FUNবিজ্ঞান-মারিয়ার ছেলে দিমিত্রি(দ্বিতীয় পর্ব) -অমিতাভ প্রামাণিক-শীত২০২২

প্রথম পর্ব –>

দ্বিতীয় পর্ব

bigganmendeleev

রসায়নশাস্ত্রের মেরুদণ্ড যে পিরিওডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি, তার জন্ম হয়েছিল তাঁর মস্তিষ্কে। অথচ ছেলেবেলাটা তাঁর মোটেই ফুল বিছানো পথে এগোনো হয়নি। তবে অমন মা যাঁর সহায় তাঁকে কে রুখবে? রইল  বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ-এর ছেলেবেলার  গল্প। 

দুই

পড়াশোনা তো শেষ হ’ল। কিন্তু এখন সেই শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে ভর্তির সময়ের চুক্তি অনুযায়ী যত বছর ধরে পড়াশোনা করেছে, তার দ্বিগুণ সময় শিক্ষকতা করতে হবে। গত তিন বছর ধরে অসুস্থ শরীরে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে দিমিত্রি, পরীক্ষায় গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছে, তাকে তো উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে! কিন্তু না, রাশিয়ায় নিয়মের নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। সরকার যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, তাই করতে হবে। অর্থাৎ পড়ানো।

পড়াশোনার শেষ বছরে তাদের যে বাধ্যতামূলক বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হয়েছে, দিমিত্রি সেই গবেষণা করেছে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আলেকজান্ডার আব্রামোভিচ ভস্ক্রেসেনস্কির অধীনে, খনিজ পদার্থের বিশ্লেষণের ওপর। অধ্যাপক ভস্ক্রেসেনস্কি বছর পঁচিশেক আগে ইয়াস্টাস ফন লিবিগের ছাত্র ছিলেন, যে লিবিগের নাম অনুসারে কোনো তরলের বাষ্পকে শীতল করে পুনরায় তরলীভূত করার কাচের লম্বা জ্যাকেট-পরানো সরঞ্জামকে বলা হয় লিবিগ ঘনীভাবক (কন্ডেনসার)। কালক্রমে ভস্ক্রেসেনস্কি পরিচিত হবেন রাশিয়ান রসায়নের পিতামহ হিসাবে।

Bigganmendeleev01

দিমিত্রি শুকনো মুখে ভস্ক্রেসেনস্কির কাছে গিয়ে দাঁড়াল – স্যার, আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই। ম্যাজিস্টার ডিগ্রি করতে চাই। স্কুলের ছাত্র বা শিক্ষকদের নয়, আমি পড়াতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। গবেষণা করতে চাই। ভস্ক্রেসেনস্কি দিমিত্রির অবস্থা জানেন ভালোই। এবং জানেন দিমিত্রি এক অসাধারণ পরিশ্রমী ও মেধাবী প্রতিভাধর বালক। অসুস্থ শরীরেও তার গবেষণার কাজকর্ম খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু তিনিও নিরুপায়। দেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধে কিছু করার উপায় নেই। তবু তিনি বললেন – আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

ম্যাজিস্টার ডিগ্রি প্রয়োজন হয় উচ্চতর শিক্ষার শিক্ষকতা করতে। তারও একাধিক স্তর। ভস্ক্রেসেনস্কি দিমিত্রির উচ্চতর পাঠের সুপারিশ করলেও অবিলম্বে তাকে নির্দেশ দেওয়া হল পেডাগজিক্যাল ইনস্টিট্যুটে পড়ানো শুরু করতে। কিন্তু বাদ সাধলেন সেখানকার ডাক্তার। দিমিত্রির হীনস্বাস্থ্য এবং তাঁদের মতে সে যক্ষ্মাযোগে আক্রান্ত দেখে তাঁরা সুপারিশ করলেন পড়ানোর জন্য তাকে দক্ষিণের কোনো অপেক্ষাকৃত গরম জায়গায় পাঠানো হোক। সেন্ট পিটার্সবার্গের মতো কনকনে শীতের দেশে তার রোগ উপশম হওয়া সম্ভব নয়। ডাক্তারদের এই সুপারিশের পেছনে ভস্ক্রেসেনস্কির হাত ছিল কিনা, তা জানা যায়নি।

আমাদের দেশে যেমন চেঞ্জে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন বৈদ্যরা, তেমনি দিমিত্রির জন্য যে জায়গায় পড়াতে পাঠানোর কথা স্থির হল, তার নাম ওডেসা। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে দু হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে এই ওডেসা কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী এক মনোরম জলহাওয়ার শহর, বর্তমান ইউক্রেনের অংশ। বড়সড় শহর ওডেসার জিমনাশিয়াম অর্থাৎ শিক্ষায়তনটা এক প্রাক্তন বিখ্যাত জেস্যুইট কলেজের অংশ, ওদের গ্রন্থাগারটা বিশাল, তাতে প্রচুর বইপত্তর।

এ সব তো ঠিক হ’ল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেখানে যাওয়ার সময় তার হাতে যে কাগজ এল সরকারি দপ্তর থেকে, সেখানে জায়গার নামে গড়বড় থাকায় ওডেসার বদলে দিমিত্রি যেখানে পৌঁছাল, সে এক খুদে শহর সিম্ফেরোপোল। কৃষ্ণসাগরের কাছেই ক্রিমিয়া উপদ্বীপে, বর্তমানে যে জায়গাটা ইউক্রেন দাবি করে তাদের বলে অথচ যেখানে রাশিয়ার আধিপত্য ষোলো আনা। ওডেসা থেকে স্থলপথে তার দূরত্ব শ’ পাঁচেক কিলোমিটার।

১৮৫৫ সালের ২৫শে অগাস্ট দিমিত্রি সেখানে হাজির হল। এসেই বুঝতে পারল, থাকার পক্ষে এ অতি বিপজ্জনক জায়গা। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অন্যতম সামরিক ঘাঁটি এই সিম্ফেরোপোল, উপকূলবর্তী সেভাস্টোপোল শহরগুলো। শহর জুড়ে গাদা গাদা হাসপাতাল, সব আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য। এখানে সে বাস করবেই বা কী করে, পড়াবেই বা কাদের আর নিজেই বা কী করে পড়াশোনা চালাবে? অবিলম্বে সে চিঠি লিখল ভস্ক্রেসেনস্কি ও পেডাগজিক্যাল ইনস্টিট্যুটের কর্তাব্যক্তিদের।

লাভের মধ্যে এই, এই হাসপাতালেই এক নামী শল্য চিকিৎসক ডাক্তার পিরোগভকে সে দেখাতে গেছিল একদিন। ডাক্তারবাবু অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে রায় দিলেন – দিমিত্রির রোগ আর যাই হোক, যক্ষ্মা নয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দিমিত্রি। যক্ষ্মার বলতে গেলে কোনো চিকিৎসাই নেই, তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। এর অর্থ দিমিত্রির এখনই প্রাণহানির সম্ভাবনা সম্ভবত নেই। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করলে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যেতে পারে, উপকূলীয় উষ্ণ জলবায়ুর দেশ যদিও মনোরম, স্বাস্থ্যের কারণে এখানে থাকার যে কথা বলেছিল চিকিৎসকেরা, তেমন প্রয়োজন নেই।

চিঠিপত্রের ফল ফলল। মাস দুয়েক পরেই অক্টোবরের শেষদিকে দিমিত্রি পৌঁছে গেল ওডেসায়। খুব মন দিয়ে পড়াতে লাগল গণিত আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। সঙ্গে চলতে লাগল একাধিক পদার্থের কেলাসের গঠনসাম্যের (আইসোমরফিজমের) ওপর তার ম্যাজিস্টার সন্দর্ভ (থিসিস) লেখা। এই কাজে সাহায্যের জন্য সে মাঝেমাঝেই চিঠি লিখতে লাগল ওপরওয়ালাদের, অনুরোধ দুটো। এক, সেন্ট পিটার্সবার্গে তাকে ফিরিয়ে সেখানকার গবেষণাগার ব্যবহার করতে দেওয়া আর দুই, গবেষণার জন্যই তাকে বৃত্তিসহ বিদেশে পাঠানো। যেহেতু তার যক্ষ্মা হয়নি, ওডেসাতে পড়ে থেকে তার উচ্চশিক্ষার সাধ মিটবে না।

দ্বিতীয় অনুরোধ কানে নিল না কর্তৃপক্ষ আপাতত। ছ’মাস ওডেসাতে কাজ করার পর তাকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল। ১৮৫৬ সালের মে মাসে ফিরে গেল দিমিত্রি।

* * *

ফিরে এসে যা শুনল, তা দিমিত্রির পক্ষে আদৌ আশানুরূপ নয়। পেডাগজিক্যাল ইনস্টিট্যুট নিয়ে বড়োসড়ো রাজনৈতিক ঝামেলা শুরু হয়েছে। এই রকম প্রতিষ্ঠানের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা, এই নিয়ে বিবাদ। এখানে ম্যাজিস্টার ডিগ্রি করে সে কী করবে? গঠনসাম্য ও আপেক্ষিক আয়তনের (স্পেসিফিক ভল্যুমের) ওপর তার ম্যাজিস্টার সন্দর্ভ প্রস্তুত, সে ঠিক করল সেন্ট পিটার্সবার্গ ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলে এই সন্দর্ভ জমা দেবে। সেপ্টেম্বরে সেখানে তার পরীক্ষা, যেখানে উত্তীর্ণ হলে প্রাথমিক ম্যাজিস্টার ডিগ্রি পাবে সে। চাকরি পাকা করতে হলে অবশ্য আরও একটা সন্দর্ভ জমা দিতে হবে এবং তার পরীক্ষকদেরও সন্তুষ্ট করতে হবে। চাকরির বাজার এমনিতেও খারাপ, কিন্তু দিমিত্রিকে চেষ্টা তো চালিয়ে যেতেই হবে।

মাঝেমধ্যেই মায়ের কথা মনে পড়ে দিমিত্রির। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় ও শরীরের শেষ সামর্থ্যটুকু মা কেবল তার উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার জন্যেই খরচ করে গেছেন। তাঁর ইচ্ছাকে কোনোভাবেই অপূর্ণ রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে।

৯ই সেপ্টেম্বরের প্রাথমিক ম্যাজিস্টারের পরীক্ষার সফলভাবে উৎরে গেল দিমিত্রি। পাশ করেই খবর নিল সে, পরের পরীক্ষায় কত কম সময়ে বসা সম্ভব। জানা গেল, সেটা পরের মাসের মাঝামাঝি। হাতে মাত্র এক মাস সময়, এর মধ্যে কি আর একটা সন্দর্ভ লিখে জমা দেওয়া সম্ভব! 

দিনরাত এক করে পড়াশোনা ও লেখালিখি করতে লাগল দিমিত্রি। পরের সন্দর্ভের জন্যে সে বিষয় নির্বাচন করেছে সিলিকা যৌগের স্ট্রাকচার বা কাঠামো। অমানুষিক পরিশ্রম করে এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সে জোগাড় করতে লাগল, লিখতে লাগল তার সন্দর্ভে। এই ম্যাজিস্টার ডিগ্রিটা পেলে তবেই সে স্থায়ী চাকরির জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবে। তার স্বপ্ন সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি, ওটাই রাজধানীর সবচেয়ে নামী বিশ্ববিদ্যালয়।

একুশে অক্টোবরের সেই পরীক্ষাতেও ম্যাজিস্টার সন্দর্ভ ‘ডিফেন্ড’ করে সসম্মানে পাশ করল দিমিত্রি।

সময় ভালো থাকলে এই সময় তার একটা সুন্দর চাকরির চিঠি হাতে পেয়ে যাওয়ার কথা, যাতে লেখা থাকবে – মহাশয়, আপনার আবেদনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে অমুক বিভাগে তমুক পদে নিয়োগ করছে, আপনি এত তারিখের মধ্যে এ বিষয়ে আপনার সম্মতিপত্র পাঠান। কিন্তু সময় খারাপ। সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে এই মুহূর্তে নতুন নিয়োগের আশা নেই। তার আবেদনের জবাবে সে যে চিঠিটা পেল, তা অন্য ধরনের। তাকে একেবারে নিরাশ করা হয়নি, কিন্তু যে পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তার নাম – প্রাইভেট ডসেন্ট। এই পদের চাকরি মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নির্দিষ্ট কোর্স পড়াতে পারবে, যদিও তাকে কোনো বেতন দেওয়া হবে না। যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা তার ওই কোর্স পড়তে চাইবে, তারা ওই কোর্স ফী বাবদ যা দেবে, সেটাই ওই প্রাইভেট ডসেন্টের প্রাপ্য।

দিমিত্রি জানে, এতে টাকাপয়সা খুব কম, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী! প্রাইভেট ডসেন্ট হিসাবে কিছুদিন চালাতে পারলে হয়ত এক সময় বেতনসহ চাকরিটা পাকাপাকি হয়ে যেতে পারে। ভস্ক্রেসেনস্কির বয়স হয়েছে, তিনি অবসর নিলে তার সুযোগ আসতে পারে চাকরির। কিন্তু এই মুহূর্তে তো কিছু রোজগার করতেই হবে। একটা নয়, সে চেষ্টা করবে একাধিক কোর্স পড়াতে। রসায়নের তত্ত্ব, রসায়নের ইতিহাস, জৈব রসায়ন – সমস্ত কোর্স পড়ানোর প্রস্তাব করল সে। সঙ্গে স্নাতক ছাত্রদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেওয়ার প্রস্তাবও।

১৮৫৭ সালের শুরু থেকে দিমিত্রি ক্লাস নিতে শুরু করল।

এ সমস্ত করেও যা উপার্জন হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটা বিজ্ঞানপত্রিকা (জার্নাল) বের করে, সেখানে ছোট ছোট বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিবেদন লিখে পাঠালে যদি ছাপা হয়, তবে তার জন্যে কিঞ্চিৎ পয়সা দেয়। কোনো সভা-সমিতিতে গিয়ে এ রকম কিছু লেখা পাঠ করলে সামান্য কিছু দক্ষিণা পাওয়া যায়। দিমিত্রি এর সমস্ত রকম ফন্দিফিকির বের করে চেষ্টা চালাতে লাগল। ওডেসা থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসার পর সোফিয়া কাশ নামে এক তরুণীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়ে এনগেজমেন্ট অর্থাৎ বাগদানও হয়ে গেছে।

অথচ দিমিত্রির উপার্জন নামমাত্র। আয়ের জন্য তাকে কীই না করতে হয়! সবসময় সে ব্যস্ত যাতে দু-পয়সা আয় করা যায়। এই অবস্থায় একদিন দিমিত্রিকে হতাশ করে তাদের বাগদান ভেঙে দিল সোফিয়া।

* * *

দু-বছর এইভাবে কাটানোর পর ১৮৫৮ সালের শেষদিকে একটা ভালো খবর পেল দিমিত্রি। প্রায় বছর আড়াই আগে করা তার আবেদনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য তার এক বিদেশভ্রমণ মঞ্জুর করেছে। সাধারণভাবে যাদের চাকরি পাকাপাকি, তাদের জন্যই এই বৃত্তি দেওয়া হয়, কিন্তু দিমিত্রির কার্যকলাপে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এই বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। বাইশ মাসের ফেলোশিপ। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। এই নিয়ে সে যেখানে খুশি গিয়ে গবেষণা করতে পারে।

দিমিত্রি যদিও রসায়নের আধুনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে মোটামুটি অবহিত, ইওরোপের বিভিন্ন গবেষণাগারে কে কী করছেন, সে তেমনভাবে জানে না। সে ঠিক করল, হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে সে বরং কয়েকটা গবেষণাগারে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে দেখবে কোথায় কীভাবে কেমন গবেষণা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সে কথা বলবে। তার সঙ্গে ভস্ক্রেসেনস্কির চিঠি থাকবে, আশা করা যায় কোথাও অসুবিধা কিছু হবে না।

১৮৫৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সে বের হল এই উদ্দেশ্যে। প্রথম কয়েক মাস চলে গেল প্রায় ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতেই। ল্যাভয়সিয়ের সময় থেকেই স্বপ্নের শহর প্যারিস রসায়নচর্চার জন্য বিখ্যাত। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দিমিত্রি দেখা করল বার্থেলো, ভার্জ এবং ডুমাসের সঙ্গে। জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা পেল স্বনামধন্য ফন লিবিগের। লিবিগ ছিলেন ভস্ক্রেসেনস্কির গবেষণা পরামর্শদাতা, তিনি দিমিত্রিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভস্ক্রেসেনস্কির ব্যাপারে খোঁজখবর নিলেন। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দিমিত্রি দেখল সেখানে তখন চাঁদের হাট। আসর সাজিয়ে বসেছেন রবার্ট বুনসেন, এমিল আর্লেনমায়ার, গুস্তাভ কিরচফ।   

দিমিত্রি তার নিজের গবেষণার জন্য হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিল। শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, হাইডেলবার্গের আর এক আকর্ষণ হচ্ছে সেখানকার লোকজন। শহরে রাশিয়ানদের সংখ্যা প্রচুর। ছাত্রদের প্রতি দশজনের একজন রাশিয়ান। ভাষা নিয়ে দিমিত্রির সমস্যা আছে, রাশিয়ানদের সঙ্গে থাকলে সুবিধা। রবার্ট বুনসেনের খ্যাতিও বিশ্বজোড়া। তাঁকে গাইড হিসাবে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। বছর চারেক আগে গবেষণাগার সহায়ক পিটার ডিসাগার সহায়তায় তিনি গ্যাস বার্নারের ডিজাইনের উন্নতিসাধন করেছেন, তাঁদের আবিষ্কৃত এই ডিজাইন থেকে খুব উচ্চ তাপমাত্রার দুর্দান্ত বিশুদ্ধ নীল শিখা পাওয়া যায়।

Bigganmendeleev03

বিভিন্ন গবেষণাগারে ইতোমধ্যেই এই ডিজাইনের ‘বুনসেন বার্নার’ ব্যবহার হতে শুরু হয়েছে। তিনি এখন গুস্তাভ কিরচফের সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় মৌলিক পদার্থের বর্ণালিবীক্ষণ নিয়ে গবেষণা করবেন ভাবছেন। আগে এ নিয়ে কাজ হলেও সেগুলো ঠিক নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে হয়নি। কিরচফ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, যে আলোর শিখা পাওয়া যাবে, সেই আলোকে প্রিজমের মধ্য দিয়ে পরিবহণ করিয়ে তাদের বর্ণালি পর্যবেক্ষণ করতে। এই উদ্দেশ্যে দুজন মিলে এক নতুন বর্ণালিবীক্ষণ (স্পেক্ট্রোস্কোপ) যন্ত্র তৈরি করেছেন তাঁরা। দিমিত্রিকে ভেবে বের করতে হবে সে কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চায়।

কিছুদিনের মধ্যেই নতুন বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেল দিমিত্রির। তার প্রায় সমবয়সী আলেকজান্ডার বোরোদিন গবেষণা করছে এমিল আর্লেনমায়ারের অধীনে বেঞ্জিনের ডেরিভেটিভ নিয়ে। সে আবার সুরকারও। রাশিয়ান শাস্ত্রীয় সংগীতের বিখ্যাত পাঁচজন সুরকার ‘দ্য ফাইভ’-এর অন্যতম হিসাবে বোরোদিন পরিচিত হবেন। বিখ্যাত সিম্ফনি তার নির্মিত ‘দ্য স্টেপস অভ সেন্ট্রাল এশিয়া’, অপেরা ‘প্রিন্স ইগর’। বোরোদিনের সূত্র ধরেই দিমিত্রির বন্ধুবৃত্তে আরও এলেন বোরোদিনের রাশিয়ান অধ্যাপক রসায়নবিদ নিকোলাই জিনিন, ইনি অবশ্য দিমিত্রির চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়, গবেষণা করেছেন লিবিগের গিসেনের গবেষণাগারে বেঞ্জোয়িন কন্ডেনসেশনের ওপর এবং তার ভিত্তিতে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি পেয়ে সেখানে অধ্যাপনা করছেন। সেখানে তাঁর কাছে কিছুদিন প্রাইভেটে রসায়ন শিক্ষা লাভ করেছিল এক সুইডিশ তরুণ, তার নাম আলফ্রেড নোবেল। সাইকোলজিস্ট ও ফিজিওলজিস্ট ইভান সেচেনভও বন্ধু হল দিমিত্রির।

এক তরুণী জার্মান অভিনেত্রী অ্যাগনেস ফয়েখটম্যানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল দিমিত্রি। রোজা নামে তাদের এক কন্যা জন্মাল।

* * *

রসায়নে, বিশেষ করে জৈব রসায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছিল সে সময়। বিভিন্ন রসায়নবিদ বিভিন্ন ধরনের বিক্রিয়া সম্পাদন করছিলেন, সেই বিক্রিয়াগুলোর মাধ্যমেই তাঁদের নাম পরিচিত হচ্ছিল বিজ্ঞানীমহলে। অ্যাডলফ ভার্জ যেমন শুকনো ইথারে অ্যালকিল হ্যালাইডের সঙ্গে সোডিয়াম ধাতুর বিক্রিয়া করে উৎপাদন করেছেন অ্যালকিল হ্যালাইডের দ্বিগুণ কার্বন সংখ্যাবিশিষ্ট অ্যালকেন, আর সেই বিক্রিয়ার নাম হয়ে গেছে ভার্জ বিক্রিয়া। এসব সত্ত্বেও রসায়নশাস্ত্রে তত্ত্ব বলতে তেমন কিছু নেই। শতাব্দীর গোড়ার দিকে জন ডাল্টন নামে এক ইংরেজ শিক্ষক পরমাণুর গঠন-সংক্রান্ত কিছু তত্ত্বের প্রবর্তন করেছিলেন, অনেকে মানে, অনেকে তা মানে না। আমিদিও অ্যাভোগাড্রো ধারণা দিয়েছেন আণবিক গুরুত্ব তথা মোলের, বলেছেন এক মোল পদার্থে অণুর সংখ্যা একই এবং সেটা গ্যাস হলে নির্দিষ্ট চাপ ও তাপমাত্রায় তার আয়তনও এক। নতুন নতুন মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়েছেন হামফ্রি ডেভি ও জেকব বার্জেলিয়াস। একটা পদার্থ যে অন্য একটা পদার্থের সঙ্গে কীভাবে বিক্রিয়া করে, সে ধারণা কারও কাছেই খুব স্বচ্ছ নয়। কোন জিনিসটা অণু, কোনটা পরমাণু, সেগুলো কীভাবে প্রকাশ করা উচিত, তা নিয়ে রসায়নবিদ-মহলে ব্যাপক দ্বন্দ্ব, জার্মানির কার্লসরুহে শহরে এক বিজ্ঞানসভায় আলোচনা শুনেই দিমিত্রি তা ভালোভাবে বুঝে গেল। একটা মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা যদি পরমাণু হয়, তবে তার একটা পরমাণু অন্য একটা মৌলিক পদার্থের কটা পরমাণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করবে, যাকে বলা যেতে পারে সেই মৌলের যোজ্যতা, এই আলোচনা প্রসঙ্গে পারমাণবিক গুরুত্ব বস্তুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সবাই বিভিন্ন মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব মাপামাপিতে ব্যস্ত। এই সময় বিজ্ঞানী অগস্ত কেকুলে বললেন, কার্বনের যোজ্যতা চার। কার্বনের একটা পরমাণু সর্বাধিক চারখানা অন্য পরমাণুর সঙ্গে জুড়তে পারে।

রবার্ট বুনসেন যদিও বর্ণালিবীক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত, দিমিত্রি ঠিক করল সে বিভিন্ন তরলের মোলার ভল্যুম বের করবে। মোলার ভল্যুম মানে আণবিক গুরুত্বকে ঘনত্ব দিয়ে ভাগ করলে যা হয়, সেটা। এর জন্য ঘনত্ব বের করতে হবে খুব সূক্ষ্মভাবে। এদিকে বুনসেনের গবেষণাগারে এত কিছু আছে, কিন্তু তার কাজে যা যা লাগবে, তার অনেক কিছু নেই। বুনসেনকে নালিশ করে লাভ নেই, তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত।

বিরক্ত দিমিত্রি তার ভাড়াবাড়িকেই গবেষণাগার বানিয়ে ফেলল। বাড়িতে লাগিয়ে নিল গ্যাসের পাইপলাইন। হাইডেলবার্গে যা পাওয়া গেল না, বন আর প্যারিসের অভিজ্ঞ মিস্ত্রিদের ধরে বানিয়ে নিল পাম্প-সহ একাধিক যন্ত্রপাতি। ঘনত্ব তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাপমাত্রা বদলালে ঘনত্ব বদলে যায়, তাই তার দরকার অতি সূক্ষ্ম থার্মোমিটার, সেটা জোগাড় করল। নিজেই ডিজাইন করে তৈরি করিয়ে নিল ঘনত্ব মাপার যন্ত্র – পিকনোমিটার। তার প্রয়োজন অনেক সংখ্যায় কৈশিক নল (ক্যাপিলারি টিউব), কাচের সরঞ্জাম নির্মাণকারী (ব্লোয়ার) ধরে সেগুলোর ব্যবস্থা করল। একমুখ বন্ধ কৈশিক নলে তরল ভরে উচ্চ একাধিক তাপমাত্রায় তাদের আয়তন পর্যবেক্ষণ করতে করতে সে আবিষ্কার করল সেই ঘটনার, যাকে আমরা এখন সঙ্কট (ক্রিটিক্যাল) তাপমাত্রা বলে জানি।

Bigganmendeleev02

এ সব করতে যত সময় গেল, তাতে তার গবেষণার কাজের যতটা অগ্রগতি হওয়া সম্ভব ছিল, ততটা হল না। নিরুপায় দিমিত্রি সেন্ট পিটার্সবার্গে চিঠি লিখল, তার ফেলোশিপের সময় কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দেওয়া হোক। সে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস নিয়ে গবেষণা করছে, আর কিছুদিন গেলে সে খুবই ভালো ফল পাবে। কর্তৃপক্ষ সেই অনুরোধ নামঞ্জুর করল। তাদের পাঠানো টাকা ছাড়া জার্মানিতে থাকা মুশকিল।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিমিত্রি ফিরে এল সেন্ট পিটার্সবার্গ। ফিরতেই নতুন চমক। ঠিক পাঁচদিন পর অর্থাৎ ১৯শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ঘোষণা করলেন তার বিখ্যাত মুক্তির ইস্তেহার (এমান্সিপেশন ম্যানিফেস্টো)। চাষের কাজে যে সমস্ত ভূমিহীন শ্রমিকদের নিয়োগ করা হত, তারা ছিল ভূমিদাস অর্থাৎ চাষের জন্য ক্রীতদাস। একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ সামাল দিতে এ ছাড়া উপায় ছিল না, তার ওপর ক্রিমিয়ার যুদ্ধে হেরে জনগণের চোখে জারের প্রতিমূর্তি খুব খারাপ। কিন্তু এই দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে শুরু হল রাজনৈতিক অস্থিরতা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দিমিত্রি জানতে পারল, পেডাগোজিক্যাল ইনস্টিট্যুট চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ও সাময়িকভাবে বন্ধ এবং তার সাধের প্রাইভেট ডোসেন্টের চাকরিটিও গেছে!

সে এক দুর্বিষহ অবস্থা। নিজের খাওয়ার টাকা নেই। প্রবল শীত। তার কোট, বুট সব ছেঁড়া। সেগুলো তালি মারতে যা পয়সা লাগে, সেগুলো জোগাড় করতেও তাকে ধার করতে হয়। হাইডেলবার্গে সে ছেড়ে এসেছে অ্যাগনেস ও কন্যা রোজাকে। তাদের মাস গেলে টাকা পাঠাতে হয়, সে জন্য ইতোমধ্যেই অনেক টাকা ধার করে ফেলেছে সে। টাকার চিন্তায় তার নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল।

যেখানে যেখানে পড়ালে যৎকিঞ্চিৎ টাকা রোজগার করা যায়, সব জায়গাতেই চেষ্টা চালাতে লাগল দিমিত্রি। অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে পড়াতে লাগল স্কুলে। রেলরোড ইঞ্জিনিয়ারদের স্কুলে রসায়নের শিক্ষক দরকার, দিমিত্রি পড়াতে লাগল সপ্তাহে কুড়ি ঘন্টা করে। অন্য এক ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক দরকার, সেখানে হাজির দিমিত্রি। সৈনিকদের স্কুলে রসায়ন ও ভূগোল পড়ানোর লোক চাই, দিমিত্রি বলল, আমি পড়াব।

এর মধ্যে সে জানতে পেরেছে, ভালো টাকা রোজগারের একটা উপায় হচ্ছে যদি একটা বড়োসড়ো পুরস্কার পাওয়া যায়। ডেমিডভ পুরস্কার নামে একটা মোটা অঙ্কের পুরস্কার আছে উৎকৃষ্ট বিজ্ঞানের বই লেখার জন্য। সে অবশ্য এলেবেলে বইয়ের জন্য নয়। বই হতে হবে উচ্চমানের তো বটেই, এখন আমরা যাকে বেস্ট-সেলার বলি, সেই গোত্রেরও।

লেখালিখি করতে দিমিত্রির বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই। সে তো যেখানেই লিখে দু-পয়সা পাওয়া যায়, সেখানেই লেখা পাঠায়। কিন্তু বই লেখার জন্য তো চাই অভিজ্ঞতা, যা তার নেই। ফট করে বেস্ট-সেলিং অথর হওয়া যায় নাকি?

তার চাইতেও বড় কথা, সেই বই পুরস্কার কমিটির কাছে জমা দেওয়ার শেষ তারিখ জুন মাসের মাঝামাঝি। ফেব্রুয়ারি তো শেষ হয় হয়। তার হাতে আছে মাত্র তিনটি মাস।

নিজের পুরনো ডায়েরি খুলে বসল দিমিত্রি। দেখল মায়ের মৃত্যুদিনে তার নিজের হাতে লেখা মায়ের শেষ ইচ্ছা – কথা নয়, কাজে যেন মতি থাকে তোমার। ধৈর্যসহকারে অন্বেষণ করে যাবে ঐশ্বরিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যের। 

উপায় নেই, অন্য কোনো রাস্তা নেই। বই তাকে লিখতেই হবে। যে করেই হোক, তিন মাসে শেষ করতেই হবে। এই পুরস্কার তাকে পেতেই হবে যে-ভাবেই হোক। 

কাগজ কলম নিয়ে বই লিখতে বসল দিমিত্রি।

(ক্রমশ)

 

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s