নিবন্ধ-সুকুমার রায় : শাণিত তরবারি একুশে আইন-কৌশিক দাস-শরৎ ২০২১

আগের নিবন্ধ~এক্সটেম্পোরের অ-আ-ক-খ-অর্ণব ভট্টাচার্য্য

nibondho01

পড়তে বসেছি। ভর সন্ধেবেলায়। আসলে আমি পড়াতে বসেছি বললেই ঠিক বলা হয়। সেটা আবার গটাই শুনতে বিশেষ পছন্দ করে না। কারণ, গটাইয়ের বাবা আমি যে পড়াতে পারি এমন বিশ্বাস গটাইয়ের কোনোকালে ছিল না। এমন কোনও অবিশ্বাস্য ঘটনার সম্ভাবনা যে পৃথিবীতে আছে সেটা আমিও ভাবিনি। গতবছর লকডাউন শুরুর সময় থেকে বিপদ হল। গটাইদের স্কুল বন্ধ। আমার অফিসও। কী আর করা? বাবা-মেয়ে খাটে শুয়ে গল্পের বইটই পড়ে বেশ কাটিয়ে দেব ভাবছিলাম। বিপদ ঘনাল গটাইয়ের স্কুল শুরু হবার পর। এ পর্যন্ত যেসব বিষয় নিয়ে আমাকে ভাবতে হত না, তার মধ্যে একটা ছিল গটাইয়ের পড়া বোঝানো। এখন সব বই দেখেশুনে ওদের মস্ত ভারী সিলেবাসের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে পছন্দ হল বাংলা আর ইংরেজি পাঠ্য বই। বেশ গল্পের বই পড়ার মতো পড়ে ফেলা যায় ব্যাপারটা। ঝামেলা কিছু নেই। ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞান পড়া হল পুরোটাই ঝামেলার। বোঝাটাই প্রথম ঝামেলা, তারপর তো আরও হাজার একটা ব্যাপার আছে প্রশ্ন-উত্তর লেখা জাতীয়। যাহোক করে অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গটাই ক্লাসটা পেরিয়ে গেল।

এই বছরেও পরম উৎসাহে আমি আর গটাই ‘নতুন বই হাতে নিয়ে দেখার কাজ’-টা সেরে নিয়েছিলাম বই আসার পরেই। ইংরেজি আর বাংলা বই খুলে গল্প-কবিতা সব পড়াও চলছিল মহা আনন্দে। কিন্তু মা সরস্বতী যে আমার ফাঁকিবাজিটা পছন্দ করছেন না সেটা বুঝলাম অল্প সময়ের মধ্যেই। গটাইদের অ্যাসেসমেন্ট ওয়ানের সিলেবাসে এবার আছে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পালামৌ’ থেকে একটু অংশ আর সুকুমার রায়ের লেখা ‘একুশে আইন’ ছড়াটা। তোমরা কি ‘একুশে আইন’ পড়েছ? না পড়ে থাকলে পড়ে ফেলো আর পড়া থাকলে আরেকবার পড়ে ফেলো এখানে—

একুশে আইন
সুকুমার রায়

শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দন্ড তার॥

সেথায় সন্ধে ছ’টার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচ্‌লে পরে বিন্‌টিকিটে—
দম্‌দমাদম্‌ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে—
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে॥

কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,
চারটি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাক্সো চায়—
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠোকায় একুশ বার॥

চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক-ওদিক ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
একুশ হাতা জল গেলায়॥

যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে,
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা—
হিসেব কষায় একুশ পাতা॥

হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে,
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে
একুশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে॥

এই ছড়াটা পড়া শেষ করার পরেই সরস্বতীর অভিশাপ ধেয়ে এল আমার দিকে। গটাইয়ের মুখ দিয়ে। “আচ্ছা বাবা, এই কবিতাটার নাম একুশে আইন কেন? বাইশে আইন বা পঁচিশে আইনও তো হতে পারত।”

আমি ক্লিন বোল্ড। নিজে নিদেনপক্ষে একুশ বার পড়া একটা ছড়া যে এরকমভাবে বিপদে ফেলতে পারে ভাবিনি কোনোদিন।

গটাইকে বললাম, “দ্যাখ, দুরকম পড়ার ব্যাপার আছে এখানে। একটা পরীক্ষার জন্যে, আরেকটা নিজের জন্যে। এখন পরীক্ষার পড়াটা পড়ে নিই চল, নইলে মা দুজনকেই না পড়ার জন্যে ধমকাবে। মানে তুই আর আমি তো এখন একই ক্লাসে পড়ি, বল?”

শুনে গটাই হেসেই খুন। তবে আমরা তো ভালো স্টুডেন্ট, তাই পরীক্ষার পড়াটা তখনই পড়ে ফেললাম। মানে এই ছড়াটা পড়তে গিয়ে তো হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা হচ্ছিল আমাদের। কিন্তু তার মধ্যেও আমরা খেয়াল করছিলাম পিছলে পড়াই হোক, সন্ধে ছ’টার আগে হাঁচাই হোক, দাঁত নড়াই হোক বা নাক ডাকা—সব অপরাধের শাস্তির মধ্যে ‘একুশ’ ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে। একুশ সংখ্যাটা বেশ ভালো অবশ্য। ভাঙলে দুটো মৌলিক উৎপাদক পাওয়া যায়। কিন্তু সে তো পনেরো ভাঙলেও পাই। তখন আমি গটাইকে বললাম, “বুঝলি গটা! এখানে একুশের মধ্যে একটা বেশ রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের মতো গন্ধ পাচ্ছি। একটু ইতিহাস পড়া যাক, বুঝলি!”

সে-বেটি কোথায় ইতিহাস শুনে পড়তে বসবে তা নয়, সটান বলে দিল, “আমার স্কুলের পড়া আছে বাবা, তাই তুমিই পড়ে নাও আর আমাকে বরং গল্পটা শুনিয়ে দিও।”

সেই গল্পটাই তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই।

‘একুশে আইন’ ছড়াটা লিখেছেন সুকুমার রায়। তাঁর নাম শুনলেই তোমরা আমাকে গড়গড়িয়ে বলে যাবে পরপর অনেকগুলো ছড়ার কথা, ‘বাবুরাম সাপুড়ে’, ‘বোম্বাগড়ের রাজা’, ‘খিচুড়ি’, ‘কাঠবুড়ো’ আর তারপর আসবে ‘পাগলা দাশু’-র কথা, দাশুর খ্যাপামির গল্প। এসো, আমরা সুকুমার রায়ের পরিচয়টা একটু জেনে নিই প্রথমে।

সুকুমার রায় (৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩)-এর বাবা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তোমরা তো টুনটুনির গল্প পড়েছ বা  বোকা জোলার গল্প। এই চরিত্রগুলো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অমর সৃষ্টি। আবার ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটা দেখেছ তো? তার মূল গল্পটার লেখক হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর পরিচালক হলেন সুকুমার-পুত্র সত্যজিৎ রায় (ফেলুদা, প্রোফেসর শঙ্কু আর তারিণীখুড়োর স্রষ্টা লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়)। সুকুমার রায়ের মা হলেন বিধুমুখী দেবী, নারীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী সমাজ সংস্কারক ও ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ে। সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালির নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। প্রথমে সিটি কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশুনো, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ (প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় হল অনেক পরে, ২০১০ সালে) থেকে পদার্থবিদ্যা বা ফিজিক্স ও রসায়ন বা কেমিস্ট্রি এই দুই বিষয়ে অনার্স নিয়ে তিনি গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন ১৯০৭ সালে। ১৯১১ সালে সুকুমার লন্ডনে গেছেন ফোটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়তে, ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে। এই স্কলারশিপ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের ক্ষেত্রে দেওয়া হত কৃষি বা প্রযুক্তি বিজ্ঞানে। উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে গেলে পাওয়া যেত হাজার টাকা আর ইউরোপ বা আমেরিকায় গেলে পাওয়া যেত দু-হাজার টাকা। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই স্কলারশিপ পেয়েছিলেন দু’জন – শ্রী সমরেন্দ্রনাথ মৌলিক (পতঙ্গবিদ, পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন) ও শ্রী সুকুমার রায় (চৌধুরী)।

সুকুমার পড়তে গিয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজিতে। সেখানে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আবিষ্কার করা প্রিন্টিংয়ের হাফটোন পদ্ধতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রমাণ করে  লন্ডনের রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির ফেলো হয়ে দেশে ফিরলেন ১৯১৩-তে। ফিরে এসে সদ্য প্রকাশিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লেখা শুরু করেছেন আর তারপর ১৯১৫ সালে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পরে ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি। সঙ্গে লেখালেখিও চলেছে পুরোদমে। তিনি চেনা-অচেনা জীবজন্তু নিয়ে যে-সমস্ত লেখা লিখেছেন (কিছু তাঁর জীবৎকালে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত, কিছু পরে প্রকাশিত) তার সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও কল্পকাহিনিমূলক সাহিত্য চর্চার অগ্রদূত জগদানন্দ রায়ের রচনা। এহেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তাঁর কোনও লেখার নামকরণ যে হঠাৎ বা অকারণে যুক্তিহীনভাবে করতে পারেন না এটা ধরে নিয়েই এগোতে শুরু করি আমরা।

বাংলা সন ১৩২৯ (ইংরাজি ১৯২২ সাল)-এর  ভাদ্র সংখ্যার ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় ‘একুশে আইন’ ছড়াটি। পরে তা সংকলিত হয় ‘আবোল তাবোল’ বইটিতে। ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৩। প্রকাশক ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স, ১০০ গড়পার রোড, কলিকাতা। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সুকুমারের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে প্রামাণ্য বই ‘সুকুমার সাহিত্য সমগ্র’ (তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ। প্রথম খণ্ড প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫ সালে। তৃতীয় খণ্ড সংকলিত ও প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে – জন্ম শতবার্ষিকী সংস্করণ হিসাবে।) থেকে জানতে পারছি ‘আবোল তাবোল’-এর ভূমিকায় সুকুমার লিখেছেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ-পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’ বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা খেয়াল রসের কথা তার আগে শোনেননি। পরেও আর কেউ এরকমভাবে একখানা গোটা খেয়াল রসের বই লিখেছেন বলে জানা নেই।

এই খেয়াল রসের ব্যাপারটা এসে পড়েছে যখন, এই ব্যাপারটা একটু খোলসা করে নেওয়া যাক। সুকুমার ভারতীয় শাস্ত্রের নবরসের বাইরে গিয়ে খেয়াল রসের কথা বললেও ইউরোপীয়রা এইরকম ছড়াকে বলেন ‘ননসেন্স ভার্স’ বা ‘ননসেন্স পদ্য’। আমরা একে কিম্ভূত ছড়াও বলতে পারি। এইধরনের ছড়া সাধারণত কৌতুক পরিবেশনের জন্য লেখা হয়। এতে বলিষ্ঠ পদ্যের উপাদান হিসেবে ছন্দ ও অন্ত্যমিল থাকে, কিন্তু যা থাকে না তা হল সোজাসাপটা মানে। কীরকম বলো তো? ধরা যাক, লুই ক্যারলের ‘Jabberwocky’ আর তা অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘জবরখাকি’ ছড়াটার কথা। লুই ক্যারলের লেখাটা পাবে ‘Through the Looking-Glass, and What Alice Found There’ বইটাতে আর সত্যজিৎ রায়ের ‘জবরখাকি’ পেয়ে যাবে ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ বইতে। দুটো লেখার শুরুটা ছিল এরকম—

nibondho02

Jabberwocky

’Twas brillig, and the slithy toves
     Did gyre and gimble in the wabe:
All mimsy were the borogoves,
     And the mome raths outgrabe.
– Lewis Carroll

জবরখাকি

বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউ-এর ধারে
আর যত সব মিমসে বোরোগোবে
মোমতারাদের গেবগেবিয়ে মারে।
– সত্যজিৎ রায়

আপাতভাবে এর অর্থ বা এর থেকে কোনও গল্প খুঁজে বের করা অসম্ভব। পুরো কবিতাগুলো ইন্টারনেটেও আছে, দেখে নিতে পারো। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ সিনেমায় রাজামশাই আর মনোজের কোড কবিতাটা পুরোটা মনে পড়লেও অর্থহীনতার অর্থ বুঝতে পারবে। তোমরা বলতেই পারো তাহলে আমাদের বাংলা ছড়াও তো এইরকম আপাত অর্থহীন। একটা উদাহরণ দিই।

আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি,
যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি।
রেল কম, ঝমাঝম,
পা পিছলে আলুর দম।

সবাই পড়েছি ছোটবেলায়। প্রথম শেখা ছড়াগুলোর মধ্যে এটা একটা। বড়ো হয়ে জানলাম, এই ছড়ার পেছনে আছে এক গল্প। সিপাহি বিদ্রোহের একবছর পর ১৮৫৮ সালের ১৫ অগস্ট, বাংলায় প্রথম ট্রেন চলেছিল ঝমাঝম শব্দ করে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত। সেকালে হুগলি স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ওরফে যগু মাস্টার। অপভ্রংশে তা হয়ে যায় যদু মাস্টার। এই যদু মাস্টারকে নিয়েই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায় এই ছড়া। এই বাংলা ছড়াগুলোকেও ননসেন্স ভার্স ভাবতে পারতাম, তবে আটকা পড়ছি অন্য জায়গায়। হয় গল্প থাকা আর না হলে সরাসরি মানে থাকা। আমাদের দেশীয় ছড়া পড়লে গল্প বা ছবি কল্পনা করা যায় যেটা ননসেন্স ভার্সে হবে না।

গটাইকে পরের দিন বললাম, “আইন কাকে বলে জানিস?”

উত্তর পেলাম, “সরকারের তৈরি করা প্রোটোকল যেগুলো আমাদের মেনে চলতে হয়।”

“আমাদের মানে?”

“দেশের লোকদের।”

তোমরাও কি তাই বলছ? আমি প্রায় সেরকমই একটা সংজ্ঞা পেলাম ব্ল্যাকের অভিধান থেকে। হেনরি ক্যাম্পবেল ব্ল্যাক ১৮৯১ সালে প্রথম লেখেন একটি আইনের অভিধান যেখানে বলা হচ্ছে – আইন হল দেশের নাগরিকদের সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য তৈরি নিয়ম-কানুন যা প্রতিটি নাগরিকের অনুসরণ ও পালন করা অবশ্যকর্তব্য। সেখানে আরও বলা হচ্ছে, দেশের শান্তি বজায় রাখতে, দেশের সবাই যাতে প্রাপ্য সব সুবিধা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে আইনকে দরকার যা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে যে-কোনো দেশের সর্বত্র সমান আইন বলবত হবে। সেটা নিশ্চিত করতে হলে সবার মতামত মেনে আইন তৈরি করে, লিখে, বই হিসেবে ছেপে বের করা দরকার আর দরকার সেই বইটির সরকারি স্বীকৃতি। আমাদের দেশেরও এমন একখানা বই আছে যার নাম ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা ভারতীয় দণ্ডবিধি। একে ‘ভারতীয় দণ্ড সংহিতা’-ও বলা হয়ে থাকে।

ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রথম সংকলিত হয়ে আসে ১৮৬০ সালে। তোমরা যারা ভারতের ইতিহাস পড়ছ বা পড়েছ, তাদের অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা জানো। ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডে তৈরি হওয়া এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভারতে পা রাখে ১৬১২ সালে। এরপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলার শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয় তারা এক শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে যার বিভিন্ন পদাধিকারীদের মধ্যে প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন গভর্নর জেনারেল। ১৮৩৩ সালে এক নতুন সনদের মাধ্যমে বাংলার গভর্নর জেনারেলকে ভারতের গভর্নর জেনারেল আর তাঁর অধীনে একটি সরকার তৈরি করে দিয়ে ভারতের শাসক হয়ে ওঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই নতুন তৈরি সরকারের নাম হল ভারত সরকার। গভর্নর জেনারেলের অধীনে ‘আইন পরিষদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দেওয়া হয়। আজকের লোকসভা ও রাজ্যসভার মতোই সেদিন ভারতবর্ষের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল আইন পরিষদের হাতে। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকারকে ভারতের দায়িত্বভার অর্পণের আগেই ১৮৩৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন ভারতে তৈরি হয়েছিল প্রথম ভারতীয় আইন কমিশন যার সভাপতি ছিলেন ইংরেজ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ টমাস ব্যাবিংটন মেকলে – লর্ড মেকলে। এই আইন কমিশন ১৮৩৭ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রথম খসড়া তৈরি করেন। বার বার পরিবর্তিত হবার পরে ১৮৫৬ সালে তা গৃহীত হয় ও ১৮৬০ সালের ৬ই অক্টোবর প্রথম ‘ভারতীয় আইন সংহিতা’ আইন পরিষদে পাশ হয়ে যায়। আজও পর্যন্ত ভারতে যে আইনের শাসন বলবত আছে তার মূলে আছে এই আইন সংহিতাই। তবে আইনের বিভিন্ন ধারার পরিবর্জন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন আমাদের দেশেও চালু আছে অন্যান্য দেশের মতোই।

সুকুমার রায় তাঁর ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়াগুলো শিশুদের জন্য লিখলেও ছড়াগুলো এতটাই প্রাণবন্ত যে সে-সব ছড়া বড়োদেরও মুখে মুখে ঘোরে। এই ছড়াগুলো যেমন বড়োদের না পড়ার মতো হালকা চালের নয়, তেমনই ছোটোদের না বোঝার মতো ভারিক্কিও নয়। আগেই বলেছি ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৩-এ এবং তাতেই সংকলিত ছিল ‘একুশে আইন’ ছড়াটি। ছড়াটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২২ সালের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়।

‘একুশে আইন’ এই শব্দবন্ধটি যে বহুকাল ধরে চলে আসছে এমনও নয়। বরং এই ছড়াটি প্রকাশের আগে শব্দবন্ধটির ব্যবহার সম্ভবত হয়নি। অথচ সুকুমার রায় এই ছড়াটির নাম দিলেন ‘একুশে আইন’। কেন? কারণ, এই মজার ছড়াটি কেবল অদ্ভুতুড়েই নয়, প্রতীকীও। ছড়াটি বুঝে পড়লে ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশ’ আর কবির কল্পনার দেশ হয়ে থাকে না। তার ভৌগোলিক অবস্থানটি আমাদের চোখে ধরা পড়ে যায়। আমরা জলজ্যান্ত একটি দেশের ঠিকানা এই ছড়া থেকে পেয়ে যাই যেখানে পিছলে পড়া, হাঁচা, দাঁত নড়া, গোঁফ গজানো, এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়ে তাকানো, পদ্য লেখা, নাক ডাকা ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজা আছে। এমন দেশে আইন মেনে চলা নিরীহ নাগরিক সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন পাছে গুরু দণ্ডবিধান করা আছে অথচ আদতে লঘু কোনও অপরাধে তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হয়। সেইদিক দিয়ে দেখলে এই ছড়াটি যেন ইংরেজদের অধীন ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থার এক ছবি তুলে ধরে আমাদের সামনে। কীরকম ছিল সে ব্যবস্থা? দু-একটা উদাহরণ দিই।

(১) বাংলার জমিদাররা ছিলেন ইংরেজদের অধীন। তাই তাঁদের প্রতিবছর খাজনা বা কর (Tax) জমা দিতে হত। এই খাজনা জমার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল, নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে খাজনা জমা দিতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে খাজনা জমা করতে না পারলে জমিদার তাঁর জমিদারি হারাবেন। এ আইনের নাম ছিল ‘সূর্যাস্ত আইন’। এ অবশ্য আইন সংহিতা তৈরির আগের ঘটনা। তবে এও এক ‘একুশে আইন’।

(২) আজকের রাসায়নিক নীল (রবিন ব্লু, উজালা এইসব) আসার আগে সাদা জামা কাপড়ের রং ফেরাতে ব্যবহার করা হত ভেষজ নীল। ভারতের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশ নীল ব্যবসায়ীরা (এদের বলা হত নীলকর) স্থানীয় চাষিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে নীল চাষ করাত। প্রথমদিকে নীল চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক থাকলেও পরে লাভ কমে যাওয়ায় কৃষকরা ফিরে ধান, পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেজন্য নীলকররা চাষিদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে ইংরেজ সরকার নীলদেরই পক্ষ নেয়। চাষিদের সমর্থকদের (তাঁরা ইউরোপিয়ান হলেও) ওপরে সরকার পুলিশি অত্যাচার চালাতে শুরু করেন। এই ঘটনা কিন্তু আইন সংহিতা প্রণয়নের পরে ঘটেছে। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই ‘নীল ঘূর্ণি’ পড়লে এই অত্যাচারের কাহিনি জানতে পারবে তোমরা।

আসলে ‘একুশে আইন’ ছড়াটির মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার এবং তার আইন আর শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেছেন সুকুমার। যে-কোনো শাসনব্যবস্থা তার অধীন নাগরিকদের কাছে দাবি করে আনুগত্য। অনুগতদের জন্য থাকে বরাভয় আর তার উলটো পিঠে শাস্তি বা নির্যাতনের হুমকি থাকে ভয়ের উপাদান হিসেবে। আনুগত্যে গড়বড় হলেই ভয় আর অভয়ের এই ভারসাম্যটা ভেঙে যায়। শাসকের দাঁত-নখ বেরিয়ে আসে শেষপর্যন্ত। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল। ১৯২২ সালে তাঁর নিজেরই সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’-র শারদীয় সংখ্যায় লিখেছিলেন কবিতাটি। পড়ে দেখো।

আনন্দময়ীর আগমনে

কাজী নজরুল ইসলাম

আর কতকাল থাকবি বেটী
মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে
অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক,
বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,
আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ
অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ
নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর,
অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ,
রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী
তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র
কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস,
রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি
আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে
ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের
রক্ত মাগে দশভুজা।
‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে
আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর
মা দুলালী কন্যা অয়ি!

এই আদ্যন্ত রাজনৈতিক কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার অপরাধে প্রথমেই ৮ই নভেম্বর ১৯২২ তারিখে পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। এরপর ২৩শে নভেম্বর কাজী নজরুল ইসলামকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি কবি বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যের আকাশে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ হিসাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই জবানবন্দিতে নজরুল বলেছেন: ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…’।

ভবিষ্যতে এমন ঘটার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই রাজদ্রোহিতার অপরাধকে আইন মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তকমা দিয়েছিল লর্ড মেকলের নেতৃত্বাধীন প্রথম ভারতীয় আইন কমিশন। ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত ভারতীয় দণ্ড সংহিতার খসড়া প্রস্তাবে প্রথমে ১১৩ ধারা হিসাবে নিয়ে আসা হয়েছিল রাজদ্রোহিতার অপরাধকে। যদিও ১৮৬০ সালে সংহিতা প্রকাশের সময় ১১৩ ধারা অনুপস্থিত ছিল। ১৮৭০ সালে ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ জেগে ওঠার আঁচ পেয়ে ভারতীয় দণ্ড সংহিতার সংশোধনী প্রস্তাবে পুরোনো ১১৩ ধারা আসে নতুন ১২৪-এ ধারা হিসেবে। নজরুলকে ১৯২২ সালে জেলে ভরা হয়েছিল ওই ধারায় – রাজদ্রোহের অপরাধে, প্রতিবাদী কবিতা লেখার অপরাধে, মুখ খোলার অপরাধে, ‘ধূমকেতু’ সম্পাদনার অপরাধে। ১২৪-এ ধারা আর রদ হয়নি কখনও।

তবে রদ হয়েছিল অন্য নানা আইন। ১৮৭৮ সালে ইংরেজ শাসকেরা দেশীয় সংবাদপত্র আইন বা ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট জারি করেন। এই আইনবলে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মুদ্রকদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিতে পারতেন যে তাঁরা রাজদ্রোহ বা উস্কানিমূলক কিছু ছাপবেন না। এই জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখা, প্রেস বন্ধ করে দেওয়া বা প্রেসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকারও দেওয়া হয়। তবে চাপের মুখে পড়ে ১৮৮২ সালে এই আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

১৯০৮ সালের সংবাদপত্র আইন [The Newspapers (Incitement of Offences) Act] বলে, ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ছিল হিংসায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে প্রেস ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। অবশ্য এই আইন বলে প্রেস বন্ধ হলে ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করার অনুমতিও ছিল।

১৯১০ সালের ভারতীয় প্রেস আইনে (The Indian Press Act) স্থানীয় সরকারগুলিকে প্রেসের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা ও অনধিক ২০০০ টাকা জমা রাখার অধিকার দেওয়া হয়। এই আইনে ছিল, কোনও প্রেস আপত্তিকর কিছু ছাপলে ওই টাকা বাজেয়াপ্ত করা যাবে। নতুন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জমা রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল এই আইনে। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার দু-মাসের মধ্যে হাইকোর্টের বিশেষ ট্রাইবুনালের কাছে আপিল জানানোর অধিকারও দেওয়া হয়েছিল একই সঙ্গে।

১৯২১ সালে ইংরেজ সরকার স্যার তেজবাহাদুর সপ্রুর নেতৃত্বে প্রেস আইনগুলির কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ১৯০৮ ও ১৯১০ সালের আইন দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

১৯১৫ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার চরম বিব্রত ছিলেন বাংলায় রডা কোম্পানির হাত থেকে যুগান্তর দলের হাতে অস্ত্র এসে পড়া আর পাঞ্জাবের গদর পার্টির উত্থান নিয়ে। সঙ্গে মহারাষ্ট্রেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার জন্য লড়াই। তাই সেই সময়ে ইংরেজ সরকারের একটি দমনমূলক আইনি হাতিয়ার দরকার হয়ে পড়েছিল। সেইজন্যে স্যার রেজিনাল্ড ক্র্যাডক ভারতরক্ষা আইন ১৯১৫ (Defence of India Act of 1915) প্রস্তাব করার পর একটিমাত্র অধিবেশনে তা গৃহীত হয়। যদিও এটি ছিল আপতকালীন অস্থায়ী আইন যার মেয়াদ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছ’মাস পর পর্যন্ত। অন্যসব দমনমূলক আইনের মতো ১৯১৫ সালের ভারতরক্ষা আইনেও জনস্বার্থ রক্ষার কথাই বলা হয়েছিল। আর ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়াকে রক্ষার কথা। সেজন্য যে-কোনো বন্দিকে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখা, বিশেষভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা বা বিচারের জন্য উপস্থাপন না করা এইসব ব্যবস্থাই ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতরক্ষা আইন ১৯১৫ বাতিল হয়ে গেলে ব্রিটিশ সরকার দমন পীড়নের মাধ্যমে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করতে এবং আরও তীব্র হয়ে ওঠা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হন। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯১৭ সালে বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সিডিশন কমিশন গঠন করেন। ভারতীয়দের হিংসাত্মক আন্দোলন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে কমিশনের করা সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ১৯১৯ সালের ১৮ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার এক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এবং দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেন। এই আইন সাধারণভাবে কুখ্যাত হয় রাওলাট আইন নামে, যদিও এই আইনের পুরো নাম ছিল The Anarchical and Revolutionary Crimes Act of 1919। এই আইনে (১) সরকার বিরোধী যে-কোনো প্রচারকার্যকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, (২) কোনোরকম সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই যে-কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় ও বিনা বিচারে গ্রেফতার করার, যতদিন খুশি আটক রাখার অবাধ ক্ষমতা ও ঘরবাড়ি তল্লাশির অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছিল, (৩) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল এবং (৪) সরকার সাধারণ আইনের প্রয়োগ স্থগিত রেখে জনসাধারণকে চরম পুলিশি ও প্রশাসনিক অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছিল এই আইনে।

১৩ এপ্রিল ১৯১৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এই আইনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে একটি চারদিকে ঘেরা বাগানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বলে চিহ্নিত করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন, গান্ধীজি সত্যাগ্রহের হুমকি দেন। আর ১৬৫০ রাউন্ড গুলিতে নিহতের সংখ্যা তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের বলা সংখ্যা ৪০০-ই হোক বা স্বামী শ্রদ্ধানন্দের বলা ১৫০০, এই হত্যাকাণ্ডের দায় এসে পড়ে ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের ঘাড়ে। তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু এত প্রাণহানির পরে রাওলাট আইনের কী হল?

২০০৬ সালে প্রকাশ পেয়েছে জন রিডিকের বই The history of British India: a chronology। সেখানে বলা আছে ‘Accepting the report of the Repressive Laws Committee, the British colonial government repealed the Rowlatt Act, the Press Act, and twenty-two other laws in March 1922.’।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, দূর্বা ঘোষ তাঁর লেখা Gentlemanly Terrorists-Political Violence and the Colonial State in India : 1919–1947 বইতে কিন্তু লিখছেন, ‘Ultimately, the legislation recommended by the Rowlatt report was never enforced on a national level and the legislation was repealed quietly in September 1921’।

এই দ্বিতীয় মত মেনে নিলে ১৯২১ সালে রাওলাট আইন রদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আইনি পদ্ধতিতে রদ পরের বছরে হলেও সুকুমারের মতো সমাজ সচেতন মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল না এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারা। অর্থাৎ মোট বাইশটি আইন ১৯২২ সালে বাতিল করা হলেও অন্তত তিনটি দমনমূলক আইনের বাতিল প্রক্রিয়া হয় শুরু হয়েছিল বা আইনগুলি বাতিল হয়েছিল ১৯২১ সালে। সেইজন্যেই কি সুকুমারের কলমে জন্মেছিল ননসেন্স ভার্স ‘একুশে আইন’ যা পরের বছর প্রকাশ পায়? সেই সময়ে শুধুমাত্র সুকুমার রায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল ওই তিনটি আইনের অতি সক্রিয়তার প্রসঙ্গকে ননসেন্স ভার্সের মোড়কে ভরে পরিবেশন করা। তিনি সেটাই করেছেন। এমনভাবে করেছেন যে একই সময়ে সরাসরি সরকারের সমালোচনা করা কবি নজরুলকে পুলিশ ধরলেও সুকুমারের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা হয়নি তাদের। কারণ তিনি ‘ননসেন্স ছড়াকার’। তিনি এমন ছড়া লেখেন যার বিষে জর্জরিত হলেও ছড়াকারকে ধরা যাবে না। অথচ রচনার প্রায় একশো বছর পরেও সেই ‘ননসেন্স ছড়া’ পড়তে গিয়ে তাঁর দেওয়া নাম আজকের কিশোরীর মাথায় এনে দিয়েছে প্রশ্ন, ‘একুশে আইন’ কেন? বাইশে বা পঁচিশেও তো হতে পারত। আর সে-যুগের সেরা বিজ্ঞানের ছাত্র, একই বছরে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে স্নাতক, গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলার সুকুমার রায় যে অযৌক্তিক কারণে এই নামকরণ করার মতো মানুষ ছিলেন না সেটা এই আলোচনার পরে আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।

***

গটাই ঘুমিয়ে পড়েছে গপ্পো শুনে। মনে হয় স্বপ্ন দেখছে, খাঁচায় বন্দি করার চেষ্টা করা হচ্ছে একজন মানুষকে। তাঁর পেছনে ছুটে পল্টনেরা ঘেমে উঠেছে। তাদের একুশ হাতা জল গেলানোর চেষ্টা করছেন ইংরেজ প্রভু। একদল লোক মুদির খাতা নিয়ে ছুটছে পেছন পেছন। সামনের মানুষটার হাতে তলোয়ারের মতো করে ধরা আছে কলম। গোল গোল চশমার আাড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। শানিত তলোয়ারের মতো ওই কলমটির সামনে পড়ে কচুকাটা হচ্ছে খাঁচার বাঁধন। ‘আবোল তাবোল’ পড়া শেষে তাই আমরা বলতে বাধ্য হই – ‘কথার ওপর, কথার টেক্কা/ কথাই টানছে, কথার এক্কা/ কথাই সওয়ার কথার ঘোড়ায়/ কথার ছন্দ, পদ্য ছোটায়/ আমাকে ভাবায়, সুকুমার রায়/ আমাকে ভাবায়’ (কবীর সুমন)।

1 thought on “নিবন্ধ-সুকুমার রায় : শাণিত তরবারি একুশে আইন-কৌশিক দাস-শরৎ ২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s