বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে
ইয়ে মানে, বলছিলাম যে কবি বোধ হয় কথাটা আয়রনি হিসেবেই বলেছিলেন। তিনি তখন নিশ্চয়ই জানতেন না যে আধুনিক বিজ্ঞান এই প্রশ্নের উত্তরটিও খুঁজে বের করে আনতে সক্ষম। হ্যাঁ, মানে অমরত্বের কথাই বলছি। অমরত্ব, অর্থাৎ ইমমরটালিটি। শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই সম্ভব।
তাহলে গোড়া থেকেই বলি। অমরত্ব কী বা কেন বুঝতে গেলে মৃত্যুর কারণটা বুঝতে হবে আগে। সোজা কথায় আমরা বলি যে বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু, তাই তো? তাহলে এই বয়স ব্যাপারটা কী? বৃদ্ধ বয়সের কারণে প্রাণীর শরীর দুর্বল হয় কেন? এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর হল কোষের ‘হেফ্লিক লিমিট’ (Heyflick limit)।
সোজা ভাষায় বলতে গেলে একটি স্বাস্থ্যবান কোষ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ঠিক কতবার বিভাজনে সক্ষম, সেই সংখ্যাটিকে বলা হয় হেফ্লিক লিমিট অথবা হেফ্লিক ফেনোমেনন। প্রতিটি কোষের ক্রোমোজোমে টেলোমেয়ার নামক একটি অংশ থাকে। এই টেলোমেয়ার তৈরি হয় বহুসংখ্যক নিউক্লিওটাইড দ্বারা। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় একটি নিউক্লিওটাইড কোষ থেকে কমে যায়। এভাবে নিউক্লিওটাইডের সংখ্যা যখন একদম শেষ হয়ে যায়, তখন কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যায় এবং এরপর সেই কোষের মৃত্যু ঘটে। কাজেই বুঝতেই পারছ যে এই নিউক্লিওটাইডের সংখ্যার ওপরেই হেফ্লিক লিমিট নির্ভর করছে।
বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রে এই নিউক্লিওটাইডের সংখ্যা ভিন্ন হয়। যে প্রজাতির কোষে নিউক্লিওটাইড যত বেশি, তাদের হেফ্লিক লিমিটও ন্যাচারালি তত বেশি। অর্থাৎ সেই প্রজাতির প্রাণীর গড় আয়ুও তত বেশি হয়। এই কারণেই কচ্ছপ, গ্রিনল্যান্ড শার্ক প্রভৃতি প্রাণীরা একশো বছরেরও বেশি বাঁচে।
মানুষের কথাই ধরা যাক। আমাদের ক্ষেত্রে হেফ্লিক লিমিট মোটামুটি ৪০ থেকে ৬০। অর্থাৎ, আমাদের দেহের প্রত্যেকটি সুস্থ কোষ নর্ম্যালি চল্লিশ থেকে ষাটবার বিভাজিত হতে পারে। বিভাজনের সীমা পার হলে সেই কোষের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। ছোটোবেলায় হেফ্লিক লিমিট থাকে বেশির দিকে। যৌবনকাল পেরোলে এই লিমিট ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তখন বৃদ্ধি শেষ হয়ে যায় এবং দেহে ক্ষয় শুরু হয়। সোজা কথায় আমরা বুড়ো হয়ে যাই।
আমার এত বকবক করার পেছনে কারণ একটিই, অমরত্বের রহস্য সন্ধান করা। মোদ্দা কথা এই জানা গেল এই যে দেহের মৃত্যু আসলে অতি বিপুল সংখ্যক কোষের মৃত্যু। তাই কোনোভাবে যদি হেফ্লিক লিমিটকে বাড়িয়ে লিমিটলেস করে দেওয়া যায় তাহলে খাতায় কলমে মানুষ অমর হয়ে যাবে। কোষও মরবে না তাই সেই কোষের তৈরি দেহও হবে অমর। আইডিয়ালি এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃতির পরিহাস দেখো, কোনো কারণবশত যদি স্বাভাবিক কোষের হেফ্লিক লিমিট ইনডিফিনিট হয়ে যায় তবে সেই অমর কোষ তার নর্ম্যাল কাজকর্ম ছেড়ে শুধুমাত্র বিভাজনই করতে শুরু করে। এই অবস্থা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। ডাক্তারবাবুর ভাষায় একে বলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। সোজা কথায় ক্যানসার!
এককথায় বলতে গেলে, প্রকৃতি-মা যদি একহাতে কিছু দেন তবে অন্য হাতে তিনি কিছু কেড়েও নেন। অবশ্য এই নিয়মের ব্যতিক্রমও রয়েছে। প্রকৃতিতে এমন কিছু প্রাণী রয়েছে যারা বায়োলজিক্যালি ইমমরটাল। অর্থাৎ নেহাত কোনো দুর্ঘটনা বা রোগগ্রস্ত না হলে তাদের মৃত্যু অসম্ভব।
অমরত্বের লিস্টে যিনি ফার্স্ট গার্ল, তার নাম হাইড্রা । হাইড্রা একটি অতিক্ষুদ্র প্রাণী। মোটে তিরিশ মিলিমিটার উচ্চতা। এরা পুকুর, নদী অথবা হ্রদের জলে বসবাস করে। এদের কোষে FoxO নামক একটি বিশেষ জিনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই জিনের সাহায্যে এরা নিউক্লিওটাইড ডুপ্লিকেট তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলস্বরূপ এদের কোষ অমর, হেফ্লিক লিমিটের আওতার বাইরে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় দেখে গেছে যে চার বছর সময়সীমা পর্যন্ত হাইড্রার কোষে বয়স বৃদ্ধি বা বিভাজন শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এরপর বিজ্ঞানীরা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।
এখন তুমি বলবে যে চার বছর আর এমন কী, তাই তো? দাঁড়াও বাপু, অত সহজ নয়। চার বছর বলেছি মানুষের হিসেবে। মানুষের ক্ষেত্রে যদি ধরি মোটামুটি ষোলো বছর বয়সে যৌবন প্রাপ্তি হয়, তাহলে হাইড্রার ষোলো বছর অর্থাৎ বয়ঃপ্রাপ্তি হয় পাঁচদিনে। অর্থাৎ হাইড্রার পাঁচদিন মানে মানুষের ষোলো বছর। সেই হিসেবে হাইড্রার চার বছরের অর্থ হল মানুষের হিসেবে চার হাজার ছশো বাহাত্তর বছর। সাড়ে চার হাজার বছর বয়সেও যদি কোনো প্রাণী বুড়ো না হয়, তবে সে অমর নয়তো কী!
দ্বিতীয়জন হলেন একটি বিশেষ প্রজাতির জেলিফিশ।
ইনি নোনা জল অর্থাৎ সমুদ্রের বাসিন্দা। নাম টুরিটোপসিস ডোরনি (Turritopsis dohrnii)। ডোরনি প্রজাতির জেলিফিশ প্রকৃত অর্থেই অমর। প্রত্যেকবার প্রজননের পর এরা আবার শৈশবে (পলিপ স্টেজে) ফিরে যায় এবং নতুন করে জীবন শুরু করে। পরীক্ষাগারে আরো দেখা গেছে যে খাদ্যের অভাব বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির আভাস পেলেও ডোরনি প্রজাতির জেলিফিশ নিজেকে রক্ষার জন্য পলিপ স্টেজ ধারণ করে। পূর্ণবয়স্ক কোষের এমন রূপান্তরকে ট্রান্সডিফারেনসিয়েশন (transdifferentiation) বলে। একথা হলফ করে বলতে পারি যে রোগব্যাধি বা আক্রমণ না হলে ডোরনি-মশাইয়ের মৃত্যু তো দূরের কথা, বুড়ো হওয়ারও কোনো সম্ভবনা নেই।
আমাদের তৃতীয় অতিথিটির নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ, লবস্টার।
নাম তো জানো, কিন্তু এটা কি জানো যে লবস্টার প্রাণীটিও কিন্তু মোটামুটিভাবে বায়োলজিক্যালি ইমমরটাল? আইডিয়াল অবস্থায় থাকলে লবস্টারের কখনোই মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। এদের শরীরে ‘টেলোমারেজ’ নামক এনজাইম থাকে। এই উৎসেচকের উপস্থিতির কারণে প্রতিবার কোষ বিভাজনের পর এরা কোষের টেলোমেয়ার অংশটি মেরামত করে নিতে সক্ষম। এর ফলে লবস্টারের বৃদ্ধি হয় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়সের কারণে লবস্টারের দেহে ক্ষয় নয়, উলটে তাদের শরীর আরো বড়ো হয় এবং শক্তি সঞ্চার হয়। তাহলে এখন তোমরা প্রশ্ন করবে যে লবস্টার তবে মারা যায় কেন? তাই তো? উত্তরখানা বলছি শোনো। লবস্টারের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক মৃত্যুর একমাত্র কারণ হল ‘মোল্টিং’ (moulting)।
মোল্টিং মানে খোলস বদলে ফেলা। কাঁকড়া বা লবস্টারের ক্ষেত্রে তাদের বহিঃকঙ্কালের মধ্যের নরম শরীরটির স্বাভাবিক বয়সজনিত বৃদ্ধি ঘটে, কিন্তু বাইরের খোলসটি বাড়ে না। এই কারণে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে এই ধরনের প্রাণীগুলি নিজেদের পুরোনো খোলস বদলে নতুন বহিঃকঙ্কাল গঠন করে। নইলে বুঝতেই পারছ, ছোট্টো খোলসের মধ্যে বড়ো শরীরের প্রাণী আঁটবে কী করে? পুরাতন খোলস বদল এবং নতুন খোলস গঠনের এই প্রক্রিয়াটিকেই বলে মোল্টিং।
সমস্যাটা দাঁড়ায় এইখানে যে এই মোল্টিং পদ্ধতিটি অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। এ যেন বার বার নিজেই নিজেকে জন্ম দেওয়ার মতো কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। অত্যন্ত বৃহৎ শরীরের লবস্টার শেষের দিকে মোল্টিং-এর সময় অত্যধিক পরিশ্রমের কারণেই মারা যেতে পারে। তাছাড়া সদ্যোজাত নতুন খোলস শক্ত হতে কিছুটা সময় নেয়। খোলস শক্ত হওয়ার আগে আততায়ীদের দ্বারা আক্রমণের ফলে বেচারা ক্লান্ত লবস্টার নিজেকে বাঁচাতে অবধি পারে না।
চতুর্থ এবং শেষজনের কথা বলে শেষ করছি। রিজেনারেটিং ফ্ল্যাট ওয়র্ম বা চ্যাপ্টা কৃমি প্ল্যানেরিয়ান।
লবস্টারের মতো প্ল্যানেরিয়ানের অমরত্বের জন্যও দায়ী টেলোমারেজ এনজাইম।
তবে টেলোমারেজের ভূমিকা এখানে আরো প্রবল। প্ল্যানেরিয়ান কৃমির ক্ষেত্রে তাদের রিজেনারেশন বা পুনর্জন্মের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে তাদের শরীরকে মাঝামাঝি চিরে দিলে চেরা অংশগুলির থেকে তারা নতুন শরীর তৈরি করে নেয়। শেষের ছবিটি দেখলেই ব্যাপারটা বুঝে যাবে। কী আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না!
আধুনিক বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলেছে। অমরত্বের ব্যাপারটিকে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও হাস্যকর দিবাস্বপ্ন হিসেবে ধরা হত। অথচ দেখো, আজ এই যুগে দাঁড়িয়ে অমরত্বের উচ্চাশা কিন্তু নিছক কল্পনা নয়। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে! হয়তো ‘জয়ঢাক’-এর খুদে পাঠক বন্ধুদের মধ্যেই ভবিষ্যতের সেই বিজ্ঞানতাপস লুকিয়ে রয়েছেন, যিনি মানব সমাজে রোগব্যধির অভিশাপ দূর করে, অমরত্বের আশীর্বাদ আনবেন। সেই শুভদিনের জন্য তোমাদের সব্বাইকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলুম।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর