বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-বিচিত্র জীবজগৎ-গিরগিটির ভোলবদল-যূথিকা আচার্য্য-শরৎ ২০২১

বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে

biggangirgiti01

গিরগিটিদের আরেক নাম বহুরূপী, তা তোমরা নিশ্চয় জানো। এমন নামের কারণ এই যে, কিছু প্রজাতির গিরগিটি ইচ্ছেমতো তাদের শরীরের রং বদলে ফেলতে পারে এবং শুধু গিরগিটিই নয়, সরীসৃপ কুলতিলক ক্যামেলিয়ন, অক্টোপাস, স্কুইড, কয়েক প্রজাতির ব্যাঙ ও মাছেদের মধ্যেও এই অদ্ভুত ক্ষমতা দেখা যায়।

এই রং-বদলের ব্যাপারখানা কিন্তু ভারি মজার। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে ভোল-বদলের মূল কারণ হল আত্মরক্ষা। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে শিকারি প্রাণীর দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করা, এককথায় যাকে বলে ক্যামোফ্লাজ; কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠল যে আত্মরক্ষাই যদি বর্ণ পরিবর্তনের মূল কারণ হবে তাহলে মাত্র কিছু শ্রেণির গিরগিটি বা ক্যামেলিয়নদের মধ্যেই এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে রইল কেন? আত্মরক্ষার প্রয়োজন তো সবার রয়েছে। ইভোলিউশন বা অভিযোজনের নিয়ম অনুযায়ী তো তাহলে বেশিরভাগ সরীসৃপের মধ্যেই এই ক্ষমতা তৈরি হওয়া উচিত। বিজ্ঞানীরা আবার ভাবতে শুরু করলেন।

পরবর্তীকালে গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল যে ক্যামোফ্লাজ নয়‍, বরং রং-বদলের পেছনে প্রধান কারণগুলি একদম অন্যরকম।

প্রথম কারণ হল পারস্পরিক যোগাযোগ। পরীক্ষা করে দেখা গেল যে গিরগিটি বা ক্যামেলিয়নের কাছাকাছি তাদের স্বগোত্রীয় অন্য কোনও সরীসৃপ থাকলে ভোল-বদলের ভেলকিখানা হয় রীতিমতো জবরদস্ত। তখন ত্বকের রং দেখে তাদের মেজাজ-মর্জি এবং তারা কী বলতে চাইছে তা দিব্যি বোঝা যায়। যেমন দেখো, পুরুষ প্রাণীর কাছাকাছি অন্য পুরুষ সরীসৃপ এলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য দুজনেরই গায়ের রঙ নিমেষে বদলে যায়। নেহাত বেচারারা কথা বলতে পারে না, বললে নিশ্চয় তখন ‘অলরাইট, কামেন ফাইট! কামেন ফাইট!’ গোছের কিছু একটা শোনা যেত।

আবার বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীদের মধ্যে রঙের খেলা হয় অন্যরকম। মানে মনে করো পুরুষ ক্যামেলিয়নের বাসার কাছাকাছি একটি সুন্দরী স্ত্রী ক্যামেলিয়ন এসেছেন। পুরুষটির ভারি ইচ্ছে তার সঙ্গে একটু আলাপ করার। সে অমনি চটপট তার গায়ের রংখানা বদলে বেশ মোলায়েম গোলাপি বা নরম সবুজ রঙের হয়ে যাবে। যেন বলছে, ‘এই যে ম্যাডাম, কেমন আছেন?’

biggangirgiti02

এর উত্তরে স্ত্রী প্রাণীটিও নিজের বর্ণ পরিবর্তন করবে। পুরুষটিকে যদি তার পছন্দ হয় তবে সেও বেশ পছন্দমতো হালকা রঙে রাঙিয়ে নেবে নিজেকে (১)। আর যদি নায়িকার বক্তব্য এমন হয় যে ‘দূর হ হতচ্ছাড়া, তোর গায়ে বড়ো গন্ধ!’ তাহলে তার রং বদলে হবে অন্যরকম। আবার খুব রেগে গেলে বা ভয় পেলেও এরা দ্রুত নিজের শরীরের রং বদলে ফেলে।

দেখা গিয়েছে যে রেপটাইলদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান প্রজাতি, অর্থাৎ যারা সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার নিয়মকানুন জানে, কেবলমাত্র তাদের মধ্যেই এই বর্ণ পরিবর্তনের ক্ষমতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে রং বদলে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে। তবে রং-বদলের নিয়মকানুন এক নয়। সেটা প্রতিটি প্রজাতিতে অন্যরকম। যেমন কিছু প্রজাতিতে শরীরের রং কালো হলে বোঝায়, ‘খবরদার হতভাগা! কাছে আসিস নে, নইলে কামড়ে দেব।’ তেমনি আবার অন্য কিছু প্রজাতিতে ওই একই কথা বোঝানোর জন্য লাল রঙের (২) ব্যবহার হয়।

যোগাযোগ ছাড়াও গাত্রবর্ণ পরিবর্তনের আরও একখানা কারণ হল সূর্যের উপস্থিতি এবং তাপমাত্রা। সরীসৃপ গোত্রের সবাই শীতল রক্তের প্রাণী, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে এক্টোথার্মিক (ectothermic)। তাই শরীরের উপযুক্ত তাপমাত্রা মেইনটেন করার জন্য এদের কাছে সূর্যের আলো অতি আবশ্যিক। আবার তাপমাত্রা খুব বেশি হলেও বিপদ। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপের ফলে মৃত্যু হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই সমস্যার সমাধান করতেও এরা ত্বকের রং পরিবর্তন করে। শীতকালে পারিপার্শ্বিক থেকে তাপ শোষণের জন্য তাদের রং হয় গাঢ় নীল বা কালচে বাদামি, আবার গরমের সময় তাপ প্রতিফলনের জন্য তাদের ত্বকের রং হয় আকাশী নীল বা হালকা সবুজ। আমরা যেমন গরমকালে হালকা রঙের সুতির জামা পরি এবং ঠান্ডা লাগলে পরি কালো জ্যাকেট, এখানেও ঠিক তেমনি।

এ তো গেল ভোল-বদলের কারণ। এবার আসি ভোল-বদলের প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ গিরগিটির ত্বকের ওপর এমন অদ্ভুত রং-বদলের খেলা হয় কী করে? এই প্রশ্নের উত্তরখানাও বেশ মজার। গিরগিটির ত্বক বহুস্তরীয় এবং সবচাইতে ওপরের স্তরটি হল স্বচ্ছ। নীচের দিকের স্তরগুলিতে ক্রোমাটোফোর নামক এক বিশেষ ধরনের কোষ থাকে। এই কোষ রঙের পিগমেন্ট তৈরি করে এবং বহন করে। ক্রোমাটোফোরের মধ্যেও বেশ কয়েকটি ভিন্ন বিভাগ রয়েছে। যেমন ত্বকের একদম নীচের লেয়ারে থাকে মেলানোফোর, যা মেলানিন নামক কালচে ব্রাউন পিগমেন্ট তৈরি করে। এর ওপরে থাকে ইরিডোফোর (নীল রং) এবং সবচাইতে ওপরে থাকে জ্যান্থোফোর (হলদে রং) এবং এরিথ্রোফোর (লাল রং)। এখানে তোমাদের জানিয়ে রাখি যে মানুষের ত্বকের বিভিন্ন রঙের জন্যও এই মেলানোফোরের আধিক্য বা অনুপস্থিতিই দায়ী। ত্বকে মেলানিনের সংখ্যা বেশি হলে ত্বকের রং হয় কালো এবং মেলানিনের অনুপস্থিতিতে ত্বকের রং হয় সাদা।

নর্ম্যালি এই রঙিন ক্রোমাটোফোর কোষগুলি সংকুচিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক, তাপমাত্রা এবং অন্য প্রাণীর উপস্থিতিতে গিরগিটি তার পছন্দমতো ক্রোমাটোফোর প্রসারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে নীল ও হলুদ একসঙ্গে প্রসারিত হলে সবুজ রং তৈরি হয়, লাল ও নীলের মিশ্রণে হয় বেগুনি আবার লাল ও হলুদ মিশলে হয় কমলা রং। ঠিক এমনিভাবেই গিরগিটির ত্বক জুড়ে চলে নানারকম রঙের খেলা।

গিরগিটির ভোল-বদলের ব্যাপারে আরও একখানা দারুণ ইনফরমেশন জানিয়ে রাখি তোমাদের। ব্যাপারটা হল এই যে, গিরিগিটি শুধু তার চোখ দিয়েই নয়, তার পেটের ত্বক দিয়েও ‘দেখতে’ সক্ষম। আমরা যেমন স্পর্শের মাধ্যমে বুঝতে পারি যে কোনও বস্তু মসৃণ অথবা খসখসে কি না, তেমনি গিরগিটি এবং ক্যামেলিয়ন পেটের ত্বক দিয়ে স্পর্শ করে যে-কোনো বস্তুর টেক্সচারের সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে তার রঙের হদিশও বুঝতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে তাদের চোখ ঢেকে দিলেও পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে রং এবং টেক্সচার মিলিয়ে ক্যামোফ্লাজ করতে তাদের মোটেই অসুবিধে হয় না।

তোমরা নিশ্চয় ভাবছো যে এটা কী করে হয়। স্পর্শ করে রং চেনা কি আদৌ সম্ভব!

এর উত্তরে বলি যে, হ্যাঁ, সম্ভব। ‘অপসিন’ নামক প্রোটিনের সাহায্যে এমনটা হতে পারে। আমাদের চোখে অপসিনের উপস্থিতির কারণেই আমরা প্রতিটি রংকে আলাদা করে চিনতে পারি। বিভিন্ন রঙের আলোর উপস্থিতিতে অপসিন আমাদের মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট সিগন্যাল পাঠায়। এই সিগন্যালের প্রকৃতি নির্ভর করে যে বস্তুকে দেখছি তার রঙের ওপর। সোজা ভাষায় বলতে গেলে এভাবেই আমরা দেখি।

পরীক্ষাগারে দেখা গিয়েছে যে গিরগিটি এবং ক্যামেলিয়ন জাতীয় সরীসৃপদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র চোখেই নয়, অপসিন উপস্থিত রয়েছে তাদের পেটের ত্বকেও। এভাবেই তারা ত্বক দিয়ে দেখতে পায়। মজার ব্যাপার, তাই না!

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

4 thoughts on “বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-বিচিত্র জীবজগৎ-গিরগিটির ভোলবদল-যূথিকা আচার্য্য-শরৎ ২০২১

Leave a reply to Anirban Sarkar Cancel reply