বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-নিলামের গল্প(পর্ব৩)-স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায়-শরৎ২০২১

নিলামের গল্প (পর্ব ১), পর্ব ২

নিলামের তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা আজকে নতুন নয়, বহুবছর আগে থেকেই তাত্ত্বিকরা এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন।

আসলে জিনিসপত্রের দাম ঠিক করার ব্যাপারে নিলাম বেশ কাজের জিনিস । দাম তো অনেকভাবেই ঠিক করা যায় – যেমন আমরা দেখেছিলাম সুজাতা কাকিমা আর পাপু সবজিওয়ালা নিজেদের মধ্যে দরাদরি করে শশার দাম ঠিক করছে – সে তো করতেই পারে, ছোট ছোট কেনাবেচায় এতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। সত্যি বলতে কি আরও অনেক কেনাবেচা আছে যেখানে এইভাবে দরাদরি করে দাম ঠিক করাটাই দস্তুর। মনে করো তোমাদের একটা নতুন বাড়ি বানাবার পরিকল্পনা চলছে। তোমার মা-বাবা অনেকের কাছে খোঁজখবর নিয়ে পাশের পাড়ার রাজাবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। রাজাবাবু একজন কন্ট্র্যাক্টর, তিনি টাকার বিনিময়ে কাজের কন্ট্র্যাক্ট বা চুক্তি করে থাকেন, কোন কাজ কীভাবে হচ্ছে সেই সবের ওপর নির্ভর করে তিনি একটা দর বলে থাকেন, সেই দর যদি যাঁদের বাড়ি হবে তাঁদের পছন্দ হয় তাহলে সেই দামেই কাজ হয়; আর তা না হলে তাঁরা অন্য কোনও দর বলেন (যা রাজাবাবুর দেওয়া দরের চাইতে কম), সেই দর রাজাবাবুর গ্রহণযোগ্য মনে হলে তিনি তাতে রাজি হন এবং সেই দামেই তখন কাজ হয়। কিন্তু যতক্ষণ দু’পক্ষের মধ্যে দাম নিয়ে মতের মিল না হচ্ছে ততক্ষণ দরাদরি চলতেই থাকে। মতের মিল একান্তই হওয়া সম্ভব নয় বুঝলে দু’পক্ষই সে ব্যাপারে আর এগোন না, ব্যাপারটার ওখানেই ইতি টানেন।

তো এখন তোমাদের বাড়ির ক্ষেত্রে মনে কর রাজাবাবু বাড়ি বানাবার সমস্ত মালমশলা আর মিস্ত্রী – এই সব কিছু মিলিয়ে দর দিলেন চল্লিশ লাখ টাকা। তোমার মা বাবা হিসেব চাইলেন, কীসের ভিত্তিতে দর এমন হল – মানে ইট বাবদ রাজাবাবু কত দাম ধরছেন, বালি, সুরকি, চুন ইত্যাদি আরও যেসব মালমশলা লাগে সেই বাবদই বা কত ধরছেন – এই সব আরকি। রাজাবাবু যদি বলেন তিনি ইট প্রতি দশ টাকা দাম ধরছেন, তখন তোমার মা বা বাবা বলতেই পারেন যে ইঁটের দাম ন’টাকা ধরা হোক। একই ভাবে অন্যান্য মালমশলার ক্ষেত্রেও দাম নিয়ে দরাদরি চলতে পারে। দরাদরি চলতে পারে মিস্ত্রীর রোজকার মজুরি কত ধরা হচ্ছে তাই নিয়েও। এই সমস্ত দরাদরি করে অবশেষে একটা সমঝোতায় আসা যায়।

এইভাবে হয়তো চল্লিশ লাখের হিসেবটা কমিয়ে উনচল্লিশ লাখ পঞ্চাশ হাজারে আনা সম্ভব হল। কিন্তু এক্ষেত্রে একজন ক্রেতা এবং একজন বিক্রেতার মধ্যে রফা হচ্ছে, তাই এইভাবে দরাদরি করে দামটা সহজে মোটামুটি তাড়াতাড়ির মধ্যেই এক জায়গায় স্থির করা গেল।

কিন্তু যেখানে ক্রেতা বা বিক্রেতা বা দুজনের সংখ্যাই  অনেক বেশি? কিংবা যেখানে আরও বেশি পরিমাণের জিনিসপত্র নিয়ে কাজ কারবার? সেইসব ক্ষেত্রে কিন্তু এইভাবে দরাদরি করে দাম ঠিক করতে বিশেষ সুবিধে হয় না। কে কার সঙ্গে কতটা দর করবে, কতক্ষণ ধরেই বা সে দরাদরি চলবে, এমনকি কতবার কারো সঙ্গে দর করা হবে এই পুরো ব্যাপারগুলোই তখন ভয়ানক ঘেঁটে যায়। শুধু তাই নয়, এতজন মিলে এতরকম দরাদরি করলে সর্বসম্মতিক্রমে একটা দাম ঠিক করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তার ওপর এতজন মিলে এত দরাদরি চলতে থাকলে দাম ঠিক হওয়ার সময়টাও অনেক বেশি লেগে যায়। দাম ঠিক হতে সময় যত বেশি লাগে জিনিসপত্র কেনাবেচার ব্যাপারটা ততটাই ধীরে হয়ে পড়ে আর তার জন্য কেনাবেচার পুরো পদ্ধতিটাই কেমন যেন ঘেঁটে যায়।

অথচ দাম ঠিক না হলে কেনাবেচা হবে কেমন করে? আর দামটা ঠিক করবেই বা কে? এই সমস্যার খুব সহজ সমাধান দেয় নিলাম। তবেই না সেই ব্যাবিলনের যুগ থেকে, হয়তো বা তার আগে থেকেও, যত্র তত্র নিলামের এত ব্যবহার! ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতকে ব্যাবিলন সাম্রাজ্যে (যেটা এখনকার ইরান দেশের অংশ) নিলাম বেশ চালু ব্যবস্থা ছিল। নিলাম এমন একটা পদ্ধতি যাতে দাম ঠিক করলে সেই দাম নিয়ে কেউ সাধারণত কোনও আপত্তি জানায় না।

পুরনো জিনিসপত্র যেমন ছবি, আসবাব, বিখ্যাত লোকেদের ব্যবহার করা হরেক রকম জিনিস – সাধারণ কাপ, ডিশ, জামাকাপড়, গয়নাগাঁটি থেকে শুরু করে যুদ্ধে ব্যবহার করা ঢাল তলোয়ার, বর্শা, বল্লম, তীরধনুক, বন্দুক এসবের যে নিলাম হয় তা তো আমরা অনেকই জানি। কিন্তু খুব সাধারণ কিছু কিছু, যেমন ফল, সবজি, মাছ এসবেরও যে নিলাম হয় তা জানো কি?

শোনো তবে, দিল্লীর আজাদপুরে আছে এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো ফল আর সবজির পাইকারি বাজার বা মাণ্ডি। এখানে নিলাম করে পরবর্তী অন্যান্য বাজারের, মানে আমাদের পাড়ার বাজারের মত বাজারগুলোর বিক্রেতাদের কাছে সবজি বিক্রি করা তো ভীষণই চালু ব্যাপার।

সবজি চাষীরা তাদের ফলন নিয়ে এই মাণ্ডিতে আসে, এসে তারা কমিশন এজেন্টদের হাতে নিজেদের জিনিসপত্র তুলে দেয়। এই কমিশন এজেন্টরা আসলে মধ্যস্থতাকারী। বিক্রি করবে চাষী, আর কিনবে নানান বাজারের সবজিওয়ালা। এদের মধ্যে একটা যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করে এই কমিশ এজেন্টরা। এরা বিভিন্ন ক্রেতাদের বলা দাম জানায় আর জানতে চায় সেই দামে আর কারা কারা কিনতে ইচ্ছুক।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যদিও নিলামটা একটা খোলা বাজারে হচ্ছে, এই কমিশন এজেন্টরা কখনও খোলাখুলি দাম হাঁকে না বা দর করে না, বরং ক্রেতাদের সঙ্গে ইশারা ইঙ্গিত করে কিছু সংকেতের মাধ্যমে কাজ সারে। একটা অত্যন্ত চালু সংকেত দেওয়ার পদ্ধতি হল রুমালের নীচে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংখ্যায় এবং বিভিন্নভাবে হাতের আঙুল দেখানো। এইভাবে ক্রেতা অনুযায়ী তারা দাম বাড়াতেও পারে এবং সেই জন্য এভাবেই নাকি তারা সবচেয়ে ভালো দামে সবজিগুলো বিক্রিও করতে পারে।

এই অদ্ভুত ধরণের পদ্ধতিটা নাকি সঠিক দাম পাবার একটা খুব ভালো উপায়। কমিশন এজেন্টদের মতে এমন অনেকেই থাকে যারা দর বেশিই হাঁকে কিন্তু পুরো দাম সময়মত দেয় না। এরকম সাংকেতিক দর ব্যবস্থা নাকি সেই সব ক্রেতাদের দূরে রাখতে খুব কাজে আসে।

বিক্রিবাটা ঠিকঠাক হলে কমিশন এজেন্টকে মোট পাওয়া দামের ৬ শতাংশ দিয়ে বাকিটা চাষী পায়, তবে চাষীকে এই সবজি কেনাবেচার জন্য পরিবহন, মজুর এইসব খরচটাও বইতে হয়।(১) আজাদপুরের মত এরকম স্থানীয় মাণ্ডি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আছে, এবং সেইসব জায়গায় নানারকম ভাবে নিলাম করে সবজি বিক্রি বেশ চালু একটা ব্যাপার।

জানো কি পাড়ার বাজারে যে মাছ বিক্রি হয় সেগুলোও কোনও একবার নিলামের মধ্যে দিয়ে হাত বদল করেছে? মাছের নিলাম পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই হয়। ভারতে মাছের নিলাম বেশি হয় সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে। কেরালা, তামিলনাড়ু এবং এরকম আরও কিছু রাজ্যে সমুদ্র থেকে ধরে আনা মাছ বাজারের বিক্রেতাদের কাছে নিলাম করা হয়। সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি কোথাও ধরে আনা সামুদ্রিক মাছ জমা করার কেন্দ্র থাকে, মৎস্যজীবীরা মাছ ধরে সেইসব জায়গায় নিয়ে যায়, সেখানেই থাকে নিলাম করার লোক, তারা ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে মাছের নিলাম করে দেয়। মিষ্টি জলের মাছ সংগ্রহ করার জন্য নিলামকারীরা কমিশন এজেন্টদের দ্বারস্থ হয়, তাদের দিয়েই বিভিন্ন নদীর ধার বা পুকুর থেকে মাছ কেনায়। এই কমিশন এজেন্টরা মাছ কিনে নিলামকারীদের কাছে পাঠিয়ে দেয় আর জেলেদের কাছ থেকে বিক্রি করে পাওয়া মোট দামের ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেয়। পাইকারি মাছ বিক্রেতারা এই নিলামকারীদের কাছ থেকে মাছ কিনে বিক্রি করে পাড়ার বাজারগুলোর ছোট মাছওয়ালাদের, যাদের কাছ আমরা সবাই মাছ কিনে থাকি। পশ্চিমবঙ্গের ফ্রেজারগঞ্জে একটা মৎস্য বন্দর আছে, সেখানেও সামুদ্রিক মাছের নিলাম হয়। এরকম নিলাম হয় দীঘা মোহনাতেও।

biggannilaam

মজার ব্যাপার হল, কেবল মৎস্যজীবীরাই নয়, অন্য আরও কেউ মাছের নিলাম করেছে এমন ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে – এই পশ্চিমবঙ্গেরই নদীয়া জেলার মোহনপুরে Indian Institute of Science and Educational Research (IISER) Kolkata-র মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তাদের চারটে পুকুরের মাছের নিলাম করার জন্য দরপত্র চেয়েছিল।(২) তাহলেই দেখ, প্রতিদিন যা যা ব্যবহার কর সেগুলোর সঙ্গেও কিন্তু নিলামের বেশ ভালোরকম সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং নিলাম তত্ত্ব জান অথবা না জান নিলাম ঠিক তোমার জীবনে কোথাও না কোথাও জুড়ে গেছে ।

শুধু মাছ বা ফল, সবজিই নয়, নিলাম হয় পশুরও। আমেরিকার বেশ কিছু প্রদেশে গবাদি পশুর নিলাম খুবই জনপ্রিয়। ভারতবর্ষেও বিভিন্ন মন্দিরে গোরুর নিলাম হয়ে থাকে। এমনকি  ভারত সরকারের পশুপালন ও ডেয়ারি বিভাগও গবাদিপশুর নিলাম করে থাকে। পাখির নিলামও কোনও বিরল ঘটনা নয়। ইংল্যাণ্ডে মুরগি জাতীয় এবং অন্যান্য দামি পাখির নিলাম হয় বিভিন্ন জায়গায়।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক কালে অনলাইনেও পাখির নিলাম বেশ পরিচিতি পেয়েছে।  এই পশুপাখির নিলামের সূত্রে একটা মজার গল্প বলি। “The Time Machine” খ্যাত ব্রিটিশ লেখক H. G. Wells-এর  লেখা “A Deal in Ostriches” একটা বেশ মজাদার  ছোটপল্প।

biggannilaam02

গল্পটার কথক একজন ট্যাক্সিডার্মিস্ট, অর্থাৎ যারা মৃত পশুপাখির দেহ সংরক্ষণ করে। মিউজিয়াম বা পুরনো জমিদার বাড়ি-টাড়িতে যে স্টাফ করা হরিণ বা বাঘের মাথা কিংবা কোনও পাখি দেখেছ, সেগুলো এই ট্যাক্সিডার্মি বিদ্যার প্রয়োগেই করা হয়েছে। তো এই গল্পটাতে একজন ট্যক্সিডার্মিস্ট স্মৃতিচারণ করছেন, তিনি অল্প বয়সে একবার সমুদ্রপথে করে ভারত থেকে ইংল্যাণ্ড যাবার সময় জাহাজে উটপাখির নিলাম দেখেছিলেন যাতে একটা উটপাখি তিনশ পাউণ্ডে বিক্রি হয়েছিল, এবং আরেকটাকে চারশ পাউণ্ডেও বিক্রি করতে অস্বীকার করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, উটপাখিগুলোর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল না যে তাদের দাম অত হবে। গল্পটা আসলে অন্য জায়গায়। জাহাজে পাঁচটা উটপাখি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এক কেয়ারটেকার ধরণের লোকের তত্ত্বাবধানে। এক ভারতীয় যাত্রী অভিযোগ করেছিল যে তার অন্যমনস্কতার সুযোগে এই পাঁচটার মধ্যে থেকে কোনও একটা উটপাখি তাঁর পাগড়িতে ঠোক্কর মারতে গিয়ে তার পাগড়িতে রাখা একটা হিরে গিলে ফেলেছে। লোকটা ঠোক্কর খেয়ে উটপাখিটাকে তাড়া দিতেই সে দৌড়ে গিয়ে বাকি উটপখিগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে আলাদা করে চেনার কোন উপায় নেই। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে খুব অল্পও সময়ের মধ্যে, তাই যতক্ষণে সে আবিষ্কার করেছে যে তাঁর পাগড়িতে রাখা হিরেটা নেই, যদিও সেটাও খুব তাড়াতাড়ি, তবু তার মধ্যেই হিরে গেলা উটপখিটাকে আলাদা করে চেনার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে

জাহাজে অনেক হইচই হল, কারুর মতে এটা একটা দুর্ঘটনা, কিছুই করার নেই, আবার কারুর মতে হিরের মালিকের হিরে ফেরত পাবার পূর্ণ অধিকার আছে। হিরের মালিক, যার নাম মোহিনী পাদিশাহ, সে তো খুব লাফালাফি শুরু করল, সে নাকি উটপাখি না মেরেই অন্য ভাবে উটপাখির পেট থেকে হিরে বের করবে। কিন্তু তার জন্য তো উটপাখিগুলোকে কিছু ওষুধ খাওয়াতে হবে, তাতে আবার তাদের কেয়ারটেকারের আপত্তি, তার কাছে যা যা খাওয়াবার আদেশ আছে তার বাইরে সে একবিন্দু অন্য কিছু খাওয়াতে রাজি নয়! এইসব নিয়ে অনেক চাপান উতোরের পর পটার নামে এক ইংরেজ সব কটা উটপাখি কিনে নিল। যদিও এই সওদার বৈধতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিল, কিন্তু সেগুলো বেশিক্ষণ ধোপে টেঁকে নি। এবার পটার করল কি, একটা রেখে বাকি চারটে উটপাখিকে এক এক করে নিলামে তুলল। এই নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন কিছু আপত্তি জানিয়েছিলেন বটে, কারণ হারিয়ে যাওয়া হিরে ওইভাবে নিলাম করা কতটা আইনসঙ্গত তাই নিয়ে তাঁর প্রশ্ন ছিল, কিন্তু পটারের বক্তব্য পরিষ্কার, সে উটপাখির নিলাম করছে, হিরের ব্যাপারে কিছুই জানে না। পটারের কথার যুক্তি খণ্ডানো গেল না, তাই উটপাখির নিলাম শুরু হল। তবে যারা নিলামে দর হাঁকল তাদের সকলেরই মনের মধ্যে ছিল যে তার কেনা উটপাখিটার পেটে হিরেটা থাকলেও থাকতে পারে, আর তাই সাধারণ উটপাখির যা দাম হয়, তার চেয়ে বেশি দরেই তারা হাঁকতে শুরু করেছিল। প্রথমে যে উটপাখিটা নিলামে বিক্রি হল, সেটা জিতেছিল একজন ইহুদি, কিনেই সে পাখিটাকে কেটে ফেলল, কিন্তু তার পেটে হিরে পাওয়া গেল না মোটেই। সুতরাং বাকি চারটে উটপাখিকে নিয়ে লোকজনের উৎসাহ বলাই বাহুল্য আরও বেড়ে গেল। পাদিশাহও এই নিলামে অংশ নিয়েছিল, সে অনেক দূর অবধি দরও হেঁকেছিল, কিন্তু জিততে পারে নি একটাতেও। যাই হোক, সে সব বিজয়ী ক্রেতাদের কাছে গিয়ে নিজের ঠিকানা দিয়ে বলার অনেক চেষ্টা করেছিল যে হিরেটা পেলে তাকে পাঠিয়ে দিতে, কিন্তু তাকে কেউ পাত্তা দেয় নি। জাহাজ থেকে নেমে তো যে যার পথ ধরল। এর কিছুকাল পরে এই ট্যাক্সিডার্মিস্ট যখন একদিন কেনাকাটি করতে রিজেন্ট স্ট্রীট বলে একটা জায়গায় গেছেন, হঠাৎ দেখলেন পাদিশাহ আর পটার একসঙ্গে একদম গলাগলি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আনন্দ করছে। তখন তিনি বুঝেছিলেন, হিরেটা হয়তো সত্যিই ছিল, কিন্তু কোনও উটপাখি সেটা আদৌ খেয়েছিল কি না সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

এই গল্পটা থেকে যে মজার জিনিসটা বেরিয়ে আসছে তা হল নিলামে দাম কেমন উঠবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে নিলামে তোলা বস্তুটার সম্পর্কে যারা দর করবে তারা কী ভাবছে তার ওপর। সকলেই জানে যে উটপাখির দাম কখনও অত বেশি হয় না, কিন্তু একটা সাধারণ উটপাখি যার পেটের মধ্যে কিনা হিরে থাকলেও থাকতে পারে, কেবলমাত্র এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই কত লোকে বেশি বেশি দর হেঁকে ফেলল! এটা অনেকটা জুয়া খেলার মত, হিরে পাবেই, এ নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু পেলে বরাত খুলে যাবে এই আশায় সাধারণ উটপাখিগুলো এমন অসাধারণ ভাবে তাদের কাছে রাতারাতি দামি হয়ে উঠল!

আবার ফিরে আসি নিলাম আর জিনিসপত্রের দামের সম্পর্কের কথায়। প্রতি নিলামের ক্ষেত্রেই সবাই, মানে যারা ঐ নিলামে অংশ নিচ্ছে তারা প্রত্যেকেই পরিষ্কার জানে কি ভাবে চূড়ান্ত দাম, অর্থাৎ যে দামে নিলামের সামগ্রী হাতবদল করবে সেটা ঠিক হল।  কিন্তু মজার ব্যাপার হল এক এক নিলামে দাম এক এক রকম ভাবে ঠিক হয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কথাটা সত্যি। আগেই বলেছি যে নিলাম আরোহী (ascending) বা অবরোহী (descending) হতে পারে। আমাদের অতি পরিচিত ইংরেজি নিলাম যেখানে অনেক ক্রেতা আর একজন বা একাধিক বিক্রেতা এক জায়গায় জমায়েত করে আর ক্রেতারা সবাই কে কত দামে কিনতে চায় সেটা হেঁকে বলে, সেই দাম ক্রমশ চড়তে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না যে দামে পৌঁছেছে তাতে ইচ্ছুক ক্রেতার সংখ্যা আর নিলামে তোলা জিনিসের সংখ্যা একই হচ্ছে। তারপর যখন যে কটা জিনিস আছে ঠিক তত জন ক্রেতা ঐ দামে কিনতে উৎসাহী হন তখন সেই দামই চূড়ান্ত বলে সকলে মেনে নেয়।

মনে করো পাড়ার পুরনো জমিদার বাড়ির উত্তরাধিকারীরা সবাই বিদেশে থিতু, ক্বচিৎ কদাচিৎ দেশে আসে, এত বড় বাড়ি তাদের পক্ষে ঠিক করে রাখা বড়ই মুশকিল হচ্ছে, তাই বাড়িটা তারা বেচে দেবে ঠিক করল। প্রোমোটারের সঙ্গে কথাবার্তাও ঠিকঠাক হয়ে গেছে, কিন্তু গোল বেধেছে বাড়ির পুরনো আসবাবগুলোকে নিয়ে। প্রোমোটার সেসব কিনতে নারাজ, অথচ এত ভালো সব আসবাব নষ্ট করে ফেলাও যাচ্ছে না! কী করা যায়? সহজ উপায়, পার্ক স্ট্রিটের নিলামঘরে যোগাযোগ করা। তারাও তাই করল।(সঙ্গে রইল কলকাতার প্রাচীনতম নিলামঘরের ছবি)

biggannilaam03

নিলামঘরে একটা একটা করে জিনিস নিলামে তোলা হচ্ছে, এক এক করে সব পালঙ্ক, আলমারি, বেলজিয়ান কাচের ড্রেসিং টেবিল, পাথরের মাথাওয়ালা বড় টেবিল এরকম আরও কত কি! সব কটাকেই দেখিয়ে এবং তাদের বিশদ বিবরণ দিয়ে ক্রেতাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তারা কে কত দাম দিতে ইচ্ছুক। কম দাম থেকে শুরু করে দাম উত্তরোত্তর চড়তে থাকছে – এই ভাবে চলতে চলতে গিরীশ পার্কের অসমঞ্জবাবু তাঁর আদরের ব্রাউনি কুকুরটার জন্য একটা চমৎকার গদি আঁটা চেয়ার কিনে ফেললেন, সবাই পালঙ্ক, আলমারি এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল, তাই চেয়ারের দাম খুব বেশি দূর ওঠে নি, এমন কারুকার্য করা সেগুন কাঠের সাহেবি প্যাটার্নের চেয়ারটা পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার টাকায়! ভাবা যায়! শুরু হয়েছিল পাঁচশ টাকা থেকে, তারপর অনেক ঘষটে ঘষটে যখন আড়াই হাজার টাকা দর উঠেছে, অসমঞ্জবাবু এক লাফে তিন হাজার হেঁকে বসলেন। আর কেউ তার সমান বা বেশি দর হাঁকল না, সুতরাং চেয়ারটা তাঁর হস্তগত হল। অসমঞ্জবাবু তো মহা খুশি, খুশি ব্রাউনিও, চেয়ারে বসেই ফিকফিক করে হাসতে শুরু করেছে। যেহেতু এই ধরণের নিলামে দাম কমের দিকে শুরু হয়ে  ক্রমশ বেশির দিকে চড়ে, তাই এই ধরণের নিলামকে আরোহী নিলাম বলে, একথা আগেই জেনেছি।

আবার উল্টোটা ঘটে ওলন্দাজি নিলামের বেলায়, সেখানে বিক্রেতা একটা চড়া দাম হেঁকে শুরু করে আর জিজ্ঞেস করতে থাকে কে সেই দামে কিনতে ইচ্ছুক, কেউ ইচ্ছে প্রকাশ করলে জিনিসটা বা জিনিসগুলো তখনই বিক্রি হয়ে যায়, আর না করলে দাম নামানো হতে থাকে যতক্ষণ না কোনও ক্রেতা ইচ্ছুক হচ্ছেন। এইভাবে যে দামে এসে রফা হয়, সেটাই চূড়ান্ত দাম। এইভাবে দাম নীচের দিকে নামতে থাকে যে নিলামে তাকে অবরোহী নিলাম বলে, তাও আমরা আগে জেনেছি। নেদারল্যাণ্ডে ফুল আর সম্পত্তির নিলামের ক্ষেত্রে এই নিলাম পদ্ধতির বহুল ব্যবহারের জন্যই একে ওলন্দাজি নিলাম নাম দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু জানো কি যে, নেদারল্যাণ্ডে নিলাম শুরুর বহু আগেই এরকম নিলামের ব্যবহার পৃথিবীতে ছিল? গ্রিক পণ্ডিত হেরেডোটাসের লেখা থেকে জানা যায় প্রাচীন ব্যবিলনে এমন অবরোহী নিলাম পদ্ধতি ভালোই চালু ছিল। নেদারল্যাণ্ডে ফুল আর সম্পত্তির এই নিলাম পদ্ধতি তো এখনও চালু আছেই – নেদারল্যাণ্ডের আলাসমির-এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের নিলাম হয়। যে বাড়িতে এই নিলামটা হয় সেটা ১২৮ একর জমির ওপর তৈরি। সঙ্গে তার একটা ছবি দিলাম।

biggannilaam04

সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার ফুল এখানে বিক্রির জন্য আনা হয়। এর মধ্যে যেমন ইউরোপের দেশগুলো আছে, তেমনই আছে ইসরায়েল, ইথিওপিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, কেনিয়া এমন আরও কত দেশ। প্রতিদিন প্রায় দু’শ লক্ষ ফুল কেনবেচা হয় এখানকার নিলামে, আর বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে (যেমন ভ্যালেন্টাইনস ডে বা মাদার্স ডে) এই বিক্রি প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়।

এছাড়াও আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে অবরোহী নিলামের ব্যবহার ভালোমত চালু আছে।

আমাদের এখনকার কালের বড় বড় কোম্পানিরাও অবরোহী নিলাম করে থাকে তাদের নতুন শেয়ার প্রথম বার বাজারে ছাড়ার সময়। এই নতুন শেয়ার প্রথমবার বাজারে ছাড়ার পদ্ধতিটার পোশাকি নাম হল ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (Initial Public Offering) বা IPO। এই IPO-র ক্ষেত্রে অবরোহী নিলাম ব্যবহার করার মূল কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, দরদাতাদের দাম কমিয়ে রাখার প্রবণতার জন্য শেয়ারের দাম খুব পড়ে যাবার যে সম্ভাবনা থাকে সেটা এই অবরোহী নিলামের ব্যবহারে অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। ২০০৪ সালে আমাদের অতি পরিচিত কোম্পানি Google-ও তাদের IPO নিলাম করেছিল অবরোহী পদ্ধতিতে এবং এই নিলামটা বেশ সফলও হয়েছিল।

যাই হোক, আরোহী আর অবরোহী, এই দুরকম নিলামে দাম দু’ভাবে ঠিক হল, কিন্তু প্রতি নিলামের ক্ষেত্রেই দাম ঠিক হওয়াটা একদম সকলের চোখের সামনে পরিষ্কার ভাবে হল। ভালো কথা, কিন্তু এই যে দুটো নিলামের কথা বলা হল, এরা তো দুজনেই মুক্ত নিলাম (open auction)। গোপন নিলামের (sealed bid auction) ক্ষেত্রে তাহলে দামের ব্যবস্থাটা কি? সেটা তো আর এমন খোলামেলায় হয় না! তা হয় না বটে, কিন্তু দাম কিভাবে ঠিক হতে যাচ্ছে, তা কিন্তু নিলামে অংশগ্রহণকারীরা আগে থেকেই জানে। এ আবার কেমনতর কথা? গোপন নিলাম, এদিকে দাম কিভাবে ঠিক হবে, সবাই আগে থেকেই জানে? আরে রোস বাপু, গল্প আছে । ব্যাপারটা হল, দাম ঠিক কত হবে সেটা কেউ আগে থেকে জানে না, কিন্তু দাম কিভাবে ঠিক করা হবে সেটা সকলেই জানে। গোলেমেলে লাগছে ব্যাপারটা? আচ্ছা একটু বুঝিয়ে বলি তবে।

মনে কর একটা সরকারি কারখানা বেসরকারিকরণ করা হবে, মানে সরকার আর তার দায়ভার বইতে পারছেন না, তাই কোন বেসরকারি সংস্থার হাতে কারখানার সব দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু তা বিনামূল্যে নয়। যে সংস্থা এই কারখানাটা কিনতে ইচ্ছুক তাকে এর জন্য দাম দিতে হবে। কত দাম দেবে? সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নিলাম করে দাম ঠিক করা হয়। যেসব বেসরকারি সংস্থা এই কারখানা কিনতে ইচ্ছুক খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের  বলা হল একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে মুখবন্ধ খামে ভরে দরপত্র জমা দিতে। সেই নির্দিষ্ট তারিখটা পার হলে তারপর দরপত্রগুলো খোলা হবে, যে সবচেয়ে বেশি দর হেঁকেছে তাকে কারখানাটা বেচা হবে। কিন্তু এতেও বোঝা গেল না যে, যে জিতল সে কত দাম দিচ্ছে। হঠাৎ ভাবলে মনে হতে পারে যে যা দর সে জমা দিয়েছিল, সেটাই তো তার দেওয়ার কথা। ঠিকই, এটা ঘটে অনেক সময়েই, মানে যে জিতল, সে যে দর দিয়েছিল সেটাই তাকে দাম হিসেবে দিতে হল। নিলাম তত্ত্বের পরিভাষায় এর নাম হল সর্বোচ্চ মূল্য নিলাম বা ফার্স্ট প্রাইস নিলাম (first price auction)। এতে সর্বোচ্চ দর হাঁকা ক্রেতাই জেতে এবং সে তার নিজের জমা দেওয়া দরের সমান দাম দেয়। ১৯৯১ সালে ভারতবর্ষে প্রথমবার টেলিকম স্পেকট্রাম লাইসেন্সের নিলাম হয় আর সেই নিলামে এই ফার্স্ট প্রাইস নিলাম পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু এটাই একমাত্র দাম নির্ধারণ পদ্ধতি ভাবলে ভুল হবে। এমন ভাবেও নিলামটা করা যায় যে, যার জমা দেওয়া দর সবচেয়ে বেশি, সে জিতল, কিন্তু সে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরের সমান দাম দিল। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটা কিন্তু গোপন নিলামের একটা অত্যন্ত চালু পদ্ধতি, এর নাম দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্য নিলাম বা সেকেণ্ড প্রাইস নিলাম  (second price auction)। বিভিন্ন দেশে টেলিকম স্পেকট্রাম লাইসেন্সের নিলাম এই সেকেন্ড প্রাইস নিলামের মাধ্যমে করা হত। নিউজিল্যান্ডে ১৯৯০ সালে টেলিকম স্পেকট্রাম রাইটস এভাবেই নিলাম করা হয়েছিল।

এছাড়াও গোপন নিলাম আরও বহু ভাবে করা যেতে পারে। কখনও আবার মুক্ত এবং গোপন নিলাম মিলিয়ে জুলিয়ে হাইব্রিড নিলামও করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০০০ সালে ইংল্যান্ডে টেলিকম স্পেকট্রাম লাইসেন্স বিক্রিতে ব্যবহার করা অ্যাংলো-ডাচ নিলামের কথা, যার প্রথম ভাগে ইংরেজি অর্থাৎ আরোহী নিলাম করে পরে ফার্স্ট প্রাইস গোপন নিলাম করা হয়। এমনভাবে নিলাম করার ধারণাটি দিয়েছিলেন পল ক্লেম্পারার নামে একজন প্রখ্যাত ব্রিটিশ নিলাম তাত্ত্বিক (auction theorist)। এই নিলামটার শুরুতে যখন ইংরেজি নিলাম পদ্ধতি ব্যবহার করা হল, তখন কেবলমাত্র দাম উপরদিকে চড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছুক ক্রেতারা বেরিয়ে যেতে লাগল, তারপর শেষ পর্যায়ে যখন যে কটা লাইসেন্স তার চেয়ে মাত্র একজন বেশি ক্রেতা আছে, তখন ফার্স্ট প্রাইস গোপন নিলাম করা হল। তাই শেষ পর্যন্ত যারা বিজয়ী তাদের যে দাম দিতে হল সেটা এই শেষ পর্যায়েই এসে ঠিক হল, কিন্তু মনে রাখতে হবে এই দাম নির্ধারণটা আসলে এই পুরো নিলাম পদ্ধতিটারই ফলাফল।

কোনও নিলাম কিভাবে করা হবে, অর্থাৎ সেই নিলামের আদত পদ্ধতি, মানে নক্সা বা ডিজাইন (design) সবচেয়ে উপযুক্ত উপায়ে কেমনভাবে করা যাবে সেটা বের করা নিলাম তাত্ত্বিকদের একটা বড় কাজ। এর জন্য তাঁদের প্রথম মাথায় রাখতে হয় যে, যে নিলামটা করা হচ্ছে সেটা কেন করা হচ্ছে অর্থাৎ নিলাম করার উদ্দেশ্যটা কি। নিলামের উদ্দেশ্য নানারকম হতে পারে একথা আমরা আগেই জেনেছি – নিলাম থেকে সবচেয়ে বেশি যতটা সম্ভব টাকা রোজগার করা, কিংবা নিলামের মধ্যে দিয়ে নিলামে তোলা জিনিসগুলো এমন লোকের হাতে পৌঁছে দেওয়া যার বা যাদের কাছে ঐ জিনিসগুলোর মূল্য সবচেয়ে বেশি (মনে করে দেখ রথীনবাবুর বইয়ের নিলামে এই উদ্দেশ্যটাই কাজ করেছিল)।

নিলাম ডিজাইন করা ছাড়াও কিন্তু নিলাম তাত্ত্বিকদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নিলাম বিশ্লেষণ করা। অনেক সময় নিলাম হয়ে যাবার পর দেখা যায় কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, যেমন নিলাম করে যত দাম পাওয়া যাবে ভাবা হয়েছিল, তার ধারেকাছেও দাম পৌঁছল না, কিংবা নিলামে যত সংখ্যক দরদাতা (bidder) অংশ নেবে আশা করা গিয়েছিল তার সিকিভাগও অংশ নিল না, এমনকি কখনও এমনও হয়েছে যে কোনও দরদাতাই অংশগ্রহণ করেনি, এই ধরণের আরও কত কি!

যখন এইসব ঘটে, তখন অবধারিতভাবেই প্রশ্ন ওঠে এমনটা হল কেন? এই কেনর উত্তর খোঁজাও কিন্তু নিলাম তাত্ত্বিকদের আরেকটা বড় কাজ, কারণ এর মধ্যে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে পরবর্তী নিলামে এইধরণের ঘটনা ঘটা আটকাবার সূত্র। এই কেনগুলোর উত্তর তাঁরা যত বেশি খুঁজে পান, তত শক্তিশালী হয়ে ওঠে পরবর্তী নিলামগুলোর ডিজাইন, একদম শুরু থেকেই আরও অনেক আটঘাট বেঁধে নিলামে নামা সম্ভব হয়। অনেক সময় নিলামের কোনও আশাতীত বিপর্যয়কর ফল নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে এও দেখা গেছে নিলাম পদ্ধতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই, হয়তো যে জিনিসের নিলাম হচ্ছে সেটার পরবর্তী ব্যবহার কি হতে যাচ্ছে তার প্রভাব নিলামে এসে পড়েছে এবং সেই জন্যই ওসব বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু কথা হল, প্রভাব তো সেই নিলামের ফলের ওপরেই পড়ছে, সুতরাং নিলামের ডিজাইন করার সময় সেই ব্যাপারগুলোকেও যথাসাধ্য মাথায় রেখে নিলামটাকে ঠিকমত সাজাতে হবে। কথাগুলো শুনতে সরল, কিন্তু এই কাজটা আদতে ভয়ানক কঠিন। কোন দিক থেকে যে কি খোঁচা এসে হাজির হবে, বোঝাই দুষ্কর। আবার মাঝে মাঝে তো এমনও হয় যে কোনও একটা বা কয়েকটা দিক সামলাতে গেলে অন্য কোনও দিক থেকে সমস্যার উদয় হয়। সুতরাং এমন হতেই পারে যে সব সমস্যার উৎসগুলো বুঝেও সব কটাকে একসঙ্গে সমাধান করা গেল না, একটা সামলাতে গেলে আরেকটা মাথা চাড়া দিল!

এই সময় নিলাম তাত্ত্বিকরা কী করবেন? এর উত্তর এক কথায় দিতে হলে একটা কথাই বলা যায় – অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। অর্থাৎ এদের কোনও নির্দিষ্ট সমাধান নেই। এই সব সময়গুলোতেই নিলাম তাত্ত্বিকদের কৃতিত্বের পরীক্ষা – কিভাবে তাঁরা এই বহুমুখী সমস্যাগুলোর সম্পূর্ণ সমাধান করতে না পারলেও একটা সুষম ভারসাম্য অবস্থা তৈরির ব্যবস্থা করতে পারেন, নিদেনপক্ষে কোনও পথ বাতলাতে পারেন যেটা সরকার বা ওরকম কোনও কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে তৈরি হওয়া সম্ভব।

নিলামের তত্ত্বে কিভাবে উপযুক্ত ডিজাইনের কথা ভাবা হয়েছে আর বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় সেগুলো সত্যিই কতটা সফলভাবে কাজে লেগেছে বা লাগেনি, যখন লাগেনি তখন তত্ত্বের পরিসরে আর কী কী নতুন ভাবনার পথ খুলেছে তা বুঝতে হলে কিছু বাস্তবে ঘটে যাওয়া নিলামের কথা জানতে হবে, সে গল্প আবার পরে হবে।

———————

https://economictimes.indiatimes.com/infrastructure/azadpur-mandi-behind-the-scenes-of-asias-largest-wholesale-market/transactions-worth-hundreds-of-crores/slideshow/20042464.cms

  https://www.iiserkol.ac.in/media/filer_public/96/80/96802ac8-0807-4628-8914-2bc63b01be50/auction-notice-fishes.pdf

 ক্রমশ

    জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s