FUNবিজ্ঞান-স্থির অস্থির(পর্ব ৩) -প্রণব নাথ চক্রবর্তী- বসন্ত২০২২

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব

Untitled-1

জটিল পথের সহজ মাপ

যখন ছোটো ছিলাম তখন পূজার ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমরা কলকাতার এক ঘিঞ্জি এলাকায় থাকতাম। আমার মামাবাড়িটা ছিল দমদমের এক খোলামেলা জায়গায়। দাদুর সঙ্গে মামাবাড়ি যেতাম। দাদু আমাকে নিয়ে একবার ডানদিক, একবার বাঁদিক ঘুরে ঘুরে চলতেন।

biggansthirasthir03

তবে পুরো রাস্তা হেঁটে যেতাম না। কিছুটা পথ বাসে চড়ে যেতাম। যেতে প্রায় দু-ঘণ্টা লাগত। আমার কাছে এই জটিল পথটাকে এক ঠোঙা জিলিপির মতন লাগত। বাড়ি থেকে বাস-স্ট্যান্ড আর বাস-স্ট্যান্ড থেকে মামাবাড়ি—দুটোই মহা জিলিপি। বাস-রাস্তাটা অনেকটা সরল ছিল।

বড়ো হয়ে ম্যাপের উপরে আমাদের বাড়ি আর মামাবাড়ি—ওই দুই বিন্দু যোগ করে দেখেছি। এই সরল রেখাটা ৩০ কিলোমিটার লম্বা। আমাদের বাড়ি থেকে ওই রাস্তাটা সিধা উত্তর-পশ্চিমদিকে গেছে।

সরল রেখাটা ৩০ কিলোমিটার লম্বা। মামাবাড়ি যেতে আমাদের দু-ঘণ্টা সময় লাগত। অর্থাৎ, আমরা ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে উত্তর-পশ্চিমদিকে এগিয়ে যেতাম। (এটা আমাদের গতিবেগের গড় হিসাব।)

জিলিপি মার্কা রাস্তাটা সত্যিকারের ভ্রমণপথ। আর এই আইসক্রিমের কাঠির মতো সিধা পথটা সবকিছুর গড় হিসাব। ছোটবেলার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবুও গড় হিসাবটা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

আসল জিলিপি রাস্তা বড়োই জটিল। প্রথমে এত মিটার চলো। তারপরে এত ডিগ্রি ডানদিকে ঘুরে আরও এত মিটার চলো। এইরকম বিশাল এক ফর্দ। জ্যামিতি ক্লাসের ‘রাফ খাতা’-র সঙ্গে যথেষ্টই মিল আছে।

অথচ আইসক্রিমের কাঠির মতো রাস্তাটা অনেক সরল। গড় রাস্তার চেহারা আসলের সঙ্গে মিলবে না। তবু শুরু আর শেষ বিন্দু দুটি একদম খাঁটি। কত বেগে কোন দিকে চলেছি—এই প্রশ্নের উত্তর বদলাবে না।

পৃথিবীর তিন চরকি পাকের কথা বলেছি। আরও কত চরকি-ফরকি আছে কে জানে। আচ্ছা! পৃথিবীর ভ্রমণ পথের সরল রূপ হয় না?

পৃথিবীর জটিল পথের সহজ রূপ

পৃথিবীর ছোটাছুটি করার গতিগুলো খুবই কড়া কড়া। তার উপরে ওই ছোটাছুটি করার জন্য মাঠ-ঘাট কিছুই নেই। মহাশূন্যের ভেতরেই ছুটতে হয়। তাই মাপজোকের মাপকাঠিটা খুব জম্পেশ হওয়া দরকার।

মাপকাঠি হিসাবে আলোর ঢেউকে সবাই খুব পছন্দ করে। কেন পছন্দ তার গোটা চারেক কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

১) আলো ‘বিদ্যুৎ চুম্বক’ (Electro Magnetic Wave) শক্তির খুব ছোটো ছোটো ঢেউ। খুব ছোটো ঢেউ দিয়ে অতি সূক্ষ্ম মাপজোক অনেক বেশি ভালো হয়। সূক্ষ্ম মাপজোকের জন্য আলোর জুড়ি মেলা শক্ত।

২) আলো অতি সহজেই চোখে দেখা যায়। হালকা আর উজ্জ্বল আলো পাশাপাশি রাখলে অনায়াসে আলাদা করে চেনা যায়।

৩) পৃথিবীর গতির থেকে আলোর গতি বহুগুণ বেশি। পৃথিবী এক বছরে সূর্যের চারপাশে যতটা পথ চলে, আলো সেই পথ এক ঘণ্টায় যায়।

৪) জলের ঢেউ জলের ঘাড়ে বসে এগিয়ে চলে। শব্দের ঢেউ হাওয়ার ঘাড়ে বসে এগিয়ে চলে। আলোর ঢেউ বস্তুর ঘাড়ে চেপে চলে না। কিছুই নেই এর ভেতর দিয়ে দিব্যি চলাফেরা করে। তারাদের আলো মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে ছুটে এসে আমাদের চোখে পৌঁছে যায়।

মাপকাঠি তো খুঁজে পাওয়া গেল। এবার মাপজোকের পালা। পৃথিবী এখন কত জোরে কোন দিকে ঘুরছে, ওই আইসক্রিমের কাঠির মতো ভ্রমণ-পথের হিসাব করা কি সম্ভব—এটাই মাপজোকের প্রধান উদ্দেশ্য।

পৃথিবীর গতি মাপা গেল

অবশেষে ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী মাইকেলসন আর মোরলে এক জটিল পরীক্ষার (Michelson-Morley’s Experiment) ব্যবস্থা করেন।

মাপবার যন্ত্র যতটা সূক্ষ্ম হলে পৃথিবীর গতি মাপা সম্ভব, তার থেকেও বেশি সূক্ষ্ম ছিল তাঁদের যন্ত্র। একটা বিশ্বাসযোগ্য ফলের আশা ছিল। কিন্তু কপালে নেইকো ঘি ঠকঠকালে হবে কী? মাপজোকের ফলাফল দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। বিশ্বাসজনক পরীক্ষার অবিশ্বাস্য ফলাফল।

মাপজোকের ফলাফল = ‘এই পৃথিবীটা মহাশূন্যে স্থির হয়ে আছে’।

যা ব্বাবা, তবে দিন-রাত হচ্ছে কেমন করে? পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণ করা কি ডকে উঠে গেছে? মাপতে গিয়ে কিছু ভুলচুক হয়নি তো?

একটা প্রশ্ন মনের ভেতরে খচখচ করতে লাগল। এমন তো হতেই পারে, যখন পৃথিবীর গতি মাপা হচ্ছিল তখন পৃথিবীর গতি খুব কম ছিল। তাই মাপা যায়নি। যুক্তিটা বোকা বোকা মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

মনে করি, একটা দোলনা দুলছে। দোলনাটা ছুটে গিয়ে একবার উঁচুতে উঠে, তারপর ছুটে নীচের দিকে নেমে আসে। উঁচু থেকে নীচে যাবার সময় দোলনা দিকপরিবর্তন করে। সেই সময় দোলনার গতিবেগ শূন্যের কাছে থাকে। যখন পৃথিবীর গতি মাপা হচ্ছিল ওই সময়, পৃথিবীর গতি হয়তো শূন্যের কাছাকাছি ছিল। (দোলনার মতো)

পৃথিবী প্রায় বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এইরকম গোলাকার পথের সব জায়গা জুড়ে পৃথিবীর গতি শূন্যের কাছাকাছি থাকা সম্ভব নয়। সেই জন্য এপ্রিল ১৮৮৭ থেকে জুলাই ১৮৮৭ অবধি টানা চার মাস ধরে পৃথিবীর গতি মাপা হয়েছিল। একটানা মাপজোক, কোনও থামা-থামি নেই।

দেখা গেল, ওই চার মাস ধরেই পৃথিবীমশাই চুপ করে একজায়গায় বসে ছিলেন (কুঁড়ের বাদশা?)। একই সঙ্গে ঘণ্টায় ১ লক্ষ কিলোমিটার বেগে সূর্য প্রদক্ষিণ, আর চুপচাপ বসে থাকা—কেমন করে সম্ভব?

biggansthirasthir01

বিজ্ঞানীদের মুণ্ডু ঘুরে গেল। নানা পণ্ডিত নানান কায়দায় মাপজোক করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু পৃথিবী সেই গোঁ ধরেই বসে রইল। একই সঙ্গে চুপ করে বসেও থাকবে, আবার সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করবে।

চোখে টেলিস্কোপ লাগালে দেখব যে, পৃথিবী বনবন করে লাট্টুর মতো ঘুরছে আর সূর্যের চারদিকে পাক খাচ্ছে। টেলিস্কোপের বদলে যদি আলো দিয়ে মাপা হয়, তখন দেখা যাবে পৃথিবী স্থির।

টেলিস্কোপ আর আলো দিয়ে গতি মাপার যন্ত্র, কোনোটাই ফেলনা নয়। দুই যন্ত্রই যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। তাহলে ঝামেলাটা কোথায়? সবাই ফেলটু ছাত্র—রাত জেগে, দুলে দুলে বই পড়েছে। সবার শুভেচ্ছা আর উপদেশ মাথায় নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে (পৃথিবীর গতি মেপেছে)। কিন্তু পরীক্ষার ফল—ডাহা ফেল। পরীক্ষার খাতায় গোল্লা (পৃথিবীর গতি = ০)।

পরীক্ষায় গোল্লা পাওয়া মহা আশীর্বাদ

মাইকেলসন-মোরলের পরীক্ষা ডাহা ফেল করার কারণ খুঁজতে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান এক লাফে অনেক এগিয়ে গেছে। মানুষ জানে, আলোর মাপকাঠি দিয়ে বস্তুর লম্বা-চওড়া অতি সূক্ষ্মভাবে মাপা যায়। একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর থেকে কত জোরে ছুটছে, তাও সূক্ষ্মভাবে মাপা সম্ভব। কিন্তু আলোর তুলনায় বস্তুর গতিবেগ মাপা অসম্ভব।

এখন ওই মানুষটির গতিবেগ ঘণ্টায় ৩ কিলোমিটার। কথাটা মোটেই সম্পূর্ণ নয়। মানুষটি রাস্তায় আছে না চলন্ত ট্রেনের কামরার মধ্যে পায়চারি করছে তা বলতে হবে। গতি সবসময় তুলনামূলক। বস্তু হয়ে জন্মালে ওই ‘তুলনামূলক গতি’ আইনকে মানতেই হবে। আলো বস্তু নয় (শক্তির ঢেউ) তাই ওই বস্তুর ‘তুলনামূলক গতি’ আইনকে আলো মানে না। তাই আলোর তুলনায় বস্তুর কোনও গতিবেগ হয় না। মাপতে যাওয়াটাই বোকামি।

biggansthirasthir02

ক্রমশ

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s