আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া , হাট্টিমাটিমটিম থেকে হটিটি
আকারে চড়ুইয়ের সমান আর দেখতে অনেকটা আমাদের ঘরের পাখি, ঘরোয়া চড়াইর মতো। স্ত্রী ও পুরুষ একইরকমের দেখতে হয়। মাথার রঙ চকচকে কালো ও ঘাড়ের উপর দিয়ে গলা পর্যন্ত বিস্তৃত। চোখের নীচের অংশের রঙ সাদা। নীচের চঞ্চুর থেকে একটা মোটা কালো রেখা লেজের শেষভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। দেহের উপরিভাগের রঙ ধূসর। পেট সহ দেহের নীচের অংশ সাদা।
পুরো ভারতবর্ষে দেখা যায়। হিমালয়ে ২০০০ মিটার উচ্চতার উপরে অনুপস্থিত। শস্যদানা, ফুলের কুঁড়ি, বাদাম, ফল, কীটপতঙ্গ, তাদের লার্ভা ও ডিম প্রধান খাদ্য। গাছপালাযুক্ত অঞ্চলে দেখা যায়। খুব গভীর জঙ্গলে দেখা যায় না। এক ডাল অন্য ডালে ঘুরে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। গাছের থেকে যে-কোনো অবস্থানে ঝুলে থাকতে পারে। প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখি ‘উই-চি, উই-চি’ বলে শিসের আওয়াজ করে গান গায়। ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে বাসা বানায়। পালক, শুকনো ঘাস দিয়ে গাছের কোটরে বা মাটির গর্তে বাসা বানায়। ৪ থেকে ৬টা লাল-বাদামি দাগওয়ালা সাদা বা গোলাপি সাদা রঙের ডিম দেয়। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে।
এরা গাছের সরু ডাল-পাতার শীর্ষে ঝুলে থাকে আর ভীষণ ছটফটে। অনেকটা টুনটুনির মতো, কিছুতেই এক জায়গায় থাকে না, তাই এদেরকে লেন্সবন্দি করতে পারা এক কঠিন পরিশ্রমের কাজ। তাক করতে না করতেই আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে অন্য ডালে। রামগাংড়া অনেক নামেই পরিচিত যেমন রামগঙ্গা, রূপালি টুই, তিতপোখ। আবার অনেকে একে বনচড়াই বলেও জানে। ইংরেজি নাম সিনেরিওস টিট অথবা গ্রেট টিট (Cinereous Tit or Great Tit)।
বেশ কিছুদিন ধরে ফেসবুক পাখি দেখার পেজে দেখতে পাচ্ছি অনেকেই এই পাখির ছবি পোস্ট করছে। এমনকি আমার বাড়ি থেকে ৫-৬ কিমি দূরেও একজন দেখে ফেলেছে, আর আমি ভাবি আমাকে এরা দেখা দেয় না কেন? মনখারাপ থাকে এই ভেবে। কী আর করা যাবে, পাখিরা তো এইসব ভাবে না যে সাথীদের বলল, ওরে চল, ওই মানুষটার খুব মনখারাপ আমাদের দেখতে না পেয়ে, চল ওর বাড়ির কাছ থেকে ঘুরে আসি। আহা! এমন যদি ওরা ভাবতে পারত কত ভালো হত।
২০১৯ সালের মে মাসে জয়ঢাক পত্রিকার আহ্বানে উত্তরাখণ্ডের চোপতায় অবস্থিত তুঙ্গনাথ ও চন্দ্রশিলা ট্রেক অভিযানে যোগ দিই। ফেরার পথে আমরা এক অত্যন্ত শান্ত, সবুজ পাহাড় ঘেরা হিমালয়ের গ্রাম মনডল, ওখানেই আমরা রাত্রিযাপন করি। মনডলকে বলা হয় পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। ওখানে পৌঁছানো মাত্র আমি পাহাড়ি হাঁড়িচাচার দর্শন পাই। অনেকটা পথ অতিক্রম করে আমরা এখানে পৌঁছেছিলাম, তাই সকলেই ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। তাই দুপুরের আহার সেরে নিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেওয়া ঠিক হল। বিকেলের দিকে আমরা অনসূয়া নদীর ধারে যাব ঠিক করলাম। যেহেতু বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম তাই সহজেই চোখ বুজে এল। বোধ হয় ঘণ্টা খানেক দিবানিদ্রা ভালোই সেরেছি, আমার চোখ খুলে গেল কিচিরমিচির আওয়াজে। বাইরে পাখি আছে টের পেলাম। আমার পাশে আরও দুজন তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তাদেরকে বিরক্ত না করে ধীরে ধীরে উঠে পড়লাম। ক্যামেরা টেবিলের ওপর রাখা ছিল। হাতে নিয়ে সোজা খোলা বারান্দায় চলে এলাম। সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি, চারপাশে প্রচুর পরিমাণে গাছগাছালি আর চারপাশে সবুজ পাহাড়, দূরে কলকল করে অনসূয়া নদীর বয়ে চলার শব্দ পাচ্ছি। এখানে যখন বেলায় এসে পৌঁছলাম তখনই এই খোলা বারান্দা চোখে পড়ে আমার আর দেখেই মনে হয়েছিল পাখি দেখার আদর্শ স্থান এটাই। পৌঁছেই আমি এখান থেকে দর্শন পেলাম পাহাড়ি হাঁড়িচাচার (গ্রে ট্রিপাই)। আর এই বারান্দা থেকে পাখিদের সঙ্গে পাচ্ছি উন্মুক্ত প্রকৃতি, নদী, পাহাড়—আর কী চাই। দেখে মনে হচ্ছিল অন্তত গ্রীষ্মে যদি এসে এখানেই সময় কাটানো যেত কত ভালো হত।
যেদিক দিয়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দ পাচ্ছিলাম, খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি কোথায় গাছের পাতার মধ্যে কী পাখি অনর্গল চেঁচামেচি করে চলেছে অথচ দেখা যাচ্ছে না। তারপর দেখি তিনি বেশ কসরত করতে করতে এক গাছের ডালে উলটে বসে, মুখ ফিরিয়ে। গায়ের রঙ দেখলাম ধূসর ছাই রঙের, পেট সাদা, আকারে চড়াই পাখির মতো।
সে আর মুখ আমার দিকে ফেরালই না অভিমানে। ছবি তুললাম ঠিকই, কিন্তু মনোমতো হল না। ওই অবস্থাতেই সে উড়ে বেরিয়ে গেল আর ফিরল না। এই পাখি আমি দেখেছি কি না বুঝতে পারছি না। তাই আমার মোবাইলে একটি পাখি দেখার ও চেনার একটা ই-বুক রয়েছে। তাতে সব পাখির ডাকও রয়েছে। ডাক শুনেও পাখি চিহ্নিত করা যায় ইচ্ছে করলে। এই পাখি স্বর আমার মনে ছিল তখন। তাই আর দেরি না করে ই-বুক বার করলাম। ওর চেহারা দেখে আমার মনেই হয়েছিল এ নিশ্চয়ই পাহাড়ি টিট হবে। তাই টিটদের পরিচ্ছেদে খুঁজতে আরম্ভ করলাম। দেখলাম এ তো সত্যিই টিট, কিন্তু কেবলমাত্র পাহাড়ের নয়, এরা সমতলেও থাকে। তাই প্রত্যাশা বেড়ে গেল। তাহলে তো বাড়ি ফিরে গিয়েও একে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। মনডলকে পুরোপুরি উপভোগ করে পরের দিন ফিরে এলাম হরিদ্বার। এক রাত কাটিয়ে পরের দিন দিল্লি হয়ে আবার কলকাতায়।
সেটা ছিল ২০১৯ সালের মে মাস। হিমালয়ের অনেক মধুর স্মৃতি নিয়ে সময় কাটাই যেগুলো মাঝেমধ্যে ল্যাপটপে আর এখন টিভির পর্দায়ও দেখা যায়। বেশ কাটছিল দিনগুলি—কর্মব্যস্ততায়, নিজের লেখালিখি, বই পড়ে, সিনেমা দেখে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা—চা, চপ আর মুড়ির আড্ডায়। ২০২০ সালের মার্চ মাস পড়তেই সবকিছু থিতিয়ে পড়ল। এক অতিমারির কবলে পড়ে মানুষ হয়ে গেল গৃহবন্দি, কিন্তু প্রকৃতি ফিরে পেল তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যা কিনা মানুষ করে তুলেছিল অনিশ্চিত। ইতিমধ্যেই আমরা প্রকৃতির অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি—গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে যার পরিণাম আজ মানুষ অক্সিজেনের জন্য হাহাকার করছে। ঠিক তেমনই জলের অপচয়ও বন্ধ করতে হবে আমাদের, না-হলে হয়তো ঠিক অক্সিজেনের মতো জলেরও না আকাল পড়ে যায়। তারপর অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট অথবা স্ন্যাপডিল থেকে জল অর্ডার করে আনাতে হবে। তাই আমাদের সকলকেই এখন থেকে সচেতন হয়ে এগোতে হবে। যাই হোক, এই দুর্দশার দিনগুলো, যার নাম দেওয়া হয়েছে লক-ডাউন, বাড়ির জানালা অথবা ছাদে বসেই কেটে যায় বিষন্নতার ছায়ায়। এর মধ্যেও একটু আনন্দ পাওয়া যায় প্রকৃতির আর সব জীবজন্তুদের দেখে। কেমন যেন মনে হয় যে ওরা আমাকে দেখে মুখ ভেঙচি করে খ্যাপায়, ‘কী, কেমন লাগছে খাঁচায় বন্দি থাকতে’। বোধ হয় এটাই আমাদের প্রাপ্য ছিল। যদি এবার শিক্ষা পেয়ে আমরা শুধরে যাই।
২০২০ সালে আমরা গৃহবন্দি ছিলাম মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত। তারপর একটু একটু করে সবকিছু খুলতে আরম্ভ করে, বিদ্যালয় এবং কলেজ বাদে। সেটা ছিল আনলক প্রথা। তারপর দুর্গাপুজোর পর থেকে সব ঠিক হতে আরম্ভ করল। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই বুঝি অতিমারি বিদায় নিল। কিন্তু সে আবার এই মার্চে ফিরে এল আরও ভয়ংকর রূপ নিয়ে এবং এসেই এক এক করে মারতে শুরু করল। আবার আমরা ঘরে বন্দি হলাম। আর সময় কাটাবার জন্য আমি আমার ক্যামেরা হাতে হয় জানালায়, নয়তো ছাদে।
গত বছরের লক-ডাউনে এই জানালায় বসেই নিত্যনতুন পাখির ছবি তুলেছি, আবার পুরোনো পাখির ছবি নতুন কায়দায় তুলেছি। সেবার তো আকস্মিকভাবে আমার বাড়ির ঠিক পেছনে এক মৌবাজ (অনেকটা চিলের মতো দেখতে) এসে হাজির। তাকে আবার ১০-১২টা কাক মিলে তাড়াল। তার কিছুদিন পর হিমালয়ের এক কপোত (পায়রা) এসে হাজির। সেটা ছিল মার্চ মাসের শেষে। ভাগ্যবান মনে হয়েছিল নিজেকে যে বাড়ির জানালায় বসে হিমালয়ের পাখির দর্শন পেলাম। কিন্তু এই বছরের লক-ডাউন যেন একটু ব্যতিক্রম। হতাশা অনেক, অক্সিজেনের আর ওষুধের জন্য হাহাকার, মৃত্যু মিছিল আর তার সঙ্গে কিছু স্বার্থপর মানুষের লোভ—সব মিলিয়ে মানুষের জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে। কবে এর থেকে সবাই মুক্তি পাবে কেউ জানে না। তার মধ্যেও একটাই প্রাণের আলো দেখা যায়, তা হল আমাদের চারপাশের প্রকৃতি ও তার জীবেরা। এবারের লক-ডাউনে আমার প্রাপ্তি সেই মনডলের রামগাংড়া বা বনচড়াই।
ফেসবুকে যখন দেখলাম যে রামগাংড়া আমার এলাকায় চলে এসেছে তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। আর হল তাই। সকালে আমার বক্স জানালায় বসে চা পান করছি, তখনই কানে এল এক চেনা পাখির ডাক। দু-বছরেরও বেশি পেরিয়ে গেছে, তাই ডাকটা মনে করতে কষ্ট হচ্ছিল। পেছনের কদমগাছের বড়ো বড়ো পাতার আড়ালে কিছু লাফালাফি করছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সময় নষ্ট না করে আগে উঠে গিয়ে ক্যামেরা তৈরি করলাম। ডাক তখনও শোনা যাচ্ছে। আমিও তৈরি, দেখামাত্র শুট করব আর বন্দি বানিয়ে নেব। যাবে কোথায় বাছা, আমিও শিকারি কম নই। আমি পড়েছি যে এই পাখি হয় খুব উঁচু ডালে অথবা সরু ডালে বসে ঝুলতে দেখা যায়। তাই চোখ রেখেছিলাম মগডালের দিকে আর গাছের বামদিকে একটা সরু কাঠির মতো ডাল বেরিয়ে আছে, তার দিকে। আমার অপেক্ষার অবসান হল। একসঙ্গে একজোড়া রামগাংড়া সরু প্রশাখাটির ওপর বসে বেশ দুলতে লাগল। এবার আর কোনও ভুল নয়, জানালায় বসেই কার্যসিদ্ধি, চমৎকার ভঙ্গিতে দুজনের ছবি এক ফ্রেমে।
এবারের লক-ডাউনে যে প্রাপ্তি হল এই আনন্দের কোনও সীমা নেই আমার কাছে। কারণ, মনডলে এত কাছে পেয়েও ওকে ফ্রেমবন্দি করতে অসফল হয়েছিলাম। এরপর থেকে প্রায় দু-মাস কেটে গেছে, কিন্তু রামগাংড়ারা ফিরে যায়নি। ওরা এখন থেকে এখানেই ঘোরাফেরা করে। মনে হয় জায়গাটা ওদের পছন্দ হয়েছে। আজকাল তো বাড়ির পেছনে বেলগাছে বসে প্রায়ই ডাকতে থাকে। আমার বাড়ির পেছনে অনেক গাছ রয়েছে। তাছাড়া পেছনে দুটো বড়ো ঝিল, ওখানেও অনেক পাখিদের নিবাস।
আমার মন বলছে আর কিছুদিনের মধ্যে রামগাংড়া আরও অনেক পরিমাণে দেখা মিলবে, যেভাবে আমরা চড়াই, বুলবুল, ময়না, দোয়েল দেখি, এরপর থেকে সাধারণ চড়াইর সঙ্গে দেখা মিলবে বনচড়াইরও। লক-ডাউনের কিছু সুফল তো নিশ্চয়ই আছে।
ছবি-লেখক
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে