প্রথম পর্ব , দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
রসায়নশাস্ত্রের মেরুদণ্ড যে পিরিওডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি, তার জন্ম হয়েছিল তাঁর মস্তিষ্কে। অথচ ছেলেবেলাটা তাঁর মোটেই ফুল বিছানো পথে এগোনো হয়নি। তবে অমন মা যাঁর সহায় তাঁকে কে রুখবে? রইল বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ-এর ছেলেবেলার গল্প।
xxxxxxxxxxxxxxxxxx
প্যাভেল নিকোলাইয়েভিচ ডেমিডভ ছিলেন রাশিয়ার একজন কেউকেটা মানুষ। তাঁর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা নিকিতার আমলে ডেমিডভ পরিবারের প্রভাব বেড়ে ওঠে রাশিয়ায়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কর্মকার। লোহা পিটিয়ে হরেক জিনিসপত্তর তৈরি করতেন, তার মধ্যে ছিল যুদ্ধের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্রও। এই অস্ত্রের দৌলতেই তিনি রাশিয়ার তৎকালীন জার পিটার দ্য গ্রেটের চোখে পড়ে যান। পিটার তাঁকে দান করেন উরাল পর্বতশ্রেণির পুবদিকের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের খনি ও সেখানে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিকদের স্বত্ব। এই খনিগুলো থেকে তোলা হ’ত লোহা ও তামার আকরিক, সোনা, প্ল্যাটিনাম, রত্নাদি প্রস্তুতির পাথর।
বলাই বাহুল্য, এগুলোর সুবাদে তাঁর কপাল খুলে গেল। ধনদৌলতের পরিমাণ বাড়তেই থাকল উত্তরোত্তর। দুই পুরুষের মধ্যেই সম্পত্তির পরিমাণ এত বেড়ে গেল যে ডেমিডভ পরিবারের নিজস্ব টাঁকশাল তৈরি হল, তৈরি হল নিজেদের সেনাবাহিনীও। উরাল এবং সাইবেরিয়ার বিশাল এলাকার উন্নয়নে ডেমিডভ পরিবারের অবদান প্রচুর।
নিকোলাইপুত্র প্যাভেল ডেমিডভের জন্ম আমাদের ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথের জন্মের কিছু পরে। তিনি পারিবারিক উত্তরাধিকার সাফল্যের সঙ্গে বহন করে চললেন। তাঁদের অধীন যে সমস্ত শ্রমিক বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়ার দরুন কাজ করতে পারত না, তাদের অবসর দিয়ে মাইনের অর্ধেক মূল্যের পেনশন চালু করলেন। ভগ্নস্বাস্থ্য শ্রমিকদের ও যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের বিধবা ও অনাথ সন্তানদের সাহায্যের জন্য দান করলেন বিপুল মূল্যের ধনরাশি। চারখানা বিশাল হাসপাতাল নির্মাণ করলেন পারিবারিক অর্থে। এবং ১৮৩১ সালে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের অধীনে চালু করলেন পাঁচ হাজার রুবল অর্থমূল্যের ডেমিডভ পুরস্কার।
ইভানপুত্র দিমিত্রি মেন্ডেলিভের এই পুরস্কারটা চাই। পাঁচ হাজার রুবল এক বিশাল অঙ্ক। কিন্তু বাজারে তার ধার-কর্জের পরিমাণ কম নয়। এই পুরস্কার কোনোভাবে পেয়ে গেলে সেগুলো শোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু চাইলেই কি আর পাওয়া যায়! তিরিশ বছর ধরে এই পুরস্কার দেওয়া চলছে, অধিকাংশ পুরস্কারই দেওয়া হয়েছে ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানের কয়েকটি বিভাগে। রসায়নে এ পর্যন্ত মাত্র একজনের গলাতেই এই পুরস্কারের মালা পরানো হয়েছে, তিনি কার্ল আর্নস্ট ক্লস, সেও পনের বছর আগে। তিরিশ বছরে মাত্র এক জন, পরিসংখ্যানের বিচারে দিমিত্রির আশা নেই বললেই হয়।
তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, হাতে সময় একেবারেই নেই। তিন সাড়ে তিন মাসে একটা বেস্টসেলার বই লিখতে হবে রসায়নের! অথচ রাশিয়ান ভাষায় পাতে দেওয়ার মতো রসায়নের একটা বইও নেই। কাকে অনুসরণ করে কীভাবে লিখবে সে?
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি সাতাশ বছর বয়সী দিমিত্রি শুরু করল এই বই লেখা। দিন রাত এক করে বই লিখতে লাগল সে। লেখার পাশাপাশি ডায়েরিতে টুকটাক ব্যক্তিগত জীবনের বর্ণনা। তা থেকে এই সময়ের কথা জানা যায়। ডায়েরির কয়েকটা লাইন এই রকম –
৩ মার্চ – লিখছি, সারাদিন ধরে লিখছি। ভূমিকা অংশটা শেষ করলাম। অসুস্থ বোধ করছি। এতক্ষণ ঠায় বসে থাকা।
১০ মার্চ – ওরা আমার বইয়ের চ্যাপ্টারটা পড়েছে এবং অনেক মন্তব্য করেছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমি যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে ভালোই মন্তব্যগুলো। ওদের পছন্দ হয়েছে।
২৬ এপ্রিল – এই রসায়ন বিষয়টাতে আমি এর মধ্যেই বিরক্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আমাকে এখনও প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হবে, এবং তা দ্রুতগতিতে।
৮ জুন – এই বইয়ের পেছনে আমি যত পরিশ্রম করেছি, জীবনে এত পরিশ্রম আর কিছুতে করতে পারব বলে মনে হয় না।
জুন মাসের মাঝামাঝি ৫০০ পৃষ্ঠারও অধিক এই বই লেখা সম্পূর্ণ হল। রাশিয়ান ভাষায় লেখা এই বইয়ের নাম – অর্গানিচেস্কায়া খিমিয়া অর্থাৎ অর্গানিক কেমিস্ট্রি বা জৈব রসায়ন। জমা পড়ল পুরস্কারের জন্য। সে সময়ের রাশিয়ার দুই স্বনামধন্য জৈব রসায়নবিদ কার্ল জুলিয়াস ফ্রিশে এবং নিকোলাই নিকোলেভিচ জিনিন এই বইটার প্রাথমিক পর্যালোচনা করে রায় দিলেন – অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকই হয় একটা নিয়ম অনুসরণ করে তথ্যের সমাহার অথবা তাদের সীমিত তালিকা। এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম দিমিত্রি মেন্ডেলিভের বইটা, যাতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তথ্যগুলোকে তত্ত্বের সাহায্যে খুব সফলভাবে সাজানো হয়েছে। সেই প্রথম কেউ হাইড্রোকার্বন যৌগগুলোর ফর্মুলা বিচার করে বইতে লিখেছে, কার্বন আর হাইড্রোজেনের অনুপাত অ্যালকেন তথা ‘স্যাচুরেটেড’ হাইড্রোকার্বন যৌগগুলোতেই সবচেয়ে কম। বিচারকমণ্ডলীর শীর্ষে ছিলেন মেন্ডেলিভেরই গুরু অধ্যাপক ভস্ক্রেসেনস্কি।
১৮৬১ সালেই বইটার প্রথম সংস্করণ বিক্রি হয়ে গেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রয়োজন হল দ্বিতীয় সংস্করণের। জনপ্রিয়তার নিরিখেও অসামান্য। ১৮৬২ সালে সে বছরের ডেমিডভ পুরস্কার পেল দিমিত্রি।
* * *
আঠাশ বছর বয়স এখন দিমিত্রির। মেঘে মেঘে বেলা তো কম হ’ল না। দিদি ওলগা ঠিক করল যে ভাইয়ের এবার বিয়ে দেওয়া দরকার। ওলগা দিমিত্রির চেয়ে বয়সে কুড়ি বছরের বড়, এক অর্থে মায়ের মতোই। সে ভাবল, ঘরে বউ না থাকলে জীবন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে যায় না? ভাই তার মেধাবী হলে কী হয়, তেমন যেন সংসারী নয়, দেখলেই বোঝা যায় সব সময় চিন্তামগ্ন, কপাল কুঁচকেই আছে সর্বক্ষণ, মনে সুখ নেই। বিয়ে দিলে নিশ্চয় সংসারে মন বসবে, তাতে তার জীবনে সুখ আসবে।
মেয়েটি দিমিত্রির চেনা এবং দিমিত্রি পছন্দও করে তাকে। সম্ভবত মেয়েটিও দিমিত্রিকে। কিন্তু বিয়ে করার ব্যাপারে তারা কেউই মনস্থির করতে পারেনি। দিদির পীড়াপীড়িতে অবশ্য দিমিত্রির প্রতিরোধ টিঁকল না। শুভলগ্নে এক দিন বিয়ে হয়ে গেল তার।
পাত্রীর নাম ফিওজভা নিকিতিশনা লেশচেভা। তাঁর বাবার – সৎ বাবার – সঙ্গে মেন্ডেলিভ পরিবারের সম্পর্ক বেশ অনেকদিনের। পিওতর আর নিকোলাই পাভলভিচ ইয়েরশভ নামে দুই ভাই পড়তে এসেছিল টোবোলস্কের জিমনাসিয়ামে। সেই সময় সেই জিমনাসিয়ামের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন দিমিত্রির পিতৃদেব, ইভান। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে পিওতর পড়তে চলে যায় সেন্ট পিটার্সবার্গে। সেখান থেকে যখন আবার টোবোলস্কে ফিরে আসে, তখন সে একজন মস্ত কবি, তার বেশ নামডাক হয়েছে। সে ওই জিমনাসিয়ামে শিক্ষকের চাকরিতে বহাল হয়। ঠিক ওই সময়েই ইভানের চোখের সমস্যার কারণে চাকরি যায়, মেন্ডেলিভ পরিবার আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে এবং দিমিত্রির মা মারিয়া তাঁর দাদার কাচের কারখানা দেখভাল করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। এ সময় দিমিত্রি ওই জিমনাসিয়ামের ছাত্র এবং পিওতর ওখানকার শিক্ষক। মারিয়ার ছিল বিপুল গ্রন্থরাজিবিশিষ্ট এক গ্রন্থাগার, টোবোলস্কের সবচেয়ে বড়, সেখানে বইপত্তর পড়তে আসতেন পিওতর। ফলে পিওতরের সঙ্গে মেন্ডেলিভ পরিবারের ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। পিওতরের প্রভাবেই দিমিত্রি আর তার ঠিক ওপরের দাদা পলের লেখাপড়া হতে থাকে সুন্দরভাবে। জিমনাসিয়ামের প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে তিনি দিমিত্রিকে বয়সপূর্তির দু-বছর আগেই সেখানকার সর্বোচ্চ ক্লাশ থেকে পাশ করিয়ে দেন এবং মারিয়া তাকে নিয়ে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেন মস্কো হয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে।
ডেমিডভ পুরস্কার পেল যখন দিমিত্রি, তখন কবি এবং রূপকথার গল্পলেখক হিসাবে পিওতরের খুবই নামডাক হয়েছে। রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকথার লেখক আলেকজান্ডার পুশকিনের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়। বস্তুত পিওতরের লেখা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং বিতর্কিত রূপকথা ‘দ্য হাম্পব্যাকড হর্স’ লোকে ভাবে পুশকিনেরই ছদ্মনামে লেখা। এই গল্পে ইভান নামে এক চাষির ছেলের ছিল এক পক্ষীরাজ ঘোড়া। রাশিয়ার জারের চোখে পড়ে যায় এই ছোকরা এবং তার নানাবিধ কার্যকলাপের খবর শুনে জার তাকে দিয়ে ক্রীতদাসের মতো খাটিয়ে নেয়। যে কাজই তাকে দেওয়া হয়, যত অমানুষিকই হোক, ইভান সেটা সম্পন্ন করে ফেলে। এ কাজে তার সহায়ক ওই পক্ষীরাজ ঘোড়া। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে জারের দাবি অনুযায়ী সে জাদু আগুনপাখিও ধরে আনে। এই সব করতে করতেই সে রূপসী জারকন্যার চোখে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হয়।
যেহেতু এই গল্পে রাশিয়ার জারকে তখনকার জারের মতোই একনায়কতান্ত্রিক নির্মম অত্যাচারী হিসাবে দেখানো হয়েছে এবং প্রতিক্ষেত্রেই জারের দাবি হাস্যকর প্রতিপন্ন হয়েছে, পিওতরের এই রূপকথা অচিরেই সারা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তত দিনে অবশ্য বিভিন্ন রূপে এর অনেকগুলো সংস্করণ তৈরি হয়ে গেছে।
পিওতর টোবোলস্ক জিমনাসিয়ামের চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়ই দিমিত্রির জন্ম এবং তখনই এই রূপকথা জনপ্রিয় হয়ে গেছে। কিন্তু মেন্ডেলিভ পরিবারের মতোই তাঁর পরিবারেও সে সময় দুর্যোগ লেগেই থাকত। সেই সময়েই পিওতর তাঁর বাবা ও ভাইকে কয়েকদিনের ব্যবধানে হারান। বছর চারেক পর তাঁর মা মারা যান। দিমিত্রির বয়স যখন মাত্র এগারো, তখন পিওতরের স্ত্রীর মৃত্যু হয়। দু-বছর পরে তিনি আবার বিয়ে করেন, কিন্তু সেই দ্বিতীয় স্ত্রীও আর মাত্র পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন।
ডেমিডভ পুরস্কার যখন হাতে উঠল দিমিত্রির, তখন ‘দ্য হাম্পব্যাকড হর্স’-এর ওপর থেকে বাধানিষেধ উঠে গেছে। পুরস্কারের অর্থে দিমিত্রি পিওতরের এই অসামান্য রূপকথার নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে।
পিওতরের প্রথমা স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন পিওতর। প্রথম বিয়ে থেকে স্ত্রীর এক কন্যা ছিল, সেই কন্যাই ফিওজভা। তার পদবী লেশচেভা হলেও মায়ের সঙ্গে থাকার কারণে সে ইয়েরশভ পরিবারের অংশ। সতেরো বছর আগে তার জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যু হয়েছে, এই পরিবারের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। দিদি ওলগার চাপে ১৮৬২ সালের তিরিশে এপ্রিল দিমিত্রির বিয়ে হয়ে গেল ফিওজভার সঙ্গে। নবদম্পতি মধুচন্দ্রিমায় বিদেশে বেড়াতে গেল। লন্ডনে এক বিশ্ব প্রদর্শনী চলছিল তখন। সেটা দেখল তারা একসঙ্গে। অন্যান্য দেশের আরও কিছু শহরে একত্রে ঘুরে এল তারা।
* * *
মনে রাখতে হবে, ডেমিডভ পুরস্কার পাওয়ার সময় কিন্তু দিমিত্রি এক রকমের বেকার। চাকরি নেই। রসায়নের ওপর বই লিখে পুরস্কার পেলেন বটে, সে সময় শুদ্ধ বিজ্ঞানের চেয়ে প্রযুক্তির ওপর নজর বৃদ্ধি পাচ্ছে। লন্ডনে জার্মান রসায়নবিদ অধ্যাপক হফম্যানের কাছে গবেষণা করতে ঢুকেছিল তরুণ ছাত্র উইলিয়ম হেনরি পার্কিন। হফম্যানের স্বপ্ন কৃত্রিম উপায়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন প্রস্তুত করবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশ সেনারা ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে নিরক্ষীয় জলবায়ুর দেশ ভারতবর্ষ ও আফ্রিকায়, যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব বেশি। সেনা ব্যারাকে একবার এই রোগ ঢুকে গেলে হুড়হুড় করে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে মারা যায় তারা। এর প্রতিষেধক সিঙ্কোনা গাছের আদি জঙ্গল আছে লাতিন আমেরিকার পেরু-বলিভিয়ায়। সেখান থেকে চারা চুরি করে এক অস্ট্রেলিয় যুবক মাত্র কুড়ি ডলারে বিক্রি করে দিয়েছিল ওলন্দাজদের, তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোতে এর চাষ করছে আর এর ছাল চড়া দরে বিক্রি করে ফুলে ফেঁপে উঠছে। ওলন্দাজদের সঙ্গে টক্কর দিতে হলে কৃত্রিমভাবে এর তৈরি ছাড়া উপায় নেই।
১৮৫৬ সালের ইস্টারের ছুটিতে কুইনাইন প্রস্তুত করার সম্ভাব্য এক রাসায়নিক পথ পার্কিনকে জানিয়ে জার্মানিতে গেলেন হফম্যান। ভেবেছিলেন, ছুটির মধ্যে পার্কিন কাজ এগিয়ে রাখবে। সেই কাজ করতে গিয়ে পার্কিন পেয়ে গেলেন বেগুনি রঙের এক অপূর্ব বস্তু, যার মধ্যে কাপড় ডুবিয়ে দিতে কাপড়ে সেই রঙ ধরে গেল। অবিলম্বে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে দাদার সঙ্গে একত্রে বাড়ির পেছনে এই রঙের কারখানা খুলে বসল পার্কিন। হফম্যানের অধীনে গবেষণা তার ওইখানেই ইতি।
এটাই প্রথম গবেষণাগারে প্রস্তুত কৃত্রিম রঙ। আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে এর জনপ্রিয়তা এত বাড়তে লাগল যে এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাগারে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়ে গেল। শুরু হতে লাগল রাসায়নিক কারখানা। মাত্র কয়েক বছর পরেই জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হবে বাডিশে আনিলিন উন্ড সোডা ফাব্রিক বা বি এ এস এফ নামে এক রাসায়নিক কোম্পানি।
রসায়ন ও তৎসংক্রান্ত প্রযুক্তির আঁতুড়ঘর তখন জার্মানি। জোহানেস রুডলফ ফন ওয়াগনার নামে এক জার্মান রসায়নবিদ জার্মান ভাষায় গাবদা সাইজের এক বই লিখেছেন, ইংরাজি করলে যার নাম হয় – হ্যান্ডবুক অভ কেমিক্যাল টেকনলজি। এই বইয়ের মতো বিশদ বর্ণনা আর কোনো বইয়ের নেই তখন। জ্বালানি, ধাতুবিদ্যা, বিভিন্ন রাসায়নিকের উৎপাদন পদ্ধতি, জৈব যৌগ ও তাদের উৎপাদন, কাচ ও মৃৎপাত্র, খাদ্য ও সংরক্ষণ, তন্তু, সাবান-তেল-আঠা – কী নেই সেখানে! স্বাভাবিকভাবেই এর জনপ্রিয়তা আকাশ-ছোঁয়া। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে এর। দিমিত্রি ঠিক করল সে এই বইয়ের অনুবাদ করবে রাশিয়ান ভাষায়।
কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে মন ভরল না দিমিত্রির। কিছু কিছু অধ্যায় সে হুবহু অনুবাদ করল বটে, কিন্তু কিছু কিছু অধ্যায় – বিশেষ করে শর্করা, চিনি, অ্যালকোহল ও কাচ – সে মূল বইয়ের চেয়েও বিশদে বর্ণনা করল। নিছক অনুবাদকের চেয়েও ওই অধ্যায়গুলোর ক্ষেত্রে সেই যেন মূল লেখক। ১৮৬২ সালেই সেই অনুবাদ টেকনিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া বা প্রযুক্তির বিশ্বকোষ নামে চার বিশালাকৃতি খণ্ডে প্রকাশিত হল। এই যে প্রযুক্তির স্বাদ পেয়ে গেল দিমিত্রি, এ তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। বস্তুত, এই বই শেষ হওয়ার আগে, ১৮৬১ সালের ক্রিসমাসের সপ্তাহে সে তার নোভগোরদ এলাকার কাঠ-পাতনকারী বন্ধু র্যাচেল এবং পরের বছর ককেশাসের ধনকুবের তৈল-শোধনাগারের মালিক কোকোরেভকে প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রদান করেছিল।
ওয়াগনারের বইটার অনুবাদ ও কয়েকজনকে প্রযুক্তিগত বিষয়ে সাহায্যদান করে দিমিত্রি প্রযুক্তির জগতেও অচিরেই দেশের মধ্যে স্বীকৃতি পেয়ে গেল। আর সেই সুবাদেই সেন্ট পিটার্সবার্গ প্র্যাকটিক্যাল টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুটে টেকনোলজি চেয়ারে একটা ডোসেন্ট পোজিশন পেয়ে গেল। সে সময় ওই প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর ছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত সুরকার পিওতর ইলাইচ চাইকোভস্কির পিতা ইলায়া চাইকোভস্কি। দিমিত্রির পি এইচ ডি ডিগ্রি নেই, তবুও তাকে প্রফেসর পদে সরাসরি বহাল করা হ’ল, এই দৃষ্টান্ত তখন নেই বললেই চলে। প্রফেসর হওয়ার সুবাদে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরস্থ কমিউনিটি অ্যাপার্টমেন্টে তাদের থাকার জায়গা মিলে গেল। এখানে ক্লাশ নেওয়া, রসায়নের গবেষণাগারের তদারকি করা ছাড়াও দিমিত্রি স্নাতক বোর্ডের দেখভাল করতে লাগল।
প্রচুর খনিজ তেলের খনি আবিষ্কারের সুবাদে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এ সময় উন্নতির পথে। দেশে অ্যালকোহল উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী। সরকার চাইল এর ওপর আবগারি শুল্ক বসিয়ে উৎপাদন ও উপভোগ নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন কোনো তরলে কতটা অ্যালকোহল আছে, তার সম্পূর্ণ সঠিক পদ্ধতি এবং তৎসংক্রান্ত যন্ত্রপাতির। ওয়াগনারের বইতে অ্যালকোহল সংক্রান্ত অধ্যায় যেহেতু দিমিত্রি অনুবাদ করেছে এবং তার সঙ্গে যোগ করেছে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণাও, উপরন্তু জার্মানির হাইডেলবার্গে গবেষণাকালীন সে যেহেতু নিজে নিজেই আবিষ্কার করেছে এক নতুন ধরনের ঘনত্বমাপক যন্ত্র বা পিকনোমিটার, দেশের সরকার সাব্যস্ত করল দিমিত্রিই এই কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি। ১৮৬৩ সালে দেশের আবগারি মন্ত্রক তাদের স্পেশ্যাল টেকনিক্যাল কমিটিতে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করল দিমিত্রি মেন্ডেলিভকে। তাকে বলা হ’ল এর জন্য একটা প্রোজেক্ট লিখে জমা দিতে এবং তার পরিবর্তে সে কী চায়, তাও জানাতে। দিমিত্রি প্রোজেক্টে লিখল, তার নিজের জন্য চাই এর উপযুক্ত বেতন এবং দু ব্যারেল অ্যালকোহল। সরকার তা মঞ্জুর করল।
বিভিন্ন ধরনের পাতন পরীক্ষার মাধ্যমে দিমিত্রি তৈরি করল অত্যন্ত পরিশুদ্ধ ইথাইল অ্যালকোহল। তার সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার জল মিশিয়ে বিভিন্ন তাপমাত্রায় তাদের আয়তন ও ঘনত্ব মেপে সে জটিল এক সমীকরণ বের করল, যা ব্যবহার করে লঘু অ্যালকোহলের দ্রবণে অ্যালকোহলের একেবারে সঠিক পরিমাণ বের করা যায়। তার নির্দেশে সরকার সেই নিয়মেই অ্যালকোহলের ঘনত্ব নির্ধারণ করে তার ওপর শুল্ক বসানো সাব্যস্ত করল।
এমন নয় যে এই কাজটা দিমিত্রি কেবলমাত্র সম্পন্ন করল সরকারের কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত পয়সা রোজগার করবে বলে। মায়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না দিমিত্রি। মাঝেমাঝেই উল্টেপাল্টে দেখে সেই ডায়েরির পাতাটা, যেখানে লেখা আছে মায়ের শেষ কথাগুলো – কথা নয়, কাজে যেন মতি থাকে তোমার। ধৈর্যসহকারে অন্বেষণ করে যাবে ঐশ্বরিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যের। জল ও ইথাইল অ্যালকোহলের আণবিক গুরুত্ব তার জানা। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন অনুপাতে তাদের মিশ্রণের আয়তন ও ঘনত্ব মেপে গ্রাফ কাগজে প্লট করে সে দেখল কয়েকটা মোল-অনুপাতে তাদের মান অন্যগুলোর চেয়ে এমন আলাদা, যেন মনে হয় ওই অনুপাতে তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো নতুন যুত-যৌগ তৈরি হয়েছে। ইথানল ও জলের মোলার অনুপাত ১:৩, ৩:১ আর ১:১২-তে এই রকম দেখতে পেল সে। এদের নতুন যৌগ বলে ঘোষণা করে সে একটা থিসিস লিখে ফেলল, যার শিরোনাম – অন দ্য কম্পাউন্ডস অভ অ্যালকোহল অ্যান্ড ওয়াটার।
এবং এর জন্যই ১৮৬৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করল।
* * *
রসায়নবিদ হিসাবে দিমিত্রির কার্যকলাপ বিষয়ে আমরা এখনও কিছুই বলিনি, যথাসময়ে সে সব পেশ করা হবে। তবে এখানে একটা কথা লিপিবদ্ধ করে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ হিসাবে শিরোপা পাওয়ার পর তাঁর নামে অনেকগুলো মনগড়া ভুল কৃতিত্বের প্রচলন হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – তিনি নাকি রাশিয়ান বিখ্যাত সুরা ভদকার উদ্ভাবক।
বলাই বাহুল্য, দিমিত্রির জন্মের বহু শত বর্ষ আগে থেকেই ভদকা রাশিয়ায় জনপ্রিয়। কিন্তু এই মিথ চালু হওয়ার কারণ দিমিত্রির ওই পি এইচ ডি সন্দর্ভ, যেখানে সে গবেষণা করেছিল বিভিন্ন অনুপাতে অ্যালকোহল ও জল মিশিয়ে যে মিশ্রণ পাওয়া যায়, তাদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে। বহু পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালিখি হয়েছে, বহু ভদকা ব্র্যান্ড দিমিত্রি মেন্ডেলিভের ছবি ব্যবহার করে ক্রেতাদের বোকা বানিয়েছে। এমনকি কেবলমাত্র ভদকার ওপর ১৯৯১ সালে লেখা গবেষণাধর্মী বইতেও – উইলিয়াম পোখলেবকিনের হিস্ট্রি অভ ভদকা – এই জিনিসই লেখা আছে। ভদকার সরকারিভাবে স্বীকৃত জন্মদিন নাকি ৩১শে জানুয়ারি, ওই যেদিন দিমিত্রি তার পি এইচ ডি ডিগ্রি ‘ডিফেন্ড’ করেছিল ১৮৬৫ সালে!
আগে যা লিখলাম, দিমিত্রি তার সন্দর্ভে প্রমাণ করেছে ইথাইল অ্যালকোহল এবং জল বিভিন্ন অনুপাতে মেশালে যে দ্রবণ তৈরি হয়, বিভিন্ন তাপমাত্রায় তার কিছু ধর্ম বিশুদ্ধ অ্যালকোহল এবং বিশুদ্ধ জলের তুলনায় অনেকটা আলাদা তিনটে মোলার অনুপাতে। তারা হচ্ছে ১ঃ৩, ১ঃ১২ এবং ৩ঃ১।
প্রথমটার ব্যাপারে একটু বলি। ইথাইল অ্যালকোহল বা ইথানলের (C2H5OH) আণবিক গুরুত্ব হচ্ছে ২৪+৫+১৬+১ বা ৪৬। জলের (H2O) আণবিক গুরুত্ব ২+১৬ বা ১৮। ১ অণু ইথাইল অ্যালকোহল আর ৩ অণু (৩ x ১৮) জল মিশিয়ে যে দ্রবণ, তাতে ইথাইল অ্যালকোহল আর জলের ওজনের অনুপাত হবে ৪৬ঃ৫৪। যেহেতু ৪৬+৫৪=১০০, এর অর্থ এতে ওজন হিসাবে অ্যালকোহল থাকবে ৪৬% আর জল ৫৪%। ধরা যাক ৪৬ গ্রাম ইথানল আর ৫৪ গ্রাম জল মেশানো হ’ল। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল (০.৭৮৯ গ্রাম/মিলি) আর বিশুদ্ধ জলের (০.৯৯৭ গ্রাম/মিলি) ঘনত্ব জানা থাকায় এদের আয়তন হবে যথাক্রমে ৫৮.৩০ আর ৫৪.১৬ মিলিলিটার। দিমিত্রি দেখল, যে সেই আয়তনে এদের মেশালে দ্রবণের আয়তন ৫৮.৩০+৫৪ অর্থাৎ ১১২.৪৬ না হয়ে হচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ২% কম, ১১০ মিলিলিটারের কাছাকাছি। সে বলল, এর অর্থ অ্যালকোহল আর জলের মধ্যে রাসায়নিক একটা সম্বন্ধ তৈরি হচ্ছে। যদি এরা সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ আলাদাভাবে থাকত, তবে মিশ্রণের আয়তন হ’ত ওদের আলাদা আয়তনের যোগফল। ওজন তো আর বদলাবে না, তাই মিশ্রণের আয়তন, তথা ঘনত্বের এই যে বিচ্যুতি, এগুলো বিভিন্ন তাপমাত্রায় বিভিন্ন অনুপাতের ক্ষেত্রে মেপে সে দেখাল এগুলো ওপরে-লেখা ওই তিনটে অনুপাতের ক্ষেত্রেই সর্বাধিক। দ্রবণে অ্যালকোহলের মোলার কনসেন্ট্রেশন বা ঘনত্বের (C) সঙ্গে দ্রবণের ডেনসিটি বা ঘনত্বের (ρ) পরিবর্তন যদি হয় dC/dρ, তবে এই ইনফ্লেকশন পয়েন্ট বা বিচ্যুতি সঠিকভাবে পরিমাপ করতে সে এর দ্বিতীয় ডেরিভেটিভ অর্থাৎ d2C/dρ2 প্লট করে এই সিদ্ধান্তে এল।
অথচ ভদকায় অ্যালকোহল আর জল থাকে ৪০ঃ৬০ আয়তন অনুপাতে, অর্থাৎ ওজন অনুপাতে প্রায় ৩৪.৫ঃ৬৫.৫ অর্থাৎ ৪.৮৪ঃ১। তর্কের খাতিরে একে ৫ঃ১ ধরে নিলেও দিমিত্রি মেন্ডেলিভের সন্দর্ভে বর্ণিত অনুপাতের চেয়ে এটা অনেকটাই আলাদা।
আরও দাবি করা হ’ল যে মেন্ডেলিভ-আবিষ্কৃত ভদকার এই মিশ্রণ নাকি এমন যে খোলা পাত্রে রেখে দিলেও এর স্বাদ বিনষ্ট হয় না, কেননা এতে অ্যালকোহল ও জলের অনুপাত বজায় থাকে। মানে ভদকা পান করতে করতে কেউ উঠে গেল হয়ত, গ্লাসে পড়ে রইল পানীয়, কয়েকদিন পর এসে সে ওই গ্লাসে যে পানীয়টা দেখবে, তাতে অ্যালকোহল ও জলের অনুপাত আগের মতোই থাকায় সে নির্দ্বিধায় ওটা পান করতে পারবে। এটা হওয়া সম্ভব যদি এই অবস্থায় অ্যালকোহল আর জল একই গতিতে বাষ্পীভূত হয়, যেমনটা নাকি হয় ৯৫.৬% ইথানলের ক্ষেত্রে, যাকে বলা হয় অ্যাজিওট্রপিক মিক্সচার। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল। মাত্র দুদিনেই ৪০% অ্যালকোহল নেমে আসে ৩১%-এ, কেননা ভদকার মিশ্রণে অ্যালকোহল জলের তুলনায় অনেক বেশি তাড়াতাড়ি উবে যায়। তবে এটা ঠিক যে, দেশের আবগারি মন্ত্রকের বিশেষ টেকনিক্যাল কমিটির উপদেষ্টা হিসাবে মদে অ্যালকোহলের পরিমাণ মাপার যে সুচারু পদ্ধতি ১৮৬৫ সালে মেন্ডেলিভ গবেষণাগারে আবিষ্কার ও দেশের সর্বত্র চালু করল, তার জন্যই আবগারি শুল্ক হিসাবে বিংশ শতকের প্রথমদিকে, মেন্ডেলিভের জীবিতকালেই, কর থেকে প্রাপ্ত রাশিয়ান সরকারের মোট আয়ের প্রায় এক চতুর্থাংশ রোজগার হতে লাগল।
ক্রমশ
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর