FUNবিজ্ঞান- বিপন্ন মেরুভল্লুক-ড. উৎপল অধিকারী -শরৎ২০২২

এই লেখকের আগের লেখা- শব্দ দূষণ প্রতিরোধী গ্রিন মাফলার

bigganmerubholluk

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শ্বাপদ বর্গের স্তন্যপায়ী প্রাণী হল মেরুভাল্লুক বা শ্বেতভাল্লুক। পৃথিবীতে মোট আটরকম প্রজাতির ভাল্লুক পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম হল শ্বেত ভল্লুক। প্রধানত উত্তর মেরু ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে এই প্রাণীটি বাস করে। এছাড়াও রাশিয়া, জার্মান, চিনের সাংহাই অঞ্চল, কানাডা, আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড ও নরওয়ে ইত্যাদি অঞ্চলগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে প্রাণীটির দেখা মেলে। দুধসাদা এই ভল্লুকের দেহের ওপরের দিকে পশমের মতো নরম এবং সাদা রোম থাকলেও তার ঠিক নীচে ঘন কৃষ্ণবর্ণের  ত্বক দেখা যায়। সাদা বর্ণের জন্য এরা বরফের দেশে অবাধ বিচরণ করলেও সহজে এদের চেনা যায় না। এটি একপ্রকার ক্যামোফ্লেজ। বাঘের চেয়ে বড়ো এই প্রাণীটির পুরুষদের ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোগ্রাম এবং স্ত্রীদের ওজন ২০০ থেকে ৩০০ কিলোগ্রাম এবং এরা সাধারণত ১.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের ত্বকের নীচে পুরু চর্বি সঞ্চিত থাকার কারণে সহজেই এরা প্রবল ঠান্ডাকে প্রতিহত করতে পারে। পেট ভর্তি করে খাবার খেয়ে এরা দীর্ঘদিন না খেয়েও থাকতে পারে ও দীর্ঘদিন পর্যন্ত শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে পারে, যা অত্যন্ত প্রতিকূল ও হিমশীতল পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য খুবই উপযোগী। এদের প্রিয় খাবার হল সমুদ্রের সিলমাছ। এছাড়াও এরা হরেকরকমের মাছ, জলজ পাখি, পাখির ডিম ইত্যাদি সহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী পেট পুরে খেয়ে নেয়। বিভিন্ন স্থলজ প্রাণী হত্যা করে ভক্ষণ করতেও এদের দেখা যায়। এরা শিকার করা প্রাণীর ত্বক এবং চর্বি খেতে খুব পছন্দ করে। একজন সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক, ক্ষুধার্ত ভাল্লুক প্রায় ১৫ কেজি মতো খাবার খেতে পারে। অনেক সময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা মানুষকে আক্রমণ করে হত্যা করে এবং তার মাংস ভক্ষণ করে। প্রাণীটির ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত তীব্র। এরা বরফের এক মিটার স্তরের নীচেও কোনও কাঙ্ক্ষিত শিকারের গন্ধ নিতে পারে। এদের নাকটি বেশ সংবেদনশীল। পুরোপুরি আমিষাশী, শিকারি এই প্রাণীটির পাগুলি শক্তিশালী, থাবাগুলি বড়ো, পায়ের তলায় পুরু চামড়া ও রোম থাকে। থাবাগুলি ভাল্লুককে সাঁতারেও বিশেষ সহযোগিতা করে। এখানে বড়ো বড়ো ধারালো নখ থাকে, যেগুলি শিকারের সময় এদের সাহায্য করে। শক্তিশালী চোয়ালগুলিতে মোট ৪২টি দাঁত আছে এবং রোমশ লেজটি ৭ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা।

এরা ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত অক্লান্তভাবে হাঁটতে পারে এবং প্রয়োজনে প্রতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতেও পারে; অত্যন্ত তীব্রতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে শিকার ধরতে পারে। সাদা ভল্লুক কখনো-কখনো ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার বেগে হিমশীতল জলে সাঁতার কাটে। উত্তর মেরুর সমুদ্র উপকূল পরিদর্শনকারী ভ্রমণকারীরা দৃশ্যটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। মেরু অঞ্চলে যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে চলে যায়, তখনও এই প্রাণীটি ওই অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ায়। এদের আয়ুষ্কাল মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। অন্যান্য প্রজাতির ভাল্লুকের চেয়ে মরু ভাল্লুক দেরিতে প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। এরা সাধারণত একলা থাকতেই বেশি পছন্দ করে, তবে প্রজননের আগের মুহূর্তে স্ত্রী এবং পুরুষ একসঙ্গে বাস করে এবং সন্তান জন্মানোর পরও বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকে। জন্মের তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এই প্রাণীগুলি প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। এদের সঙ্গমের মরশুম হল মার্চের শেষ থেকে জুন পর্যন্ত। এরা একসঙ্গে ১-৩টি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের সময় বাচ্চার ওজন খুবই কম থাকে, মোটামুটি ৫০০ গ্রামের মতো। সেই সময় এদের চোখ ফোটে না। জন্মের এক মাস পর এরা প্রথম পৃথিবীর আলো দেখে। এই সময় এদের দেহটি পাতলা পশমের মতো রোম দ্বারা আবৃত থাকে। মা তাদের শরীরের তাপ দিয়ে এদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। বাচ্চার দেড় বছর বয়স পর্যন্ত পিতা-মাতা সর্বতোভাবে তাদের রক্ষা করে। এই সময় তারা প্রজননে লিপ্ত হয় না ও গর্ভধারণও করে না। বাচ্চা বড়ো হওয়ার পর মা ভাল্লুক আবার গর্ভবতী হয়। একজন স্ত্রী মেরু ভল্লুক তাদের জীবদ্দশায় প্রায় ১৫টি সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা রাখে। ভাল্লুক মা, মানুষের মায়ের মতোই মমতাময়ী। বাচ্চা জন্মানোর আগেই সমুদ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরে এরা মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রাখে এবং গর্ভাবস্থায় বেশিরভাগ সময় ওই গর্তের মধ্যে দিন কাটায়। এই সময়ে এরা মোটামুটি আশি থেকে নব্বই দিন বিশ্রামরত অবস্থায় থাকে। শাবকেরা যখন ছোটো থাকে, তখন মায়েরা প্রবল প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। যেনতেন প্রকারেণ এরা এদের সন্তানকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তখন তারা আগ্নেয়াস্ত্রও ভয় পায় না বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে মেরু অঞ্চলের অতি প্রতিকূল পরিবেশের জন্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্বেত ভল্লুকের পঞ্চাশ শতাংশ শাবক জন্মের ১০ দিনের মধ্যেই মারা যায়।

তবে বর্তমানে শ্বেত ভল্লুক আই.ইউ.সি.এন-এর রেড ডাটা বুকের তালিকায় ভালনারেবল প্রাণী। মানুষের লোভ, চোরা শিকারির আক্রমণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের দাপট ও বিভিন্ন দূষণের ফলস্বরূপ তাদের সংখ্যা পৃথিবীতে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে পৃথিবীর উপরে মোট বরফের পরিমাণ পঁচিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। হিমবাহের বরফ গলে যাচ্ছে। তার ফলে এই প্রাণীটি তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে। রাশিয়ার একটি প্রত্যন্ত রাজ্যে একবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল কেবলমাত্র শ্বেত ভল্লুকের দৌরাত্ম্যের জন্য। তারা ওই রাজ্যের বিভিন্ন লোকালয়, অফিস, বাড়ি ইত্যাদি জায়গায় ঢুকে পড়েছিল এবং মানুষকে অকস্মাৎ আক্রমণ করছিল। বাসস্থানের অভাব এবং খাদ্যের অপ্রতুলতাই এর কারণ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত এই মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা প্রায় ২২ থেকে ৩১ হাজার মতো। কিন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের সংখ্যা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। তাই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সাধারণ জনগণ, সরকার সর্বতোভাবে এগিয়ে এসেছে বিপন্ন এই প্রাণীটিকে থেকে রক্ষা করতে। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আর্টিক অববাহিকার দেশগুলি একটি সংরক্ষণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রাণীটিকে রক্ষা ও তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য জার্মান, রাশিয়াসহ আই.ইউ.সি.এন-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ব্যাপকভাবে কাজ করে চলেছে।

bigganmerubholluk02

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ‘সোচি শীতকালীন অলিম্পিক’-এর প্রতীক ছিল এই প্রাণীটি। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট, কানাডা ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশের মুদ্রায় এদের ছবি ব্যবহার করা হয়ে  থাকে। এছাড়াও উত্তর মেরু অঞ্চলে মানুষের লোককথায়, গল্পে, বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এরা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাশিয়া, জার্মান ও সাংহাই বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় তাদেরকে সংরক্ষণ করছে। অর্থাৎ এক্স-সিটু এবং ইন-সিটু উভয় পদ্ধতিতেই তাদের সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এস্কিমোদের কিংবদন্তি অনুসারে, প্রকৃতির শক্তির প্রতীক হল এই শ্বেত ভল্লুক। তাই তারা বিভিন্ন হাড়, কাঠ, পাথর ইত্যাদিতে এদের অবয়ব খোদাই করে রাখে। তাদের ধারণা, এই মূর্তিগুলি তাদের পরিবারের শক্তি এবং সৌভাগ্যকে সূচিত করে। বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন, চকলেট ইত্যাদিতে ‘পোলার বিয়ার’-এর ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে মানুষের সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে এই নিরীহ, রাজকীয় ও বিপন্ন প্রাণীটিকে বিপদ থেকে। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই প্রাণীটিকে দেখার সুযোগ পাবে।

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s