বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-বিজ্ঞানের কথক ঠাকুর-ডঃউৎপল অধিকারী -বসন্ত২০২১

জগদানন্দ রায়কে টিপিক্যালি বিজ্ঞানী না বলা হলেও তিনি ছিলেন একজন সায়েন্স অরেটর, সায়েন্স রাইটার ও সায়েন্স সার্ভেন্ট। আমৃত্যু তিনি বিজ্ঞানকে ভালোবেসেছেন, তৃণমূল স্তরে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছেন ও বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন করেছেন। তাই তিনি স্বভাব বিজ্ঞানী ও শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞানীর ঋত্বিক। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন সৃষ্টির অন্যতম কারণ হল প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নির্ভয়ে শিক্ষাগ্রহণ, মন ও অন্তরাত্মার সর্বোত্তম বিকাশ সাধন। বিজ্ঞানাচার্য হিসাবে জগদানন্দবাবু অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন সারাজীবন। তিনি ছাত্রদের সর্বদা বলতেন, প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো, জিজ্ঞাসু মন তৈরি করো। ‘শালিক দুটো ঝগড়া করছে কেন? চড়ুই পাখিটা ব্যস্ত হয়ে কী বলছে? ফিঙেটা কী দেখে অত নাচানাচি করছে? কিংবা এই দেখো পোকাখেকো গাছ কেমন পোকা ধরে খাচ্ছে।’

রবি ঠাকুর শিলাইদহে থাকাকালিন রথীন্দ্রনাথকে অঙ্ক শেখাতেন ও জমিদারি সংক্রান্ত নানা কাজ করতেন জগদানন্দ রায়। কিন্তু জমিদারির নায়েবগিরি থেকে শিক্ষকতাতেই বেশি আনন্দ পেতেন তিনি। তাই রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন যাবার প্রস্তাব তিনি লুফে নিয়েছিলেন। তারপর তো ইতিহাস।

ইংরেজি ১৮৬৯ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত রায় পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অভয়ানন্দ রায় ছিলেন আত্মভোলা, দিলদরিয়া মানুষ ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী। শিক্ষা গ্রহণে ও জ্ঞান আহরণে পিতার ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু অল্প বয়সে পিতার মৃত্যু তাঁদের সমগ্র পরিবারকে চরম দারিদ্রতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। কৃষ্ণনগরেই তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন অতিবাহিত হয়। কলেজ থেকে বি.এ পাস করার সময় তাঁর নির্বাচিত ও প্রিয় বিষয় ছিল বিজ্ঞান। বাল্যাবস্থা থেকেই প্রকৃতি চর্চা ও মহাকাশ নিরীক্ষণ ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। কৈশোরকালিন তিনি তখনকার দিনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভারতী’-তে তাঁর লেখা ‘পিপীলিকা ধেনু’ ও ‘পুষ্পতত্ত্ব’ প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকায় অনেক লেখাই তাঁর প্রকাশিত হয়। লেখালেখির সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুনজরে পড়েন তিনি। তিনি স্বয়ং তাঁকে জমিদারিতে নিযুক্ত করেন। এর পরবর্তী ঘটনা আমাদের জানা।

চিত্তাকর্ষক বাংলা ভাষায়, বিজ্ঞান রসে সিক্ত করে তিনি শিক্ষাদান করতে থাকেন। শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ছোটোখাটো যন্ত্রপাতি জোগাড় করে সেখানে তৈরি করলেন একটি ক্ষুদ্র ল্যাবরেটরি। সেখানে উৎসুক ছাত্ররা প্রাণভরে দেখত আকাশ ও পর্যবেক্ষণ করত প্রকৃতি। ছোটো ছোটো পরীক্ষার মাধ্যমে, যুক্তির মাধ্যমে ছাত্রদের বিজ্ঞানমনস্ক তৈরি করতেন তিনি।

ছেলেবেলায় তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রায় ভগ্ন একটি হাত দূরবীন, একটা ব্যারোমিটার, একটা বৈদ্যুতিক ঘণ্টা, দুটো ছোটোবড়ো তাপমান যন্ত্র, কয়েকটা কাচের নল, কিছুটা বৈদ্যুতিক তার ও একটা বুনসেন সেল। এগুলি নিয়ে তিনি নানান বৈজ্ঞানিক কেরামতি করতেন। কালো কাপড়ে মোড়া লন্ঠনের স্বল্প আলো নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন রাতের আকাশ দেখতে।

শিক্ষক হিসাবে তিনি যখন শান্তিনিকেতনে নিযুক্ত, তখনো তিনি রবি ঠাকুরের ৩০০ টাকায় কেনা তিন ইঞ্চি একটি টেলিস্কোপ দিয়ে রথীন্দ্রনাথ সহ আশ্রমের অন্যান্য ছাত্রদেরকে রাতের আকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্র চেনাতেন। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, জগদানন্দবাবু রীতিমতো হাতেকলমে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। বিজ্ঞানের দুর্বোধ্য বিষয়গুলি সহজভাবে ব্যাখ্যা করতেন, উদাহরণ দিতেন। যেমন, ‘পাছে ইটপাথর-কাঁকরের খোঁচা মাথায় লাগে এই ভয়ে শিকড়গুলিও মাথায় টুপি লাগাইয়া মাটির তলায় চলে। এই টুপিকে বৈজ্ঞানিকরা মূলত্রাণ (Root cap) নাম দিয়েছেন।’

সারাজীবনে তিনি মোট চব্বিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যথা ‘বাংলার পাখি’, ‘পোকামাকড়’, ‘গাছপালা’, ‘প্রকৃতি পরিচয়’, ‘আলো’, ‘তাপ’, ‘চুম্বক’, ‘নক্ষত্র চেনা’, ‘বিজ্ঞানের গল্প’, ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ ইত্যাদি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা বেশিরভাগ বইই বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় এবং তা ব্যক্তিগত অনুসন্ধান ও তথ্যে ভরপুর। বইগুলি তখনকার দিনের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবিতে পরিপূর্ণ। তাই সেগুলি আজও বিজ্ঞানী এবং উৎসাহী মানুষদের কাছে চিত্তাকর্ষক ও অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঠিকভাবেই বলেছেন ‘জ্ঞানের ভোজে এ এদেশে তিনিই সব প্রথমে কাঁচা বয়সের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ্য পরিবেশন করেছিলেন।’ তাই বলা যায় যতদিন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা থাকবে, ততদিন জগদানন্দ রায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s