প্রথম পর্ব–>
এবার দ্বিতীয় ঝামেলাটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আলোর গতিকে নিখুঁতভাবে মাপতে হবে। মাপের ভেতরে ‘প্রায়’ শব্দটা থাকা চলবে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল গতি হচ্ছে আলোর গতি। স্থির-অস্থির সবার কাছে আলোর গতির মান এক। আলোর গতির (C) নিখুঁত মাপ চাই।
এবার বিজ্ঞানীদের গিজগিজে বুদ্ধির জয়। প্যারিস মিউজিয়ামে রাখা প্ল্যাটিনামে তৈরি এক মিটার লম্বা রডটাকে সঠিক ‘এক মিটার’ বলা হয়। সেই মাপটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক নতুন ‘মিটার’ (Meter) তৈরি করা হয়েছে। আলোর গতি মাপার জন্য ওই নতুন মিটার ব্যবহার করলে ‘প্রায়’ শব্দটা লাগবে না। এমনকি ভগ্নাংশ ও দশমিক বিন্দুও লাগবে না।
কীভাবে এই যুদ্ধ জয় করা হয়েছে তা বলবার চেষ্টা করছি। প্রথমে খুব ভালো মাপ। তারপরে আরও ভালো মাপ। তারপরে আরও, আরও ভালো মাপ। এইভাবে এগিয়ে C = ‘প্রায় 299792458’ মিটারে দাঁড়াল।
বিজ্ঞানীরা বললেন, আলো এক সেকেন্ডে যতটা পথ চলতে পারে, সেই রাস্তাকে 299792458 দিয়ে ভাগ করলে যতটা লম্বা হবে, এই নতুন মিটার ঠিক ততটাই লম্বা। সব ঝামেলার অবসান। এখন বুক ফুলিয়ে বলা যায়, আলো সেকেন্ডে 299792458 মিটার পথ চলে—বেশি নয়, কমও নয়।
বিজ্ঞানীদের মাথা ঠান্ডা। কিন্তু এই নতুন মিটার আর নতুন সেকেন্ডকে নিয়ে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়বে না তো? দুই-তিন গজ কাপড় কেনা, অথবা সময়মতো অফিস যাওয়া—সবকিছু ভণ্ডুল হবে না তো?
না, সেই ভয় নেই। পুরোনো আর নতুন মিটারের ফারাক এতটাই কম যে, খালি চোখ তো দূর স্থান, সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা যাবে না। এই নতুন মিটার সাধারণ মানুষের জীবনে কোনোই প্রভাব ফেলবে না।
পুরোনো আর নতুন সেকেন্ডের মধ্যেও ফারাক অতি নগণ্য। যদি নতুন সেকেন্ডের ঘড়ি আর পুরোনো সেকেন্ডের ঘড়িকে পাশাপাশি রাখা হয়, তখন তাদের আলাদা করা শক্ত। দুটো ঘড়ি একই সময় দেখাবে। কয়েক বছর বাদে হয়তো দু-এক সেকেন্ডের তফাত হতে পারে, নাও হতে পারে।
বয়স বাড়ার বিপত্তি
ছোটবেলায় স্থির আর অস্থির দিব্যি বুঝতে পারতাম। নতুন সেকেন্ড, পুরোনো সেকেন্ড ইত্যাদি সমস্যা মনের উপর কোনও ছাপ ফেলত না। বড়ো হয়ে পণ্ডিতদের লেখা পড়ে নিজের জ্ঞান বাড়াবার চেষ্টা করাটাই কাল হল। বুদ্ধি গুলিয়ে গেল; স্থির আর অস্থির জট পাকিয়ে গেল।
কেন গুলিয়ে গেছে, সেই কথাটা বলার চেষ্টা করছি। আমরা জানি যে, পৃথিবী তার গোলগাল মোটাসোটা শরীর নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় এক পাক খায়। সেই সঙ্গে আমরাও ঘুরছি। বিনা পয়সার চরকি পাক।
পৃথিবীর আরও একটা চরকি পাক আছে। সূর্যের চারদিকে ঘুরপাক খাওয়া। বছরে এক পাক হলে কী হবে, গতিবেগ খুব কড়া। ঘণ্টায় এক লক্ষ কিলোমিটারের থেকেও বেশি। আর চরকি পাকের রাস্তাও যথেষ্ট লম্বা। প্রায় একশো কোটি কিলোমিটার। কোনও রেসিং কার অথবা কোনও সুপার-সোনিক প্লেনও আমাদের পৃথিবীর কাছে পাত্তাই পাবে না।
সূর্যের চারপাশে এক পাক খেতে পৃথিবীর পাক্কা এক বছর লাগে। ওই সময়ে পৃথিবী নিজ অক্ষের উপরে মোটামুটি ৩৬৬ বার পাক খায়। কেউ হয়তো ভাবছে যে ৩৬৫ লিখতে গিয়ে ৩৬৬ লিখে ফেলেছি। তা কিন্তু নয়। আসল সংখ্যাটা হচ্ছে, ৩৬৬.২৪২৫-এর মতন। খুচরো অংশটা বাদ দিয়ে লিখেছি ‘মোটামুটি ৩৬৬ বার’।
পৃথিবী বছরে ৩৬৬ পাক খায়, অথচ মাত্র ৩৬৫ বার দিন-রাত হয়। ওই বাড়তি পাকটা কোথায় গেল? বাড়তি পাকের গল্পটা বলছি। পৃথিবীটা যদি ২৪ ঘণ্টা পাক খাওয়া বন্ধ করে, তবে প্রতিদিনের সূর্য ওঠা আর ডোবা বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবী তখনও সূর্যের চারদিকে এক পাক খাবে। আমরা দেখব সূর্য বছরে একবার পশ্চিমে উদয় হয়ে পূর্বদিকে ডুবে গেল।
সূর্যের চারদিকে এক পাক খাওয়ার ফলে বছরে একটা উলটো দিন-রাত হয়। অর্থাৎ, বছরে ৩৬৬টা সোজা দিন-রাত আর একটা উলটো দিন-রাত হয়। তাই ৩৬৬ পাকের এক পাক খুলে যায়, বাকি থাকে ৩৬৫ পাক। (৩৬৬-র পরের দশমিক সংখ্যাটা জমা হয়ে ‘লিপইয়ার’ তৈরি করে।)
এই ২৪ ঘণ্টার চরকি আর এক বছরের চরকি একসঙ্গে চলছে। এই দুই চরকি পাকের ফলে পৃথিবীর ভ্রমণ পথ এক অতিকায় অমৃতির মতো দেখায়।
এবার আমাদের তিন নম্বর বিনা পয়সার চরকির কথা বলছি।
এই মহাকাশে প্রায় দশ হাজার কোটি তারার ঝাঁক (Galaxy) আছে। তার মধ্যে একটি ঝাঁকের নাম ‘ছায়াপথ’ (Milky Way)। ওই ছায়াপথকে অনেকে আবার ‘আকাশগঙ্গা’ নামে চেনে।
এই ছায়াপথে কুড়ি হাজার কোটির থেকেও বেশি তারা বাস করে। সেই তারাদের মধ্যে একটি তারা আমাদের সুজ্জিমামা। তাই আমরাও এই ছায়াপথের বাসিন্দা। এই ছায়াপথ তার বিশ হাজার কোটি তারার দলবল নিয়ে মহাশূন্যে পাক খাচ্ছে। আমাদের তিন নম্বর বিনা পয়সার চরকি।
মহাকাশে এইরকমের বিনা পয়সার ছোটাছুটি কত আছে কে জানে। সব ছোটাছুটি একসঙ্গে করলে মনে হবে এক বস্তা জট পাকানো স্প্রিং। ওই জটিল পথের একটা সহজ সরল গড় হিসাব কি সম্ভব?
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ- পার্থ চক্রবর্তী