বৈজ্ঞানিকের দপ্তর ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-লিউয়েন হক-অরূপ ব্যানার্জি-শীত ২০২০

ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে 

পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষ তার চারপাশের পরিবেশের মধ্যে নিজেকে চিনতে পারে ও জানতে পারে। তবু সেই চেনাজানার মাঝে বিস্তর ফাঁক থেকে যায়, কারণ দেখা-শোনা-স্বাদ-স্পর্শ-অনুভূতির রাস্তাটা হল মানুষের শরীরের কিছু যন্ত্র। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক—শরীরে এইসব যন্ত্রের স্বাভাবিক নির্দিষ্ট গণ্ডি আছে, যার বাইরে প্রকৃতির সব রহস্য রয়ে যায় অচেনা ও আজানা। প্রকৃতিকে চিনতে গিয়ে প্রাচীনকালে উন্নত দেশগুলিতে তাই গড়ে উঠেছিল দর্শন। বিজ্ঞান তখনো উন্নত হয়নি। তাই অদেখা অচেনা জগৎ নিয়ে মানুষ যা কিছু বলেছে, তার ভিত্তি ছিল কল্পনা। তাই কাল্পনিক জগৎ ফুটে উঠেছিল দার্শনিক চিন্তাভাবনায়। তারপর মানুষ ভাবতে শুরু করল, এভাবে স্রেফ দর্শন দিয়ে চারপাশের পরিবেশ চেনা ঠিক হবে না, সত্য জানতে হবে। তখন শুরু হল যন্ত্রের আবিষ্কার, যার মাধ্যমে মানুষ ছাড়িয়ে যাবে তার খালি চোখে দেখার পরিধি। তাই গ্যালিলিওর হাতে জন্ম নিল টেলিস্কোপ। ধরা পড়ল দূর গ্রহ-নক্ষত্রের চেহারা। খালি চোখে যা ছিল বিন্দু, যন্ত্রে তাই ধরা দিল কয়েকশত গুণ বর্ধিত আকারে। তারপর টাইকো ব্রাহে, কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কেমন করে সূর্যের চারদিকে ঘোরে পৃথিবী, শনির বলয় দেখতে কেমন, চাঁদের গায়ের কালো কালো ছোপ আসলে পাহাড়। ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে দার্শনিকদের চিরাচরিত প্রাচীন ধারণা ভেঙে পড়ল। কেউ অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিয়ে বলল, সব বুজরুকি, মানুষকে বোকা বানানোর ভোজবাজি। বিজ্ঞান যত এগিয়ে গেল, ততই বিজ্ঞানকে নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা করার মানুষজন সংখ্যালঘু হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা বিজয়ী হলেন।

এ তো গেল দূরের জিনিসটাকে একবারে টেনে হিঁচড়ে কাছে টেনে নিয়ে আসার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। কিন্তু অতিক্ষুদ্র জিনিস, যা খালি চোখে দেখা যায় না, তাকেও তো চোখের পর্দায় এনে ফেলতে হবে! এটি হল মাইক্রো-ওয়ার্ল্ড। এক খ্যাপা পাগল সেটিও করে দেখালেন।

হল্যান্ডের (বর্তমান নেদারল্যান্ডস) ডেল্‌ফ শহরে এক বিরাট বাড়ির নীচুতলায় খোলা জানালা দিয়ে প্রতিবেশীরা দেখতে পেত, একটি মানুষ মেঝেতে উবু হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে একটা টেস্টটিউবের খোলা মুখে। হাতে তার রয়েছে একটা ধাতুর তৈরি যন্ত্র। সে কী করছে জিজ্ঞাসা করলে লোকটা মুখে রা-টি কাটত না, বরং সকলের কাছ থেকে তার কার্যকলাপ লুকিয়ে রাখাটাই ছিল পছন্দ।

ডেল্‌ফ শহরের সেই আত্মভোলা মানুষটি ছিলেন এন্টনি ভ্যান লিউয়েনহুক। খোলা জানালার আলোর পাশে তার হাতে ধরা থাকত টেস্টটিউবের মধ্যে নালার জল, আরেক হাতে একটা ছোট্ট ধাতুর তৈরি হাতল লাগানো যন্ত্র। সে যন্ত্রের একপ্রান্তে আটকানো ছিল ছোট্ট মুসুরির ডালের আকৃতির কাচ। কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলে অনেক ছোটো ছোটো জিনিস আকারে বড়ো হয়ে চোখে ধরা পড়ত। কাচের খণ্ডটা তিনি ঘষে মেজে উপযুক্ত করে তৈরি করেছিলেন। টেস্টটিউবের জলের মধ্যে লিউয়েনহুক দেখতে পেলেন অদ্ভুত সব প্রাণী, যাদের খালি চোখে মানুষ দেখতে পায় না। ততদিনে মাইক্রোস্কোপ জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানী রবার্ট হুকের হাতে, সেটি হল কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ। তাতে আবার নানান অসুবিধা। সেটা বেশ জটিল আর ত্রুটিপূর্ণ। লিউয়েনহুক বুঝেছিলেন, খুব ছোটো প্রাণী দেখতে হলে লেন্স হতে হবে অনেক ছোটো। যত লেন্স বড়ো হয়, ততই তার এক ত্রুটি দেখা দেয়, যাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন ‘ক্রোমাটিক এবারেশন’। এই ত্রুটির ফলে নানা রঙের ছোপের প্রভাবে প্রতিবিম্ব হয়ে যায় ঝাপসা।

লিয়েনহুক কাচের টুকরো এমনভাবে ঘষে তৈরি করলেন, যার কেন্দ্রের অংশ মোটা, আর ধারের দিকটা পাতলা। ফলে যে উত্তল লেন্স তৈরি হল, তার বস্তুর ছবি বহুগুণ বড়ো করে দেখাবার ক্ষমতা হল, আর আকৃতি ছোটো হওয়ায় রঙের ত্রুটিও আর রইল না। বেশ স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখা গেল। তৈরি হল প্রথম সিম্পল মাইক্রোস্কোপ। প্রবল উৎসাহে লিয়েনহুক সংগ্রহ করলেন বৃষ্টির জল, নালার জল, পুকুরের জল, মানুষের লালা। তারপর সেই মাইক্রোস্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখলেন নানাধরনের সেই তরলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য সচল জীবাণু। ব্যাকটেরিয়া আর প্রোটোজোয়ার অস্তিত্ব সর্বপ্রথম গোচরে এল মানুষের। আত্মভোলা লিউয়েনহুক এবার ছোটো ছোটো পিঁপড়েদের মুখ কেমন দেখতে, তা দেখে খুশি হয়ে নাচানাচিও করলেন হয়তো, তবে ঘুণাক্ষরেও কাউকে সেকথা ফাঁস করলেন না। দিলে হয়তো লোকে তাঁকে পাগল ভাবত।

নিজের আবিষ্কৃত মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তিনি অন্য দুনিয়ার যে চমৎকার দৃশ্য দেখলেন, তাই দেখে লিখে রাখলেন, জলের ভিতর ছোট্ট ছোট্ট নানা প্রাণী, খালি চোখে দেখা সবচাইতে ছোটো একটা পোকার চাইতে যারা হাজার গুণে ছোটো, তারা কখনো ডিগবাজি খায়, নাচে, গোল হয়ে ঘুরপাক খায়, আবার কখনো হঠাৎ লম্ফ দিয়ে অন্য জায়গায় চলেও যায়। নিজের দাঁতের ফাঁকে আবিষ্কার করলেন কিলবিলে সব অত্যাশ্চর্য প্রাণী। গাছের গায়ে ছত্রাকদের বেড়ে ওঠা দেখলেন, পর্যবেক্ষণ করলেন ডিম থেকে লার্ভা কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবেই বা তার থেকে বেরিয়ে আসে সার সার পোকা।

আণুবীক্ষণিক প্রাণীজগৎ নিয়ে লিউয়েনহুক কেন মেতে উঠেছিলেন, কীসের তাড়নায় তিনি বানিয়ে গেছেন একটার পর একটা নানা আকৃতির লেন্স, তা আজও রয়ে গিয়েছে এক রহস্যের আবরণে মোড়া। তবে তিনি যে জীববিজ্ঞানী রবার্ট হুকের লেখা বই ‘মাইক্রোগ্রাফিয়া’ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সেটা জানা গেছে। তিনি রবার্ট হুককে লেখা একটা চিঠিতে নিজের মনের কথা খানিকটা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে, বিজ্ঞানমহল তাঁর কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, ‘লোকটা রূপকথার গল্প বলে ভোলাবার চেষ্টা করে, যা কিছু দেখে তা সব ওঁর চোখেই শুধু ধরা পড়ে।’ প্রথাগত বিজ্ঞান শিক্ষা না থাকার জন্য বিজ্ঞানীরা যে খুব সহজে লিউয়েনহুকের আবিষ্কারকে পাত্তা দিতে চাননি, একথায় তা জলের মতো পরিষ্কার। নিজের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই লিখে যাননি এন্টনি ভন লিয়েনহুক। শুধু তাঁর লেখা কিছু চিঠিপত্রেই মনের কথা খানিকটা জানতে পারা গেছে। আদপেই কোনো প্রথাগত বিজ্ঞানী ছিলেন না লিউয়েনহুক। ছেলেবেলায় কতটা পড়াশুনো করেছেন, তাও রয়ে গিয়েছে এক ধোঁয়াশা হয়ে। খুব ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়ে তিনি অ্যামস্টারডাম যান কাপড়ের ব্যাবসার প্রশিক্ষণ নিতে। নিজের পিতৃভূমি ডেল্‌ফে ফিরে এসে বিশাল এক কাপড়ের দোকান খোলেন। ব্যাবসা বেশ জাঁকিয়ে করতে থাকেন। লেন্স নিয়ে তাঁর কার্যকলাপের কথা যখন বিজ্ঞানমহলে জানাজানি হয়, তখন তিনি মধ্য পঞ্চাশের প্রৌঢ়। জীবাণু অনুসন্ধানের উপর তিনি যে কাজগুলো করছিলেন, তার এক খতিয়ান লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে জানিয়ে দেন তাঁর এক বন্ধু। তারপর রয়্যাল সোসাইটির অনুরোধে নিয়মিত তাঁর গবেষণার তথ্য চিঠি লিখে জানাতে শুরু করেন। এর মধ্যেই তিনি মানুষের রক্ত চলাচল এবং তার উপাদান নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। তারপর নিজের দেহে ছুঁচ ফুটিয়ে রক্ত বার করে কাচের স্লাইডে রেখে নিজের আবিষ্কৃত সিম্পল মাইক্রোস্কোপ দিয়ে রক্তের লোহিত কণিকা দেখতে পান। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। রয়্যাল সোসাইটি লিউয়েনহুককে সোসাইটির সদস্য পদ দান করে। নব্বই বছর বয়সে যখন লিউয়েনহুক পরলোক গমন করেন, তখনো তিনি সেই সদস্য পদে বহাল থাকেন।

রয়্যাল সোসাইটির প্রকাশিত মুখপত্র ‘ফিলসফিকাল ট্র্যান্সাক্সশন’-এ নিয়মিত তাঁর লেখা গবেষণাপত্র প্রকাশ হলে বৈজ্ঞানিকমহল তাঁর চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা জানতে পারে। এর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞসমাজ এরিস্টটল প্রচারিত ‘স্পন্টানিয়াস জেনারেশন থিয়োরি’-তে বিশ্বাস করত, যাতে মনে করা হত, কেবলমাত্র অজৈব পদার্থ থেকে ছোটো ছোটো প্রাণীদের উদ্ভব হয়। কিন্তু লিউয়েনহুকের মাইক্রোস্কোপ আরেক অজানা পৃথিবীর সন্ধান দিল—মাইক্রো-ওয়ার্ল্ড। তিনি ক্ষুদ্র প্রাণীদের জন্মের ইতিকথা বোঝালেন ঘাড় ধরে লেন্সের নীচে নজর ফিরিয়ে। দেখা গেল কীভাবে ছত্রাকেরা জন্মায়। পিঁপড়ের ডিম বলে যা ভাবা হত, তা হল আসলে পিঁপড়ের পিউপা, ডিম তার চাইতেও ছোটো।

সারাজীবনে প্রায় চারশো ছোটোবড়ো লেন্স তৈরি করেছেন লিউয়েনহুক, যাদের কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব ৫০ থেকে ৩০০ গুণ বাড়িয়ে দেখাবার ক্ষমতা ছিল। ফিলসফিকাল ট্র্যান্সাক্সশনে তার লেখা গবেষণাপত্রের সংখ্যা ২৭৫, মেম্যারস অফ প্যারিস একাডেমি অফ সায়েন্সে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ২৭।

প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও কেবলমাত্র অনুসন্ধিৎসা এবং নিষ্ঠা একজন মানুষকে কীভাবে প্রকৃত অর্থে এক বিজ্ঞানী করে গড়ে তুলতে পারে, তার প্রমাণ হলেন এণ্টনি ভন লিউয়েনহুক। মাইক্রো-বায়োলজির গবেষণায় তাই তিনি চিরকালের জন্য নিজের নাম অমর করে রেখে গেছেন।

 জয়ঢাকের  বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

2 thoughts on “বৈজ্ঞানিকের দপ্তর ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-লিউয়েন হক-অরূপ ব্যানার্জি-শীত ২০২০

  1. এমনই হয়। আইনস্টাইন বলেছেন :
    I have no special talent I am only passionately curious .

    Like

  2. খুব ইন্টারেস্টিং লাগল অরূপ। হারানো আর পুরানো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।

    Like

Leave a comment