বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্মণ, মানুষখেকো নেকড়ে
মূল: বন বন্দুকের ডায়েরি-মার্ভিন স্মিথ
মানুষখেকো নেকড়ে মারা যাবার দিন দুয়েক বাদে একদিন সন্ধের পর সেই বুড়ো ভিল বিরাট এক দলবল নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে এসে হাজির। তাদের মধ্যে দুজন একটা লম্বা বাঁশ বয়ে আনছিল। বাঁশের মাঝখানে একটা শরীর বেঁধে-ছেঁদে ঝোলানো। তাতে তখনো প্রাণ আছে।
শরীরটা একটা কিশোরের। তার হাত আর পা দড়ি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে বাঁধা। সারা গায়ে বেদম পিটুনির দাগ। তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বার বার বের করে গরগর করে উঠছিল সে। তার হাতে ছুরির ফলার মতো লম্বা লম্বা নখ। ধরা দেবার আগে সেই দাঁত আর নখ যে সে বেশ খানিক কাজে লাগিয়েছে তার প্রমাণ দিচ্ছিল তাকে ধরে আনা লোকজনের গায়ের আঁচড়-কামড়ের দাগগুলো।
তার বাঁধন খুলে দিতে বলায় সবাই একযোগে বলে উঠল, “খুলবেন না সাহেব। তাহলেই এক দৌড়ে পালিয়ে যাবে।”
শেষে তার কোমরে একটা কুকুর বাঁধবার শেকল বেঁধে দিয়ে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে নামিয়ে আনা হল তাকে। কিন্তু পালাবার কোনো ইচ্ছেই দেখা গেল না তার মধ্যে। তার বদলে হাত-পাগুলো গুটিয়ে ছোটো একটা শিশুর মতোই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল সে। তার মাথার লম্বা, জটাপাকানো, পিঙ্গল চুল কাঁধ অবধি ছড়ানো। হাত-পাগুলো সরু সরু। তাতে অনেক আঘাতের দাগ। পেটটা গোল হয়ে উঁচু হয়ে রয়েছে। তার বেশিরভাগ দাঁতই ক্ষয়াটে, তবে ছেদক আর শ্বদন্তগুলো বেশ তীক্ষ্ণ।
খানিক পোড়ানো মাংস সামনে ধরে দিতে প্রথমে সে সেটাকে ভালো করে শুঁকল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখের একপাশ দিয়ে তার বড়ো বড়ো টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে না চিবিয়েই গিলে খেতে শুরু করল। মাংস খাওয়া শেষ হবার পর হাড়গুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিবোনোর পালা চলল তার। বোঝা যাচ্ছিল ওই করেই তার বাকি দাঁতগুলো অমন ক্ষয়াটে রূপ ধরেছে।
ছেলেটার গায়ে একটা তীব্র বুনো গন্ধ ছিল। ক্যাম্পের কুকুররা দেখি সে-গন্ধ পেয়ে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাবার তাল করছে। ওরই মধ্যে আমার নান্দের-এর দিকে চোখ পড়তে দেখি ছেলেটা বার বার তার কাছে যেতে চায়। নান্দের হল আমার একটা বড়োসড়ো ব্রিঞ্জারি কুকুর। পছন্দের কারণ, তার চেহারাটা অবিকল একটা নেকড়ের মতো।
তাঁবুর ভেতর নিয়ে যাবার পর দেখা গেল আলোয় তার বেজায় ভয়। কিছুতেই আলোর কাছে সে যাবে না। হাজার বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়েও সে ভয় ভাঙানো গেল না তার। যতবার তাঁবুতে ঢোকানো হয়, ততবারই সে অবধারিতভাবে এক ছুটে তার কোনো অন্ধকার কোণে কিংবা কোনো ক্যাম্প খাটের তলায় গিয়ে ঢুকে জড়সড় হয়ে কুণ্ডলী পাকাবে।
তবে তাঁবুতে তাকে থাকতে দেবার উপায় ছিল না। কারণ, তার চুলে অসংখ্য উকুন আর গায়ে অসহ্য গন্ধ। শেষমেশ কুকুরদের বেঁধে রাখবার জায়গায় তাকে একটা খড়ের বিছানা করে দেওয়া হল। সেখানে একটা খোঁটার সঙ্গে শেকলে বেঁধে রেখে তাকে পাহারা দেবার জন্য একটা নজরদার বসিয়ে দেওয়া হল।
পরদিন সকালে উঠে আমাদের বন্দিকে ভালো করে দেখলাম। বড়োজোর বছর দশেক বয়েস হবে তার। অনেক কষ্টে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে মেপে দেখা গেল, লম্বায় সে চার ফুট এক ইঞ্চি। কনুই, হাঁটু, পায়ের আঙুল, হাতের তেলোর নীচের অংশ কাঠের মতো শক্ত, কড়া পড়া। বোঝা যাচ্ছিল ওইতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ছোটাই তার অভ্যাস। মাঝেমধ্যে দু-পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক পা ছুটে গিয়েই সে ফের চার হাত-পায়ে উবু হয়ে বাঁদরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুট দেয়। তবে সাধারণত হাঁটু আর কনুইতে ভর দিয়ে নীচু হয়ে চলাফেরা করে সে। আগের পর্বে যে তার চলাফেরার পথে মাঝে মাঝেই তার চলার চিহ্ন হারিয়ে যাবার কথা লিখেছি, এবারে বোঝা যাচ্ছিল সে-সব জায়গায় সে দু-পায়ে উঠে দাঁড়াত আর তাই তার পায়ের চিহ্ন অন্য লোকজনের পায়ের চিহ্নের থেকে আলাদা করে চেনা যেত না।
গায়ে কোনোধরনের পোশাক তার বিলকুল না-পসন্দ। শোবার জন্য দেওয়া খড়ের বিছানা ছুড়ে ফেলে বালিতে একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে গিয়ে গুটিসুটি মেরে সেঁধোয়। ধরে-বেঁধে তার চুল ছোটো করে ছেঁটে দেওয়া হল। তারপর তাকে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যেতে মহা মুশকিল বাধল। বেজায় ভয় পেয়ে দাঁত-নখ খিঁচিয়ে সে এমন মূর্তি ধরল যে কার সাধ্য তাকে জলে নামায়। দুই ঝাড়ুদার আর দুই মেথর মিলে তাকে পাঁজাকোলা করে ধরে জলে চোবাতে হিমশিম খেয়ে গেল। শেষে নান্দেরকে ধরে এনে তার পাশে জলে নিয়ে নামাতে সে খানিক শান্ত হয়। গোটা ক্যাম্পের মধ্যে নান্দেরকেই খানিক যা বিশ্বাস করত সে। আর সবচেয়ে অপছন্দ ছিল কাম্বারলেজের লোমঢাকা টেরিয়ারটাকে।
গুলি করে মারা মেয়ে নেকড়েটার ছালটা এনে তাকে দেখাতে হঠাৎ ভারি উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। বার বার চামড়াটাকে উলটেপালটে দেখে আর কান্নাভরা ডাক ছাড়ে মুখ উঁচিয়ে। ডাকটা অনেকটা শেয়ালের বাচ্চার ডাকের মতো শোনাচ্ছিল। কাজেই ক্যাম্পে তার ডাকনাম হয়ে গেল সীয়াল।
প্রথমবার দেখবার পর আর কখনো তাকে চামড়াটা দেখালে সে বেদম ভয় পেত। মোটে কাছে এগোতে চাইত না চামড়াটার। সারাটা দিন পড়ে পড়ে ঘুমোত শুধু। আর সন্ধে হলেই জেগে উঠে ছটফটানি শুরু করত। এ-সময়টা জঙ্গলের দিকে পালাবার জন্য টানাহ্যাঁচড়া বেড়ে উঠত তার। কুকুরদের বিস্কুট মুখে তুলেও দেখত না কখনো। মাংস আর ভাত একসঙ্গে সেদ্ধ করে খেতে দিলে তার থেকে বেছে বেছে মাংসের টুকরোগুলো তুলে খেয়ে ভাতটা ছড়িয়ে ফেলত চারদিকে। আর, কখনো কাঁচা মাংস পেলে তার খুশি সেদিন দেখে কে! সবচাইতে প্রিয় ছিল মুরগির নাড়িভুঁড়ি। কখনো ক্যাম্পের রাঁধুনি ও-জিনিস তার কাছাকাছি ছুড়ে ফেললে কেউ আটকাবার আগেই দু-হাতে সে-সব তুলে নিয়ে মুখে চালান করে দেবে।
মরা জীবজন্তুর ব্যাপারেও তার প্রবল লোভ। তীব্র ঘ্রাণশক্তি ছিল ছেলেটার। অনেক দূরে কোনো মরা গরু বা মোষ কেউ ফেললেও সে সঙ্গে সঙ্গে তার গন্ধ পাবে। আর তারপর বেঁধে রাখা শেকলটা ধরে সেদিকে যাবার জন্য সে কী টানাটানি তার!
এরপর খুব শিগগিরই নতুন কিছু লক্ষণ দেখা দিল তার মধ্যে। তার একটা হল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। যতদিন আমি সেখানে ছিলাম, ততদিন তাকে কথা বলতে দেখিনি, কিন্তু পরে শুনেছিলাম, খুব তাড়াতাড়ি তার পাহারাদারদের কাছ থেকে গোন্দদের ভাষা শিখে নিয়েছিল সে। ধরা পড়বার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বুদ্ধিতে তার সঙ্গী কুকুরদের থেকে অনেকদূর এগিয়ে গেল সে। মাথায় নিত্যনতুন বুদ্ধি গজাতে শুরু করল তার। কুকুরদের যখন খেতে দেওয়া হত, তখন তাদের পাশে চুপটি করে বসে চুপিচুপি তাদের পাত্র থেকে মাংসের টুকরো সরিয়ে ফেলত। তারপর প্রিয় বন্ধু ব্রিঞ্জারিকে সেগুলো খেতে দিত।
কিছুদিন এভাবে কাটবার পর একদিন তাকে ধরে ন্যাড়া করে দিয়ে, ভালো করে তেল-হলুদ মাখিয়ে গরম জলে রগড়ে স্নান করিয়ে দেওয়া হল তাকে। এতে তার গায়ের বুনো গন্ধটা দূর হল খানিক। এবারে, একটা কৌপিন দেওয়া হল তাকে। সেটা পরে থাকলে প্রতিদিন তাকে একটা বড়োসড়ো কাঁচা মাংসের টুকরো উপহার দেওয়া হত। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল কৌপিন পরে থাকতে আর তার কোনো আপত্তি হচ্ছে না।
ততদিনে সে বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এলাকায়। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন তাকে দেখতে আসে। তার কেটে ফেলা নখ আর চুলের টুকরো দর্শকদের কাছে বিক্রি করে তার পাহারাদার মেথররা বেশ দু-পয়সা কামিয়ে নিচ্ছিল তখন। সে-নাকি জলাতঙ্কের অব্যর্থ দাওয়াই।
ওদিকে, গ্রামের মেয়ের দল তাকে ভাবত বনের দেবতা। দুধ আর বনমুরগি দিয়ে রোজ তার পুজো দিতে আসত তারা দূরদূরান্ত থেকে। তার নাম তারা দিয়েছিল নেকড়েঠাকুর। তাদের বিশ্বাস, এ-ঠাকুরের দয়া হলে তাদের গরু-মোষের দলের ওপর বনের জন্তুদের কুদৃষ্টি পড়বে না মোটে।
সিয়াল কিন্তু মেয়েদের এই পুজো-টুজো মোটেই পছন্দ করত না। তাদের সঙ্গে আসা ছোটো ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠত। বুঝতে অসুবিধে হত না, ছোটো ছেলেমেয়েদের মাংস দিয়ে সে আর তার নেকড়ে মা বহুবারই তাদের খাওয়াদাওয়া সেরেছে। ফলে এই পুজোর সময় তাকে পাহারা দেবার লোক বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল আমাদের।
কেমন করে নেকড়ে-মানুষ তৈরি হয়? দিশি লোকজন বলে, যখন কোনো মা নেকড়ের ছানারা মারা যায় তখন দুধে তার বুক ভরে গিয়ে ব্যথা শুরু হয়। এই সময়টা সে সুযোগ পেলেই মানুষের বাচ্চা চুরি করে তাকে দুধ খাইয়ে বুকের ব্যথা কমায়। আর একবার নেকড়ের দুধ খেলে দলের নেকড়েরাও মানুষের ছানাকে নিজেদের একজন বলে মেনে নেয়। তাকে নিজেদের মধ্যে রেখে তখন বড়ো করে তোলে তারা।
কিছুদিন বাদে ভোপালে ফেরবার সময় লেফটেন্যাট কাম্বারলেজ সিয়ালকে তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যান। শুনেছিলাম পরে তাকে উত্তর-পশ্চিমের কোনো মিশনারি স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে-সময় তার গল্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ভারতে। মনে হয় ওকে অবলম্বন করেই কিপলিং তাঁর মৌগলিকে তৈরি করেছিলেন।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে
কি সাংঘাতিক বাস্তব। অবাক লাগে, খানিক কষ্ট ও হয় সিয়ালের জন্যে।
LikeLike
Osadharon ekti post. Joydhakke dhonnobad ei postti sokoler kache pouche Dewar jonno.
LikeLike