আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা
পাখি দেখা – ১২
চঞ্চল প্রকৃতির পাখি টুনটুনি। কোথাও বসে থাকার সময় নেই তার। সারাদিন ওড়াওড়ি ও গাছের ডালে ডালে লাফালাফি করতেই থাকে এই টুনটুনি পাখি। এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে শুধু ফুড়ুত ফুড়ুত করে আসা-যাওয়া করতেই থাকে। আর তাই এই পাখিকে আমরা অস্থির পাখি হিসেবে চিনে থাকি। টুনটুটি সারাক্ষণ লতাগুলোর ফাঁক-ফোকরে লাফিয়ে বেড়ায়। এই ছোট পাখির দেখা মেলে ঝোঁপঝাঁড়ে বা বনে জঙ্গলে। ছোট গাছ কিংবা মাঝারি গাছে বাসা বাঁধে এরা। ছোট এই পাখিটা খুব চালাক প্রকৃতির পাখি। চোখের পলকেই উড়ে যায় এরা। দুর হতে দেখলে মনে হয় যেনো তার লেজটা খসে পড়ছে। চঞ্চল এই পাখিটি আমাদের গ্রাম-বাংলার এক ঐতিহ্য। টুনটুনি সত্যিই বুদ্ধিমান পাখি এবং এর বুদ্ধির পরিচয় আমরা শৈশবেই পেয়েছি ওর গল্প পড়ে অথবা আমাদের দাদু দিদাদের থেকে ওদের গল্প শুনে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির লেখা টুনটুনির গল্প সকলেরই জানা। তবুও এই পাখির সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার আগে আমাদের শৈশবটাকে আরো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। সেই গল্পই একটু সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে উপস্থাপন করলাম।
১) টুনটুনি ও বিড়ালের গল্প
এক গৃহস্থের বাড়ির বাগানে বেগুন গাছের পাতা সেলাই করে টুনটুনি বাসা বেঁধেছিল। সেই বাসাতে তার তিনটি ছানা হয়েছিল। গৃহস্থের বাড়ির পোষা বিড়ালের খুব লোভ ছিল ছানাগুলির ওপর। প্রতিদিন সে গিয়ে টুনটুনির বাসার সামনে বসে টুনটুনির খোঁজ করত আর বুদ্ধিমান টুনটুনি সব বুঝেই বিড়ালকে তোষামোদ করত মহারানী বলে সম্বোধন করে। তাতে বিড়াল ভীষণ খুশি হয়ে ফিরে যেত। এই ভাবেই প্রতিদিন চলতে থাকে। বিড়াল আসে আর মহারানী সম্বোধন শুনে খুশি হয়ে ফিরে যায়। আস্তে আস্তে টুনটুনির ছানারাও বড় হয়ে গেল। একদিন টুনটুনি তাদের জিজ্ঞেস করল যে তারা তাল গাছের ওপরে উড়ে যেতে পারবে কিনা। শুনে ছানার ডানা মেলে উড়ে তাল গাছে গিয়ে বসল। তাই দেখি টুনটুনি নিশ্চিন্ত হল। এবার যখন বিড়াল এল খোঁজ নিতে ওমনি টুনটুনি বিড়ালকে পা উঠিয়ে লাথি দেখিয়ে বললো – যা দূর হ, লক্ষিছাড়ী বিড়ালনী। বলেই সেও ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। বিড়াল আর কি করে, দাঁত খিঁছিয়ে টুনটুনিকে ধরতে চেষ্ঠা করে বিফল হল। বরং বেগুনের কাঁটার খোঁচা খেয়ে বিমর্ষ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
২) টুনটুনি আর নাপিতের গল্প
একবার হল কি টুনটুনি পায়ে কাঁটা ফুটে গেল। ভারী যন্ত্রণা হল কাঁটা ফোটাতে। কারণ সেটা ফোড়ায় পরিনত হল। তাই সে গেল নাপিতের কাছে কাঁটা তুলতে। নাপিত নাক সিঁটকিয়ে বললো যে রাজার কাজ করে একটা সামান্য টুনটুনির ফোড়া কাটবে কেন। তাই শুনে টুনটনি রাজার কাছে গিয়ে তাকে নালিশ করল। রাজা এই কথা শুনে হেসেই অস্থির। তাতে টুনি পাখির খুব রাগ হল। সে গেল ইঁদুরের কাছে নালিশ জানাতে যে রাজার ভুঁড়িটাকে ফুটো করে দিতে। শুনে ইঁদুর ভয়ে পেল – ওরে বাবা রাজার ভুঁড়ি সে ফুটো করতে পারবেনা। তাই শুনে বিরক্ত হয়ে সে গেল বিড়ালের কাছে বলতে ইঁদুর কে ধরতে। বিড়াল বললে যে সে সারাদিন খুব খেটেছে এখন তার ঘুম পাচ্ছে তাই সে ইঁদুর ধরতে অক্ষম। টুনি এরপর লাঠিকে গিয়ে বললো বিড়ালকে মারতে। লাঠি বললে যে বিড়াল তো ওর কোনও ক্ষতি করেনি যে ওকে মারবে, তাই সে এই কাজ করতে পারবেনা। তখন টুনি গেল আগুনের কাছে বলতে যে লাঠিকে পোড়াতে হবে। আগুন বললে যে সারাদিন অনেক কিছু পুড়িয়েছে তাই এখন আর লাঠি পোড়াতে পারবেনা। টুনি এবার সাগরকে গিয়ে বললো যে আগুন নিভিয়ে দিতে। সাগর পরিষ্কার অস্বিকার করল এই কাজ করতে। তারপর সে হাতি কি গিয়ে বললো সাগরের সব জল খেয়ে নিতে। হাতি বললে অত জল সে খেতে পারবেনা তাহলে তার পেট ফেটে যাবে। কেউ তার কথা শুনছেনা দেখে টুনি শেষে গেল মশার কাছে। মশাকে গিয়ে বললো যে হাতিকে কামড়াতে। মশা শুনে বললে এ আবার কি কঠিণ কাজ। তখন সে সারা রাজ্যের মশাকে একত্রিত করে পিন-পিন-পিন-পিন করে হাতি কে কামড়াতে গেল। অত মশাকে একসাথে দেখে হাতি ভয় পেল। তখন হাতি বললে সাগর শুষি, সাগর বলে আগুন নেভাই, আগুন বলে লাঠি পোড়াই, লাঠি বলে বিড়াল মারি, বিড়াল বলে ইঁদুর ধরি, ইঁদুর বলে রাজার ভুঁড়ি ফুটো করি, রাজা বলে নাপিতের মুন্ডুছেদ করি আর নাপিত হাত জোড় করে টুনিকে বলে আয় তোর ফোড়া কাটি। টুনটুনির ফোড়া সেরে যেতেই আবার সে খুশি হয়ে নাচতে নাচতে গাছের ডালে ডালে লাফাতে শুরু করল আর গাইতে লাগল – টুনটুনা-টুন-টুন-টুন, ধেই ধেই।
৩) টুনটুনি আর রাজার গল্প
এক রাজার টুনটুনিকে জব্দ করার গল্প। রাজার লোকেরা তার টাকা পয়সা রোদে শুকুতে দিয়েছিল। রাজার বাগানের কোনেই ছিল এক টুনটুনির বাসা। বিকেলে টাকা ফিরিয়ে আনার সময় রাজার লোকেরা একটি টাকা ঘরে তুলতে ভুলে যায়। সেই চকচকে টাকা টুনটুনি তুলে এনে তার বাসায় রাখল। পরের দিন সভায় যখন সবাই হাজির হটাৎ টুনটুনি সভায় উড়ে এসে বললো – রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে। রাজা জিজ্ঞেস করাতে সভার লোকেরা জানাল টুনি পাখির কথা। রাজা আদেশ দিলেন টুনির ঘর থেকে টাকা নিয়ে আসতে। এবার টুনি এসে আবার সভায় বললো – রাজা বড় ধন কাতর, টুনির ধন নিলে বাড়ির ভিতর। তাই শুনে রাজা আবার সেই টাকে টুনির ঘরে রেখে দিলেন। এবার টুনি আনন্দে ফিরে এসে বললে – রাজা ভারী ভয় পেল টুনির টাকা ফিরিয়ে দিল। এবার এই কথা শুনে রাজা চটে গিয়ে আদেশ দিলেন টুনিকে ধরে আনতে, সে ওটাকে ভেজে খাবে। সাত রানিকে হুকুম দিলেন ওটাকে ভাজতে। কিন্তু রানিদের ভারই কষ্ট হল অত সুন্দর পাখিটাকে মারতে। তারা যখন এক এক করে হাতে নিয়ে দেখছিল সু্যোগ পেয়ে টুনি ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। রানিরা খুব ভয়ে পেয়ে রাজা্কে এক ব্যাঙ ভেজে খাওয়াল। পরেদিন যখন রাজা সভায় বসেছেন ওমনি টুনটুনিটা কোত্থেকে উড়ে এসে বললো – বড় মজা বড় মজা রাজা খেলেন ব্যাঙ ভাজা। এবার রাজা ভয়ানক ক্ষেপে গেলেন টুনটুনির ওপর। উনি আদেশ দিলেন ওকে ধরে আনতে। তারপর সভার মধ্যেই জল দিয়ে গিলে ফেললেন। কিন্তু তারপরেই রাজা এক মস্ত ঢেকুর তুললেন আর তার সাথেই টুনটুনি বেরিয়ে এসে উড়ে পালাল। আবার সবাই গিয়ে পাখিটাকে ধরে আনলো। তারপর আবার রাজা জল দিয়ে গিলে খেলেন। এবার রাজার এক পেয়াদা কে বলা ছিল তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। টুনটুনি এবার যদি পালায় তবে ওটাকে কেটে দু টুকড়ো করে দিতে হবে। যেই না এবার রাজা ঢেকুর তুললেন ওমনি টুনটুনি আবার বেরিয়ে এল। এবার রাজার সেপাই থতমত খেয়ে তলোয়ার উঁচিয়ে মারতে গেলে টুনটুনির গা ফসকে গিয়ে রাজার নাকের ওপর গিয়ে পড়ল। রাজা প্রচন্ড যন্ত্রণায় চ্যাঁচেতে লাগলেন। তখন ডাক্তার, বৈদ্য এসে ওষুধ দিয়ে পট্টি বেঁধে রাজা কে বাঁচালেন। টুনটুনি তা দেখে বলতে লাগল – নাক কাটা রাজা রে, দেখ না কেমন মজা রে। রাজার লোকেরা আবার ধরতে গেলে সে উড়ে অনেক দূরে অন্য দেশে চলে গেল। রাজার লোকেরা দেখল টুনটুনির খালি বাসা পড়ে রয়েছে।
এই ভাবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি মহাশয় টুনটুনির বুদ্ধির ব্যাখ্য করেছিলেন তার এই গল্পগুলির ম্যাধমে। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই টুনটুনির ভীষণ বুদ্ধি। সেটা ওর চলাফেরা থেকেই বোঝা যায়। ওর বাসা বানানর পদ্ধতি এক পাকা দরজির মতো। এরককম বুদ্ধি না থাকলে কোনও পাখি এত সুন্দর বাসা বানাতে পারেনা এক বাবুই ছাড়া। টুনটুনি পাখিকে তাই দরজি পাখিও বলা হয়। ইংরেজিতে তাই বলা হয় ‘টেইলর বারড্’ (Tailor Bird)। গাছের বড়ো পাতা ঠোঁট দিয়ে সূঁচের মতো একসঙ্গে গাছের আঁশ অথবা মাকড়সার জালের রেশমি সুতো দিয়ে কাঠামো করে তার মধ্যে আসল বাসা গড়ে। এই রকম বুদ্ধি না হলে এত কারুকার্য্য করে বাসা বানাতে পারে এই ক্ষুদ্র পাখি।
এরা ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় বাসা বাঁধে। ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ অথবা ঝোপঝাড় ওদের পছন্দ। শিম, লাউ, কাঠ বাদাম, সূর্যমুখী, ডুমুর ও লেবু গাছে এরা বেশি বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির জন্য স্ত্রীকে পুরুষ টুনটুনি সাহায্য করে।স্থানভেদে টুনটুনির বৈশিষ্ট্য একেক রকম হলেও অধিকাংশ টুনটুনির বুক ও পেট সাদাটে। অনেকটা মাটির ঢিলার মতো। ডানার উপরিভাগ ও মাথা জলপাই-লালচে। চোখের মণি পাকা মরিচের মতো। বুক সাদা পালকে ঢাকা। লেজ খাড়া, তাতে কালচে দাগ আছে। ঋতুভেদে পিঠ ও ডানার রং কিছুটা বদলায়। টুনটুনি বিভিন্ন রকম খাবার খায়। তার মধ্যে অনেক অপকারী পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ অন্যতম। ছোট কেঁচো, মৌমাছি, ফুলের মধু, রেশম মথ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। ধান-পাট-গম পাতার পোকা, শুয়োপোকা ও তার ডিম, আম পাতার বিছা পোকা তাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে।
আমাদের দেশে তিন প্রকারের টুনটুনি পাখি দেখা যায়। এক হল যেটা খুব সাধারণ টুনটুনি (Common Tailor Bird)
একে সমস্ত স্থানেই দেখতে পাওয়া যায়। স্বভাব ভীষণ চঞ্চল আর সমানে ডাকাডাকি করতে থাকে। আরেক হল পাহাড়ি টুনটুনি, হিমালয় অথবা পাদদেশে দেখা যায়। সাধারণ টুনটুনিদের মতো অতটা খোলা পরিবেশে বেরোতে দেখা যায়না। এদের মাথার চাঁদির সামনেটা উজ্জ্বল কমলাটে, সরু হলদেটে সাদা ভ্রু, চোখের পেছনেও বেশ খানিকটা বিস্তৃত থাকে। ওপরের ডানা আর পিঠ পুরোপুরি জলপাই-সবজেটে। গলা ও বুকের মাঝ বরাবর সাদা, পেট আবার উজ্জ্বল হলুদ রঙের। সাধারণ বুলবুলি ডাকের সাথে খুব একটা মিল নেই। একটা কর্ণ-ভেদ করা জোরাল শীষের মতো। তৃতীয়টি হল কালো গলা টুনটুনি (Dark Necked Tailor Bird)। অনেকটা সাধারণ টুনটুনির মতোই দেখতে। তবে কপাল থেকে চাঁদির পেছন পর্য্যন্ত পুরোপুরি মরচে-কমলাটে। ওপরে টুনটুনিদের তুলনায় আরও উজ্জ্বল, জলপাই-ব্রোঞ্জ রঙের, বেশেষ করে দুটি ডানা। এমনকি ডানার গোড়ায় বাঁকের কাছে সোনালি-হলদেটে ছাপও বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। নিচে ধুসর সাদা, তলপেটের কাছে লেজের তলা আবার উজ্জ্বল হলুদরঙা। এদের ডাকও অন্য দুটি টুনটুনিদের চেয়ে ভিন্ন রকমের, তবে বেশ কান-ভেদ করা শব্দ। এই দুই প্রকারের টুনটুনিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি এখন পর্য্যন্ত।
আমার অবাক লাগে যে এই টুনটুনি পাখিকে অনেকে গায়ক পাখিও বলে থাকে। রুডইয়ার্ড কিপলিং তার জাঙ্গল বুক বইতে একে অমর করে রেখেছেন। এইটুকু ক্ষুদ্র পাখির এত জোর ডাক না শুনলে আন্দাজ করা কঠিন। ওর এই ডাক গানের চেয়ে বাজনা বললে বেশি ভাল লাগত। দোয়েল, কোয়েল, বুলবুলি, ময়নারা যখন মিষ্টি গান গাইবে তখন টুনটুনি তার আওয়াজে বাজনার তাল দেবে। এ এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক সুরে পরিনত হবে। আহা! এরকম সুর তাল যদি ধরা যেত তাহলে সেটাই হত এই পৃথিবীর সব থেকে মধুর ধ্বনি
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে
পাখিদেখার লেখাটি পড়ে অনেক বেশি ভাল লাগল। বেশ সুন্দর হয়েছে লেখাটি।
LikeLike