সৌম্যকান্তি জানা-র আগের লেখা- ক্লোরোফিল চোর, বঁটিঝাঁপের মেলায়, রঙবদল, অবচেতন মনের আয়না, হাওয়া বাবা হাওয়া, অ্যাটমোবাবু কাবু , শিম্পাঞ্জির হাত, ক্লেয়ারভয়েন্স কারসাজি
(এক)
“পরেশদা, জম্পেশ করে একটা চা বানাও দেখি।”
পকেট থেকে রুমাল বার করে মাথাটা মুছতে মুছতে পরেশের দোকানের সামনে বেঞ্চটায় বসল লেট্টু। স্বাধীনতা দিবসের আর একদিন বাকি। কোথায় ছেলেপুলে সকাল সকাল স্কুলে গিয়ে প্রভাতফেরিতে যাবে; কেক, কলা আর ডিমসেদ্ধ খাবে তা নয়, আকাশটা সব ভেস্তে দেওয়ার ফন্দি করেছে। লেট্টু মনে মনে ভাবে।
“দুধ, না লিকার?” পরেশ আঁচে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে।
“লিকারই দাও। পার্টনারগুলো এলে না হয় দুধ চা খেতাম। একটু বড়ো আর কড়া করে কোরো। আদ্দেক ভিজে গেছি।”
কথা শেষ করার আগেই একটা ছাতা মাথায় দিয়ে হাজির কেতো আর বুবাই।
“কতক্ষণ, লেট্টুদা?” ছাতা বন্ধ করতে করতে কেতো বলে ওঠে।
“তা তোরা দুই গর্দভ তো আলাদা পাড়ায় থাকিস। এক ছাতায় এলি কী করে?” কেতোর কথার উত্তর না দিয়ে লেট্টু পালটা প্রশ্ন করে।
“আমিই তো কেতোর বাড়ি গিয়েছিলাম।” বুবাই একগাল হাসি নিয়ে লেট্টুর পাশে এসে বসে।
“আমাকে না জানিয়ে গেলি যে বড়ো? বেশ বড়ো হয়ে গেছিস, তাই না?” লেট্টুর গলায় গাম্ভীর্য।
“না গো লেট্টুদা। সকালে একটা পড়া জানার জন্য কেতোকে ফোন করেছিলাম। তখনই কেতোর মুখে ডবল রুটির কথা শুনে ওর সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম।”
“ডবল রুটি? মানে?” একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে লেট্টুর চোখে-মুখে।
চা খেতে খেতে কেতোর মুখে ডবল রুটির গপ্পোটা মন দিয়ে শুনে নিল লেট্টু। কেতোর কাকিমা নাকি সপ্তাহ খানেক আগে কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে গিয়েছিল। মন্দিরে ঢোকার আগে মন্দির-সংলগ্ন পুকুরের ঘাটে পা ধুতে গিয়ে দেখে সামনে একটা সাদা গোলাকার কিছু ভেসে আছে। উনি হাতে করে জিনিসটি তুলে দেখেন, কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। জিনিসটি আধা কঠিন আর ফোলা, অনেকটা বান রুটির মতো। কেতোর কাকিমার হাতে জিনিসটি দেখে এগিয়ে আসেন মন্দিরের এক পাণ্ডা। তিনি জিনিসটি ভালো করে দেখে বলেন, “আপনি অতি সৌভাগ্যবতী মহিলা। এ হল মায়ের প্রসাদ। যে এই প্রসাদ পায় তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।”
সব শুনে যুগপৎ বিস্ময় ও আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন কেতোর কাকিমা। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে চলে আসেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তিনি দেখে বলেন, “এ তো মায়ের প্রসাদী রুটি। তুমি হয়তো মায়ের আশীর্বাদ পেতে চলেছ। এই রুটি সবাই পায় না। এই রুটি খাওয়া যায় না। তুমি এই রুটি বাড়ি নিয়ে যাবে। একটা নতুন মাটির কলশিতে একের তিন ভাগ জল ভরে তাতে তিন মুঠো চিনি দেবে। তারপর তাতে এই রুটিটা রেখে কলসির মুখে একটা মাটির সরা চাপা দিয়ে তোমার ঠাকুরঘরে রেখে সাতদিন ধরে ভক্তিভরে পুজো করবে। যদি সাতদিন পরে দেখো একটা রুটি থেকে দুটো রুটি হয়ে গেছে তবে বুঝবে তোমার সঙ্গে আছে মায়ের আশীর্বাদ। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। তারপর তুমি নতুন রুটিটা তোমার পছন্দের একজন সাত্ত্বিক মানুষকে দান করে দেবে। আর পুরোনো রুটিটা তুমি মায়ের চরণে উৎসর্গ করবে। যদি রুটি ডবল হয়ে যায়, বুঝবে মায়ের আশীর্বাদ পেয়েছ। আর যদি ডবল না হয় বুঝবে তুমি মায়ের আশীর্বাদ পাওনি।”
এই কথা শুনে কেতোর কাকিমা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে পুরোহিতের কথামতো কলশির মধ্যে রুটি, জল ও চিনি রেখে সরা-ঢাকা দিয়ে রাখেন। তারপর এক সপ্তাহ ধরে সকাল-সন্ধে মন্দিরের ওই পুরোহিতকে দিয়ে পুজোপাঠ করান। এক সপ্তাহ পরে মানে আজ সকালে সরা খুলে কেতোর কাকিমা দেখেন রুটি ডবল হয়ে গেছে! আর তা নিয়েই সারা পাড়া তোলপাড়। কাতারে কাতারে লোক দেখতে আসছে রুটি ডবল হওয়ার ধামাকা।
কেতোর বর্ণনা শুনে কিছুক্ষণ থম হয়ে রইল লেট্টু। পরেশ যে এতক্ষণ কেতোর কথা মন দিয়ে শুনছিল তা বোঝা গেল তার কথাতেই—“রহস্যটা কী বলো তো লেট্টুভাই?”
লেট্টু একবার পরেশের দিকে মাথা তুলে দেখে কেতোকে বলল, “আজ বিকেলে তোর বাড়িতে যাব। তুই আমাকে তোর কাকিমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডবল রুটি ধামাকা দেখাতে পারবি?”
“অবশ্যই। ক’টায় যাবে?”
“এই ধর চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ।”
“আমিও কি যেতে পারি?” বুবাই ফুট কাটল।
“কেন নয়? ইচ্ছে হলে যাবি।”
“তাহলে ওই কথাই রইল।” বলে হাঁটা লাগাল লেট্টু।
(দুই)
কেতোর কাকিমার একচিলতে ঠাকুরঘরে তিলধারণের জায়গা নেই। কালীর ফটোর সামনে একটা রেকাবিতে রাখা আছে দুটো বান রুটির মতো দেখতে জিনিস। তার ওপরে জবাফুলের কয়েকটা ছেঁড়া পাপড়ি আর দূর্বা ঘাস ছড়ানো। সবাই এক-এক করে এসে রুটি দেখে জোড়হাত কপালে ঠেকাচ্ছে।
কেতোর কাকিমা উপস্থিত লোকজনদের একটু বলে-কয়ে লেট্টুকে এগিয়ে যাওয়ার জায়গা করে দিলেন। লেট্টু কাছে গিয়ে ভালো করে রুটি দুটো দেখল। একটার রঙ লালচে-সাদা, আর একটা ধবধবে সাদা। রঙ দেখেই লেট্টু বুঝে নিল সাদা রুটিটা পরে তৈরি হয়েছে। সবাই রুটি বললেও জিনিস দুটিকে লেট্টুর আদৌ রুটি বলে মনে হল না। রুটির মতো দেখতে অন্য কিছু। কিন্তু কী?
“কাকিমা, আমি রুটিটা একবার হাতে নিয়ে কপালে ঠেকাতে পারি? খুব ইচ্ছে করছে।” লেট্টু চোখে-মুখে ভক্তিভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“বাবা, তুমি হাতে নিতে চাইলে সবাই হাতে নিতে চাইবে। তা কি হয়?”
“তাহলে রেকাবিটা একবার কপালে ঠেকাই? খুব মন চাইছে কাকিমা।” ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠল লেট্টু।
“আচ্ছা বাবা। তুমি যখন এত করে মায়ের প্রসাদ কপালে ঠেকাতে চাইছ, তাই করো। জয় মা কালী।” কপালে জোড়হাত ঠেকালেন কেতোর কাকিমা।
লেট্টু সাষ্টাঙ্গে প্রণামের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। তারপর দুটো হাত সামনে প্রসারিত করে রেকাবির কাছে নিয়ে গেল, আর কপালটা ঠেকাল রেকাবির এক প্রান্তে। লেট্টুর ভক্তি দেখে কেতো আর বুবাই অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। জমিয়ে অভিনয় করছে লেট্টু। পাবলিক বুঝতেই পারছে না।
প্রায় এক মিনিট পর ‘জয় মা কালী’ বলে উঠে পড়ল লেট্টু।
“আসি কাকিমা। কাল আবার এসে একবার প্রণাম করে যাব।” লেট্টু ঠাকুরঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল।
“আবার কাল আসবে?” বুবাই ফুট কাটল।
“তোর না ইচ্ছে হয় আসবি না। আমি আসব। কী বলেন কাকিমা?” লেট্টু বুবাইয়ের দিকে মুহূর্তের কড়া চাউনি দিয়ে গলার স্বর মিহি করে বলল।
“একশোবার আসবে বাবা। আজকালকার দিনে তোমার মতো এমন ভক্তিপরায়ণ ছেলে দেখাই যায় না!”
কেতোর কাকিমাকে প্রণাম করে লেট্টু বেরিয়ে এল। পেছনে পেছনে বুবাই আর কেতো।
“তোমার কী প্ল্যান বলো তো লেট্টুদা? যা অভিনয় দেখালে!” কেতোর চোখে কৌতুক।
“কীসের অভিনয়? আমার ভক্তিভাব জেগেছে।” ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দিল লেট্টু।
কথা শুনে কেতো আর বুবাই খিকখিক করে হেসে উঠতেই লেট্টু শান্ত গলায় বলে উঠল, “হে মা কালী, বাচ্চাগুলোকে একটু সুমতি দাও!”
(তিন)
সকাল সকাল কেতোর কাকিমার বাড়িতে হাজির হয়ে গেল লেট্টু। এসেই যথারীতি ভক্তিরসের বন্যা বইয়ে দিল। তখন সবে দু-চারজন লোক রুটি দর্শন করতে এসেছে। লেট্টু ফের সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার অছিলায় রুটিতে আঙুল দিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে দেখেছে গতদিনের থেকে সামান্য শক্ত হয়ে গেছে। আর নতুন রুটিটাতে সামান্য লাল আভা ধরেছে। পুরোনো রুটিটা আরও একটু লাল হয়েছে।
কেতোর কাকিমাকে লেট্টু আবারও প্রণাম করতে খুশিতে বিগলিত হয়ে বললেন, “বাবা, তোমার বয়সি এমন কালীভক্ত ছেলে আমি একটাও দেখিনি।” উপস্থিত অন্যদের উদ্দেশে বললেন, “আজকালকার ছেলে হয়েও বয়স্কদের প্রতি কত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখেছ?”
সবাই সম্মতিসূচক মাথা দোলাতে লাগল। কিন্তু কেতোর চোখ ছানাবড়া। ব্যাপারটা কী? নিশ্চয়ই কোনও একটা প্ল্যান ঘুরছে লেট্টুর মাথায়।
“বাবা, আমি কাল রাতে ভেবে দেখলুম, তোমার মতো কালীভক্ত আমার চেনাজানা লোকেদের মধ্যে একটাও নেই। আর তাই আমি ঠিক করেছি, নতুন রুটিটা আমি তোমাকেই দেব। আমার বিশ্বাস তুমিও মায়ের আশীর্বাদ পাবে।” কথাগুলো বলে কেতোর কাকিমা কপালে জোড়হাত ঠেকালেন।
এ তো মেঘ না চাইতেই জল নয়, এক্কেবারে বরফ! এত তাড়াতাড়ি কেতোর কাকিমার মনকে যে দুর্বল করে দেওয়া যাবে সে ভাবতে পারেনি। আনন্দে লেট্টুর মন পাহাড়-প্রমাণ লাফিয়ে উঠল। কিন্তু এই খুশিকে একচিলতেও বাইরে প্রকাশ করল না লেট্টু। উলটে ফের একবার কেতোর কাকিমার পায়ে হাত ছুঁইয়ে বলে উঠল, “আমি ভাগ্যবান কাকিমা। মায়ের আশীর্বাদ পাব কি না জানি না, কিন্তু আপনার আশীর্বাদ পেয়েছি, এটাই আমার কাছে অনেক বড়ো পাওয়া।”
“না বাবা, তুমি নিশ্চিত মায়ের আশীর্বাদ পাবে। আমার মন বলছে তোমার কাছেও রুটি ডবল হবে।”
“তাই যেন হয় কাকিমা।” লেট্টু জোড়হাত কপালে ঠেকাল।
নতুন রুটিটা একটা কলাপাতায় মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে একটা মাটির সরায় রেখে লেট্টুর হাতে তুলে দিলেন কেতোর কাকিমা। লেট্টু চেঁচিয়ে বলে উঠল, “কালীমাতা কি জয়!”
(চার)
কেতোর কাছে খবর শুনে বিকেলেই লেট্টুর বাড়ি হাজির বুবাই, টুকুন, পিচকু আর মেনাল্ডো। ওরা লেট্টুর ঘরে ঢুকে দেখে টেবিলের উপর রাখা একটা মাটির কলশির মধ্যে কিছু একটা দেখছে লেট্টু। বুবাই বলে ওঠে, “কলশির মধ্যে রুটিটা রেখে দিয়েছ লেট্টুদা?”
ঘাড় ঘুরিয়ে লেট্টু বুবাইদের দেখে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে। ইঙ্গিত পেয়েই সবাই চুপ করে যায়। ওরা জানে লেট্টুর কথা অমান্য করার কী কঠোর শাস্তি। একে একে ওরা চুপচাপ বসে পড়ে লেট্টুর বিছানায়। লেট্টু কলশির মুখে একটা প্লেট ঢাকা দিয়ে ওদের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে।
“তারপর, তোরা হঠাৎ না বলে-কয়ে অসময়ে আমার বাড়িতে এলি যে বড়ো?” লেট্টু ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে।
“আমি সকালের ব্যাপারটা ওদের বলেছিলাম। তাই শুনে সবাই বলল, লেট্টুদা রুটি নিয়ে কী করছে দেখব চল।” কেতো একটু ভয়মিশ্রিত গলায় উত্তর দিল।
“দেখা হয়েছে তো? তাহলে এবার যা।” নিরাসক্তভাবে বলে ওঠে লেট্টু।
“সে কী গো লেট্টুদা! রুটিটা তো চোখেই দেখলুম না এখনও।” পিচকু বলে ওঠে।
“এক সপ্তাহ পরে দেখবি। এখন ভাগ তো!”
“সবে এলাম, এখনই ভাগিয়ে দিচ্ছ?” বিরসবদনে বলে ওঠে মেনাল্ডো।
“এখন তোমাদের আতিথেয়তা করার সময় আর মানসিকতা আমার নেই। তাই আসতে পারো।”
অগত্যা চারজন অনিচ্ছা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রুটিটা নিয়ে কী করতে চায় লেট্টু সেটাই তো জানা হল না। তাছাড়া রুটিটা কি সত্যি সত্যি রুটি? এ নিয়ে ওদের মনে ঘোর সন্দেহ আছে। আর এই সন্দেহ নিরসন করতে পারে একমাত্র লেট্টু। কিন্তু সে-ই তো ওদের ভাগিয়ে দিচ্ছে। ধীর পায়ে ওরা দরজার বাইরে আসতেই লেট্টুর গলা শোনা গেল—“সাতদিন আমার বাড়িতে কেউ আসবি না। আর আমিও সাতদিন পরেশদার দোকানে যাব না। মনে রাখিস।”
কেতোরা চলে যেতেই ঝটপট জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে লেট্টু বেরিয়ে পড়ল। আধঘণ্টা হাঁটতেই পৌঁছে গেল সন্দীপ-স্যারের বাড়ি। গেট খুলে ঢুকে কলিং বেল বাজাতেই বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়। লেট্টু পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে করতে বলল, “আমাকে চিনতে পারছেন স্যার?”
“চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু মনে করতে তো পারছি না।” সন্দীপ-স্যার চশমার উপর দিয়ে লেট্টুর মুখের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
“স্যার, আমি প্রত্যয়। প্রত্যয় ধর। তিন বছর আগে এইচ.এস. পাশ করেছি।”
“ও আচ্ছা, তুই! আয় বাবা, ভেতরে এসে বোস।”
সন্দীপ-স্যার লেট্টুকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলেন। সন্দীপ-স্যার হলেন লেট্টুদের স্কুলের বায়োলজির স্যার। ক্লাসে যেমন আকর্ষণীয়ভাবে পড়াতেন, তেমনই অসাধারণ ছবি আঁকতেন। ক্লাসে তাঁর পড়ানো শুনেই অধিকাংশ ছাত্রের পড়া হয়ে যেত। আর কত দ্রুত ও সহজে নেফ্রন, নিউরোন, ক্রোমোজোম কিংবা হৃৎপিণ্ড ও অক্ষিগোলকের লম্বচ্ছেদের ছবি আঁকা যায় তা ক্লাসেই শিখিয়ে দিতেন সন্দীপ-স্যার। লেট্টু জানে, সন্দীপ-স্যার বাড়িতে গাছগাছালি-পোকামাকড় নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন। তাঁর গবেষণার শখ আছে। এজন্য তিনি বাড়িতে ছোট্ট একটা ল্যাবও তৈরি করেছেন। তবে এর আগে লেট্টু কোনোদিন তাঁর বাড়িতে আসেনি।
“কী মনে করে প্রত্যয়?”
“একটা জরুরি প্রয়োজনে আপনার কাছে এলাম স্যার।”
“জরুরি? কেমন জরুরি শুনি।” সন্দীপ-স্যারের চোখে কৌতূহল।
লেট্টু সংক্ষেপে রুটি ডবল হওয়ার গল্পটা শুনিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা স্যার, আপনার বাড়ির ল্যাবে মাইক্রোস্কোপ আছে আপনি একবার আমাদের ক্লাসে বলেছিলেন। এখনও আছে স্যার?”
“তা আছে। কিন্তু তা দিয়ে তুই কী করবি?”
“স্যার, ওই রুটিটা কী বস্তু তা মাইক্রোস্কোপে আপনি একটু দেখবেন।”
“আমি কি বুঝতে পারব?” স্যারের মনে সন্দেহ।
“দেখাই যাক না স্যার। তবে আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন।”
“চল তবে আমার ল্যাবে।”
সন্দীপ-স্যার লেট্টুকে নিয়ে গেলেন তাঁর দোতলার একটা ঘরে। ওটাই তাঁর ল্যাব কাম লাইব্রেরি। লেট্টু পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বার করে ঢাকনা খুলে সন্দীপ-স্যারের হাতে দিয়ে বলল, “স্যার, এতেই আছে সেই রুটির একটা ছোট্ট নমুনা। একটু দেখুন তো।”
স্যার কৌটোটা ধরে ভালো করে দেখে বললেন, “দাঁড়া, আগে একটা ওয়াচ গ্লাসে জল দিয়ে নমুনাটাকে রাখি। একটু শুকিয়ে গেছে।”
তারপর স্যার ছোট্ট একটা কাচের বাটিতে সামান্য জল নিয়ে তাতে কৌটো উপুড় করে নমুনাটা ঢেলে দিলেন। তারপর চিমটের সাহায্যে সামান্য একটু নমুনা কেটে তুলে একটা স্লাইডের উপরে রেখে নিডল দিয়ে ছিঁড়ে দিতে দিতে বললেন, “বুঝলি প্রত্যয়, মনে হয় আমি যা ভাবছিলাম সেটাই হবে, তবে মাইক্রোস্কোপে দেখে কনফার্ম হতে পারব।”
“দেখুন স্যার।” লেট্টুর যেন আর তর সয় না।
সন্দীপ-স্যার তাক থেকে একটা নীলরঙা শিশি নিয়ে তা থেকে ড্রপারে সামান্য তরল তুলে স্লাইডে রাখা নমুনার উপর এক ফোঁটা দিলেন। তারপর তার উপর পাতলা ও গোলাকার কাচের তৈরি কভার স্লিপ রেখে বাড়তি তরল একটা ব্লটিং পেপার দিয়ে শুকিয়ে নিলেন।
“এটা কী কেমিক্যাল স্যার?” লেট্টু স্লাইডের উপর একটু ঝুঁকে পড়ল।
“ল্যাকটোফেনল কটন ব্লু।” স্লাইডটা মাইক্রোস্কোপে সেট করতে করতে স্যার উত্তর দিলেন। তারপর চোখ রাখলেন মাইক্রোস্কোপের আই-পিসে।
“কী বুঝছেন স্যার?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে স্যার মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “যা ভেবেছি, ঠিক তা-ই।”
(পাঁচ)
দিন দশেক পর একদিন বিকেলে পাঁচ স্যাঙাতকে নিয়ে কেতোর কাকিমার বাড়িতে হাজির হল লেট্টু। সঙ্গে মাটির সরা-ঢাকা একটা কলশি। লেট্টুকে দেখেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছুটে এলেন কেতোর কাকিমা।—“নিশ্চয়ই রুটি ডবল হয়ে গেছে, তাই না? নতুন রুটিটা ধার্মিক কাউকে দিয়ে পুরোনো রুটিটা মন্দিরে মায়ের কাছে রেখে এসো বাবা।”
“রুটি ডবল হয়েছে কি হয়নি নিজেই ঢাকনা খুলে একবার দেখুন কাকিমা।” মাথা নীচু করে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে লেট্টু বলে উঠল।
“নিশ্চয়ই হবে। তোমার মতো সাত্ত্বিক ছেলের কথা মা শুনবে না তো কার কথা শুনবে?” কেতোর কাকিমা কথাগুলো বলতে বলতে কলশির মুখ থেকে সরা সরিয়ে উঁকি দিলেন। আর তার পরেই তাঁর ভ্রূ কুঁচকে গেল।—“সে কী কাণ্ড! একটাই তো আছে। তুমি ঠিকঠাক রেখেছিলে তো বাবা?”
“একদম কাকিমা।” লেট্টু এবার স্পষ্ট গলায় বলে উঠল।
কেতোর কাকিমা বড়ো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রুটি ডবল না হওয়ায় লেট্টুর জন্য তিনি সত্যিই বেশ মর্মাহত।
“আপনিই বরং আরেকবার এই রুটিটা আপনার কাছে রেখে দেখুন কাকিমা। তারপর ডবল হলে আর কাউকে দিয়ে দেবেন। আমাকে মা কালী আশীর্বাদ করবেন না।” কথাগুলো বলে উঠে পড়ল লেট্টু।
এক সপ্তাহ পরে সকাল সকাল দলবল নিয়ে লেট্টু ফের হাজির হল কেতোর কাকিমার বাড়ি। কিন্তু এবার কেতোর কাকিমার চোখ-মুখ যেন শুকনো।
“ডবল রুটি দেখতে এলাম কাকিমা।” লেট্টু বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল।
“কী কারণে জানি না বাবা, রুটি ডবল হয়নি। উলটে ওই রুটিটা পচে চিনি-জলের নীচে ডুবে গেছে। মা কেন এবার আমাকে আশীর্বাদ করলেন না জানি না। কী অন্যায় করলাম আমি? পুজো-আচ্চার তো কোনও ত্রুটি রাখিনি আমি!” কেতোর কাকিমার গলা কান্নাভেজা।
“ওই রুটি আর কোনোদিনই ডবল হবে না কাকিমা।”
“কেন বাবা? কী দোষ আমার?”
“কোনও দোষ নয় কাকিমা। আসলে ওটা তো রুটিই নয়।” লেট্টুর চোখে কৌতুক।
“সে কী বলছ বাবা! কালী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বলেছেন।”
“স্রেফ ধাপ্পা। মিথ্যে বলেছেন। রুটি হলে তো খাওয়া যেত। উনি কিন্তু খাওয়ার কথা বলেননি। যে-কোনো পুজোর প্রসাদ তো খাওয়া হয়, তাই না?”
কেতোর কাকিমা মাথা দুলিয়ে লেট্টুর কথায় সম্মতি দিলেন।—“তাহলে এটা রুটি না হলে কী?”
“ব্যাঙের ছাতা চেনেন কাকিমা? ছত্রাক? পচা ফল বা বাসি রুটি-কেকের উপর হয়?” লেট্টুর সহাস্য প্রশ্ন।
“চিনি তো। কিন্তু এ তো ব্যাঙের ছাতা নয়।”
“তা নয়, তবে ওই একই জাতের। এ হল একরকম ছত্রাক। মিষ্টি রস পেলে তার উপর জন্মায়। খুব দ্রুত বাড়ে। আর তার ফলে ছত্রাকের একটা গোলা তৈরি হয়।”
লেট্টুর কথা শেষ হবার আগেই টুকুন ফুট কাটল—“ছত্রাকের হাইফার গোলা, তাই তো?”
“সাব্বাস! একদম ঠিক বলেছিস।” টুকুনের পিঠ চাপড়ে দিল লেট্টু।
“হাইফা মানে?” কেতোর কাকিমার চোখে বিস্ময়।
“এ হল অনেক সূক্ষ্ম সুতোর মতো অংশ। এই অংশ দিয়েই যে-কোনো ছত্রাকের দেহ তৈরি হয়। মাইক্রোস্কোপের নীচে সব দেখা যায়।”
একটু দম নিয়ে ফের শুরু করল লেট্টু—“ছত্রাকের এই ব্যাপারটা কালী মন্দিরের পুরোহিত জানেন। তাই বলেছেন, এ-প্রসাদ খাওয়া যায় না। আর ওই ছত্রাকের গোলাটা চিনি মেশানো জলে রাখতে বলেছেন কারণ, ছত্রাক চিনির রস পেলে দ্রুত বাড়ে। ছত্রাকের সাদা হাইফাগুলো জট পাকিয়ে দেখতে রুটির মতো হয়। যত দিন যায় ওই ছত্রাকের হাইফার জট তত পুরু হয়। দেখতে ঠিক যেন বান রুটি। তাই ঠাকুরমশাই একে রুটি বলে চালিয়েছেন। মন্দিরের অনেকেই মনে হয় ব্যাপারটা জানে। কেউ একজন হাইফার একটা জট মানে রুটি পুকুরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। লক্ষ রাখছিল কে সেটা পায়। তারপর তাকে টুপি পরিয়ে এক সপ্তাহ পুজো করিয়ে কিছু কামানো যাবে। চিনির রস পেয়ে পুরোনো হাইফার জট থেকে নতুন হাইফার আরেকটা জট মানে রুটি তৈরি হয়ে গেলে সেটা আরেকজনকে দিয়ে দিতে বলেছে। মানে তার বাড়িতেও পুজোপাঠ করে কিছু ইনকাম হবে। আর পুরোনো রুটিটা মন্দিরে দিয়ে দিতে বলেছে কারণ, ওটা দিয়ে আবার কাউকে ডবল রুটির টুপি পরানো যাবে। এভাবে রুটির সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে পুরোহিতদের ইনকামও তত বাড়তে থাকবে।”
এতক্ষণ বলে একটু দম নিয়ে লেট্টু বলল, “এবার ডবল রুটি ধামাকা কী বুঝলেন তো কাকিমা?”
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো লেট্টুর কথাগুলো শুনছিলেন কেতোর কাকিমা।—“তুমি কি শিওর বাবা, ওটা ছত্রাক?”
“একশো ভাগ। ছত্রাকের একটু বয়স হলে তার রেণু তৈরি হয়। তখন তার রঙ সামান্য বাদামি বা লালচে লাগে।”
“তাই বাসি রুটির উপর ছাতা ধরলে কয়েকদিন পর বাদামি দেখায়?” মেনাল্ডোও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
“কারেক্ট! গুড অবজারভেশন।” লেট্টু মেনাল্ডোর পিঠ চাপড়ে দেয়।
“তুমি কী করে জানলে ওটা ছত্রাক?” কেতো ফুট কাটল।
“ওরে গাধা, আমি প্রমাণ ছাড়া কোনও সিদ্ধান্তে কখনও পৌঁছোই না। আমি ওই রুটির একটা টুকরো নিয়ে তোদের সন্দীপ-স্যারের বাড়ি গিয়েছিলাম। স্যার তাঁর ল্যাবে পরীক্ষা করে প্রমাণ করে দিয়েছেন। বুঝলি হতভাগা?”
“ওরেব্বাবা! এত কাণ্ড! এ তো বিরাট জালিয়াতি! ফালতু ফালতু এই ছাতার মাথা রুটির জন্য আমার অনেকগুলো টাকা নষ্ট হল।” কেতোর কাকিমার কথায় এবার হতাশা ঝরে পড়ল।—“মন্দিরে যাই একবার! ওই পুরোহিতের একদিন কি আমার একদিন!” গজরাতে গজরাতে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন কেতোর কাকিমা।
পিচকু এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু দেখছিল, শুনছিল। এবার সে ফুট কাটল—“সবই তো বুঝলুম লেট্টুদা, কিন্তু তোমার বাড়িতে রুটি ডবল হল না কেন?”
“আন্দাজ কর দেখি। ঠিক বললে বুঝব তোরা আমার শিষ্য হবার যোগ্য।” লেট্টুর চোখে-মুখে দুষ্টুমি।
পাঁচজন সমস্বরে বলে উঠল, “জলে চিনি মেশাওনি।”
“সাব্বাস! তোরা আমার মান রাখলি। নে, আজ বিকেলে পরেশদার দোকানে সব খরচ আমার।”
সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর লেট্টুদা, হিপ হিপ হুররে!”