথা বললে কিন্তু আয়না-চালান সফল হবে না। ওকে ভালো করে দেখতে দাও।

গম্ভীরানন্দ মিনির উদ্দেশ্যে আবার বলল, ভালো করে দেখো তো মা, কাকে দেখছো?

এবার মিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলল, ঠাকুমা।

গম্ভীরানন্দ আয়নাটা মিনির সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমরা উত্তর পেয়ে গেছো। আমার কাজ শেষ।

– কিন্তু এ কী করে সম্ভব বাবা? আমার শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। তিনি আমাদের সংসারে থাকেন। তাঁর বয়সও অনেক। দু’চোখে ছানি হয়েছিল। ভালো করে দেখতে পান না। তিনি কেন আমার চুড়ি নেবেন? নিয়েই বা কী করবেন? পুচকুর মা একটানা বলে গেল।

গম্ভীরানন্দ উঠে দাঁড়াল। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে বলল, কে যে কখন কী উদ্দেশ্যে চুরি করে কে বলতে পারে? বয়সকালে মতিভ্রমও তো হয়!

কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ছোকরাটির হাতে দিয়ে সবাই বেরিয়ে এল গম্ভীরানন্দের আস্তানা থেকে।

(তিন)

গম্ভীরানন্দের ড্রয়িংরুমে সেদিন হাজির হয়েছে দুই যুবক আর একটা বাচ্চা ছেলে। আয়না-চালানের আয়োজন সম্পূর্ণ। গম্ভীরানন্দ ঘরে ঢুকে ঘাড় ঘুরিয়ে উপস্থিত সকলকে একবার দেখে নিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। তারপর যথারীতি আয়নায় সিঁদুর মাখিয়ে ও ধূপ জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে গম্ভীর স্বরে বলল, “কার কী সমস্যা হয়েছে?”

ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও চোখে গগলস পরা যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার বাইকটা চুরি হয়ে গেছে বাবা!”

– তাই নাকি? কবে?

– তিন দিন আগে।

– কোথা থেকে?

– এই শিরাকোল থেকে। আমার বাড়ি পাশের গ্রাম, বাগাড়িয়াতে। আমি ব্যবসা করি। মহাজনকে পেমেন্ট দেবো বলে শিরাকোলের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গিয়েছিলাম। মিনিট কুড়ি লেগেছিল। বেরিয়ে দেখি নেই! ভ্যানিশ! খুব বিপদে পড়েছি বাবা! ব্যবসার খাতিরে প্রচুর ছোটাছুটি করতে হয়। বাইক না থাকলে কী করে ব্যাবসা চালাব? যুবকটির গলা ধরে এলো।

– হুম। কিন্তু পুলিশে না গিয়ে আমার কাছে কেন এলে?

– গিয়েছি তো! কিন্তু পুলিশের উপর আমার ভরসা নেই বাবা!

– হুম। তা বুঝলাম। কিন্তু ওই বালকটি বাইক চোরকে চিনবে কী করে? বাইক চোর ওই বালকের অচেনা ব্যক্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 

– তা ঠিক। তবে আমরা তো লোকাল লোক। তাই চেনা চোর হতেও পারে। আর যদি চেনা নাও হয় তাতেও একটা সুবিধা হবে। যদি চোরের মুখ দেখতে পায় তবে তার বর্ণনা আমরা পুলিশকে দিতে পারব।

– হুম। বালকটি কে হয়?

– আমার ভাইপো, জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে।

গম্ভীরানন্দ আড়চোখে অপর যুবকটির দিকে তাকাতেই গগলস পরা যুবকটি বলে উঠল, “ও আমার বন্ধু, ব্যাবসার পার্টনার।”

– দেবী মহামায়ার কাছে এসে তোমার মনের সব কথা তুমি খুলে বলো। মা মহামায়া তোমাকে পথ দেখাবেন।

যুবকটি কালীর ফটোর সামনে এসে বসে হাত জড়ো করে বিড়বিড় করতে লাগল। তারপর সাজি থেকে একটা জবাফুল নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে ফটোর সামনে রেখে উঠে দাঁড়াল।

গম্ভীরানন্দ বাচ্চা ছেলেটির দিকে ঘুরে বলে উঠল, “এসো খোকা। আমার কাছে এসো।”

যুবকটি বলে উঠল, “যা না বিট্টু, কোনও ভয় নেই। তান্ত্রিকবাবা যা যা বলবেন, তুই তাই তাই করবি।”

বিট্টু উঠে গিয়ে বসল তান্ত্রিকের পাশে। গম্ভীরানন্দ কিছুক্ষণ মন্ত্রোচ্চারণ করার পর কয়েকটা দূর্বা ঘাস ও একটা জবাফুল বিট্টুর মাথার উপরে রাখল। কপালে এঁকে দিল সিঁদুরের তিলক। তারপর আয়নাটা নিয়ে ধরল বিট্টুর সামনে।

– কিছু দেখতে পাচ্ছো খোকা?

বিট্টু খুবই স্মার্ট ছেলে। ঝটিতি উত্তর দিল, “সিঁদুর।”

দুই যুবক, এমনকি গম্ভীরানন্দের সহকারীও নিঃশব্দে হেসে উঠল। তবে গম্ভীরানন্দ গম্ভীর। বলল, “সিঁদুরের ভেতর দিয়ে কী দেখতে পাচ্ছো? ভালো করে দেখো।”

বিট্টু আয়নাটার সবদিকে চোখ চালাতে লাগল। তারপর বলে উঠল, “কিছুই তো দেখছি না।”

– আরও ভালো করে দেখো খোকা। খুব মন দিয়ে। কারও মুখ। 

বিট্টু আরও কয়েক সেকেন্ড গভীর মনোযোগ দিয়ে আয়নাটা দেখল। তারপর মুখ তুলে কয়েক সেকেন্ড গম্ভীরানন্দের দিকে তাকাল।

– কাউকে দেখতে পেলে খোকা?

– হুম। তোমার মতো দেখতে।

চমকে উঠল গম্ভীরানন্দ, “কী বলছিস খোকা? ভাল করে দেখে বল।” গম্ভীরানন্দের চোখে বিস্ময়।

বিট্টু আবার আয়নাটা দেখে বলে উঠল, “বলছি তো আয়নায় তোমার ছবি দেখা যাচ্ছে।”

গম্ভীরানন্দকে স্পষ্টতই বিব্রত দেখাচ্ছে। 

– খোকা, আমার মতো চুল-দাড়ি হয়তো আছে, কিন্তু আমি নিশ্চয়ই নয়। পার্থক্য থাকবেই। ভালো করে দেখো।

বিট্টু আবারও জোর দিয়ে বলে উঠল, “না না, একদম তুমি। কপালে সিঁদুরের তিলক আছে। তোমার নাকের ওই কালো জিনিসটাও দেখা যাচ্ছে।”

গম্ভীরানন্দ এমন বিপদে মনে হয় কখনও পড়েনি। তার নাকে যে আঁচিলটা আছে তাও ছেলেটা বলছে কী করে? বানিয়ে বানিয়ে বলছে না তো? প্রায় বিশ বছর ধরে সে আয়না-চালান করছে, কোনওদিন এমন বিব্রত হয়নি।

– ভাই, আমার মনে হয়, তোমার ভাইপো কিছু গোলমাল করছে। তুমি অন্য কোনও বাচ্চাকে নিয়ে আর একদিন এসো।

এতক্ষণ চুপচাপ বসে কান্ডকারখানা দেখছিল দ্বিতীয় যুবক। সে বলে উঠল, “গম্ভীরানন্দবাবু, দেশের নেতা মন্ত্রীরা যদি চোর হতে পারে তাহলে তান্ত্রিক বাইক-চোর হতে পারে না? ”

ক্ষেপে উঠল গম্ভীরানন্দ। উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “কী বলতে চাইছ তুমি? তোমাদের বাইক আমি চুরি করেছি?”

– হতে পারে না? বাচ্চারা তো মিথ্যে বলে না, তাই না? আর তাছাড়া আপনার সাথে তো আমাদের কোনও শত্রুতাও নেই। শান্ত গলায় বলে উঠল যুবকটি।

গগলস পরা যুবকটিও বলে উঠল, “যাক, পুলিশের কাছে আমাদের বিষয়টা বলতে অনেক সুবিধাই হবে।”

গম্ভীরানন্দ এবার দু’হাত জড়ো করে গলার স্বর একেবারে নীচে নামিয়ে এনে বলল, “ভাই, সত্যি বলছি আমি বাইক চোর নই। জীবনে কোনওদিন চুরি করিনি।”

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গগলস পরা যুবকটি ঝাঁজিয়ে উঠল, “কিন্তু মানুষকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে সম্পত্তি আর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়িয়ে চলেছেন, তাই তো? ”

গম্ভীরানন্দের মাথা তখন ঝুঁকে পড়েছে মেঝের দিকে।

“আজকে আপনার এই লোকঠকানো আয়না-চালানের পুরো এপিসোড গোপন ক্যামেরায় রেকর্ডিং করে নিয়েছে আমার বন্ধু। আর এ হল একটি নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক। পুরো ঘটনা পুলিশকে তো জানাবোই, আগামীকাল টিভিতে দেখেও নিতে পারবেন। অবশ্য শ্রীঘরে থাকলে দেখতে পাবেন না!” ব্যঙ্গ করে বলে উঠল গগলস পরা যুবকটি।”এবার স্পষ্টতই ভেঙে পড়ল গম্ভীরানন্দ। জড়িয়ে ধরল যুবকটির পা। আমি চুরি করিনি ভাই, “বিশ্বাস করো। পুলিশের কাছে এসব বোলো না ভাই।”

“তা কী করে হয়? আপনি গ্যারান্টি সহকারে সমস্যার সমাধান করেন। চোর-ডাকাত ধরে দেন। আর এখন এসব বললে হবে?” সাংবাদিক যুবকটি টিপ্পনি কাটল।

“ভাই যত টাকা চাও আমি তোমাদের দেব। শুধু রেকর্ডিংটা পুলিশকে আর নিউজ চ্যানেলে দিও না। আমাকে বাঁচাও ভাই।” গম্ভীরানন্দের চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।

গগলস পরা যুবকটি বলে উঠল, “বাঁচাতে পারি একটা শর্তে।”

“কী শর্ত? আমি যে কোনও শর্তে রাজি।” আকুল হয়ে উঠল গম্ভীরানন্দ।

“লিখিতভাবে জানাতে হবে যে আপনি এতদিন আয়না-চালানের মতো বুজরুকি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে ঠকিয়েছেন, আর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে জীবনে আর কোনওদিন এই বুজরুকি করবেন না।”

কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে গম্ভীরানন্দ মাথা নিচু করে বলল, “আমি রাজি।”

(চার)

শিরাকোল বাসস্ট্যান্ডে লেট্টুদের দেখেই পুচকু চেঁচিয়ে উঠল, “লেট্টুদা, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা কোমর ধরে গেল! কী খবর?”

“দাঁড়া, একটু চা খেতে খেতে সব বলবো। সুমনের মনে হয় খুব খিদেও পেয়েছে।” গগলসটা মুছতে মুছতে লেট্টু উত্তর দিল।

“না রে ভাই, খিদে তেমন পায়নি। নাটকটা দেখে পেট ভরে গেছে। অভিনয়টা বেড়ে করেছিস তুই।” গালভরা হাসি সুমনের।

সুমন হল লেট্টুর কলেজের বন্ধু। সাংবাদিক সাজিয়ে সুমনকে নিয়ে আসার প্ল্যানটা লেট্টুরই। আর বিট্টু হল সুমনের কাকার ছেলে। যেমন বুদ্ধিমান, তেমন বিচ্ছু। সব শিখিয়ে পড়িয়ে আনলেও সন্দেহ ছিল, আসল সময়ে বিট্টু অভিনয়টা ঠিকঠাক করতে পারবে কিনা। কিন্তু অভিনয়ে সেও যে লেট্টুর থেকে কোনও অংশে কম নয় দেখিয়ে দিয়েছে।

“আজকের হিরো বিট্টু।” বিট্টুর পিঠ চাপড়ে দেয় লেট্টু।

চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে পুচকু বলল, “তোমার লুকটাও পুরো অন্যরকম ছিল লেট্টুদা। চেনা দায়।”

– সে কি এমনি এমনি? দু’সপ্তাহ ধরে দাড়ির পেছনে সময় দিতে হয়েছে।

– আচ্ছা লেট্টুদা, গম্ভীরানন্দ যে ভন্ড তা তো বুঝলাম, কিন্তু বাচ্চা ছেলে মেয়েরা কী করে সিঁদুর মাখানো আয়নায় কারও মুখের ছবি দেখতে পেত? কী এর ব্যাখ্যা?

– শোন, ছোটো ছেলেমেয়েরা সাধারণত মানসিকভাবে দুর্বল হয়। আয়নায় সব জায়গায় সমানভাবে সিঁদুর লাগে না। ফলে সিঁদুর না-লাগা অংশে নিজের বিচ্ছিন্ন প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। আর তাকে যখন মানসিকভাবে চাপ দিয়ে কাকে দেখতে পাচ্ছ বলা হয় তখন সে অবচেতন মনে যেকোনও একজনকে ভেবে নেয়, আর তার নাম বলে। দেখা গেছে, চুরির ক্ষেত্রে বাড়িতে যাকে নিয়ে বেশি চর্চা করা হয় তার নামই বাচ্চাটি বলে, কারণ অবচেতন মনে তার নামটাই আসে প্রথমে। আর আয়নাতে বিচ্ছিন্ন প্রতিবিম্বটা সেই ব্যক্তির বলেই ভেবে নেয়। যে কোনও দুর্বল মনের মানুষ নিয়ে এই আয়না-চালান বুজরুকি চালানো সম্ভব।

সুমন বলল, তার মানে অবচেতন মনের আয়নায় দেখা মানুষটিই পায় অপরাধীর তকমা।

– ঠিক তাই। আগের দিন মিনি আয়নায় ঠাকুমাকে দেখেছিল কারণ, ওর অবচেতন মনে ঠাকুমার ছবি বেশি আসে। কিন্তু ঠাকুমা চুড়ি চুরি করতেই পারে না তা তো প্রমাণিত।

পুচকু বলল, “হ্যাঁ সুমনদা, মা’র খেয়াল ছিল না যে চুড়িগুলো সাবানের কৌটোর মধ্যে রেখেছে। আর ঘাটে দেখতে না পেয়ে চুরি হয়েছে বলে কত কান্ডই না করল।”

লেট্টু দুলে উঠল, “এত কান্ড হয়েছিল বলেই না গম্ভীরানন্দের বুজরুকি বন্ধ করতে পারলাম! ”

এতক্ষণ চুপ করে থাকা বিট্টু বিজ্ঞের মতো ফুট কাটল, “ভগবান যখন যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন! ”  

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s