তোমারা যারা জয়ঢাকের পাঠক, তারা প্রত্যেকেই ভীষণ প্রতিভাবান তা আমি জানি। জয়ঢাকের ‘লিখিব খেলিব আঁকিব সুখে’ বিভাগে তোমাদের সুন্দর সুন্দর লেখা, আঁকা ইত্যাদি দেখলে তা দিব্যি বোঝা যায়। পড়াশোনার বাইরেও তোমরা কেউ কেউ সুন্দর ছবি আঁকো, কেউ শেখো গান, কেউ আবৃত্তি, কেউ নাচ, কেউ-বা বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাও।
কিন্তু আমি আজ একটা এমন ধরনের এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির কথা শোনাব যা ভীষণ ভীষণ মজার অথচ তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তা হচ্ছে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা বা এক্সটেম্পোর (Extempore)। তোমরা হয়তো বিভিন্ন লাইব্রেরি বা ক্লাবের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় এই তাৎক্ষণিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেখেও না বুঝে এড়িয়ে গেছ। কিন্তু বিষয়টি যদি জানতে হয়তো তড়িঘড়ি তুমিও গিয়ে সেই প্রতিযোগিতায় নাম দিতে। তাই আর দেরি না করে বলেই ফেলি বিষয়টি কীরকম।
এই প্রতিযোগিতায় বেশিরভাগ জায়গায় বেশ কয়েকটি চিরকুটের মধ্যে থেকে দুটি চিরকুট বাছতে বলে এবং সেই চিরকুটে থাকে দুটি বিষয়। যেমন ধরো, ‘লকডাউনে তুমি ও তোমার বন্ধুরা’ অথবা ‘বিদ্যাসাগরের দুশো বছর’ এবং এরকম অনেক কিছু। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে থেকে যে-কোনো একটি বেছে নিয়ে তোমাকে টানা পাঁচ মিনিট কথা বলে যেতে হবে। পাঁচ মিনিটের এক মিনিটও বেশি নয় কিন্তু, না হলেই নাম্বার ঘ্যাচাং ফুঁ।
এবার তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কথা বলতে বলতে পাঁচ মিনিট সময়ের হিসাব কী করে রাখবে। চিন্তা নেই, তার জন্যে চার মিনিট হয়ে যাবার পর বিচারকেরা একটা ওয়ার্নিং বেল দেবেন, অর্থাৎ হাতে আর এক মিনিট সময়। আর পাঁচ মিনিট হয়ে গেলে আরেকবার বেল বাজাবেন অর্থাৎ, এবার যে থামতে হবে, সময় শেষ। অনেক জায়গায় একসঙ্গে দুটি বিষয়ের বদলে একটি চিরকুট বাছতে বলে। সেটি না বললে আরেকটা। তবে পরেরটি কিন্তু বলতেই হবে, আগেরটিতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না।
আরেকটা মজার কথা হল, বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি সম্বন্ধে ভাবতে এক মিনিট সময় দিলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই ভাবনার সময় থাকে না। অর্থাৎ, চিরকুট তুলেই বলা শুরু করতে হবে। ভাবতে পারছ কতটা চ্যালেঞ্জিং!
আমি এখন কলেজে পড়লেও এই প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশগ্রহণ করি স্কুলে। সেখানে এ.বি.টি.এ-র পক্ষ থেকে প্রতিবছর আন্তঃস্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত, এখনো হয়। সেখানে ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভের জন্য খোলা থাকে এই প্রতিযোগিতা। স্কুল, পৌরসভা, জেলা—প্রতিটি স্তর থেকে নির্বাচিত প্রতিযোগীরা রাজ্যস্তরে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুলে আলাদাভাবে এই প্রতিযোগিতা হয়। তবে বিভিন্ন লাইব্রেরি বা ক্লাবে, একদম ছোটোদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকে, সেখানেও তোমরা অংশগ্রহণ করতে পার। সাধারণত এই ইভেন্টে যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিজয়ী নির্বাচিত হয় তা হল—
১) টপিক বুঝতে পারা: অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমাকে বলতে বলা হয়েছে, সেই বিষয়েই বলতে হবে। যেমন, ‘আমার রবি ঠাকুর’। এখানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তোমার কেন ভালো লাগে সেটা বলতে হবে, শুধুমাত্র তাঁর জীবনী বললে হবে না।
২) উপস্থাপন: তুমি কতটা গুছিয়ে, সুন্দরভাবে বলতে পারছ, তার উপর নাম্বার থাকে।
৩) তথ্য: তথ্যমূলক বিষয়ের ক্ষেত্রে, যেমন ‘বাংলা সিনেমার ১০০ বছর’, সেখানে প্রথম বাংলা সিনেমা কবে মুক্তি পায়, প্রথম বাংলা নির্বাক অথবা সবাক সিনেমা কোনটি, তা বলতে পারলে ভালো হয়।
৪) টপিক ঘোরানো: এটা খুব মজার। তুমি একটাই বিষয়কে কতরকমভাবে বলতে পারছ তার উপর নাম্বার থাকে। যেমন ধরো তোমাকে বিষয় দেওয়া হল, ’ফ্যান’, তাহলে তোমাকে ভাতের ফ্যান, সিলিং ফ্যানের উপকারিতা আবার তুমি কার ফ্যান অর্থাৎ কার ভক্ত, তিনটেই বলতে হবে।
কী মজার মনে হচ্ছে তো? তোমারা যখন খুব বড়ো হয়ে যাবে তখনো এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। এখন প্রশ্ন হল, এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু কি আনন্দই পাওয়া যায়? মোটেই না! যে-কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দটাই, মজা পাওয়াটাই আসল হলেও কিছু পরোক্ষ উপকারও থাকে। যেমন এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তোমাদের জড়তা কেটে যাবে, তোমরা সুবক্তা হয়ে উঠবে—ভবিষ্যতে এই গুণ তোমাদের অনেক কাজে আসবে। তুমি যেমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলবে তেমন অন্যরাও আলাদা আলাদা টপিকে বক্তব্য পেশ করবেন, ফলে তোমরা বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারবে। যেহেতু এই প্রতিযোগিতায় সাহিত্য, ইতিহাস, খেলাধুলা, সাম্প্রতিক সময়ের উপর বিভিন্ন টপিক থাকে, তাই এইসব বিষয়ে তোমরা ক্রমে পারদর্শী হয়ে উঠবে। দেখবে পাঠ্য বইয়ের বাইরেও বিভিন্ন তথ্য জানতে কী ভালো লাগে। সুবক্তা হয়ে ওঠার কারণে তোমরা নিজেরা যেমন পড়াশোনা ভালো করে বুঝতে পারবে তেমন কোনো বন্ধুকেও সুন্দর করে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারবে। যারা একটু লাজুক, তারা তাৎক্ষণিক বক্তৃতা করলে দেখবে আর সকলের সামনে কথা বলতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
তাহলে স্কুলে বন্ধুরা মিলেও তো খেলা যায়, তাই না? বন্ধুদের মধ্যে থেকে দুজন বিচারক হও। তারা বাকিদের বিষয় দিক এবং তারা সেই বিষয়ে বলা প্র্যাকটিস করুক। যেমন, প্রিয় গোয়েন্দা, গঙ্গা দূষণ, শীতের বইমেলা, বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ, ইলিশ ভাজা, দুর্গাপূজায় কলকাতা, মাঠের খেলা বনাম মোবাইল গেম ইত্যাদি।
তবে এত কিছুর পরেও একটা দুঃখের কথা আছে। তাৎক্ষণিক বক্তৃতা শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা নয়, একটা শিল্প। কিন্তু কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াতে গিয়ে মানুষের হাতে সময় কমে যাচ্ছে। ফলে এইসব প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে শুধুমাত্র প্রতিযোগীর অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আশা করি তোমরা তা আর হতে দেবে না। তাহলে আর দেরি কীসের? এবার থেকে স্কুলে এরকম কোনো প্রতিযোগিতা হলেই ছুট্টে গিয়ে নাম দিও কিন্তু।
দারুণ লিখেছ অর্ণব!
LikeLike