FUNবিজ্ঞান-স্থির অস্থির -প্রণব নাথ চক্রবর্তী- শরৎ২০২২

Untitled-1

আমি তখন খুবই ছোটো। আমার ঠাকুমা প্রায়ই আমায় বলতেন, ‘তুই বড়ো চঞ্চল।’ তিনি বলতেন, ‘চুপচাপ বসে থাকা তোর কুষ্ঠিতে লেখা নেই। তাই দিনরাত এদিক ওদিক দৌড় দিস। এইবার আমার কাছে একটু স্থির হয়ে বস তো দেখি। স্থির হয়ে বসে থাকার অভ্যাস করতে হয়।’

কাকে স্থির বলে আর কাকে অস্থির বলে, সেই রহস্যটা ঠাকুমার কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলাম। আমি যখন ঠাকুমার পাশে থাকি অথবা ঠাকুমার আশেপাশে ঘুরঘুর করি তখন আমি স্থির।

তবে দাদার মতামত একেবারে আলাদা ছিল। দাদা আমায় কেরিয়ারে বসিয়ে সাইকেল চালাত। দাদা বলত, ‘একদম চুপ করে থাক। খবরদার নড়াচড়া করবি না।’ আমি প্রাণপণে স্থির হয়ে বসে থাকতাম। দাদা খুশি হয়ে বলত, ‘তুই চমৎকার স্থির হয়ে বসতে জানিস। তোকে পেছনে নিয়ে সাইকেল চালাতে কোনোরকম অসুবিধাই হয় না।’

ঠাকুমা না দাদা, কে বেশি ঠিক? এই রহস্যের সমাধান করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে তোমরা হয়তো বুঝতে পারবে। তাই ওই ধাঁধার একটা ছবি দিলাম। চেষ্টা করে দেখো।

Untitled-1

ছোটবেলার বুদ্ধি দিয়ে ভেবে ঠিক করলাম, বাবাকে পাকড়াতে হবে। বাবা জ্ঞানী মানুষ, উনি নিশ্চয় বলতে পারবেন। এই ভেবে একদিন বাবার কাছে গেলাম। বাবা গম্ভীর মুখে সামনের বারান্দাতে পায়চারি করছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল। অগত্যা বাবার পথ আটকে আমার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম। বাবা বললেন, ‘একদম ঝামেলা করবি না। আমাকে একটু স্থির হয়ে চিন্তা করতে দে।’ এই বলে বাবা আবার সেই পায়চারি শুরু করলেন। বুঝলাম, এই পায়চারি করাটাই বাবার স্থির হয়ে থাকা। আর পায়চারি থামালেই ঝামেলা অর্থাৎ অস্থিরতা।

১। কে স্থির আর কে অস্থির?

এটা ‘স্থির’ আর ওইটা ‘চলন্ত’ বললে একটা ধোঁয়াশা থেকেই যাবে। কার তুলনায় স্থির আর কার তুলনায় চলন্ত, সেই কথাটা বলতেই হবে। তাহলে ‘স্থির’ আর ‘চলন্ত’ শব্দ দুটো একেবারেই মূল্যহীন হয়ে যাবে।

মনে করি, একটা চলন্ত ট্রেনের কামরার মধ্যে কয়েকজন লোক বসে আছে। ট্রেনটা একটা ছোটো রেল-স্টেশনের পাশ দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে। ওই স্টেশনের বেঞ্চিতে ক’জন লোক চুপচাপ বসে আছে। অনেকক্ষণ স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে থাকায় খুব ঘুম পাচ্ছিল। একজন বলে উঠল, ‘ওই ট্রেনের লোকগুলো কী জোরে ছুটে চলে গেল। চেষ্টা করেও কারও মুখ চেনা গেল না। অত জোরে ছুটলে কি লোক চেনা যায়?’

Untitled-1

ওই ছুটন্ত ট্রেনের কামরার একটা বেঞ্চে বসে ক’জন লোক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, ‘গত তিন-চার ঘণ্টা ধরে এই বেঞ্চে স্থির হয়ে বসে আছি। এবার একটু নড়াচড়া না করলে তো হাত-পা সব জমে যাবে। যখন কোনও স্টেশনে ট্রেনটা থামবে, তখন নড়াচড়া করার সুযোগ পাব।’

এই ঘটনার সামান্য একটু গভীরে ঢুকছি। মনে করি একজন বিজ্ঞানী চাঁদে বসে আছেন। তিনি টেলিস্কোপ দিয়ে ওই স্টেশনের আর ছুটন্ত ট্রেনের ছবি তুলছেন। তিনি দেখছেন, পৃথিবীটা লাটুর মতো বনবন করে ঘুরছে। সেই সঙ্গে ওই রেল-স্টেশনটাও বনবন করে ঘুরছে। ওই স্টেশনটা যদি স্থির হয়ে থাকত, তবে অনেক ভালো ছবি তোলা যেত।

পৃথিবীর পরিধি = 40008 KM আর পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় এক পাক খায়। বিষুবরেখার কাছাকাছি মাঠঘাট, ঘণ্টায় 1700 KM বেগে ছুটছে।

ঘটনার আরও গভীরে ঢুকে কাজ নেই। আসলে আমাদের চাঁদমামাও তো স্থির হয়ে বসতে জানেন না। মাস ফুরিয়ে যাবার আগেই এই পৃথিবীর চারদিকে এক পাক শেষ করেন। তাই আর গভীরে ঢুকব না।

২। অস্থির এক দৌড়বীর।

একটা গল্প মনে পড়ে গেল। ম্যারাথন দৌড় আরম্ভ হয়েছে। অনেক প্রতিযোগী রাস্তায় ছুটছে। এক প্রতিযোগী একটা লরির উপরে উঠে দৌড় শুরু করল। সেই লরিটা ওই প্রতিযোগীকে নিয়ে অন্য সব প্রতিযোগীদের হারিয়ে দিয়ে আগেভাগে ম্যারাথনের ফাইনাল পয়েন্টে পৌঁছে গেল। লরিতে চড়া প্রতিযোগীর দাবি, সে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। তাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে। তার যুক্তি, সে পুরো ম্যারাথনের রাস্তা দিয়েই এসেছে। সারাটা পথ দৌড়েছে, একবারও থামেনি। তাই প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কারটা তাকেই দিতে হবে।

Untitled-1

কিন্তু দুঃখের (আনন্দের?) বিষয়, কেউই তার কথায় কান দিল না। সবাই বলল, ‘তুমি আসলে একই জায়গাতে দৌড়চ্ছিলে। ওই লরির তুলনায় তোমার গতিবেগ তো শূন্য ছিল। পুরস্কার নয়, তোমার প্রাপ্য তিরস্কার।’

লরিতে চড়া প্রতিযোগী নতুন এক যুক্তি দিল, ‘ধরো, একটা জাহাজ দ্রুত গতিতে চলছে। সেই জাহাজের ডেকের উপরে দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তখন কি তোমরা জাহাজের গতিবেগ নিয়ে মাথা ঘামাও? তাহলে

লরিটা থেমে ছিল না চলছিল, এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? যে প্রতিযোগীকে তোমরা প্রাইজ দিতে চাও, তার পাশে পাশে একই গতিতে যদি লরিটাকে চালাতাম? লরির তুলনায় তার গতিবেগ তো শূন্য থাকত। তখন কি তার প্রাইজ কেড়ে নিতে?’

চিঁড়ে কিন্তু ভিজল না। উলটে সকলে মিলে তাকে বোঝাল—‘জাহাজের প্রতিযোগীদের গতিবেগ জাহাজের তুলনায় মাপা হয়েছে। তোমার গতিবেগ লরির তুলনায় মাপা হবে। লরির তুলনায় তোমার গতিবেগ তো শূন্য ছিল।’

যদি কোনও সময় লরির রেস হয়, তবে রাস্তার তুলনায় লরির গতিবেগ মাপা হবে। এটা মানুষের রেস, লরিকে প্রাইজ দেওয়া হবে না। লরিতে চড়া দৌড় বীরের লরির ভাড়াটা বৃথা (?) গেল। প্রাইজ পাওয়া গেল না।

তবে একটা নতুন জ্ঞান লাভ হল। স্থির না গতিশীল, জানতে চাইলে কার তুলনায় স্থির আর কার তুলনায় গতিশীল তা বলতেই হবে। নয়তো কথাটার কোনও মানেই থাকবে না।

এই দুনিয়ায় বস্তু হয়ে জন্মালে এই তুলনামূলক স্থির অস্থির আইনকে মানতেই হবে। কোনও বস্তুই (পদার্থ) ‘স্থির অস্থির’ আইনের ছাড় পায় না।

(তুলনা করলে তবে ‘স্থির অস্থির’, নইলে কিছুই নয়।)

আলো, তাপ, বেতার তরঙ্গ ইত্যাদি কিন্তু বস্তু (পদার্থ) নয়। এইসব অপদার্থ হয়ে জন্মালে তুলনামূলক স্থির অস্থির আইনের ছাড় পাওয়া যায়। সোজা কথা একবার অপদার্থ বনে গেলে তুলনা-টুলনা মাথায় উঠে যাবে।

(অপদার্থ হলে তখন ‘তুলনামূলক’ শব্দটা ব্যবহার করা যাবে না।)

আলো, তাপ, বেতার তরঙ্গ, মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি অবস্তুদের একটি মাত্র গতিবেগ হয়। সেই গতিবেগকে আলোর গতি (C) বলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা এই আলোর গতির মাপজোক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে C-কে মাপা সম্ভব হচ্ছিল না। দুটো মস্ত ঝামেলা বিজ্ঞানীদের পথ আগলে বসে ছিল।

প্রথম ঝামেলা, ‘সেকেন্ডের সঠিক মাপ’ কেমন করে পাওয়া যাবে? আগে মানুষ ভাবত যে, পৃথিবীর বছরগুলো সমান লম্বা। তাই ওই বছরকে সমান ভাগে ভাগ করে করে সেকেন্ড তৈরি হয়েছে। কিন্তু আণবিক ঘড়ি (Atomic Clock) আবিষ্কারের পরে বোঝা গেছে, পৃথিবীর বছরগুলো সমান নয়। তবে ভুলের পরিমাণটা খুবই কম। বছরে মোটামুটি আধা সেকেন্ডের মতন ভুলচুক হয়। এই ভুলটা গোঁজামিল দিয়ে সামলানো হয়। কীভাবে গোঁজামিল দেওয়া হয়, তার হিসাব দিচ্ছি।

বছরের মাপের ভুলটা যদি আধা সেকেন্ডের কম হয়, তখন তাকে ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দেওয়া হয়। যথা নিয়মে, ৩১শে ডিসেম্বর, রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৬০ সেকেন্ডের পরেই নতুন বছর শুরু হয়। কোনও বছর হয়তো আধা সেকেন্ডের থেকেও বেশি ছোটো হয়ে গেছে। তাকে সামাল দেবার জন্য বছর শেষ হবার এক সেকেন্ড আগেই ওই নতুন বছর শুরু হয়। ঘড়িতে ওই ৬০ নম্বর সেকেন্ডটা বাজার সুযোগই পায় না। রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডের পরেই নতুন বছর চালু করা হয়।

কোনও বছরটা হয়তো আধা সেকেন্ডের থেকেও বেশি লম্বা হয়ে গেল। তখন ওই ভুলটা সামাল দেবার জন্য বছরকে এক সেকেন্ড বেশি লম্বা করা হয়। ওই বছরের শেষ দিনে ঘড়িতে রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৬১ সেকেন্ড বাজে। তারপরে নতুন বছর শুরু হয়।

Untitled-1

এই সময়কে UTC (Coordinated Universal Time) বলে। এই UTC আর GMT-র মধ্যের ফারাকটাকে ০.৯ সেকেন্ডের বেশি হতে দেওয়া হয় না। ফারাকটা ০.৯ সেকেন্ডের বেশি হলেই শেষ সেকেন্ডটা হয় ঘ্যাচাং, নয়তো ৬০ পরে ৬১ নম্বর সেকেন্ড জুড়ে দেওয়া হবে।

বছরে ০.৯ সেকেন্ডের ভুল! সেই ঘড়ির সেকেন্ড দিয়ে আলোর গতি মাপা? কী লজ্জার কথা! সবাই তো ছিঃ ছিঃ করবে। মানুষের মাথার বুদ্ধি তো শেষ হয়ে যায়নি। ওই বুদ্ধি দিয়ে একটা নিখুঁত ঘড়ি বানালেই হয়।

৩। সব থেকে ভালো ঘড়ি

নিখুঁত ঘড়ি কেমন করে বানানো যায় এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক চিন্তাভাবনা করেছেন। তারা দেখলেন যে, Cesium 133 পরমাণুর বিকিরণের কম্পন পৃথিবীর পাক খাওয়ার তুলনায় অনেক বেশি নিখুঁত। ওই সিজিয়াম পরমাণু প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 9192631770 বার কাঁপে। কম্পন সংখ্যার আগে ‘প্রায়’ শব্দটা ব্যবহার করতে হয়েছে। অর্থাৎ খাঁটি নিখুঁত মাপ নয়, অল্পস্বল্প ভেজাল আছে। মাপের কোনও দোষ নেই। ভালো করে মাপলাম। তারপর আরও ভালো করে মাপলাম। তারপর আরও আরও ভালো করে মাপলাম। এই আরও আরও আরও লিস্টের শেষ নেই।

বিজ্ঞানীদের মাথাভরা গিজগিজে বুদ্ধি। তারা এক নতুন উপায় বার করলেন। নিখুঁতভাবে সিজিয়াম পরমাণুর কম্পন সংখ্যা মাপার কাজ বন্ধ করে দিলেন। তার বদলে চালু সেকেন্ডের মাপটাকেই বদলে দিলেন।

Cesium 133 পরমাণু 9192631770 বার কম্পনের জন্য যতটা সময় নেয়, সেই সময়টাকে নতুন সেকেন্ড বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। এই নতুন সেকেন্ড দিয়ে তৈরি ঘড়ির নাম Atomic Clock (আণবিক ঘড়ি)।

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ- পার্থ চক্রবর্তী

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

1 thought on “FUNবিজ্ঞান-স্থির অস্থির -প্রণব নাথ চক্রবর্তী- শরৎ২০২২

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s