বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল, বাঘমারা ভীম, ডাইনি প্যান্থার
বুনো মোষ শিকারের সেরা সময় কোনটা সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন মার্চ-এপ্রিলের শুখা মরশুমই ওর সেরা সময়। তাঁদের যুক্তি, ও-সময় জলে টান ধরে। তাই জঙ্গলের দু-চারটি বড়ো ঝিলের পাশে তারা আসতে বাধ্য। তবে আমার মনে হয় শিকারের সময়টা কোন এলাকায় শিকার করা হচ্ছে তার ওপরে নির্ভর করে। মোষেরা বেজায় পেটুক হয়। ফলে যে জায়গায় যথেষ্ট ঘাস নেই সেখানে জল যতই থাক, তাদের দেখা মিলবে না।
মোষ শিকারের জন্য আমার নিজের পছন্দ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ছোটোনাগপুর। ও-সময় সেখানে সবুজ ধানক্ষেতে বর্ষার জল জমে পুরু কাদা হয়ে থাকে। একসঙ্গে প্রচুর খাবার আর সেই সঙ্গে পাঁকে গড়াগড়ি খাবার লোভে তাই তখন সে-এলাকার ক্ষেতগুলোতে মোষের মেলা বসে যায়। সত্যি বলতে কী, ধানের চারার আগাগুলো যে তারা মুড়িয়ে খায়, তাতে চাষিরা খুশিই হয়। বলে, ওতে নাকি গাছ আরও বেশি করে ধানের শিষ ছাড়ে। কিন্তু আসল ক্ষতিটা তারা করে দেয় জমির জলকাদা ধামসে গড়াগড়ি খেয়ে। গাংপুর, সারাণ্ডা আর ছোটোনাগপুরের দক্ষিণ এলাকায় আবার বর্ষা নামবার কিছুদিন বাদেই মোষের দল পাহাড় ছেড়ে নেমে আসে। ও-অঞ্চলের ঘন জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ছোটো ছোটো ধানক্ষেতগুলোর কাছাকাছি তখন তাদের দেখা মেলে।
বাংলা-নাগপুর লাইনে রেল খোলবার আগে ও-এলাকায় অগুনতি বুনো মোষ মিলত। সে-সময় তিন সপ্তাহে একজন শিকারির ও-এলাকায় সতেরোটা মোষ শিকারের কথাও আমার কানে এসেছে। রেল খোলবার পর আজকাল ওসব এলাকায় বুনো মোষের দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তবে রেল-লাইনের ধার ঘেঁষে কিছু জায়গা এখনও আছে যেখানে এখনও পুজোর আশেপাশে গেলে মোষ মিলবেই।
মাংসের ওই পাহাড়কে কাবু করতে ভারী বুলেটের দরকার হয়। ওর শরীরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল ঘাড়। সেখানে একটা গুলি ঠিকঠাক লাগাতে পারলে হয় সে মেরুদণ্ডে চোট পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাটা কলাগাছের মতো শুয়ে পড়বে, অথবা শ্বাসনালি ফুটো হয়ে কয়েকশো গজ ছোটবার পর মাটি নেবে। শরীরের অন্য কোথাও বুলেট বিঁধলে তাতে তার বিশেষ হেলদোল হয় না। কয়েক বছর আগে একটা বিরাট পুরুষ মোষের কাঁধ আর কোমরে রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি করে দিয়েও তাকে পেড়ে ফেলতে পারিনি আমি। জন্তুটা মারা গিয়েছিল ঠিকই, তবে তা বুলেটের ঘায়ে নয়। অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে।
এই ঘাড়ে গুলি করবার বুদ্ধিটা আমায় দিয়েছিল গাঙ্গপুরের বিসরা এলাকার কোল শিকারি চারুন। মানুষটা বোবা। তবে মুখে কথা বলতে না পারলেও হাত-পা নেড়ে, নানান অঙ্গভঙ্গি করে মনের কথাটি সে ঠিকই বুঝিয়ে দেয় সঙ্গের লোকজনকে। তাছাড়া, আর সমস্ত বোবা মানুষের মতো সে কালা মোটেই নয়। তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি তার। আমাদের কানে আসবার অনেক আগেই সে মোষের দলের খুরের শব্দ পায়। বয়স তার ষাট পেরিয়েছে। কিন্তু তবু এখনও আমাদের দলের সেরা খোঁজারুকেও সে হাঁটায় হারিয়ে দেবে। হেঁটে চারুনের ক্লান্তি নেই। ছোটোনাগপুরের প্রাক্তন কমিশনার মিস্টার হেউইট তাকে একটা গাদাবন্দুক দিয়েছিলেন। অস্ত্রটা নিয়ে বিস্তর গর্ব করে সে। সেইটে কাঁধে ঝুলিয়ে যখন সে কোনও হাতি বা মোষের পেছনে ধাওয়া করে, তাতে কখনও খালি হাতে ফিরতে দেখিনি তাকে।
কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন বেঙ্গল-নাগপুর রেলের বিসরা স্টেশনের কাছে ঘাঁটি গেড়েছি। তখন হঠাৎ একদিন ভোরবেলা দেখি চারুন আসছে। তার হাত দুটো মাথার দু-দিকে মোষের শিঙের মতো করে ধরা। অর্থাৎ বুনো মোষের দেখা পেয়েছে সে। কাছে এসে হাত দুটো নামিয়ে ডানহাতের একটা আঙুল তুলে দেখাল সে। তার মানে একটা মোষ। তারপর মাটির দিকে দুটো হাত একসঙ্গে ছড়িয়ে বুঝিয়ে দিল কতটা গোবর সে একসঙ্গে দেখেছে। বোঝা গেল মোষটা বিরাট বড়ো। তারপর হাত তুলে রেল-লাইনের দক্ষিণদিকে একবার দেখিয়েই আকাশে আঙুল তুলে পুবের দিকে খানিক উঁচুতে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল, দক্ষিণদিকে এগোলে, সূর্যটা যখন আকাশের ওই জায়গায় আসবে তখন মোষের দেখা মিলবে আমাদের। সেদিকে তাকিয়ে আন্দাজ করলাম, ঘণ্টা দুই দক্ষিণমুখো হাঁটলে ন’টা নাগাদ মহাপ্রভুর দেখা মিলবে।
বর্ষার দিনে হাতি বড়ো ভালো বাহন। জলকাদা ভেঙে যাওয়া, তারপর সারাদিনের খাটুনির পর শিকার নিয়ে হা-ক্লান্ত হয়ে অন্ধকারে বৃষ্টি জলকাদার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ফেরবার চাইতে হাওদায় বসে ফেরা অনেক বেশি আরামের। সেই সঙ্গে নিরাপদও।
অতএব খানিকক্ষণের মধ্যে আমাদের মাল বইবার হাতি ‘ভিস্তি’ চারুন আর তার দুই চ্যালার পিছুপিছু দুলকি চালে রওনা হল। ভিস্তির পিঠে মাহুতের পেছনে বসে আমিও চললাম বন্দুক হাতে। আমার হাতি মারবার ভারী বন্দুক তখন কলকাতায় গেছে সারাই হতে। কাজেই আমার হাতে ছিল একটা বারো বোরের ডাবল ব্যারেল। চারুনের কাঁধে তার সেই ক্যাপ ফাটানো গাদাবন্দুক। রেল-লাইনের দক্ষিণে কয়েকটা ছোটো টিলা পেরিয়ে আমরা পশ্চিমদিকে একটা নাবাল জায়গায় এসে হাজির হলাম খানিক বাদে। সেখানে একটা শুকনো নালার ধার ধরে ধরে মাইল খানেক গিয়ে চারুন ইশারায় আমাদের নামতে বলল। নেমে এসে তার আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে দেখলাম, কাদার ওপর স্পষ্ট বুনো মোষের খুরের ছাপ। সে-খুরের আয়তন দেখে তো আমার চোখ কপালে ওঠবার জোগাড়। লম্বায় পাক্কা সাত ইঞ্চি। বুঝলাম ইনি যে-সে মোষ নন। আয়তনে সাক্ষাৎ মহিষাসুর।
মাহুতকে হাতি নিয়ে পেছন পেছন আসতে বলে আমরা ছাপগুলো ধরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর গিয়ে একটা নির্জন ধানক্ষেতের পাশে পৌঁছে দেখি খানিক আগেই জায়গাটাকে একেবারে ধামসে রেখে গেছে জন্তুটা। চারুন ইশারায় বলল, সে সম্ভবত কাছাকাছিই কোথাও আছে। তারপর ডাইনে-বাঁয়ে সতর্ক দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে সামনে এগিয়ে গেল। গুলিভরা অস্ত্র তৈরি রেখে আমিও চললাম তার সঙ্গে।
ধানক্ষেত ছাড়িয়ে তার পাশের জঙ্গলে পা দিয়েছি কি দিইনি, হঠাৎ পেছন থেকে ভিস্তির গগন-ভেদী চিৎকার উঠল একটা। পেছন ফিরে দেখে সে হোঁচট খেতে খেতে প্রাণপণে ছুটে আসছে আমাদের দিকে, আর তার পেছনে খানিক দূরে তাড়া করে আসছে আরেকটা হাতি।
ভিস্তির আর্তনাদ আর তার মাহুতের চিৎকারে খানিক বাদে বোঝা গেল, পেছনের জন্তুটা হাতি নয়। সে আমাদের মহিষাসুর। আমাদের আসবার শব্দ পেয়ে ক্ষেত ছেড়ে উঠে খানিক ঘুরপথে গিয়ে হাতিটাকে পেছন থেকে তাড়া করেছে।
দেখে আমি একটু অবাকই হচ্ছিলাম। কারণ, সাধারণত আহত না হলে বা খুব বিপদে কোণঠাসা না হলে এরা তেড়ে আসে না। তবে এর জবাব আমি পরে পেয়েছিলাম। সে-কথা যথাসময়ে বলব। উপস্থিত আমাদের সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যটা বেশ ভয়াল। ভিস্তির পেছনে দৌড়ে এসে পাহাড়ের মতো মোষটা তখন বার বার বেদম জোরে ঢুঁ মারছে আর ভিস্তিও মার খেয়ে পেছনের পা তুলে লাফ মেরে আর্তনাদ করে চলেছে।
তবে সৌভাগ্যের বিষয় হল, জায়গাটায় তখন তলতলে কাদা। ফলে বেশি জোরে ছুটে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সেই সুযোগে আমরা কাছাকাছি একটা বড়োসড়ো গাছ বেছে নিয়ে তার মগডালে উঠে বসেছি তখন।
হাতি আর মোষ বন্দুকের পাল্লায় এসে পৌঁছতে আমি নিশানা নিয়ে একটা গুলি ছুড়লাম মোষটার দিকে। গুলিটা খেয়ে খানিক হতভম্ব হয়ে সামনের দিকে মুখ তুলে দেখল জন্তুটা। কিন্তু সেখানে তখন তার চোখে পড়ছে শুধু ভিস্তির পেছনটা। অতএব তাকেই দোষী ঠাউরে সে এইবার এমন জোরে একখানা গুঁতো কষাল যে ভিস্তি বেচারি তাইতে ছিটকে পড়ে কাদায় গড়াগড়ি। তার পিঠের ওপর থেকে হাওদা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।
তবে তার মাহুতের কপাল সেদিন খুব ভালো। এমন বিপদেও প্রাণটা গেল না তার। উড়ে গিয়ে নরম কাদায় আছাড় খেয়ে সে দেখি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে উঠে তড়বড়িয়ে আরেকখানা গাছের আগায় চড়ে বসেছে। ওদিকে ভিস্তি তখন ফের চার পায়ে খাড়া হয়ে উঠেছে। উঠে দাঁড়িয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না সে। শুঁড় তুলে গর্জন করতে করতে একছুটে সটান জঙ্গলের ভেতর।
তার পেছন পেছন ছুটতে গিয়ে মোষ হঠাৎ কাদায় পিছল খেয়ে সামনের হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। তাকে উঠতে না দিয়েই এবার আমি দু-নম্বর গুলিটা চালিয়ে দিলাম। এইবার গুলিটা ঠিকঠাক লাগল তার শরীরে। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। কিন্তু পর-মুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়ে সামনে আর কাউকে না পেয়ে পড়ে থাকা হাওদাটার ওপরেই গিয়ে চড়াও হল।
প্রথমেই সেটাকে শিংয়ে তুলে গজ দশেক দূরে উড়িয়ে দিল সে। তারপর সেটা মাটিতে পড়বার আগেই তেড়ে গিয়ে লাথির পর লাথি মেরে হাওদাটার ওপর যাকে বলে তাণ্ডবনৃত্য জুড়ে দিল একেবারে। খানিক বাদে বাদে একটু থমকে দাঁড়ায়, পিছিয়ে গিয়ে মার খাওয়া হাওদাটাকে একটুক্ষণ দেখে, তারপর ফের তেড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে। কখনও শিংয়ে তুলে ছুড়ে দেয়, আবার কখনও মত বদলে লাথির ঝড় বইয়ে দেয় বেচারা হাওদার গায়ে।
এই সুযোগে আরও দুটো বুলেট আমি দৈত্যটার গায়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু অত দূর থেকে ছোড়া গুলিতে বিশেষ কোনও ফল হল না। তখন হঠাৎ দেখি চারুন গাছের ডালে বসে-বসেই তার পরনের কাপড়টা খুলে ফেলেছে। সেটাকে নিশানের মতো হাতে ধরে সে ওপর-নীচে প্রাণপণে দোলাতে শুরু করতেই মহিষাসুরের চোখ গিয়ে পড়ল তার দিকে। তেড়ে এসে তার গাছটার গোড়ায় এমন একখানা বাজখাঁই গুঁতো কষাল সে, যে থরথর করে কেঁপে উঠল অত বড়ো গাছটা। গুঁতোটা মেরে নিজেও একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিল জন্তুটা। সেই অবসরে আমার অনুমতি নিয়ে চারুন তার গাদাবন্দুক দেগে দিল মোষকে লক্ষ্য করে।
তবে সে-গুলিতেও কাবু হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই মোষের। গাছের গায়ে অমন পেল্লায় গুঁতো মেরে তার মাথাটা কয়েক মুহূর্তের জন্য গুলিয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। সেইটে সামলে নিয়ে সে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে চারুন ফের একবার তার কাপড়টা নেড়ে দিল। সেদিকে চোখ দিতে গিয়ে এইবার দেখি তার আমার দিকেও নজর পড়েছে। অমনি মাথাটা নীচু করে লেজ আকাশে তুলে সে ফের একবার দৌড় শুরু করল। তবে এ-যাত্রা তার খানিক বুদ্ধি হয়েছে। সরাসরি গাছের গায়ে ঢুঁ মারবার বদলে সে দেখি লেজ তুলে গাছটাকে পাক দিচ্ছে বার বার। আর মাঝে-মাঝেই মুখ তুলে আমাদের দিকে দেখে মাটিতে পা ঠুকে গর্জন ছাড়ছে। সে-ডাক শুনতে অবিকল বাঘের ডাকের মতো। আসলে ক্ষ্যাপা মোষের ডাকের সঙ্গে বাঘের ডাকের ভালো মিল আছে। অভিজ্ঞ কান না হলে যে-কেউ সে-ডাককে বাঘের আওয়াজ ভেবে ভুল করবে। জঙ্গলে গিয়ে যে বহু মানুষ দূরে বাঘের ডাক শুনেছে বলে খবর দেয়, তাদের অনেকেই আসলে এই মোষের ডাক শোনে। কারণ পুরুষ বাঘ খুব কমই হাঁকার দেয়, আর মাদি বাঘের গলাও শোনা যায় সাধারণত তার মা হবার ঋতুতেই।
সে এক সাংঘাতিক দৃশ্য। জন্তুটার পা থেকে মাথা অবধি কাদায় ঢাকা। কপালের চুলে দলা দলা আঠালো কাদা আটকে আছে। ছোটো ছোটো লাল চোখগুলো ঘুরিয়ে বার বার সে আমাদের দিকে তাকায় আর মাটিতে পা ঠুকে যেন চ্যালেঞ্জ জানায়, ‘হিম্মত থাকলে মাটিতে নেমে এসে মুখোমুখি লড়ে যা।’
এই বন্দুক দিয়ে তার শক্তপোক্ত মাথাটাতে গুলি করলে কোনও ফল হবে না। আমি তাই এবার তার পিঠটা লক্ষ্য করে গুলি চালালাম যদি মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেওয়া যায় এই আশায়। গুলিটা গিয়ে তার পাঁজরে ঘা খেয়ে পেটে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
গুলিটা খেয়ে রক্তের দাগ ছড়িয়ে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে দৌড়ে গেল প্রাণীটা। তারপর একটা বড়ো গাছের পেছনে লুকিয়ে মাথাটা বের করে আমাদের দিকে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ততক্ষণে সব মিলিয়ে ছ’খানা গুলি ঢুকেছে তার গায়ে। তবু তার জীবনীশক্তি একচুল কমেনি। খানিক বাদে গাছের আড়ালেই শুয়ে পড়ল সে। তারপর সামনের পা-দুটোর ওপর মাথাটা রেখে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমাদের গাছটার দিকে।
এইবার একটু একটু করে মালুম হচ্ছিল ঠিক কী বিপদে পড়েছি আমরা। যদি মোষটা তার পাহারা ছেড়ে না নড়ে অথবা যদি আমরা তাকে মারতে না পারি তাহলে ওই গাছের মাথাতেই গোটা দিনটা, চাইকি গোটা রাতটাও বসে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের মধ্যে ছাড়া পেয়েছে একলা ভিস্তি। কিন্তু তার মাহুতও তো গাছের মাথায়। তাকে চালিয়ে আনবে কে?
গুনে দেখলাম, ঠিক তিনখানা গুলি আর বাকি আছে। এতদূর থেকে এলোপাথাড়ি সে-গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র হয়ে যাবার কোনও অর্থ নেই। কাজেই নিরুপায় হয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া তখন আর কোনও গতি ছিল না আমাদের।
গাছের আরেক ডালে ঝুলে থাকা এক খোঁজারু হঠাৎ বলে, “দুপুরের রোদ উঠলে মোষটা ঠিক জল খেতে যাবে। তখন নেমে পালানো যাবে।”
শুনে চারুন মাথা নেড়ে একবার সূর্যের দিকে আর একবার নিজের পায়ের দিকে দেখাল। অর্থাৎ সূর্য ডোববার আগে মহিষাসুরের খপ্পর থেকে ছাড়া পাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই আমাদের।
সবে তখন সকালের রোদ চড়ছে। সারাদিন গাছে বসে রোদ খেয়ে তারপর মাঝরাত্রে ছাড়া পাবার কথা ভাবতেই মাথা ঝিমঝিম করছিল আমার। ঠিক করলাম, ফের একবার ব্যাটাকে কাছে আনবার মতলব করতে হবে। অতএব চারুন ফের কয়েকবার তার কাপড়টা খুলে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখল। কিন্তু কোনও ফল হল না তাতে। জন্তুটা বেশ সাবধান হয়ে গেছে পরপর ক’খানা ঘা খেয়ে। সে শুধু স্থির হয়ে বসে আমাদের দিকে নজর রাখছে তখন।
ডালে বসে বসে ততক্ষণে আমার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। একটু পা ঘুরিয়ে বসবার চেষ্টা করতে গিয়ে আরেকটা অঘটন ঘটে গেল। আমার বন্দুকটি হাত গলে সটান গাছের তলায় গিয়ে পড়ল। এবারে আর মোষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কাছে ডাকবারও কোনও অর্থ রইল না। সঙ্গে অস্ত্র বলতে তো কেবল চারুনের গাদাবন্দুক আর তার একখানা মাত্র বুলেট!
ঘণ্টা খানেক ওভাবে বসে থাকবার পর চারুন বলল, সে নেমে গিয়ে আমার বন্দুকটা তুলে আনতে যাচ্ছে। গাছে ওঠবার ব্যাপারে সে আমার চাইতে অনেক চটপটে। কাজেই আমি খুশিমনেই সম্মতি দিলাম। সে তখন গাছের যেদিকে মোষটা নজর রাখছে তার উলটোদিক দিয়ে নেমে এসে হামাগুড়ি দিয়ে বন্দুকটা তুলে নিয়েই একছুটে গাছটার কাছে এসে সে একনজর পেছন ঘুরে মোষটা যেখানে বসে আছে সেদিকে তাকাল।
আর তারপর আশ্চর্য একটা কাজ করে বসল চারুন। গাছে না উঠে সে বন্দুকটা নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে গেল মোষটার দিকে। আমি তখন গাছে বসে বসে গলা ফাটিয়ে তাকে ডাকছি আর ইষ্টনাম জপতে জপতে তার গাদাবন্দুকটাকে উঁচিয়ে ধরে রয়েছি, যদি বিপদের মুখে কোনও কাজে আসে সেই আশায়।
কিন্তু চারুন নির্বিকার। পায়ে পায়ে মোষটার একেবারে দশ ফিটের মধ্যে গিয়ে থেমে দাঁড়াল সে। তারপর আমাদের দিকে ঘুরে ইশারায় জানাল যে মোষটা মারা গেছে। গিয়ে দেখি মোষটা মরে কাঠ হয়ে গেছে। অন্তত ঘণ্টা খানেক আগে মৃত্যু হয়েছে তার। তার মানে গুলি খেয়ে এখানটায় এসে বসে পড়েই প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছিল তার।
মৃতদেহটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তার পাঁজরে একটা তির বিঁধে আছে। এইজন্যই তবে সে রাগে দশখানা হয়ে আমাদের হাতিকে তাড়া করেছিল! ক্ষেতের মালিক এক কোল বুড়ো। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই রহস্য ফাঁস হল। সে নাকি সেদিন আমরা আসবার খানিক আগেই মোষটাকে তির দিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছিল। ওই তিরের যন্ত্রণাই একেবারে পাগল করে দিয়েছিল মোষটাকে। তারপর আমাদের আসতে দেখে সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আক্রমণ শানায়।
শেষ যে-গুলিটা আমি তাকে করেছিলাম, তাইতে তার পেটে একটা বড়ো ক্ষত হয়েছে। সম্ভবত তাই দিয়ে অতিরিক্ত রক্তপাতই তার মৃত্যুর কারণ। জন্তুটা যেখানটায় বসে মরেছিল তার রক্তে ভেজা মাটিই তার প্রমাণ ছিল।
ছোটোনাগপুরের জঙ্গলে এত বড়ো বুনো মোষ আর কখনও দেখিনি আমি। ভিস্তিকে পরদিন জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। তার বিশেষ চোট-টোট লাগেনি অবশ্য। অতগুলো গুঁতো খেয়েও তার পেছনের দিকের চামড়ায় কোনও ফুটোফাটা হয়নি। সম্ভবত মোষটার শিংগুলো বেজায় বাঁকা ছিল বলে ধারালো আগার খোঁচা লাগেনি ভিস্তির গায়ে। এমন বাঁকানো শিং একমাত্র খুব বুড়ো মোষের হয়ে থাকে।
গোটা অভিযানটা থেকে কারও যদি একটুও উপকার হয়ে থাকে তাহলে সে ছিল আমাদের মাল বইবার হাতি ভিস্তি। অত কাছ থেকে মোষের গুঁতো খেয়েও বিশেষ কিছু ক্ষতি না হওয়ায় সে এবার খুব সাহসী হয়ে যায়। পরে তো শুনেছি শিকারে গিয়ে বাঘের মুখেও এক পা নড়েনি সে। শেষমেশ শিকারের হাতি হিসেবে বেজায় নামডাক হয়েছিল তার।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে