FUNবিজ্ঞান-মাত্রাতিরিক্ত-বুমা ব্যানার্জি দাস- বসন্ত২০২৩

bigganmatratirikto00

১৮৮৪ সাল। এডউইন অ্যাবট নামে এক ইংরেজ স্কুলশিক্ষক অদ্ভুত এক কাহিনি লিখলেন। তাঁর কাহিনির চরিত্ররা এক দ্বিমাত্রিক (two dimensional) জগতের বাসিন্দা। সেই জগতের নাম ফ্ল্যাটল্যান্ড। দ্বিমাত্রিক হওয়ার দরুন স্বাভাবিকভাবেই সে-জগতে আছে কেবল দুটি মাত্রা (dimension)—দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ। বাসিন্দাদের দেখতে কীরকম তোমরা বুঝতেই পারছ।

bigganmatratirikto01

অর্থাৎ, তাদের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ থাকলেও উচ্চতা বলে কোনও ব্যাপার সে-জগতে নেই। একে অন্যকে তারা দেখতেও পায় না সম্পূর্ণভাবে। এহেন জগতে এসে উপস্থিত হল এক গোলক, যার কিনা আছে তৃতীয় এক মাত্রা—উচ্চতা।

bigganmatratirikto02

একটু ভাবা যাক দ্বিমাত্রিক জগতের বাসিন্দা বর্গক্ষেত্র মহাশয় এই আগন্তুককে কেমনভাবে দেখতে পাবে বা দেখতে আদৌ পাবে কি না। তার পৃথিবীর বাসিন্দারা উচ্চতা দেখতে পাওয়া দূরে থাক, জানেই না সেটা কী।

একটু বুঝে নেওয়া যাক। একটি মাত্র মাত্রা-বিশিষ্ট বস্তুর আছে কেবল দৈর্ঘ্য। যেমন, একটি লাইন।

bigganmatratirikto03

এই মাত্রা ধরে আমরা বাঁ অথবা ডান দিকে যেতে পারি।

দ্বিমাত্রিক বস্তুর আছে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ। যেমন আমাদের সদ্য পরিচিত বর্গক্ষেত্র মহাশয়। এই দ্বিতীয় মাত্রা ধরে আমরা সামনে বা পিছনে যেতে পারি।

bigganmatratirikto04

এবার আসা যাক তৃতীয় মাত্রাতে। অর্থাৎ, বস্তুর উচ্চতা। আগন্তুক গোলকটির যেমন আছে।

bigganmatratirikto05

এই তৃতীয় মাত্রা ধরে আমরা উপরে বা নীচে যেতে পারি। একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার, আমি মাত্রা নির্দেশক লাইনগুলোকে একে অন্যের সঙ্গে নব্বই ডিগ্রি বা সমকোণে রেখেছি বোঝার সুবিধের জন্য।

এবার দেখা যাক ত্রিমাত্রিক গোলক যখন ফ্ল্যাটল্যান্ডে এসে ঢুকছে, তাকে দেখাচ্ছে কেমন। একটু ভাবলেই তোমরা বুঝতে পারবে ফ্ল্যাটল্যান্ড-নিবাসী বর্গক্ষেত্র মহাশয় গোলককে প্রথমে দেখবে একটা বিন্দু, তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে হবে একটা গোলাকার ক্ষেত্র—সেটা আয়তনে বাড়বে, তারপর আবার কমতে কমতে বিন্দু হয়ে একেবারে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, গোলকটির বিভিন্ন অংশের প্রস্থচ্ছেদ (cross-section) কেবল দৃশ্যমান হবে। গোটা গোলকটাকে ফ্ল্যাটল্যান্ডবাসীরা কখনোই দেখতে পাবে না। ঠিক এইরকম—

bigganmatratirikto06

এসব ভয়ানক কাণ্ড দেখে তারা ভাবতেই পারে, ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের সুপার পাওয়ার আছে, তারা কথায় কথায় কোথাও ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে। সৌভাগ্যবশত আমাদের জগৎ, অন্তত আমরা যেটুকু দেখতে পাই, সেটি ত্রিমাত্রিক। কিন্তু এখানেও একটা মজা আছে। আমাদের রেটিনাতে যে ছবি পড়ে, তা কিন্তু একেবারে ক্যামেরায় তোলা ছবির মতোই দ্বিমাত্রিক। তাহলে আমরা দেখি কী করে? রেটিনার উপর পড়া সেই ছবির নানা তথ্য থেকে আমাদের মস্তিষ্ক ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে। প্রথমত, আমাদের দুটি চোখ পাশাপাশি সামান্য তফাতে থাকার ফলে একটু হলেও তারা আলাদা ছবি পাঠায় মস্তিষ্ককে। একই দৃশ্যের এই সামান্য আলাদা ছবি মস্তিষ্ককে সেই দৃশ্যের ডেপথ (উচ্চতা হোক কি গভীরতা) বুঝতে সাহায্য করে। তাছাড়া বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত বস্তুর উপর প্রতিফলিত আলোর তারতম্য, সামনে অবস্থিত বস্তুর পেছনের বস্তুকে ঢেকে দেওয়া, দূরত্বের সঙ্গে বস্তুর আয়তনের তারতম্য এসব প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে তবেই মস্তিষ্ক গোটা দৃশ্যটা তৈরি করতে পারে। তাহলে কি কারও একটা চোখে সমস্যা থাকলে বা একটা চোখে একেবারেই দৃষ্টি না থাকলে সে দ্বিমাত্রিক দেখবে সবকিছু? অবশ্যই তা নয়। একটা রেটিনার তথ্য থেকেই মস্তিষ্ক ত্রিমাত্রিক দৃশ্য তৈরি করবে, তবে তার সঙ্গে দুটো রেটিনার তথ্য থেকে তৈরি করা দৃশ্যের কিছু তফাত থাকতে পারে, থাকেও অনেক ক্ষেত্রে। ডাক্তারদের মতে, জনসংখ্যার অন্তত কুড়ি শতাংশ মানুষ ঠিকঠাক ত্রিমাত্রিক দৃশ্য অনুভব করতে পারেন না।

bigganmatratirikto07

অর্থাৎ, ডেপথ পারসেপশন মানে দূরত্ব বা গভীরতার (উচ্চতার) সঠিক অনুমান করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা তাদের থাকে না। ঘনঘন হোঁচট খান তারা, সিঁড়ি দিয়ে নামতে উঠতে অসুবিধায় পড়েন। তবে ত্রিমাত্রিক বস্তুকে একসঙ্গে সম্পূর্ণরূপে দেখার ক্ষমতা কিন্তু কারোরই নেই। একটা বাক্সের সবক’টা দিক কি আমরা দেখতে পাই একসঙ্গে?

উপরের ছবিটাকে যদি একটা ত্রিমাত্রিক বাক্স আমরা ভেবে নিই, তাহলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আমরা বাক্সটির তিনটি তল দেখতে পাচ্ছি, বাকি তিনটি কিন্তু আমরা কেবল অনুমান করে নিচ্ছি যে আছে, আসলে সেগুলো আমাদের দৃষ্টির বাইরে। সাধারণ একটা বাক্স বা ঘনকের ক্ষেত্রে এই অনুমান বা মস্তিষ্ক যা ছবি তৈরি করে তা সম্ভবত একেবারেই সঠিক, কিন্তু খুব জটিল কোনও দৃশ্য বা অপ্রতিসম মানে অ্যাসিমেট্রিক্যাল কোনও বস্তুর ক্ষেত্রে এই অনুমান যে একেবারে একশো শতাংশ সঠিক তা কিন্তু আমরা বলতে পারি না। সংশয় থাকার জায়গা আছে।

বেশ গুলিয়ে গেল ব্যাপারটা, তাই না? কিন্তু মাত্র এইটুকু গুলিয়ে গেলে তো বিজ্ঞানীদের চলে না। তাই সেই কবে ১৭৫৪ সালে ফরাসি গণিতজ্ঞ ডালেমবেয়ার (d’Alembert) চতুর্থ এক মাত্রার কথা বলেন। বলাই বাহুল্য, কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি তখন। কিছু বছর বাদে বিখ্যাত ইতালিয় গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ জোসেফ লুই লাগ্রঞ্জও (Joseph-Louis Lagrange) এই চতুর্থ মাত্রা নিয়ে কিছু কাজ শুরু করেন, তবে সেটাও বেশিদূর এগোয়নি। এর পর ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ এবং কল্পবিজ্ঞান লেখক চার্লস হাওয়ার্ড হিন্টন তাঁর একটি প্রবন্ধে এক অদ্ভুত প্রস্তাব রাখেন। সেটা বুঝতে সেই ফ্ল্যাটল্যান্ডের কথা আমাদের আবার একটু ভাবতে হবে। যেমন সেখানকার বাসিন্দারা ত্রিমাত্রিক গোলকের কেবল দ্বিমাত্রিক প্রস্থচ্ছেদ (cross-section) দেখতে পায়, ঠিক তেমনভাবে আমাদের চারপাশের জগৎকে আমরা কোনও চতুর্মাত্রিক জগতের ত্রিমাত্রিক প্রস্থচ্ছেদ ভাবতেই তো পারি। এই চিন্তাটাই হিন্টনের মনে আসে, আর ব্যাপারটা কেবল কল্পনা করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন না, চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি কেমন হতে পারে, সেটা নিয়ে যথারীতি অঙ্কও কষতে শুরু করে দেন। খুব সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করি।

bigganmatratirikto08

প্রথম ছবিটা লাইনের অর্থাৎ একমাত্রিক বস্তুর। এর কোনও সমস্যা নেই জীবনে। দ্বিতীয় ছবি দ্বিমাত্রিক, একটি বর্গক্ষেত্র। পাশাপাশি দুটো লাইন, যার প্রান্তগুলো দুটি উল্লম্ব (perpendicular) রেখা দিয়ে জোড়া। এবার ত্রিমাত্রিক বস্তু অর্থাৎ ঘনকের দিকে তাকানো যাক। এখানে দুটি পাশাপাশি বর্গক্ষেত্র, যাদের শীর্ষবিন্দুগুলি (vertices) উল্লম্ব রেখা দিয়ে জোড়া। ঘনকের প্রতিটি তল একটি করে বর্গক্ষেত্র। ঠিক একইরকমভাবে যদি আমরা চতুর্মাত্রিক বস্তুটিকে ভাবতে পারি, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? হঠাৎ দেখলে জটিল লাগলেও ওটা আসলে দুটো পাশাপাশি ঘনক এবং যথারীতি তাদের শীর্ষবিন্দুগুলি উল্লম্ব রেখা দিয়ে জোড়া। আর আগের মতোই এর প্রতিটি তল একটি করে, হ্যাঁ, ঘনক। এই চতুর্মাত্রিক এলিয়েনের মাসতুতো ভাই ঘনকটির একটি নামও দিয়েছিলেন হিন্টন। মার্ভেল স্টুডিওর কল্যাণে সেই নামটা কিন্তু তোমরা সকলেই জানো। এটাই হল বিখ্যাত টেসারাক্ট। বদমাশ লোকি এটাকে চুরি-টুরি করে একাকার করেছিল।

এইবার বিস্তর সমস্যা তৈরি হতে থাকল। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার তিনটি মাত্রা ধরে আমরা না-হয় ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে আর উপরে-নীচে যাতায়াত করতে পারি, কিন্তু আরও একটা মাত্রা যোগ হলে আমরা সেটা ধরে কোন দিকে যাব? এ যে সত্যি মাত্রাছাড়া কাণ্ড! একটাই দিক বাকি থাকছে সম্ভবত—ভিতরে আর বাইরে।

আবার একটু কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যাক। ধরা যাক, সেই ফ্ল্যাটল্যান্ডে একটা দ্বিমাত্রিক দড়ি জট পাকিয়ে পড়ে আছে, উপর দিকে একটু টেনে ধরলেই জট ছেড়ে বেচারা দড়ি সোজা হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে উচ্চতা বলে কিছু না থাকাতে এই একেবারে সহজ কাজটুকুও কেউ করতে পারছে না। এবার এক ত্রিমাত্রিক প্রাণী, না-হয় সেই গোলকটাই এসে দড়িটাকে শুধুমাত্র উপর দিকে টেনে তুলে তার জট-টট খুলে ঠিকঠাক করে দিল। গোলকের কাছে এটা কিছুই নয়, যাকে বলে চাইল্ডস প্লে, কিন্তু ফ্ল্যাটল্যান্ডারদের কাছে মনে হবে এ যেন ঐশ্বরিক কোনও ক্ষমতা। ঠিক তেমন, চতুর্থ মাত্রা যদি ভিতর বা বাইরে যাতায়াত করার ক্ষমতা দিতে পরে তাহলে চতুর্মাত্রিক কেউ হয়তো কোনোরকম ব্যবচ্ছেদ ছাড়াই অপারেশন করে ফেলতে পারবে। কত সহজে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হয়ে যাবে, সেরে উঠতে সময়ও অনেক কম লাগবে, আর আমরা ভাবব তারা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কে জানে আমাদের চারপাশে এরকম চতুর্মাত্রিক প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না, আমরা তাদের সম্পূর্ণভাবে দেখতে পেলে হয়তো বেজায় ভয় পেতাম, কিন্তু যেহেতু দেখতে পাচ্ছি না বা বলা ভালো আংশিক দেখতে পাচ্ছি, তাই তাদের চিনে উঠতে পারছি না, তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারছি না। আরও একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে এখানে। দুটো চোখ ও মস্তিষ্ক একসঙ্গে মিলে আমাদের ত্রিমাত্রিক পৃথিবী দেখতে সক্ষম করে। তাহলে কি তিনটে চোখ থাকলে আমরা চতুর্মাত্রিক পৃথিবীর সন্ধান পেতাম? এটা বলা খুব মুশকিল যদিও, কারণ দেবদেবীর ছবি বা মূর্তি ছাড়া তিনচক্ষু বিশিষ্ট বুদ্ধিমান কাউকে আমরা দেখিনি কখনও।

তোমরাই নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবে আমরা এতক্ষণ যা মাত্রা নিয়ে আলোচনা করলাম তা সমস্তই স্পেশল (spatial) বা স্থানিক। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝতে পারবে আমরা আমাদের রোজকার ত্রিমাত্রিক জগতেও আরও একটি মাত্রা ধরে সমানে এগিয়ে যাই। এমনকি তিনটি নির্দিষ্ট মাত্রার কোনও একটি ধরে না এগিয়েও সেই মাত্রা ধরে কিন্তু এগোতেই থাকি। ঠিক ধরেছ একদম, সেই মাত্রা হল সময়। সারা সকাল যদি টিভির সামনে বসে কিচ্ছুটি না করে কাটিয়ে দাও, তা হলেও সময়ের মাত্রা ধরে কিন্তু এগিয়েই যাচ্ছ অনেকটা। ভিনগ্রহী গোছের চতুর্মাত্রিক প্রাণীদের অস্তিত্বের সম্ভাবনার থেকে সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ধরে নেওয়া অনেকটাই স্বস্তিদায়ক নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা কেবল স্বস্তিদায়ক বলে কোনও জিনিস তো মেনে নেন না, নেওয়া উচিতও নয়। তাহলে দেখা যাক কী দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা।

সেই যে ফরাসী গণিতজ্ঞর কথা বলেছিলাম, যাঁর নামের উচ্চারণ আর বানানের মধ্যে বিশেষ মিল নেই, মানে সেই ডালেমবেয়ার (d’Alembert) ১৭৫৪ সালে একটা এনসাইক্লোপিডিয়ার জন্য লেখা নিবন্ধে সময়কে চতুর্থ মাত্রা বলে উল্লেখ করেছিলেন। ব্যাপার তার থেকে বেশি এগোয়নি, লোকে সম্ভবত মাথার গোলমাল পেট গরম এইসব মন্তব্য করেছিল। এরপর ১৮৮৫ সালে নেচার পত্রিকায় S ছদ্মনামে চারটি মাত্রা নিয়ে কেউ একজন একটি নিবন্ধ লেখেন, তিনিও সময়কে চতুর্থ মাত্রা বলে উল্লেখ করেন। তিনি প্রতিটি মুহূর্তের পরিপ্রেক্ষিতে একটি করে নতুন ত্রিমাত্রিক জগতের কল্পনা করেছিলেন। এই S যে কে ছিলেন, তা জানা যায়নি, তিনি অন্তরালেই থেকে গেছেন।

এরপর ১৮৯৫ সালে এইচ.জি. ওয়েলস তাঁর বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি টাইম মেশিনে টাইম ট্র্যাভেল বা সময়রেখা ধরে অতীত বা ভবিষ্যতে যাত্রার কথা বললেন। সে কাহিনি সাধারণ মানুষের মনে ধরলেও তা কাহিনিই। বিজ্ঞানীদের জন্য তা অবশ্যই যথেষ্ট নয়। সেই সময়েই আর-এক বিখ্যাত মানুষও বলে বসলেন যে সময়কে চতুর্থ মাত্রার মর্যাদা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত কারণ, কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা এমনকি স্থানও সময়ের মাত্রা ছাড়া অসম্পূর্ণ। মানে ধরো, তুমি বন্ধুকে বললে পটাশগড়ের জঙ্গলে দক্ষিণের টিলার উপর দেখা করিস, জরুরি প্ল্যান করার আছে। কিন্তু কখন দেখা করতে হবে সেটা বললে না। তাহলে? দেখা তো হবেই না, বন্ধুবিচ্ছেদ হওয়াও বিচিত্র নয়। এই ঝাঁকড়াচুলো বিজ্ঞানীর জিভ বের করা বিখ্যাত ছবি তোমরা নিশ্চয়ই দেখে থাকবে, তিনিই বিজ্ঞানীপ্রবর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

কিন্তু এরকম বলে দিলেই তো হয় না—অঙ্ক কষে, ফর্মুলা বের করে প্রমাণ তো করতে হবে ব্যাপারটা। বাকি তিন মাত্রার একক হল মিটার, কিলোমিটার, মাইল ইত্যাদি, আর সময় মাপা হয় সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা দিয়ে। বলি দুটোর মধ্যে মিল কোথায়? সম্পর্ক কী? এ যে চক আর চকোর, হিরে আর হিরণ্যকশিপু। সব তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা এই সম্পর্কটাই তন্নতন্ন করে খুঁজছিলেন। এরই মধ্যে সমসাময়িক গবেষণা থেকে জানা গেছিল আলোর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে (vacuum) কন্সট্যান্ট বা ধ্রুবক। জল বা অন্য মাধ্যমে যদিও এর পরিবর্তন ঘটে। মানে, যদি একটা চলন্ত গাড়ি থেকে আমি একটা খেলার বল গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই ছুড়ি, তাহলে রাস্তার সাপেক্ষে সেই বলের আপেক্ষিক গতি দাঁড়াবে গাড়ির গতি + বলের গতি। কিন্তু আলোর ক্ষেত্রে এরকম কিছু হয় না। অর্থাৎ বল না ছুড়ে যদি আমরা গাড়ি থেকে টর্চের আলো ফেলি, সেখানে কিন্তু এই অঙ্ক খাটবে না। আলো তার নিজস্ব গতিতেই ছুটবে। আলো একেবারেই কোনও নিয়ম মানে না।

সে না হয় হল, কিন্তু তার সঙ্গে সময়ের কী সম্পর্ক? এখানেই সেই ঝাঁকড়াচুলো বিজ্ঞানী তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিকটা দেখালেন। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি একটু।

bigganmatratirikto09

ধরে নেওয়া যাক, পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের হাতে আছে একটা লাইট ক্লক বা ফোটন ক্লক। এটা দেখতে এরকম—

এর উপরে নীচে সমান্তরাল দুটি আয়না, নীচে একটি আলোর উৎস। সেখান থেকে আলো গিয়ে উপরের আয়নায় পড়ে, তারপর প্রতিফলিত হয়ে আবার নীচে ফিরে আসে। বোঝার সুবিধের জন্য ধরে নিচ্ছি এই একবার যাওয়া ও আসা মিলিয়ে হয় এক সেকেন্ড।

এবার ধরো একইরকম লাইট ক্লক নিয়ে আর-একজন মহাকাশযানে চেপে চলেছে। যে পৃথিবীতে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সে তাহলে চলতে থাকা মহাকাশযানের লাইট ক্লকের আলোটাকে কীরকম দেখবে?

bigganmatratirikto10

যখন নীচের উৎস থেকে আলো রওনা দিল, তখন যদি উপরের আয়নার অবস্থান B হয়, তাহলে উপরের আয়নায় পৌঁছতে পৌঁছতে আয়নাটা চলে গেছে B1-এ, কারণ যানটা চলমান। একইভাবে নীচের আয়নায় ফেরত আসার সময়ে সেটা চলে গেছে A2-তে। এরই ফলে পৃথিবীতে দাঁড়ানো মানুষটি আলোর রেখাকে AB1A2 রাস্তা ধরে যেতে দেখবে। কিন্তু হিসেবমতো উপরের আয়নায় গিয়ে নীচের আয়নায় ফিরলে তবে এক সেকেন্ড হয়। এদিকে আলোর দ্রুতি বা স্পিড কোনোভাবেই পরিবর্তিত হওয়ার নয়, সে ধ্রুবক। তাহলে গতি না পালটে বেশি রাস্তা যাচ্ছে কী করে? এর ব্যাখ্যা এক উপায়েই দেওয়া সম্ভব। স্থির থাকা মানুষটির মনে হবে যেন যানে থাকা ঘড়িটা অনেক আস্তে চলছে, অর্থাৎ সেখানে সময় যেন সম্প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত ব্যাপারটাকে আইনস্টাইন নাম দিয়েছিলেন টাইম ডায়লেশন (time dilation)।

বুঝতেই পারছ ওই যান যত বেশি গতিতে চলবে, সময় তত সম্প্রসারিত হবে। আইনস্টাইন অঙ্ক কষে দেখালেন যদি আলোর গতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়, সময় তখন একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। কী ভাবছ? যদি আলোর গতি ছাড়িয়ে ফেলা যায়, তাহলে? হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে যে তাহলে সময়রেখা ধরে উলটোদিকে আমরা চলতে পারব।

আইনস্টাইনের এই ব্যাখ্যার পর সময়কে চতুর্থ মাত্রা বলে মেনে নিতে আর কেউই বিশেষ আপত্তি করেননি। যদিও এখনও এই নিয়ে তর্ক শেষ হয়নি। তাও আমরা এখনও নিজেদের জগতকে ত্রিমাত্রিক বলে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছি, আর ইচ্ছামতো টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতে গিয়ে নিজেদের অঙ্কে জঘন্য নম্বর পাওয়া বা আচার চুরির লজ্জাজনক ইতিহাস মুছে দিয়ে আসছি না। এর কারণ একটাই। আলোর গতি পেরিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, তার ধারেকাছে আমরা এখনও পৌঁছতে পারিনি। মানুষের বানানো সবচেয়ে দ্রুতগতি মহাকাশযানের গতিও আলোর গতির মাত্র 0.0৫%।

আসলে আলোর গতির এক শতাংশে পৌঁছতেও যে পরিমাণ এনার্জি লাগবে তা তৈরি করা সম্ভব নয় এখনও। হিসেব করে দেখা গেছে ৫০ কেজি ওজনের কোনও কিছুকে আলোর গতির ১% গতি দিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিলিয়ন লোকের একদিনের প্রয়োজনের সমান এনার্জি লাগবে। বুঝতেই পারছ কতটা অসম্ভব এই কাজ, অন্তত এখনও পর্যন্ত।

তবে বিজ্ঞানের কাছে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। একদিন হয়তো সত্যিই আমরা টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতে যেতে পারব, মুছে দিয়ে আসতে পারব মানব সভ্যতার অনেক কলঙ্কিত ইতিহাস, অনেক হানাহানি, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা। মানুষের মনে সদিচ্ছা আর সততা বুনে দিয়ে আসতে পারব। যতদিন সেটা না পারা যায়, অন্তত ভবিষ্যতের সময়রেখাটার যত্ন আমরা নিতেই পারি। নিরন্তর সেইদিকেই আমরা চলেছি। আর সবচেয়ে ভালো কথা হল, সেটা এই তিনটি মাত্রাতে আবদ্ধ থেকেই করা যেতে পারে।

Information courtesy: usm.maine.edu, dummies.com, http://ed.ted.com, nautil.us, sprott.physics.wisc.edu, www.daviddarling.info, www.sciencefocus.com, Wikipedia, YouTube
Image courtesy: Wolfram Demonstration Project, duke.edu, researchgate.net
(demonstrations.wolfram.com)

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s