বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল, বাঘমারা ভীম
ডাইনিবুড়ি লাগন যে আমায় কাপড়ের দাম চাইতে যেতে অভিশাপ দিয়েছিল সে-কথা তো হুজুরকে বলেছি। সে অতি ভয়ঙ্কর অভিশাপ। হাতের আঙুলগুলো সাপের মতন বাঁকিয়ে বুড়ি যখন অভিশাপ দিচ্ছে তখন তার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা বালির গায়ে অভিশাপটাকে মোটা করে দেগেও দিচ্ছিল।
তারপর থেকে তো বাঘের ভয়ে আমার একলা একলা জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ। গেলেই ভয় লাগে, এই বুঝি বাঘে ধরল! শেষমেষ একটা মুরগি বলি দিয়ে তার রক্তটা দিয়ে কুঁড়ের চারপাশে বন্ধন দিলাম। কিন্তু তাতেও ফল হল না বিশেষ।
আমাদের গাঁ-গঞ্জের বুড়িরা যে বাঘের রূপ ধরতে পারে সে-কথায় তো হুজুর বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু সে-জাদু তাদের সত্যি সত্যিই জানা। বনপাহাড়ের সব মানুষ সে-খবর জানে। সাহাব-লোগের দেশে হয়ত তেমনটা হয় না, কিন্তু আমাদের দেশে ও-সব হরবখত হয়। বিশ্বাস না হলে আমাদের মাঠা কিংবা লছ্মণ সর্দারকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। লছ্মণ তো বারহার মুখিয়া। সে মিছে কথা বলবে না। লাগন ইচ্ছে করলে যে-কোনো জন্তুর রূপ ধরে যার খুশি জান নিয়ে নিতে পারে। কোনো জংলি প্যান্থারে আমার ছাগল মারেনি হুজুর। প্যান্থারের রূপ ধরে মেরেছিল মেরেছিল ওই লাগন এ আমি নিশ্চয় জানি।
সেদিন ওর সামনের বাঁদিকের পা-টা খোঁড়া করে দিয়ে ওর কানের টুকরোটা যে কেটে নিয়েছিলাম, ওইতেই আমার জান বেঁচেছে। গাজি বলে দিয়েছিল, যদ্দিন সে-জিনিস ভরা তাবিজ আমার গায়ে থাকবে তদ্দিন আমার চুলের ডগাটাও ছুঁতে পারবে না লাগন, তা সে যে জন্তুর রূপই ধরুক না কেন।
ছাগল নিয়ে ঘটনাটার পরদিন সকালে লাগন হঠাৎ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত। এসেই বলে, “তোর কাছে নাকি একটা বাঘের কান আছে? চারটে টাকা দিচ্ছি, কানটা আমায় দিয়ে দে। ও-দিয়ে আমি ওষুধ বানাব।”
আমি মানা করতে রেগে দশখানা হয়ে সে একটা চোখ বুঁজে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে একটা অভিশাপ আঁকল ফের। তারপর দুপদুপিয়ে চলে গেল। বুঝলাম, এবার হয় ও মরবে নয় আমি।
তারপর গাজির কাছে গিয়ে তো আমি তাবিজ বানালাম। ওদিকে লাগন বেশ কদিন অসুখে ভুগল। কুঁড়ের বাইরে তখন তার দেখাই মেলে না মোটে।
সে-ছিল ফসল কাটার সময়। গাঁয়ের বৌ-ঝিরা সারাদিন ক্ষেতেই পড়ে থাকে সেই কাজে। আমাদের কুঙ্কু প্রত্যেকদিন মহুয়া গাছের তলায় তার বাচ্চাটাকে শুইয়ে রেখে মাঠে যেত। একদিন দুপুরে মাঠ থেকে গাছতলায় সে এসে দেখে বাচ্চাটা নেই। দেখে কুঙ্কুর সে কী কান্না! চিলের বাসা ভাঙলে মা চিল যেমন বিলাপ করে ঠিক তেমনি শোনাচ্ছিল কুঙ্কুর গলা।
আমরা তো আকাশপাতাল তোলপাড় করে খুঁজলাম। কোথাও তার দেখা নেই। অতটুকু বাচ্চা! সে তো আর হামা টেনে কোথাও পালাবে না! কেউ তাকে কোলে করে নিয়েও যায়নি। শেষমেষ অনেক খোঁজাখুঁজির পর গাছতলা থেকে নালার দিকে যাবার পথে দু’এক ফোঁটা রক্ত দেখে সবার সন্দেহ হল। নালার পাড়ে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে প্যান্থারের থাবার ছাপ।
সেদিকে দেখতে দেখতে গ্রামের একজন হঠাৎ বলে, “প্যান্থারটা কিন্তু তিন-ঠেঙো। কেবল তিনটে থাবার ছাপ পড়েছে মাটিতে।”
সবাই মিলে খেয়াল করে দেখা গেল কথাটা ভুল নয়। সামনের দিকের বাঁ থাবার ছাপ পড়েনি তার মাটিতে। সেই তিন পায়ের ছাপ ধরে ধরে বেশ খানিক এগোলামও আমরা, কিন্তু তারপর পাথুরে জমিতে সে ছাপ মিলিয়ে গেল।
তারপর মাঝে মধ্যেই গ্রাম থেকে বাচ্চা হারানো শুরু হল। শুধু আমাদের গ্রাম নয়, শয়তানটা চারপাশের ডালকি, হুথুটোয়া, দেওরা, সোমি এমন সব গ্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সব জায়গায় সেই একই তিন ঠেঙো ডাইনি-প্যান্থারের থাবার ছাপ। তার ভয়ে ছাগলচরানিরা অবধি শেষমেষ ছাগল নিয়ে পাহাড়ের দিকে যাওয়া ছেড়ে দিল।
এইভাবে কয়েকদিন যাবার পর দেখা গেল তার সাহস আরো বেড়েছে। বাচ্চা ছেড়ে এইবার সে গাঁয়ের মেয়েদের ধরতে শুরু করল। তার ভয়ে মেয়েদের রাস্তায় একলা বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি জোয়ান মরদরাও সন্ধের পর কুঁড়ের বাইরে পা রাখতে সাহস পায় না।
সেবার মাঘীপুর্ণিমার রাত্রে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মদ খেয়ে নাচগান করছে তখন হঠাৎ ডাইনি-প্যান্থার সটান গ্রামে এসে ঢুকে শুঁড়িখানার মালিকের চোদ্দো বছরের জোয়ান মেয়েটাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। কেউ তাকে দেখেনি। শুধু মেয়েটা উধাও,আর যেখানটায় তাকে শেষ দেখা গিয়েছিল সেখানটাতে তিন-ঠেঙো শয়তানটার পায়ের ছাপ। পরদিন সন্ধের দিকে তার মাথা আর বুকের খানিকটা খুঁজে পাওয়া গেল লাগনের কুঁড়ের পাশে।
তখন তো লাগনকে ডেকে পাঠানো হল। দেখা গেল হাড়জিরজিরে বুড়ির গায়ে হঠাৎ করে বেশ গত্তি লেগেছে। তার ঘরে তল্লাশি নিতে আমাদের গৌলা-র মেয়ের ক’খানা রূপোর গয়নারও খোঁজ মিলল। মাসতিনেক আগে সে-মেয়েকেও ঐ প্যান্থারে খেয়েছিল।
বুড়ি অবশ্য তার দোষ স্বীকার করতে নারাজ। বলে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে সে ওই গয়না কুড়িয়ে পেয়েছে। কিন্তু কেউ তার কথায় বিশ্বাস করল না। সবাই বলে ওকে পুড়িয়ে মারা হোক। কিন্তু সে-কাজ করলে আবার সরকারের ভয় আছে। তখন শলাপরামর্শ করে ঠিক হল, বুড়িকে গাঁ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তার কুঁড়েটা পুড়িয়ে দেওয়া হবে। তা সে রাত্তিরেই তার কুঁড়েয় আগুন দেওয়া হল আর গাঁয়ের চৌকিদার তাকে ধরে নিয়ে মোরং-এ তার কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এল। এরপর ক’দিন বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল। লোকজন আবার যে-যার কাজে লাগল।
কিন্তু ফের গণ্ডগোল বাধল দু-বছর আগে এক ধান কাটার দিনে। ধান কাটবার সঙ্গে সঙ্গেই তো আর ঝাড়াই হয় না! কদিন গাদা করে আমরা কাটা ধানগাছ ফেলে রাখি। ওতে ধানের শিষ ঢিলে হয়ে গেলে তারপর বলদ দিয়ে মাড়িয়ে আলাদা করা হয়। সেদিন রাত্রে আমাদের মুখিয়া তার ছেলেকে নিয়ে ধানের সেই গাদার পাশে ঘুমিয়েছিল। সকাল, হতে দেখা গেল মুখিয়ার ছেলে নেই আর ধানের গাদার পাশে সেই তিন-ঠেঙো ডাইন-প্যান্থারের থাবার ছাপ।
তখন এলাকার সেরা বাঘমারিদের ডাকা হল। তারা এসে ফাঁদটাদ পাতল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। খবর গেল রেলের সাহেবদের কাছে। তারা বন্দুক নিয়ে এসে বেশ ক’টা বাঘ আর প্যান্থার মারল, কিন্তু তিন-ঠেঙোর হদিশ তাতেও মিলল না। বারহায় তার তল্লাশি চললে সে দেওরায় দেখা দেয়। দেওরায় গেলে শুনি ফের বারহায় তার খোঁজ মিলেছে। লোকে মুরগি, পাঁঠা, এমনকি মোষের বাচ্চা বলি দিয়েও শান্তি-স্বস্ত্যয়ণ করল, কিন্তু তাতেও ডাইনি-প্যান্থারের থামবার কোনো লক্ষণ নেই। শেষে লোকজন এমন ভয় পেল যে বেশ ক’ঘর মানুষ বাড়ি ফেলে কেউ পাকতুমে, কেউ বা অন্য কোথাও পালিয়ে গেল।
শুধু একা আমিই ভয় পাইনি হুজুর। গায়ে আমার গাজির তাবিজ ছিল কিনা! শেষমেষ সরকার শয়তানটাকে মারবার জন্য পনেরো টাকা কবুল করল আমায়। কিন্তু আমিও কিছু করে উঠতে পারছিলাম না। যে ফাঁদই পাতি, ঠিক তাকে এড়িয়ে পালায় সে। গত নভেম্বরে মাঠোর বাচ্চা ছেলেটাকে রাত্রে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে খেলো। মাথা আর পা-দুটো শুধু পাওয়া গিয়েছিল তার, সে তো আপনিও দেখেছেন হুজুর। তারপরই তো আমি আপনার বাউর্চিখানার পেছনে ফাঁদ পাতলাম। ওইতে পা দিয়ে শেষমেষ সে মরল।
ওর এক সপ্তাহের মধ্যে খবর এল লাগন বুড়িও মরেছে। তাহলেই বুঝুন, ওই বুড়িই সেই ডাইনি-প্যান্থার হয়ে আসত কি না!
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে