FUNবিজ্ঞান-মারিয়ার ছেলে দিমিত্রি-অমিতাভ প্রামাণিক-শরৎ২০২২

bigganmendeleev

রসায়নশাস্ত্রের মেরুদণ্ড যে পিরিওডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি, তার জন্ম হয়েছিল তাঁর মস্তিষ্কে। অথচ ছেলেবেলাটা তাঁর মোটেই ফুল বিছানো পথে এগোনো হয়নি। তবে অমন মা যাঁর সহায় তাঁকে কে রুখবে? রইল  বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ-এর ছেলেবেলার  গল্প।

 ছেলেকে মনের মতো করে মানুষ করতে গেলে ভর্তি করতে হবে রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়ে; তার জন্যে পাড়ি দিতে হবে সুদীর্ঘ বাইশশো কিলোমিটার পথ। ন্যাশনাল হাইওয়ের মতো মসৃণ পথ নয়, জনমানববর্জিত অপরিসর সাইবেরিয়ান পথ। পথে পড়বে বরফাচ্ছাদিত উরাল পর্বতশ্রেণি, সেটাকে পেরোতে হবে। রেলপথ পাতার তখনও অনেক দেরি এ-সমস্ত অঞ্চলে; এতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে ঘোড়ায় টানা স্লে-তে, ঘোড়ার পিঠে এবং হেঁটে।

মারিয়া সাব্যস্ত করলেন তিনি তাই করবেন। পনেরো বছর বয়সি পুত্র দিমিত্রি আর ছাব্বিশ বছর বয়সি কন্যা লিজার হাত ধরে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলেন তিনি।

মারিয়া কর্নিলিয়েভার জন্ম হয়েছিল এক সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে, আমাদের দ্বারকানাথ ঠাকুরের জন্মের কয়েক মাস আগে। ফ্রান্সে তখন ফরাসি বিপ্লব চলছে, ভারতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ-টুদ্ধ। মারিয়ার জন্মস্থান সাইবেরিয়ার টোবোলস্ক শহর, সেই যেখানে টোবোল নদী এসে মিশে গেছে ইর্তিশ নদীর সঙ্গে। মারিয়ার ঠাকুরদা সাইবেরিয়ার প্রথম গ্লাস ফ্যাক্টরি তৈরি করেছিলেন টোবোলস্কের কাছে এক গ্রামে, খুলেছিলেন ছাপাখানা, যেখান থেকে একটা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে বইপত্তরের অভাব ছিল না। কিন্তু সেই সময় মেয়েদের তো স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রথা ছিল না, তাই বাড়িতেই দাদাদের স্কুলের পাঠ্য আর বাড়ির বইপত্র অল্পবিস্তর পাঠ করেছিল মারিয়া। কারখানায় দেখেছিল কেমন বালি, চুনাপাথর, ক্ষার উচ্চতাপে গলে মিশে তৈরি হয় স্বচ্ছ কাচ।

ষোলো বছর বয়স যখন তার, বিয়ে হল মারিয়ার। পাত্রের নাম ইভান, সে মারিয়ার চেয়ে দশ বছরের বড়ো। ইভানের বাড়ি মস্কোর কাছে ত্বের প্রদেশে, সেটা টোবোলস্ক থেকে বহুদূর। রাশিয়ান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মযাজকের ছেলে ইভান পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হয় সেন্ট পিটার্সবার্গের চিফ পেডাগজিক্যাল ইন্সটিটিউটে, সেখানে প্রধানত শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। সেখান থেকে পাশ করে তার চাকরি হয় টোবোলস্ক ক্লাসিক্যাল জিমনাসিয়ামে। রাশিয়ায় জিমনাসিয়াম মানে আমাদের এখানকার হাই-স্কুল। দু-বছর পরেই মারিয়ার সঙ্গে বিয়ে। বিয়ের পর অবশ্য উরাল পর্বত পেরিয়ে তাম্বভ আর সেখান থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে সারাটভে কিছুদিন স্কুলে চাকরি করেছে সে। পরে আবার ফিরে এসেছে টোবোলস্কের জিমনাসিয়ামে, সেখানকার প্রিন্সিপাল হয়ে। চাকরি করেছে ১৮৩৪ সাল অবধি।

এই সময়ে মারিয়া জন্ম দিয়েছে একে একে সতেরোটি সন্তানের। তিনজন জন্মেই মারা যায়, পাঁচজন মারা যায় জন্মের কিছু সময়ের পর। সবচেয়ে যে ছোটো, সেই মারিয়ার নয়নের মণি, তার নাম দিমিত্রি।

দিমিত্রির জন্মের আগে গত কয়েক বছরে অবশ্য রাশিয়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঘটে গেছে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সেগুলোকে খুব অল্প কথায় বলে নেওয়া যাক।

* * *

মারিয়ার যে-বছর জন্ম হয়, সেই ১৭৯৩ সালেই ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুইয়ের গিলোটিনে মৃত্যু হয়; তার এগারো বছর পর ফ্রান্সের সম্রাট হন নেপোলিয়ন। একের পর এক প্রতিবেশী রাজ্যে চলতে থাকে তাঁর আক্রমণ, ফ্রান্স পরিণত হয় বিশাল শক্তিশালী দেশ হিসাবে। ফ্রান্সের সেনাবাহিনী পরিচিত হয় দ্য গ্রান্ড আর্মি নামে। রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রান্স সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল, কিন্তু ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নিজস্ব পরামর্শদাতাদের মত উপেক্ষা করে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করলেন। রাশিয়ার জার তখন প্রথম আলেকজান্ডার। চার লক্ষেরও বেশি সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ন রাশিয়ায় প্রবেশ করেন চব্বিশে জুন, অধুনা পোল্যান্ডের দিক থেকে নেমান নদী পেরিয়ে। রাশিয়ান সেনারা জানত সম্মুখসমরে ফরাসিদের পরাজিত করা অসম্ভব হবে, তাই তারা ক্রমাগত পশ্চাদপসারণ করতে থাকে এবং অগ্রবর্তী ফরাসিরা যাতে ব্যবহারযোগ্য কোনও বস্তু এমনকি খাদ্য না পায়, সেজন্যে নিজেরাই নিজেদের দেশের ক্ষেতখামারে আগুন লাগিয়ে দেয়, ধ্বংস করে দেয় পথের দু-ধারের গ্রাম-শহরগুলো।

রাশিয়া বিশাল দেশ। ফ্রান্স থেকে মস্কোর দূরত্ব প্রচুর। রাশিয়ার রাস্তাঘাট বাজে। সে-রাস্তা দিয়ে খাদ্যবস্তু টেনে আনা দুরূহ। তার ওপর যত সময় যেতে লাগল, ঘন হয়ে এল রাশিয়ান শীত। তিন মাস পরে নেপোলিয়নের সেনারা যখন মস্কোর কাছে উপনীত হল, ততদিনে কনকনে ঠান্ডা পড়ে গেছে। সেই ঠান্ডার সঙ্গে যুঝবার মতো পোশাক ও খাদ্যাদি ফরাসিদের সঙ্গে নেই। ৭ই সেপ্টেম্বর শেষমেশ নেপোলিয়ন রাশিয়ানদের আক্রমণ করেন। বরোডিনের যুদ্ধে একদিনে প্রায় আশি হাজার সেনার মৃত্যু হয়। তার অর্ধেকের বেশি রাশিয়ার, কিছু কম ফরাসিদের। যুদ্ধে হিসেবমতো ফরাসিদেরই জয় হয়। নেপোলিয়ন ভাবেন এইবার আলেকজান্ডার আত্মসমর্পণ করবেন বা শান্তিচুক্তি নিয়ে আসবেন। কিন্তু তা না করে রাশিয়ানরা মস্কো থেকেও পালায়; মস্কোর গভর্নর শহরের সবাইকে নিজের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

নেপোলিয়ন ধরেই নিয়েছিলেন রাশিয়া জয় করে ফেলবেন, কিন্তু শত্রুসেনা তাদের রাজধানী ফেলে পালিয়েছে। ওদিকে দেশ থেকে খবর আসছে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার উপক্রম। রাশিয়ার আবহাওয়া তাঁদের অবশ করে ফেলছে। পোশাক-পরিচ্ছদের টিনের বোতাম ঠান্ডায় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। না পাওয়া যাচ্ছে নিজেদের খাদ্য, না খাওয়ানো যাচ্ছে ঘোড়াগুলোকে। এই অবস্থায় শত্রুর পেছনে ধাওয়া করা অর্থহীন বিবেচনা করে তিনি সেনাদের দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেন। এই ফেরাও সহজ হয়নি। তুষারঝড়ে এক-একদিনে হাজার দশেক করে ফরাসি সেনার মৃত্যু হতে থাকে। রাশিয়ার ক্রীতদাসশ্রেণির চাষিরাও তাদের ফেরার পথে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত মাত্র দশ শতাংশ ফরাসি সেনা বেঁচে ফিরতে পারে। নেপোলিয়ন নিজে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে।

এই যুদ্ধের পর নেপোলিয়নের অপরাজেয় অভিধা ঘুচে যায়। প্রথম আলেকজান্ডারের সম্মান অনেক বেড়ে যায়, তাঁকে বলা হতে থাকে ইউরোপের রক্ষক। অস্ট্রিয়া-প্রুশিয়া-রাশিয়ার মধ্যে আঁতাত গড়ে ওঠে।

পশ্চিম ইউরোপে তখন শিল্পবিপ্লবের জোয়ার চলছে। স্পেন ও পর্তুগিজদের রাস্তা ধরে ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা সারা পৃথিবীতে সৃষ্টি করছে উপনিবেশ, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাষের ক্ষেত্রে প্রজন্ম-পরম্পরায় ক্রীতদাসপ্রথা বজায় রাখায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি সে তুলনায় খুবই ধীর। সবাই ভাবছে রাশিয়া খুব শক্তিশালী দেশ, কিন্তু তার সরকার অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী, জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রথম আলেকজান্ডারের দৃষ্টি গেল সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে, কিন্তু অল্পস্বল্প রদবদল ছাড়া বিশেষ কিছু করা সম্ভব হল না।

আলেকজান্ডারের পর ১৮২৫ সালে রাশিয়ার সম্রাট হলেন তাঁর ছোটো ভাই প্রথম নিকোলাস এবং রাজত্ব করলেন তিরিশ বছর। শুরুতেই অবশ্য তিনি আভ্যন্তরীণ গোলযোগের সম্মুখীন হন। সেই সমস্যার কারণও ছিল নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধটাই। সেই যুদ্ধের পর বহু উচ্চশিক্ষিত রাশিয়ান পশ্চিম ইউরোপে গেছিল বিভিন্ন কাজে এবং সেখানকার উদার অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে আকৃষ্ট হয়ে দেশে ফিরে স্বৈরাচারী রাশিয়াকে বদলে ফেলতে আগ্রহী হয়। এরই ফল হচ্ছে ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ডিসেমব্রিস্ট বিদ্রোহ। উচ্চবিত্ত নোবল ও সেনাধ্যক্ষের ছোটো ছোটো গ্রুপে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তারা ঠিক করে, নিকোলাসকে হটিয়ে তার ভাই কনস্টানটিনকে সাংবিধানিক সম্রাটের পদে অভিষিক্ত করে নতুন রাশিয়া তৈরি করা হবে।

নিকোলাস এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন তো করলেনই, এই সঙ্গে এমন ব্যবস্থা শুরু করলেন, যার ফলে রাশিয়ায় উদার পথ অবলম্বনের আশা সুদূরপরাহত হয়ে গেল। এ-ধরনের সম্রাটবিরোধী কার্যকলাপ যাতে শুরু না হয়, সেজন্যে চালু করা হল বিভিন্ন ধরনের সেন্সরশিপ। সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কড়া নজরদারি শুরু হল। সমস্ত পাঠ্যপুস্তক সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে এল। পুলিশের চর ঘুরতে লাগল সর্বত্র এবং বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই অভিযুক্তদের ধরে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হতে লাগল সুদূর সাইবেরিয়ার জনমানবহীন প্রত্যন্ত অঞ্চলে; সেখানে বন্দি ক্রীতদাসের মতো তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো শুরু হল। শুধুমাত্র প্রথম নিকোলাসের রাজত্বেই কয়েক লক্ষ মানুষকে এভাবে পাঠানো হয়েছিল পূর্ব সাইবেরিয়ায়।

* * *

অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষের যাতায়াত ছিল টোবলস্কে মারিয়া-ইভানের বাড়িতে, যার মধ্যে ছিল উদারপন্থী রাজনৈতিক নির্বাসিত এই ডিসেমব্রিস্টরাও। একগাদা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সচ্ছল, ছিমছাম আরামের জীবন তাদের। হঠাৎ সেই জীবনে নেমে এল দুর্ঘটনা। দিমিত্রি জন্মানোর কিছুদিন পরেই ছানি পড়ার ফলে ইভান তাঁর চোখের দৃষ্টি হারালেন এবং চোখে সফল অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও রাশিয়ার সরকার তাঁর চাকরিটা খেয়ে নিল। সামান্য ক’টা পেনশনের টাকায় তো এত বড়ো সংসার চলে না। মারিয়ার বাপ-ঠাকুরদার তৈরি গ্লাস কারখানাটা ততদিনে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, সেটাকে আবার ঝেড়েঝুড়ে কিছু লোকজন নিয়োগ করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন মারিয়া। তাঁর অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু পরিবারের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন কিছু আয়ের, এ-ছাড়া উপায় কী? কারখানাটা চলছিল টিমটিম করে, দিমিত্রি কারখানায় ঘুরতে গেলে সেখানকার গ্লাস ব্লোয়ার তাকে বলত, ‘বুঝলে খোকা, পৃথিবীর আসলি জিনিস হচ্ছে গ্লাস ব্লোয়িং, তার ওপরে কিছু নেই।’ কারখানার ম্যানেজার তাকে বলত, ‘শোনো বালক, পৃথিবীর আসলি জিনিস হচ্ছে গ্লাস মেকিং, এ যদি তুমি শিখে ফেলো, তোমায় আর পায় কে!’ অবাক বিস্ময়ে বালক দিমিত্রি দেখে কীভাবে কাচের রকমারি পাত্র তৈরি হয়।

বিপদ যখন আসে, হুড়মুড়িয়ে আসে। দিমিত্রির বয়স যখন মাত্র তেরো বছর, একদিন জানা গেল, কারখানাটা আগুন লেগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এর কিছুদিন পরেই ইভান মারা গেলেন।

স্বামীহীনা মারিয়ার অবস্থা শোচনীয়। কিছুকাল আগে বড়ো মেয়ে (তার নামও মারিয়া) মারা গেছে। আট ছেলেমেয়ের ছ’জনকে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে রইল মেয়ে লিজা ও কনিষ্ঠ পুত্র দিমিত্রি। দিমিত্রিকে সাত বছর বয়সে জিমনাসিয়ামে ভর্তি করা হয়েছিল, এদিকে দেশের আইন হচ্ছে আট বছরের আগে জিমনাসিয়ামে ভর্তি নিষিদ্ধ। দিমিত্রির বয়স এক বছর কম বলে প্রথম শ্রেণিতে তাকে দু-বছর পড়তে হয়েছিল। দিমিত্রির উৎসাহ বিজ্ঞান এবং গণিতে; ভাষাশিক্ষায় তাঁর উৎসাহ নেই, ল্যাটিন বা জার্মান পড়তে হলেই তার মুখ ভার।

এভাবেই পেরিয়ে গেল আরও দুটো বছর। জিমনাসিয়ামের ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করে গেল দিমিত্রি, এখন তাকে পড়ানো দরকার ভালো কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে। মারিয়া ভেবে দেখলেন, সবচেয়ে ভালো হয় মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি করে দিলে। তার ভাই ভ্যাসিলি মস্কোতেই থাকে, তার আর্থিক অবস্থা ভালো, এই অবস্থায় তার কাছে গেলে সে কি ফেলে দিতে পারবে?

ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন মারিয়া।

* * *

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। মস্কো পৌঁছাতে লেগে গেল অনেকগুলো সপ্তাহ। পথশ্রমে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত মারিয়া মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে দিমিত্রিকে ভর্তির জন্যে নিয়ে গেলে তাঁকে জানানো হল, সরকার নিয়ম করেছে, দেশজুড়ে সমস্ত ছাত্রদের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করতে হবে। সাইবেরিয়ার ছাত্রদের জন্যে আছে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়, সেটাও টোবোলস্ক থেকে হাজার দেড়েক কিলোমিটার দূরে, তবে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তি করা যাবে না। মারিয়া বললেন, তাঁর ভাই থাকে মস্কোতে। উত্তর এল, ভাইয়ের ছেলেরা চাইলে ভর্তি হতে পারে, ভাগনেরা নয়।

দিমিত্রির মুখের দিকে তাকালেন মারিয়া। যে-করেই হোক, একে একটা ভালো সিঁড়ি ধরিয়ে দিতেই হবে। বাবা বেঁচে নেই, মা হয়ে সেই কর্তব্য তাঁকে পালন করতেই হবে। কাজান বিশ্ববিদ্যালয় ফালতু, ওখানে পড়াশোনা করে কিচ্ছু হবে না।

পরদিনই তিনি আবার ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। এবারের গন্তব্য সেন্ট পিটার্সবার্গ, সেখানেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেটা মস্কো থেকে আরও সাতশ কিলোমিটার দূরে।

bigganmendeleev02

সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, সেখানেও একই ব্যাপার, সাইবেরিয়ার ছাত্রদের জন্যে নিষিদ্ধ। চোখে অন্ধকার নেমে এল মারিয়ার। এতদিনের ছোটাছুটির ধকল তো আছেই, সঞ্চয়ের পুঁজি শেষ হয়ে আসছে, তার ওপর এই লাল ফিতের চোখরাঙানি। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতোই যখন অবস্থা, তখন প্রায় দেবদূতের মতোই তাঁর সাক্ষাৎ হল পরলোকগত স্বামীর বাল্যবন্ধু চিজভের সঙ্গে, তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের চিফ পেডাগজিক্যাল ইন্সটিটিউটে ইভানের সহপাঠী ছিলেন, তখন ওখানকার অধ্যাপক। এই প্রতিষ্ঠান সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই, আগে সেখানে শুধু শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হত, তখন অবশ্য ছাত্রদের উচ্চশিক্ষাও দেওয়া হয়। তাঁর সাহায্যে দিমিত্রির একটা অ্যাডমিশন টেস্টের ব্যবস্থা হল।

এও অবশ্য শর্তসাপেক্ষে। শর্ত হচ্ছে এখানে যত বছর কেউ পড়বে, তার অন্তত দ্বিগুণ বছর ওখানে পড়াতেও হবে বাধ্যতামূলকভাবে। প্রতি দু-বছর পরপর ছাত্র নেওয়া হয়, এ-বছর ছাত্রভর্তির বছর নয়, কাজেই এখন কেউ ভর্তি হলে তাকে দু-বছর একই ক্লাশে পড়তে হবে এবং অ্যাডমিশন টেস্টে অবশ্যই উতরোতে হবে।

দিমিত্রি যে পড়াশোনায় খুব ভালো, তা তো নয়। ভর্তির পরীক্ষায় তার স্কোর হল পাঁচের মধ্যে সওয়া তিনের কাছাকাছি। সেটা অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পক্ষে ও তার ডর্মিটরিতে থাকার পক্ষে যথেষ্ট।

শরীর ও মনের ওপর এত অত্যাচার সহ্য হল না মারিয়ার। দিমিত্রির ভর্তির তিন মাস পরেই তিনি মারা গেলেন কালান্তক যক্ষ্মারোগে। মৃত্যুশয্যায় তিনি ছেলের হাত ধরে মৃদু স্বরে বলেছিলেন, ‘শোন খোকা, আমাদের এত যে পরিশ্রম হল, এত টাকাপয়সা খরচা হল, সব শুধু তোর মুখ চেয়ে। তুই পড়াশোনা শিখবি, মানুষের মতো মানুষ হবি, এ-ছাড়া আমার তো আর কিছু চাইবার নেই, কখনও ছিলও না। মন দিয়ে পড়াশোনা করিস বাবা। দিদিকে দেখিস। টাকাপয়সার দরকার হলে মামাকে চিঠি লিখিস।’

মা যে তাকে ছেড়ে চলে যাবে, এ তো জানা ছিল না দিমিত্রির। সে কান্নাকাটি করল সারাদিন ধরে, তারপর তার ডায়েরি খুলে খসখস করে লিখতে লাগল কয়েকটা লাইন।

বছরের শেষে পরীক্ষায় দেখা গেল, ক্লাশের আঠাশটা ছেলের মধ্যে তার স্থান পঁচিশ নম্বরে। সমস্ত বিষয়ে সে পাঁচের মধ্যে দুই থেকে সাড়ে তিনের মধ্যে স্কোর করেছে, একমাত্র রসায়নে পৌনে চার।

পরের বছর একই ক্লাশে থাকল দিমিত্রি। সেটা জানাই ছিল, তাই ততটা মনখারাপের কারণ ছিল না। যেটা জানা ছিল না, তা হচ্ছে সে-বছর তার দিদি লিজাও মায়ের পথ ধরে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল। তার ভরণপোষণের খরচা দেয় মামা ভ্যাসিলি।

পরের বছর ১৮৫২ সাল। পাঁচ বছরের কোর্সের ক্লাশের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এখন দিমিত্রি। ক্লাশ চলাকালীনই একদিন খবর এল, মস্কোতে মামা ভ্যাসিলি মারা গেছেন। এখন থেকে তাকে শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে না, সেটা যাতে করা সম্ভব হয়, তার জন্যে তাকে রোজগারও করতে হবে। মায়ের কথা অহরহ মনে পড়ে তার। তার যখন জন্ম হয়েছিল, তখন মায়ের বয়স একচল্লিশ। বেশি বয়সের সন্তান বলেই তাকে আগলে রাখতেন সর্বদা। তাকে নিয়েই ছিল মায়ের যত চিন্তা। মাঝে মাঝে সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখে মায়ের কথা। সেগুলো পরে আবার খুলে খুলে পড়ে।

১৮৫৩ সাল। ক্লাশে পড়াশোনার মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ল দিমিত্রি। ভয়ংকর কাশি শুরু হয়েছে তার, কাশির সঙ্গে উঠে আসছে রক্ত। প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার তাকে দেখে রায় দিলেন, বেশিদিন বাঁচবে না। তার যে মা নেই, দিদি মারা গেছে, ভরণপোষণ দিতেন যিনি সেই মামাও পরলোকগত—এ-খবর ক্লাশের কারও অজানা নয়। ক্লাশের বন্ধুরা তাকে খুবই ভালোবাসে। কয়েকজন অধ্যাপকও। তাঁরাই তাকে অর্থসাহায্য করেন, ওষুধ-বিষুধ কিনে দেন।

১৮৫৪ সাল। দিমিত্রির বয়স কুড়ি বছর। তার শারীরিক অবস্থার অনেকটা অবনতি হয়েছে ততদিনে, কিন্তু ডাক্তারের রায় অমান্য করে সে তখনও বেঁচে আছে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের হাসপাতালে। সেখানেই তার দিন কাটে। ক্লাশের ছাত্ররা পালা করে এসে তাকে দেখে যায়। তারা সঙ্গে নিয়ে আসে ক্লাস-নোট। দিমিত্রি প্রায় সারাদিনই অবসন্ন অবস্থায় থাকে। যখন শরীরে একটু জোর পায়, তখন ক্লাস-নোট উলটেপালটে দেখে। পরীক্ষার মাস খানেক আগে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেল সে। বসল পরীক্ষায়। পরীক্ষার ফল বেরোলে জানা গেল, সে ক্লাসে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে।

পরের বছর শেষ পরীক্ষা। পাশ করে গেলে চুক্তি অনুযায়ী অন্তত দশ বছর এখানে পড়াতে হবে। মায়ের কথা ভেবেই সে নিজের মনে জোর আনে, পড়তে বসে সময়মতো। গত ক’বছরে এখানে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তাকে ছাত্র-গবেষণা করতে হয়েছে। তার মতো এত বিভিন্ন বিষয়ে কেউ গবেষণা প্রবন্ধ লেখেনি। সেগুলোর শীর্ষক দেখলেই তাক লেগে যায়। চিনের প্রাথমিক শিক্ষা, সেন্ট পিটার্সবার্গ অঞ্চলের ইঁদুর, প্রাণীজগতের বিস্তারের ওপর তাপের প্রভাব, প্রাচীন উদ্ভিদসমূহ, আমব্রার অজৈব বিশ্লেষণ, পাইরক্সিনের বিশ্লেষণ ইত্যাদি। অধ্যাপকরা জানেন দিমিত্রির এই গুণাবলি, তাঁরাও তাকে উৎসাহিত করতে থাকেন।

সে বছর শেষ পরীক্ষার ফল যখন জানা গেল, সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দিমিত্রি বিবশ হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। ডায়েরির পাতা উলটে বের করল পাঁচ বছর আগের একদিনের লেখা। মায়ের মৃত্যুশয্যায় মা তাকে বলে গেছিলেন যে-কথাগুলো, সেগুলো এই – মরীচিকার পেছনে ছুটবে না, দিমিত্রি। কথা নয়, কাজে যেন মতি থাকে তোমার। ধৈর্য সহকারে অন্বেষণ করে যাবে ঐশ্বরিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যের।

পড়তে পড়তে চোখ ভরে জল এল তার। সে-জল গড়িয়ে পড়ল সার্টিফিকেটটার ওপর। সেখানে সুচারু হস্তাক্ষরে লেখা—১৮৫৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র ও স্বর্ণপদক পুরস্কার বিজয়ী দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিভ।

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s