FUNবিজ্ঞান-নিলামের গল্প(পর্ব৭)-স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায়-শরৎ২০২২

নিলামের গল্প (পর্ব ১), পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪, পর্ব ৫, পর্ব ৬

আচ্ছা, নিলামে ক্রেতারা কী ভেবে দর হাঁকে আর বিক্রেতারাই বা কী ভেবে নিলামের নিয়মকানুন ঠিক করে?

এটা বুঝতে হলে আবারও ফিরে যেতে হবে অঙ্কের কাছে।

যারা যারা নিলামে অংশগ্রহণ করছে, তাদের প্রত্যেকেরই কিছু একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, যে উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে সে কাজ করছে, সে ক্রেতাই হোক বা বিক্রেতা। এই ক্রেতা আর বিক্রেতাদের উদ্দেশ্যের ব্যাপারটা অঙ্ক দিয়ে চমৎকারভাবে বোঝানো যায়, তবে তার জন্য আরও কয়েকটা ছোটো ছোটো বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। নিলামে তোলা বস্তুগুলোর সম্পর্কে ক্রেতাদের মূল্যায়নের কথা আমরা আগেই জেনেছি – কোন বস্তুর জন্য কোন ক্রেতা সর্বোচ্চ যত মূল্য দিতে ইচ্ছুক সেটাই তার ঐ বস্তু সম্পর্কে মূল্যায়ন বা valuation। আমরা এও জেনেছি যে এই মূল্যায়ন আসছে বস্তু থেকে পাওয়া তার উপযোগিতা অনুযায়ী, মানে বস্তুটা কারুর কাছে থাকার জন্য সে ব্যবহারিকভাবে বা নিছক আনন্দলাভ করে কতটা উপকৃত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে। এদিকে আবার বস্তুটা পেতে গেলে তাকে তো কিছু খরচও করতে হচ্ছে। এখন ব্যাপার হল বেশিরভাগ মানুষই খরচ করে পাওয়ার চাইতে নিখরচায় কিছু পেতে বেশি পছন্দ করে, আর কোন বস্তুর জন্য খরচের পরিমাণ যত বাড়ে, ক্রেতার কাছে তার উপযোগিতা ততই কমতে থাকে। সুতরাং নিলামে কিছু কেনার পর ক্রেতার উপযোগিতা আদতে ঐ বস্তুটা পাওয়ার উপযোগিতা আর তার জন্য খরচের পরিমাণের তফাতের সমান। এই তফাতটাকে যদি আমরা নেট (net) উপযোগিতা বলে ডাকি, তাহলে ক্রেতারা সবসময়েই এমনভাবে কেনাকাটা করতে চাইবে এই নেট উপযোগিতা সবচেয়ে বেশি হয়। আরেকটু ভেঙে বললে, যদি ক্রেতার মূল্যায়নকে v আর তার খরচকে p বলে ডাকা হয়, তাহলে ক্রেতার নেট উপযোগিতা হবে (v – p) এর সমান বা (v – p) এর কোন অপেক্ষক।

[এখানে বলে নেওয়া দরকার যে নেট উপযোগিতা সবসময় যে বস্তু থেকে পাওয়া উপযোগিতা আর খরচের তফাতের সমান হবে এমন নাও হতে পারে, নেট উপযোগিতা এই তফাতের কোনও অপেক্ষকও হতে পারে। সবচেয়ে সরল পরিস্থিতিতে আমরা ধরে নিতে পারি যে নেট উপযোগিতা আর বস্তু থেকে পাওয়া উপযোগিতা ও খরচের তফাত একে অন্যের সমান।]

অন্যদিকে বিক্রেতারা কি করে? এটাও আমরা আগে জেনেছি যে বিক্রেতাদের মূলত দুরকমের উদ্দেশ্য হতে পারে – সুদক্ষ বণ্টন, অথবা সর্বোচ্চ বিক্রয়লব্ধ আয়। এই দুটোর সঙ্গেই কিছু না কিছু একটা সবচেয়ে বেশি করার ব্যাপার জুড়ে আছে। যেমন সুদক্ষ বণ্টনের কথাই ভাব, এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হল সর্বোচ্চ সামাজিক কল্যাণ সুনিশ্চিত করা। আর সর্বোচ্চ বিক্রয়লব্ধ আয়ের ক্ষেত্রে তো আর আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজনই নেই।

তাহলে এবার যে প্রশ্নটা উঠে আসছে সেটা হল এই ক্রেতা বা বিক্রেতারা এই “সবচেয়ে বেশি”টা কিসে হবে বুঝতে পারবে কেমন করে? এখানেই তো অঙ্ক আমাদের ভরসা। অঙ্কের ভাষায় এই “সবচেয়ে বেশি” ব্যাপারটাকে একটা বিশেষ নামে ডাকা হয় – চরম মান (extreme values)।

সত্যি বলতে কি “সবচেয়ে কম”ও কিন্তু এই চরম মান গোত্রে পড়ে। আরও মজার ব্যাপার হল এই দুজনকেই খুঁজে পাওয়ার প্রথম ধাপটা কিন্তু  একই। তাই এই “সবচেয়ে বেশি” বা “সবচেয়ে কম” যেন অনেকটা সহোদর ভাইবোনের মত, একই মা-বাবার সন্তান, কিন্তু আলাদা ব্যক্তি।

কিন্তু অঙ্ক বললে একটা অনেক বড় পরিধি বোঝায়, এই চরম মান খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ধরণের অঙ্কটা লাগছে তার নাম তোমরা অনেকেই শুনেছ – তার নাম কলনবিদ্যা বা ক্যালকুলাস, যাকে বাংলায় ডাকা হয় কলনবিদ্যা নামে। এই ক্যালকুলাস একটা বড় মজার জিনিস। বিভিন্ন চলরাশির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন ও তার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে এর কোন জুড়ি নেই। খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ গণিতবিদ ও বৈজ্ঞানিক আইজ্যাক নিউটন এবং জার্মান গণিতবিদ গটফ্রিড উইলহেলম লিবনিজ আলাদা আলাদা ভাবে গণিতের এই শাখাটির উদ্ভাবন করেন। এই বিষয়ে দুজনের লেখাই প্রায় একই সময় প্রকাশিত হয়। তবে এতে ব্যবহৃত গণিতের ধরণের আভাস ইতিপূর্বে প্রথমে প্রাচীন গ্রীস, তারপরে চীন এবং তারপর মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও ভারতে পাওয়া যায়।

ক্যালকুলাস নামটা কেমন করে এলো সেটা জানলে এই অঙ্কটার বিষয়েও খানিক বোঝা যাবে। শব্দটা আদতে ল্যাটিন। এর অর্থ হল খুদে খুদে পাথরের দানা। সেই যে গলব্লাডারে বা কিডনিতে স্টোন হয় না, সেগুলোকেও কিন্তু ক্যালকুলাস বা তার বহুবচনে ক্যালকুলি বলে। এই ক্যালকুলাস বা খুদে খুদে পাথরের দানা দিয়ে গোনবার যন্ত্র  ‘অ্যাবাকাস’ বানানো হত।

biggannilamcabacus

তারপর সপ্তদশ শতাব্দিতে যখন অঙ্কের এই শাখাটা তৈরি হল, তাতে একটা চলরাশিকে খুব সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম টুকরোয় ভেঙে নিয়ে তার ধর্ম পরীক্ষা করার কায়দা বের করা হল। তখন ঐ সুক্ষ্ম টুকরোগুলোর সঙ্গে অ্যাবাকাসের খুদের পাথরের দানা ক্যালকুলাসদের কথা মাথায় রেখে অঙ্কের এই ধারাটার নাম দেয়া হল ক্যালকুলাস।

ধরো একটা জিনিস ছুটছে। ছুটতে ছুটতেই তার গতিটা বদলাচ্ছে। ধরো সে মোট দশ মিনিট ছুটল। তাতে তার গতিটা বদলে ঘণ্টায় ‘ক’ থেকে ঘণ্টায় ‘খ’ হল। এবারে, এই গতিটা তাহলে একটা চলরাশি। কারণ তার মান তো পালটে যাচ্ছে বারবার তাই না? দশ মিনিটে তার মান পালটে ক থেকে খ হয়ে গেছে। এবারে যদি সেটাকে দশটা সমান টুকরোয় ভেঙে নিয়ে দেখি তাহলে প্রতি এক মিনিটে তার গতির বদলটা হিসেব করতে পারব। যদি তাকে এক কোটিটা ভাগ করে নিয়ে দেখি তাহলে দশ মিনিটের এক কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ে তার গতিটা কীভাবে বদলাচ্ছে তার হিসেব পাব। ইচ্ছে করলে তাকে আরো অসংখ্য ছোটো থেকে আরও ছোটো টুকরোয় ভাগ করেও দেখা যেতে পারে। যত ছোটো করব ততই সময়ের মাপগুলো ক্রমশ শূন্যর আরো  কাছাকাছি যেতে থাকবে।

এক্ষেত্রে এই যে সময়ের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম (বা infintesimal) ভাগগুলোর জন্যে চলরাশির বদলের মানগুলো, এইগুলোকে যদি ওপরের ছবির একেকটা নুড়িপাথর (মানে ঐ যাকে বলে ক্যালকুলাস) ধরি, তাহলে মজাটা হবে এই যে, (ক) ইচ্ছে করলে একটা বড়ো ব্যাপারকে টুকরোয় ভেঙে তার মাপজোক নিতে পারব, আবার (খ)ইচ্ছে হলে অসীম খুদে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম টুকরোদের পাশাপাশি জুড়ে গোটাটার মাপও নিখুঁতভাবে বের করে নেয়া যাবে।

 এই (ক) আর (খ) হল আসলে ক্যালকুলাসের দুটো শাখা- অবকলন বা অন্তরকলন (differentiation) ও সমাকলন (integration)। এদের মধ্যে অবকলনের কাজ হল চলরাশির তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের (instantaneous change)  হিসেব নিকেশ রাখা আর তার সাহায্যে এবং সরল বা বক্ররেখার ঢাল (slope) বের করা। অন্যদিকে চলরাশির মানের পুঞ্জীভবন (accumulation of values) এবং বক্ররেখা দিয়ে ঘিরে থাকা অংশের ক্ষেত্রফল বের করার জন্য সমাকলনের দ্বারস্থ হতে হয়। প্রাচীন মিশরের, খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৮২০ অব্দের আশেপাশের সময়কার কিছু প্যাপিরাসে ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয় করতে এই সমাকলনের কিছু সূত্রের ইঙ্গিত থাকলেও এই সূত্রগুলো কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছিল তাই নিয়ে কোন নির্দেশ নেই। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ থেকে ৩৭৩ অব্দের মাঝামাঝি গ্রিক গণিতবিদ ইউডক্সাস শঙ্কু ও পিরামিডের আয়তন মাপার জন্য যে method of exhustion নামে যে সূত্র ব্যবহার করেন তাকে চলরাশির সীমা নির্ণয় এবং অবকলনের পূর্বসুরী বলে ধরা যেতে পারে। এরপর হেলেনিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ থেকে ৩১ অব্দের মাঝামাঝি) আর্কিমিডিস এই পদ্ধতিটিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান, তিনি অবিভাজ্যতার (indivisibility) ধারণা নিয়ে আসেন, যাকে ক্যালকুলাসে ব্যবহৃত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের (infinitesimal) ধারণার পূর্বসুরী মানা যেতে পারে। ইউডক্সাসের ব্যবহার করা পদ্ধতিটি খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকে চীনের গণিতবিদরা ব্যবহার করেন বৃত্তের ক্ষেত্রফল মাপতে, তবে তাঁরা এটি স্বাধীনভাবেই উদ্ভাবন করেছিলেন বলা চলে, কারণ ইউডক্সাসের কথা তাঁরা জানতেন না। খ্রিস্টিয় ৯৬৫ থেকে ১০৪০ অব্দের মধ্যে কোন সময় মধ্যপ্রাচ্যের গণিতবিদ হাসান ইবন আল-হায়থাম (ল্যাটিনে যাঁকে আলহাজেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে) চতুর্থ ঘাতের যোগফল বের করার সূত্র আবিষ্কার করেন, যা পরবর্তীকালের সমাকলনের প্রায় সমকক্ষ। খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতকে ভারতীয় গণিতজ্ঞরা, বিশেষত সঙ্গগ্রাম এবং কেরালায় কিছু পদ্ধতি ব্যবহার হয় যার সঙ্গে অবকলনের অনেক মিল রয়েছে। এরপর ক্যালকুলাসের আরও অনেক পরিবর্ধন হতে থাকে আধুনিক যুগের বিভিন্ন গণিতজ্ঞদের হাত ধরে।

নিলাম তত্ত্বে অবকলন আর সমাকলন দুইই খুব কাজে আসে। এই দুইয়ের অভিমুখ বিপরীত আর সেই বৈপরীত্যকে কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের দরের মান কি হতে পারে তা বের করা হয়। কিভাবে তা বোঝার জন্য প্রথমে অবকলন আর সমাকলন ঠিক কি কি করে সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক। শুরু করা যাক অবকলন দিয়ে। অবকলন অবধি পৌঁছবার পথে প্রথম ধাপ অপেক্ষক, সেটা আমরা বেশ ভালো করে বুঝে নিয়েছি এতক্ষণে। এরপর যে দুটো ধাপ পেরিয়ে আমরা অবকলনে পৌঁছব তাদের মধ্যে প্রথমটা হল সীমা (limit) আর তার পরেরটা হল সন্ততি (continuity)।

তাহলে এক এক করে বুঝে নেওয়া যাক। প্রথমে সীমা – এ ব্যাপারটা বোঝার জন্য চিত্র ১-এর রেখচিত্রগুলো দেখ, ১(ক) এবং ১(খ) দুটোতে দুরকম অপেক্ষক আঁকা হয়েছে।

biggannilam01

দুটো ক্ষেত্রেই  হল -এর অপেক্ষক  –  ১(ক)-তে দেখ বিন্দু  x̅-এর বাঁ দিক বা ডান দিক যেদিক থেকেই আস না কেন, অপেক্ষকের মান কিন্তু সেই একই ȳ-এর দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু ১(খ)-তে x̅-এর বাঁ দিক থেকে এগোলে অপেক্ষকের মান যাচ্ছে ȳ -এর দিকে; আবার ডান দিক থেকে এগোলে অপেক্ষকের মান যাচ্ছে -এর দিকে, স্পষ্টতই দুটো মান আলাদা। যখন কোনও অপেক্ষকের ক্ষেত্রে -এর মান একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার দিকে এগোলে -এর মান কোন সংখ্যার দিকে এগোচ্ছে সেটা আমরা কোনও রকম অস্পষ্টতা ছাড়াই নির্ধারণ করতে পারি, তখন আমরা বলি -এর ঐ মানের জন্য অপেক্ষকটির সীমার অস্তিত্ব আছে। এটা তখনই সম্ভব যখন -এর যে মানের জন্য সীমার অস্তিত্বের কথা ভাবা হচ্ছে তার ডান দিক অর্থাৎ তার থেকে বেশি মানের দিক থেকে আর বাঁ দিক অর্থাৎ তার থেকে কম মানের দিক থেকে এগোতে থাকলে দুই ক্ষেত্রেই  অপেক্ষকের একই মানের দিকে এগোয়। সুতরাং চিত্র-১-এর ক্ষেত্রে ১(ক)-তে x̅-এর জন্য অপেক্ষকের সীমার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু ১(খ)-তে যেহেতু x̅-এর বাঁ এবং ডান দিক থেকে এগোলে -এর মান দুটি আলাদা মানের দিকে এগোয়, তাই এক্ষেত্রে সীমার অস্তিত্ব নেই।

ব্যাপারটা বোঝার সুবিধের জন্য একটা বিশেষ সুড়ঙ্গের গল্পে আসা যাক। উত্তর ভারতে কালকা থেকে ট্রেনে করে সিমলা যাওয়ার পথে  সবচেয়ে লম্বা যে সুড়ঙ্গটা পেরোতে হয়, তার নাম বারোগ টানেল, একে টানেল 33 বলেও ডাকা হয়। একে ঘিরে একটা অদ্ভুত গল্প চালু আছে। ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার বারোগকে হিমাচলের এই অঞ্চলে পাহাড়ে সুড়ঙ্গ কেটে রেলপথ বানাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের কাজ শেষ করার জন্য তাঁকে একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল। পাহাড় সেখানে বেশ চওড়া ছিল। তাই তাড়াতাড়ি সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য বারোগ তাঁর অধীনস্থ শ্রমিকদের পাহাড়ের দুই প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার নির্দেশ দেন। তাঁর ধারণা ছিল দুই দিক থেকে খুঁড়তে খুঁড়তে দুই দলের শ্রমিকরা এসে মাঝখানে মিলে যাবেন আর সুড়ঙ্গও খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু শোনা যায় যে বারোগের হিসেবে কিছু ভুল হয়েছিল, তাই দুদিক থেকে খুঁড়তে খুঁড়তে দুই দল এক জায়গায় এসে মেলার বদলে আলাদা আলাদা পথে চলে যান এবং সেই জন্য সুড়ঙ্গটা আদৌ তৈরি হতেই পারে না। এটাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে রেলের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হার্লিংটনের তত্ত্বাবধানে নাকি নতুন সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। প্রথম সুড়ঙ্গের কেন্দ্র থেকে নতুন করে খুঁড়ে যেখানে হওয়ার কথা ছিল তার থেকে আরও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে সেই নতুন সুড়ঙ্গ শেষ হয়। শোনা যায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বারোগকে তাঁর ভুলের জন্য জরিমানা করেন, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্তও করেন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে বারোগ ঐ অসমাপ্ত সুড়ঙ্গের বাইরে নিজের রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। স্থানীয় লোকেরা বলেন বারোগের আত্মা নাকি এখনও ঐ সুড়ঙ্গের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, আর ঐ টানেল 33 এর মধ্যে দিয়ে ট্রেনে করে যাওয়ার সময় যাত্রীদেরও নাকি অদ্ভুত ধরণের কিছু অতিলৌকিক অনুভূতি হয়। তাই পর্যটকদের একাংশ সাম্প্রতিককালে এই সুড়ঙ্গ ও তার ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অনেক আলোচনা করছেন। 

এই গল্পের সত্যতা নিয়ে অবশ্য অনেক প্রশ্ন আছে। হতেই পারে এটা সম্পূর্ণ মনগড়া এক কাহিনী, কারণ তখনকার খবরের কাগজে এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এটুকুই জানা গিয়েছিল যে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্য সুড়ঙ্গ শেষ করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল। গল্প সত্যি হোক বা না হোক, এই পুরো ব্যাপারটা আমাদের অপেক্ষকের সীমার অস্তিত্ব বুঝতে খুব সাহায্য করবে। গল্পটা যদি সত্যি হয় তাহলে প্রথমে যখন সুড়ঙ্গ শেষ হল না, দুদিক থেকে খুঁড়তে খুঁড়তে শ্রমিকরা দুটো আলাদা রাস্তায় চলে গেলেন, তখন পরিস্থিতিটা হল অনেকটা চিত্র ১(খ)-এর মত। পথের ডান আর বাঁ দিকের সীমা পথের কেন্দ্রে এসে মিলল না, আর তাই পথের কেন্দ্রে সীমার অস্তিত্বই রইল না। আর গল্পটা যদি পুরোটা কল্পনার ডানায় ভর করে থেকে থাকে, তাহলে বাঁ দিক আর ডান দিক থেকে খুঁড়তে খুঁড়তে শ্রমিকরা একই বিন্দুতে এসে মিলে গেলেন এবং সেই বিন্দুতে এই সুড়ঙ্গ পথের সীমার অস্তিত্বও রইল, ঠিক চিত্র ১(ক)-এর  মত।

এবার আসি সন্ততির প্রশ্নে, চিত্র ১-এর (ক) লক্ষ্য কর,  যখন  x̅-এর দিকে এগোচ্ছে  তখন এগোচ্ছে ȳ -এর দিকে এবং শেষমেশ  ȳ-এ এসে দুদিক থেকেই   মিলে যাচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখ এরকম রেখচিত্র আঁকতে কাগজ থেকে একবারও পেন্সিল ওঠানোর দরকার পড়ে না, একটানা এঁকে যাওয়া যায়। এই ধরণের অপেক্ষককে বলে সন্তত অপেক্ষক বা continuous function। অঙ্কের ভাষাতেও এর একটা সংজ্ঞা আছে। সন্ততি বা continuity বলতে প্রথমে বিন্দুর সাপেক্ষে সন্ততির ধারণা বুঝতে হবে। এই ধারণাটা সীমার ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কোনও অপেক্ষকের domain -এর যে কোনও একটা বিন্দুতে যদি সীমার অস্তিত্ব থাকে আর সেই সীমার মান যদি ঐ বিন্দুতে অপেক্ষকের মানের সমান হয়, তাহলে সেই অপেক্ষকটি domain -এর ঐ বিন্দুতে সন্তত। আর যে অপেক্ষক তার domain -এর সব বিন্দুতে সন্তত, সেই অপেক্ষকটিই হল একটি সন্তত অপেক্ষক বা continuous function। বারোগ টানেলের সেই গল্পটা যদি সত্যি না হয় তাহলে সুড়ঙ্গটা একটা সন্তত অপেক্ষকের মত হবে, তার প্রত্যেক বিন্দুতে যেদিক থেকেই আসা হোক না কেন একটা সীমা থাকবে আর সেই সেই সীমার মান ঐ বিন্দুতে অপেক্ষকের মানের সমান হবে।

অপেক্ষকের কোনও বিন্দুতে যদি সীমার অস্তিত্বই না থাকে তাহলে তো সন্ততির কোনও প্রশ্নই নেই। সুতরাং খুব একটা ভাবনা চিন্তা না করেই বলে দেওয়া যায় যে চিত্র ১(খ) -এর অপেক্ষকটি অসন্তত। তবে এমনও হতে পারে যে কোনও বিন্দুতে অপেক্ষকটির সীমার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু অপেক্ষকটি সন্তত নয়। চিত্র ১(ক)-কে সামান্য বদলে দিয়ে আমরা চিত্র ২ পেতে পারি। চিত্র ১(ক)-এর সঙ্গে চিত্র ২-এর তফাত হল চিত্র ১(ক)-তে  x̅-এর দিকে  ডান এবং বাঁ দিক থেকে যখন এসে মিলছে, তখন -ও এসে ȳ -এ মিলে যাচ্ছে। কিন্তু চিত্র ২ তে , ȳ -এর দিকে এগোলেও কখনই ȳ -এর সমান হচ্ছে না।

biggannilam02

ব্যাপারটা আবারও বারোগ টানেলের সূত্র ধরে ভাবলে এরকম ভাবে ভাবা যেতে পারে যে সুড়ঙ্গে ট্রেন লাইন পাতা হওয়ার, এমনকি ট্রেন চালু হওয়ার পর একদিন হঠাৎ ভূমিকম্পে ট্রেন লাইনের নীচের মাটিতে ফাটল ধরল আর সেই জন্য সেখানে ট্রেন লাইন ভেঙে গেল। তাই দুদিকের ট্রেন লাইন বরাবর যারা সারাতে এল তারা কখনই একই জায়গায় পাশাপাশি এসে দাঁড়াতে পারল না। যতক্ষণ না ফাটল বরাবর মাটি ভরাট করে, ভাঙা লাইন জোড়া লাগানো গেল, ততক্ষণ দুদিকের সারাই মিস্ত্রীরা একই বিন্দুর দিকে এগোলেও কখনই এক বিন্দুতে এসে মিলতে পারল না।

ভেবে দেখ এরকম একটা অপেক্ষকের রেখচিত্র যদি আঁকতে চাও, তাহলে অন্তত একবার তোমাকে কাগজ থেকে পেন্সিলটা তুলতেই হবে, কাগজ থেকে পেন্সিল না তুলে কিছুতেই এই রেখচিত্র আঁকা সম্ভব নয়। এই ধরণের অপেক্ষক যাদের রেখচিত্র আঁকতে অন্তত একবার কাগজ থেকে পেন্সিল তুলতে হয়ই হয়, তাদের বলা হয় অসন্তত অপেক্ষক (discontinuous function)। অর্থাৎ এই ধরণের অপেক্ষকের ক্ষেত্রে তার domain-এ অন্তত একটি বিন্দু এমন থাকে যার জন্য অপেক্ষকের রেখচিত্র আঁকতে কাগজ থেকে পেন্সিল তোলা আবশ্যক।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটা ব্যাপার বেরিয়ে আসছে – কোনও অপেক্ষককে কোনও বিন্দুতে সন্তত হতে হলে সেই বিন্দুতে তার সীমার অস্তিত্ব আবশ্যক, কিন্তু কোনও বিন্দুতে সীমার অস্তিত্ব থাকলেই যে সেই বিন্দুতে অপেক্ষকটি সন্তত হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ঠিক একই ভাবে সম্পূর্ণ অপেক্ষকটির জন্য বলা যেতে পারে যে, অপেক্ষকটি যদি সর্বত্র সন্তত হয় তাহলে অপেক্ষকের সব বিন্দুতেই সীমার অস্তিত্ব থাকবে, কিন্তু সব বিন্দুতে সীমার অস্তিত্ব থাকলেই যে অপেক্ষকটি সন্তত হবে তা নয়। সুতরাং বলা যেতেই পারে যে সীমার অস্তিত্ব সন্ততির জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট শর্ত নয় (necessary, but not sufficient condition)।

কোনও অপেক্ষক যদি তার পুরো domain-এর ওপরেই সন্তত হয়, তাহলে তারপরে যেটা আমাদের জানার দরকার পড়ে তা হল domain-এ যে চলরাশি নেওয়া হচ্ছে, তার পরিবর্তন হলে co-domain-এর চলরাশিতে ঠিক কি ধরণের পরিবর্তন আসে। মনে কর  হল -এর অপেক্ষক। ক্যালকুলাসের মজা হল, -এর যত সূক্ষ্ম পরিবর্তনই হোক না কেন, তার জন্য  কিভাবে বদলাবে সেটাও বের করার পদ্ধতি ক্যালকুলাসে রয়েছে। এই পদ্ধতিটারই নাম হল অবকলন বা differentiation। মনে কর  যদি  পরিমাণে বদলায়, তাহলে  বদলায়  পরিমাণে, অর্থাৎ  -এর মান যখন  , তখন -এর মান হল । সুতরাং, -এর প্রতি একক পরিবর্তনের জন্য  বদলাচ্ছে   পরিমাণে। এবার এই -এর মান ক্রমশ ছোটো হতে হতে একেবারে শূন্যের কাছে গিয়ে পৌঁছলে আমরা যদি   রাশিটার সীমার মান নির্ণয় করতে পারি, তবে আমরা যা পাই তাকে বলা হয় -এর সাপেক্ষে -এর প্রথম ক্রমের অন্তরকলজ (first order derivative of  with respect to )। একে প্রকাশ করা হয়  হিসেবে।  বদলালে এই প্রথম ক্রমের অন্তরকলজ যতখানি বদলায় তাকে বলা হয় দ্বিতীয় ক্রমের অন্তরকলজ আর তাকে প্রকাশ করা হয়  হিসেবে। এই যে একটু আগেই বলা হয়েছে নিলামে ক্রেতা এবং বিক্রেতা এই দুই দলই কিছু না কিছু সবচেয়ে বেশি পাবার উদ্দেশ্যে কাজ করে, অর্থাৎ কিছু না কিছুর চরম মানে পৌঁছনোর চেষ্টা করে, সেই ব্যাপারটা কিন্তু অবকলনের সঙ্গে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় ক্রমের অন্তরকলজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সেই সম্পর্কের গল্পটা আরেক দিনের জন্য তোলা রইল।

ক্রমশ

    জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s