সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০(পঞ্চম থেকে অষ্টম স্থান)
ইউরোপিয়ান নিউরোলজি সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে এসেছে ডাক্তার অংশুমান ভট্টাচার্য্য। অংশুমান নিউরো-সার্জন। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কর্মরত। বয়স চল্লিশের কোঠায়। কিন্তু এই বয়সেই সে নিজের কর্মক্ষেত্রে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। বিশেষত ব্রেন সার্জারিতে তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। ইতিমধ্যে তার বেশ কিছু পেপার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে লিম্বিক সিস্টেম নিয়ে তার কাজ বিশেষজ্ঞ মহলে বিশেষ সমাদৃত।
ডাবলিনেও সে পেপার প্রেজেন্ট করেছে। এবারে তার বিষয় ব্রেন ট্রান্সপ্লান্টেশন। গত দশ বছরে মেডিক্যাল সায়েন্সের উল্কার গতিতে উন্নতি হয়েছে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ তো বটেই, মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন আজকে আর অলীক কল্পনা নয়। এখন ব্রেন স্ট্রোক হয়ে মস্তিষ্কের কোনো অংশ মৃত হয়ে গেলে অন্য কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের অংশবিশেষ প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু অংশুমান গত দু-বছর ধরে যে কাজ করে চলেছে তাতে মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনে একটা বিরাট লাফ দেবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অংশুমানের এবারের পেপারটা ছিল সেই বিষয়ে। যদিও সব কথা সে এখনই খুলে বলেনি, কিন্তু তার বক্তব্য যে বিশেষজ্ঞ মহলে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে সেটা সে বুঝতে পারছিল। প্রশ্নোত্তর পর্ব নির্ধারিত পাঁচ মিনিট থেকে টানতে টানতে দশে গিয়ে ঠেকেছে। বিশেষত ডাক্তার ফার্গুসনের প্রশ্ন আর থামতেই চাইছিল না। অংশুমানের মনে হচ্ছিল পারলে তিনি অংশুমান কতটা অগ্রসর হয়েছে সেটা জেনেই ছাড়বেন। অংশুমান তাঁর প্রশ্নবাণের সামনে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল। শেষপর্যন্ত সঞ্চালক-মশাই সেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করে তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
রিফ্রেশমেন্টে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছে, এমন সময় বেন এসে হাজির। বেঞ্জামিন স্টুয়ার্ট তারই মতো এন.এইচ.এস-এ আছে। কৃষ্ণাঙ্গ, দারুণ ফূর্তিবাজ। ব্রিটিশ নাগরিক। অংশুমানের সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব।
“কনগ্রাচুলেশনস আনশু। ফাটিয়ে দিয়েছ! তোমার পেপার কনফারেন্সের বেস্ট পেপার হলেও অবাক হব না।” বেঞ্জামিন বলল।
“ধন্যবাদ বেন। তোমার পেপারটাও যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং।”
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর অংশুমান জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তার ফার্গুসনকে চেনো নাকি? ওই যিনি আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিলেন?”
বেন হেসে বলল, “চিনি। নর্দান আয়ারল্যান্ডের লোক। এককালে নামকরা সার্জন ছিলেন। এখন কী করেন জানি না। তবে লোকমুখে শুনেছি ইদানিং মাথায় একটু গোলমাল দেখা দিয়েছে।” বলে সে আঙুল দিয়ে কপালের রগের কাছে স্ক্রু ঘোরানোর মতো একটা ভঙ্গি করল।
ঠিক সেই সময়েই ডাক্তার ফার্গুসন এসে উপস্থিত হলেন। সরাসরি বললেন, “এই যে, তোমাকেই খুঁজছিলাম। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলতে পারলে খুশি হব।”
অংশুমান জিজ্ঞেস করল, “কী বিষয়ে কথা বলতে চান জানতে পারি কি?”
“অফ কোর্স তোমার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে।”
“সরি ডাক্তার ফার্গুসন,” অংশুমান বাধ্য হয়ে অভদ্রতা করল, “আমার গবেষণার বিষয়ে যা বলার আমি কনফারেন্সে বলেছি। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“আহা,” ডাক্তার ফার্গুসন অধৈর্য হয়ে বললেন, “আমি কি তোমার কাছে ডিটেল জানতে চাইছি? আমি জানতে চাইছি তুমি যা বলছ সেটা হাতে-কলমে করে দেখেছ কি?”
এইবার অবশ্য অংশুমানকে সায় দিতেই হল, “না। জীবজন্তুর উপরে পরীক্ষা করেছি। কিন্তু হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমতি পাইনি।”
এবারে ডাক্তার ফার্গুসনের মুখে যে হাসিটা দেখা গেল তার মধ্যে কতটা শয়তানি আর কতটা ছেলেমানুষি বোঝা গেল না। “তুমি হয়তো জানো না আমিও দীর্ঘদিন ধরে এই একই বিষয়ে গবেষণা করছি। আমি এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলিনি। তোমাকে বলছি কারণ তোমার কথা শুনে মনে হয়েছে এ ব্যাপারে তুমি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছ।”
অংশুমান অবাক হয়ে বলল, “কোথায় করছেন আপনার গবেষণা?”
“আমার বাড়িতে, কাউন্টি অ্যান্ট্রিমে। ওখানে আমার নিজস্ব ল্যাবরেটরি আছে।” তারপর একটু থেমে বললেন, “দ্যাখো ডাক্তার ভট্টাচারিয়া, আমি তোমাকে আমার ল্যাবে ইনভাইট করছি। কালকে আমার সঙ্গে তুমি চলো। আমি কেমন কাজ করছি দেখতে পাবে। চাই কি তুমি যে কাজটা ইংল্যান্ডে করতে পারছ না সেটারও সুযোগ পেতে পারো।” ডাক্তার ফার্গুসনের মুখে একটা রহস্যময় হাসি খেলে গেল।
অংশুমান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। ডাক্তার ফার্গুসন যা বলছেন সেটা সত্যি হলে অভাবনীয় ব্যাপার হবে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি একটা বে-আইনি কাজেরও ইঙ্গিত দিচ্ছেন। শেষে বলল, “আমাকে একটু ভাববার সময় দিন ডাক্তার ফার্গুসন।”
“বেশ। আজকে সন্ধে পর্যন্ত সময় দিলাম। আমি হোটেল ম্যারিয়টে আছি। আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিও।”
ডাক্তার ফার্গুসন বিদায় নিলে বেন প্রায় লাফিয়ে উঠল। বলল, “খবরদার ওই পাগলাটে বুড়োর কথায় কান দিও না! ওর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না।”
অংশুমান বলল, “আমারও বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে। উনি গোটা পৃথিবীর থেকে লুকিয়ে কী এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছেন?”
“তুমি কি তাহলে ওঁর ল্যাবে যেতে চাও?”
“গেলে মন্দ হয় না। বিশেষ করে নর্দান আয়ারল্যান্ডটা দেখা হয়নি। জায়ান্টস কজওয়েটা দেখার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের।”
“ঠিক আছে।” বেন একটু ভেবে বলল, “কিন্তু আমিও তোমার সঙ্গে যাব।”
“তাহলে তো ভালোই হয়। আমি একজন লোকাল গাইডও পেয়ে যাব।” অংশুমান হেসে বলল।
সেদিন সন্ধেবেলায় ম্যারিয়ট হোটেলে ফোন করে অংশুমান ডাক্তার ফার্গুসনকে জানিয়ে দিল যে সে যেতে রাজি আছে। “কিন্তু আমার দুটো শর্ত আছে। প্রথমত, আমার সঙ্গে ডাক্তার বেঞ্জামিন স্টুয়ার্ট থাকবেন। আর দ্বিতীয়ত, কোনো বে-আইনি এক্সপেরিমেন্টে আমি অংশ নেব না।”
ফোনের অপর প্রান্তে ডাক্তার ফার্গুসনের হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। “ঠিক আছে তাই হবে। আগে চলো তো।”
পরদিন সকালে অংশুমান আর বেঞ্জামিন ডাক্তার ফার্গুসনের সঙ্গে রওনা দিল। ডাবলিন থেকে ট্রেনে বেলফাস্ট। আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। বেলফাস্টে ডাক্তার ফার্গুসনের প্রাইভেট লিমুজিন অপেক্ষা করছিল। তাতে চেপে ওরা রওনা দিল কাউন্টি অ্যান্ট্রিমের দিকে। ডাক্তার ফার্গুসন জানালেন, বেলফাস্ট থেকে তাঁর বাড়ি সত্তর মাইল, ঘণ্টা দেড়েকের ব্যাপার।
গাড়ি ক্রমশ উত্তরদিকে চলল। প্রথমে বেলফাস্টের ঝাঁ-চকচকে শহর ছাড়িয়ে এম ২ হাইওয়ে ধরল। মসৃণ স্লেটের মতো রাস্তা। তার উপর দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে ছুটে চলেছে তাদের গাড়িটা। দু-পাশে মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি। গাছপালা প্রায় চোখেই পড়ে না। অংশুমান জানত নর্দান আয়ারল্যান্ডে গাছপালার সংখ্যা এমনিতেই কম। কিন্তু তা বলে এখানকার জমি রুক্ষ নয়। মখমলের মতো সবুজ ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর গালিচার মতো দু-পাশে ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার তা থেমেও গেল। প্রকৃতি বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেন ঝলমল করছিল।
দেড় ঘণ্টার আগেই তারা ডাক্তার ফার্গুসনের বাড়ি পৌঁছে গেল। এদিকটা যাকে বলে কান্ট্রি-সাইড। অনেকটা বাংলার গ্রামের মতো। পার্থক্য এই যে এখানে সব বাড়ি পাকা এবং শহরের প্রায় সমস্ত সুযোগ-সুবিধাই এখানে পাওয়া যায়। ডাক্তার ফার্গুসনের বাড়িটাও পাথরে তৈরি এক মস্ত বাংলো। চারপাশে ম্যাপল, চিনার, ওকগাছের সারি। আশেপাশে অন্তত মাইল খানেকের মধ্যে আর কোনো ঘরবাড়ি নেই। বাড়িতে দুজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ নেই। ডাক্তার ফার্গুসন বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান।
বেঞ্জামিন জিজ্ঞেস করল, “আপনার ল্যাবরেটরিটা কোথায়?”
“আছে ডাক্তার বেঞ্জামিন, আছে। এখানে নয়। এখান থেকে মাইল দশেক দূরে। আজকের দিনটা আপনারা আমার আতিথ্য গ্রহণ করুন। কালকে আমি ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাব।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। ডাক্তার ফার্গুসনের বিশেষ দেখা পাওয়া গেল না। অংশুমানদের পৌঁছে দিয়ে তিনি কোথায় বেরিয়েছিলেন। ফিরলেন সন্ধে পার করে। বললেন, “সব ব্যবস্থা করে এলাম। কাল সকালেই আপনাদের ল্যাবে নিয়ে যাব।”
রাত ন’টায় ডিনার সেরে যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। বেঞ্জামিন গুড নাইট জানিয়ে বলে গেল, “একটু সজাগ হয়ে ঘুমিও। বলা যায় না বুড়োর মনে কী আছে।”
বেঞ্জামিনের আশঙ্কা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ মাঝ রাত্তিরে পাওয়া গেল। হঠাৎ কতগুলো বলিষ্ঠ হাতের ধাক্কায় অংশুমানের ঘুম ভেঙে গেল। তিনজন কালো পোশাক পরা মুখোশধারী লোক ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে। অংশুমান উঠে বসতেই একজন কর্কশ স্বরে বলল, “চুপচাপ তৈরি হয়ে আমাদের সঙ্গে চলে এসো। কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবে না।” বলে হাতে ধরা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রটার দিকে ইঙ্গিত করল।
অংশুমান বিহ্বল হয়ে পোশাক পালটে বসার ঘরে এসে দেখল বেঞ্জামিন আর ডাক্তার ফার্গুসনেরও একই অবস্থা। অংশুমানকে দেখে বেঞ্জামিন বলে উঠল, “দ্যাখো আনশু, আমি কী বলেছিলাম?”
অংশুমান ডাক্তার ফার্গুসনকে জিজ্ঞেস করল, “এসব কী হচ্ছে ডাক্তার ফার্গুসন?”
“বুঝতে পারছ না? এরা সব টেররিস্ট। আমাদের অপহরণ করা হচ্ছে। এদের কথা না মানলে আমাদের মেরে ফেলতে এদের হাত কাঁপবে না।”
অংশুমান আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে একটা ধাক্কা তার পিঠে এসে পড়ল, “শাট আপ অ্যান্ড মুভ।”
প্রত্যেকের মাথা কালো বালিশের মতো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হল। তারপর তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তোলা হল। গাড়ি চলতে শুরু করল। বেঞ্জামিন চাপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলছিল। বোধ হয় প্রার্থনা করছিল। একজন লোক কর্কশ গলায় তাকে চুপ করতে বলল। অংশুমান কিছু বলছিল না। তার মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কোথায়, কী উদ্দেশ্যে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এরা যে টেররিস্ট ডাক্তার ফার্গুসন সে-কথা জানলেন কী করে? নর্দান আয়ারল্যান্ডে টেররিজম বেশ কিছুকাল হল বন্ধ আছে। টেররিস্ট গ্রুপগুলো সরকারের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছে। তাহলে এরা কারা?
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর গাড়ি থামল। অংশুমানরা চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্ধের মতো লোকের হাত ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামল। তারপর হাত ধরেই হাঁটতে থাকল।
প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর অংশুমান বুঝতে পারল কোনো হল ঘরে এসে পৌঁছেছে। কারণ, পায়ের নিচের জমিটা এখন সিমেন্টের মেঝের মতো মসৃণ। আর বাইরে যে হাওয়ার দাপট অনুভব করতে পারছিল, সেটা এখানে নেই। এবার হল ঘর পেরিয়ে হাতগুলো ওদের আরেকটা ঘরের মধ্যে এনে ঢুকিয়ে দিল। তারপর মাথার ঢাকনাগুলো খুলে বলল, “তোমরা এখন এই ঘরেই থাকবে। যথাসময়ে তোমাদের বসের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।”
মুখের ঢাকনা সরতে অংশুমান দেখল বেশ বড়ো সাইজের ঘর। পাথরের দেওয়াল, মেঝেও পাথরের। একপাশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। দেখে মনে হয় কোনো দুর্গের অভ্যন্তর। ঘরের উলটোদিকে দেওয়ালে একটা বড়ো ভারী পর্দা ঝুলছে। বোধ হয় তার পিছনে জানালা আছে। অংশুমানদের পৌঁছে লোকগুলো দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। বেঞ্জামিন ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা সোফায় কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। অংশুমান ঘরের অন্যান্য দেয়ালগুলো দেখছিল। দুর্গই বটে। পাথরের দেওয়ালে মধ্যযুগীয় সব অস্ত্রশস্ত্র ঝুলছে। কিন্তু তাদের এখানে ধরে আনা হল কেন? কী চায় এরা? মুক্তিপণ? নাকি অন্য কিছু? ডাক্তার ফার্গুসনই-বা কোথায়? তাঁকে এ ঘরে আনা হয়নি। অংশুমান কিছুই বুঝতে পারছিল না।
একসময় সকাল হল। উলটোদিকের ভারী পর্দা ভেদ করে দিনের আলোর আভা ভিতরে আসছিল। অংশুমান উঠে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিতেই জানালার কাচ দিয়ে বাইরে সমুদ্রের জল চোখে পড়ল। বেঞ্জামিন সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অংশুমান চুপচাপ সোফায় এসে বসল।
কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। শুধু টোস্ট আর কালো কফি। দুজনে চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সেরে নিল। আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে দুজন অস্ত্রধারী লোক এসে জানাল, যাওয়ার সময় উপস্থিত।
এবার অবশ্য তাদের চোখ আর বাঁধা হল না। দুর্গের বিশাল পাথরে বাঁধানো করিডর পেরিয়ে তারা একটা বড়ো হল ঘরে এসে উপস্থিত হল। সর্বত্র কালো পোশাক পরিহিত মুখোশধারী লোক হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। এটা যে কোনো টেররিস্ট গ্রুপের গোপন ঘাঁটি, সে বিষয়ে অংশুমানের মনে কোনো সন্দেহ রইল না।
হল ঘরের একদম শেষপ্রান্তে একটা উঁচু বেদির মতো জায়গায় চেয়ারে বসে আছে একজন স্যুট-প্যান্ট পরিহিত লোক। দেখে মনে হয় ব্রিটিশ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। গায়ের রং ফর্সা, মুণ্ডিত মস্তক। এর মুখে অবশ্য কোনো মুখোশ নেই।
অংশুমান দেখে অবাক হল ডাক্তার ফার্গুসনও সেখানে উপস্থিত। অংশুমানদের দেখে দুজনেই উঠে দাঁড়াল। মুণ্ডিত মস্তক লোকটি ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনাদের এভাবে ধরে নিয়ে আসার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত ডাক্তার ভট্টাচারিয়া। আমার নাম নিক অ্যান্ডারসন। একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে আমাদের দরকার। আপনারা বসুন।”
অংশুমান আর বেঞ্জামিন সামনে রাখা দুটো চেয়ারে বসল। অংশুমান জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কারা? এটাই-বা কোন জায়গা?”
“আমাদের পরিচয় আপনার না জানলেও চলবে। আর এটা উত্তর সমুদ্রতীরে একটা প্রাচীন দুর্গ।”
“আপনারা কি কোনো টেররিস্ট গ্রুপ?”
প্রশ্নটা শুনে নিকের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। পরক্ষণেই সে সহজ হয়ে বলল, “আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী। যাই হোক, এখন যে প্রয়োজনে আপনাদের এখানে আনা হয়েছে সেটা ডাক্তার ফার্গুসন আপনাদের বলবেন।”
বেঞ্জামিন হঠাৎ হেসে উঠল, “তার মানে ডক্টর ফার্গুসনও আপনাদের সঙ্গে যুক্ত?”
“হ্যাঁ, উনিও আমাদেরই মতো একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা। ডাক্তার ভট্টাচারিয়ার কথা আমরা ওঁর কাছে জানতে পারি। আপনার মতো ব্রেন সার্জন ইউরোপে যে আর দ্বিতীয় নেই সেটা আমরা জানি। তাই এই কাজের জন্য আমরা আপনাকেই নির্বাচিত করেছি।”
“কাজটা কী?” অংশুমান প্রশ্ন করল।
ডাক্তার ফার্গুসন এতক্ষণে মুখ খুললেন। বললেন, “আংশিক মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। কিন্তু টোটাল ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট এখনো আমাদের অধরা। সরকার থেকেও এর উপরে বিধিনিষেধ রয়েছে। আমি দীর্ঘদিন টোটাল ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। ডাক্তার ভট্টাচারিয়ার পেপার পড়ে আমার মনে হয়েছে যে তিনি সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু জীবজন্তুর উপর পরীক্ষা করা এক ব্যাপার, আর মানুষের ওপর তার প্রয়োগ সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। যে কারণে আপনি আর এগোতে পারছেন না। আপনাকে আমি সেই সুযোগটা করে দেব।”
অংশুমান মাথা নাড়ল, “আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।”
“আপনাকে একটা অপারেশন করতে হবে। টোটাল ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট। কিন্তু কোনো জন্তুর উপরে নয়, মানুষের উপরে। একজন বিশেষ মানুষ।” এইটুকু বলে ডাক্তার ফার্গুসন চুপ করলেন।
বিশাল হল ঘরটায় পিন পড়লে শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পর অংশুমান জিজ্ঞেস করল, “কার উপরে জানতে পারি?”
“দুঃখিত, সেটা বলা যাবে না। তবে একজন অত্যন্ত মূল্যবান মানুষ এবং বলাই বাহুল্য আপনার কাছে আমরা সম্পূর্ণ সাফল্য আশা করি।” শেষ কথাটা যেভাবে বলা হল তাতে বেশ বোঝা যায় এর অন্যথা হলে সেটা অংশুমানদের পক্ষে ভালো হবে না।
হঠাৎ বেঞ্জামিন বলে উঠল, “কিন্তু সেই অপারেশনটা হবে কোথায়? এই দুর্গে?” তার কন্ঠে ব্যঙ্গের সুর।
“সে-সব ব্যবস্থা আছে। আপনাদের জন্য অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার তৈরি করা হয়েছে। কোনো অসুবিধা হবে না।”
“কিন্তু অপারেশনটা করতে হলে আমার সহকারী চাই, অ্যানেসথেসিস্ট চাই, সে-সব?”
“আপনার সহকারী হবেন ডাক্তার বেঞ্জামিন। অ্যানেসথেসিস্টও আছেন। আর আমি তো থাকবই।”
বোঝা গেল ডাক্তার ফার্গুসন সমস্ত প্রক্রিয়াটার উপরে নজর রাখবেন।
“আর যদি আমরা এতে সম্মত না হই?”
“দুঃখিত ডাক্তার ভট্টাচারিয়া। সেক্ষেত্রে আপনাদের দুজনের মৃতদেহ এই দুর্গের পিছনে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা হবে। লোকে জানবে নর্দান আয়ারল্যান্ডে এসে আপনারা অপহৃত হয়েছিলেন, তারপর আপনাদের লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
অংশুমান মনে মনে শিউরে উঠল। কী সাংঘাতিক! ইয়র্কশায়ারে তার বাড়িতে ঋষি আর সাহানার কথা মনে পড়ল। দুজনেই অপেক্ষা করে আছে কখন তাদের পাপা ঘরে ফিরবে। কালকে অপহরণ করে আনার সময় তাদের মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতক্ষণ কথা না বলে ওরা হয়তো অস্থির হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণ পর অংশুমান বলল, “ঠিক আছে। আমি রাজি আছি। তবে আগে আমাকে যার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন হবে এবং যার দেহে হবে সেই দুজনকেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
ডাক্তার ফার্গুসন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।”
ডাক্তার ফার্গুসনের সঙ্গে অংশুমানরা যে ঘরটায় এসে উপস্থিত হল সেটাকে দেখে আর মধ্যযুগের দুর্গ বলে মনে করার উপায় নেই। বরং সেটা একটা আধুনিক হসপিটালের অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটারের সমতুল্য। অপারেশন টেবিল, অ্যানেসথেসিয়ার যন্ত্র, সার্জারির সূক্ষ্ম ইনস্ট্রুমেন্টস—সবকিছুই মজুত আছে। ঘরের একপাশে দুটো পাশাপাশি বেডে শুয়ে রয়েছে দুটো দেহ। বেডের পাশে ই.সি.জি, ই.ই.জি এবং আরো নানারকম যন্ত্র। অনেকগুলো নল যন্ত্রগুলো থেকে বেরিয়ে এসে দেহ দুটোয় যুক্ত রয়েছে।
অংশুমানরা বেডদুটোর দিকে এগিয়ে গেল। প্রথম বেডটায় যিনি শুয়ে আছেন তাঁর বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ বছর। শ্বেতাঙ্গ। ডাক্তার ফার্গুসন বললেন, “এঁর মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করতে হবে।”
অংশুমান প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে বুঝতে পারল এঁর দেহের বিভিন্ন সিস্টেম বিকল হলেও মস্তিষ্ক কর্মক্ষম আছে। দ্বিতীয় দেহটা একজন ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী যুবকের। এরই দেহে অন্য ব্যক্তির মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন হবে। অংশুমান দেখল এই ব্যক্তির দেহের সমস্ত সিস্টেম কাজ করলেও মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন সফল হলে প্রৌঢ় লোকটি এই সুস্থ-সবল দেহ ধারণ করে আবার যুবক হয়ে উঠবেন।
পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হলে ডাক্তার ফার্গুসন জিজ্ঞেস করলেন, “কী বুঝলেন?”
“দাতা এবং গ্রহীতা দুজনেই ঠিক আছে। সাফল্যের সম্ভাবনাই বেশি।”
“ভেরি গুড!” ডাক্তার ফার্গুসন উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “তাহলে দেরি করা ঠিক হবে না। আজ বিকেলেই অপারেশন হবে।”
অংশুমান বলল, “আমার নিজস্ব কিছু জিনিস লাগবে। সেগুলো আমার লাগেজেই আছে। কিন্তু…”
ডাক্তার ফার্গুসন বাধা দিয়ে বললেন, “আপনার লাগেজ আপনি পেয়ে যাবেন। এখন চলুন। আপনারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিন।”
অংশুমানরা নিজেদের ঘরে ফিরে এল। বেঞ্জামিন ধপ করে সোফায় বসে বলল, “আমি লোকটাকে চিনতে পেরেছি। এ হল টিমফিৎ জেরাল্ড। টেররিস্ট গ্রুপের সুপ্রিমো। আগে পেপারে টিভিতে ফোটো দেখেছি। কিন্তু লোকটা তো শুনেছিলাম বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে।”
“মারা যে যায়নি সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। হয়তো এতদিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে ছিল। এতদিনে মাল্টি-অর্গান ফেলিওর হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ইনিই এই গ্রুপের মাস্টার-মাইন্ড।”
“ঠিক বলেছ। এ বেঁচে উঠলেই দলটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তারপর আবার তাণ্ডব শুরু করবে।” একটু থেমে বেঞ্জামিন বলল, “এদের আটকাতেই হবে আনশু। এ অপারেশন কিছুতেই করা যাবে না। প্রাণ গেলেও না।”
অংশুমান সহানুভূতির স্বরে বলল, “আমি তোমার ভাবনা বুঝতে পারছি। তোমার দেশভক্তির তুলনা নেই। কিন্তু ওভাবে এদের আটকানো যাবে না। টিম যদি বেঁচে নাও ওঠে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড নিক সুপ্রিমো হবে। আবার ওরা অ্যাক্টিভ হয়ে উঠবে।”
বেঞ্জামিন অংশুমানের যুক্তি বুঝতে পারল। হতাশ হয়ে বলল, “তাহলে?”
“আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। কতটা সফল হব জানি না, কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই।”
“কী প্ল্যান?”
“সেটা তোমাকে যথাসময়ে বলব। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। ডাক্তার ফার্গুসন অপারেশনের সময় থাকবেন। আমাদের উপরে নজর রাখবেন। তোমাকে যেভাবে হোক কিছু সময়ের জন্য ওঁকে ব্যস্ত রাখতে হবে যাতে আমার দিকে ওঁর নজর না থাকে। পারবে?”
“পারব।”
অপারেশন শুরুর আগে অ্যানেসথেসিস্ট ডাক্তার আর্নল্ডের সঙ্গে আলাপ হল। ইনি নর্দান আয়ারল্যান্ডেরই লোক। নিউরো-অ্যানেসথেসিয়ার বিশেষজ্ঞ। অংশুমানদের মতো এঁকেও অপহরণ করে আনা হয়েছে।
অপারেশন শুরু হল। অংশুমান মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত বোধ করলেও নিজের আবেগ সংবরণ করার শিক্ষা তার আছে। উত্তেজনা এই জন্য যে এতদিন সে কুকুর-বিড়াল এইসব জন্তুর উপরে পরীক্ষা করেছে। মানুষের উপরে যে এই অপারেশনের সুযোগ পাবে তা সে দু-দিন আগে পর্যন্ত স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। নিপুণ হাতে সে যুবকের খুলির ভিতর থেকে মৃত মস্তিষ্কটা বের করে ফেলল। তারপর টিমফিৎ জেরাল্ডের মস্তিষ্কটা সেই খুলির মধ্যে বসাল। দক্ষ হাতে মস্তিষ্কের সঙ্গে সুষুম্নাকাণ্ডের স্নায়ুগুলো জুড়তে থাকল।
ডাক্তার ফার্গুসন সজাগ দৃষ্টিতে গোটা প্রক্রিয়াটার উপরে নজর রাখছিলেন। তিনি নিজে নিউরো-সার্জন। অংশুমানের হাতের নিপুণতা দেখে তাঁর চোখেও প্রশংসা ফুটে উঠল।
প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পর যখন অপারেশন শেষের দিকে, বেঞ্জামিন হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। অংশুমান ব্যস্ত হয়ে বলল, “প্লিজ ডাক্তার ফার্গুসন, বেনকে একটু দেখুন। মনে হচ্ছে সিনকোপি। এদিকটা আমি সামলে নেব।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাক্তার ফার্গুসন এবং আরো দুজন স্টাফ বেঞ্জামিনকে মেঝে থেকে তুলে একটা ফাঁকা বেডে শুইয়ে দিলেন। ডাক্তার ফার্গুসন যখন বেঞ্জামিনকে পরীক্ষা করছেন তখন অংশুমান একটা ছোটো জিনিস টিমের মস্তিষ্কের একটা বিশেষ অংশে বসিয়ে দিল। ডাক্তার ফার্গুসন জানতেও পারলেন না। অংশুমানের ইশারায় বেঞ্জামিন অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়টা সুন্দর উতরে দিল।
অপারেশন শেষ হল। এখন বারো ঘণ্টার অপেক্ষা। অংশুমান এতক্ষণে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করল। কাল মাঝরাত থেকে দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তার উপর উত্তেজনা। সামান্য কিছু খেয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
পরদিন সকাল। টিমফিৎ জেরাল্ডের বেড ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। একসময় টিমের চোখের পাতা দুটো নড়ে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে চোখদুটো খুলে গেল। টিমের নতুন দেহ বিছানায় উঠে বসল। অংশুমান সামনে ঝুঁকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে ঘোষণা করল অপারেশন সফল হয়েছে। ঘরে একটা চাপা উল্লাস খেলে গেল। বাইরে থেকে ফায়ারিংয়ের শব্দ ভেসে এল। সবাই জেনে গেছে যে তাদের সুপ্রিমো বেঁচে উঠেছে।
টিম অংশুমানের দিকে তাকালেন। সে-চোখের দৃষ্টি নরম। খুব নম্র গলায় বললেন, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তার ভট্টাচারিয়া। আপনার দয়ায় আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। কীভাবে আপনাকে প্রতিদান দিতে পারি?”
অংশুমান বলল, “আপনার লোকদের বলুন আমাদের এই মুহূর্তে বেলফাস্ট স্টেশনে ছেড়ে আসতে। আর আপনি দলবল, অস্ত্রশস্ত্র সমেত পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করুন।”
“বেশ তাই হবে। নিক…”
ঘরভর্তি কতগুলো বিমূঢ় মুখের সামনে দিয়ে অংশুমান আর বেঞ্জামিন বেরিয়ে এল।
দু-ঘণ্টা পরের কথা। বেলফাস্ট থেকে ডাবলিনগামী দ্রুতগতি ট্রেনের কামরায় দুজনে বসে। বেঞ্জামিন অবাক গলায় বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এ কি ম্যাজিক? না-হলে যে লোকটা সারাজীবনে অন্তত পঁচিশটা টেররিস্ট অ্যাটাক করেছে, পাঁচশোর উপরে মানুষ মেরেছে, সে তোমার এককথায় আমাদের ছেড়ে দিল? তুমি কী করেছিলে বলো তো!”
অংশুমান বলল, “তুমি তো জানো মানুষের মস্তিষ্কের সিনগুলেট কর্টেক্স মানুষের চেতনা, অ্যাটেনশন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। যার কোড নেম এরিয়া-২৪। এও জানো যে এরিয়া চব্বিশে নিউরো-ট্রান্সমিটার গাবা (GABA)-র পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের সংজ্ঞা চেতনা কমে যায়। মানুষ সন্মোহনে সাড়া দেয়। ঠিক যেভাবে বেঞ্জোডায়াজেপিন ইনজেকশন দিয়ে অপরাধীদের লাই ডিটেক্টরের সামনে বসানো হয়। যাতে তাদের মস্তিষ্কের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয় এবং তারা ইনভেস্টিগেশনে সহযোগিতা করে। তোমার নিপুণ অভিনয়ের কল্যাণে ডাক্তার ফার্গুসনের নজর এড়িয়ে আমি আমারই তৈরি করা খুব অল্প মাত্রায় কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ধরে নিঃসরিত হবে এমন একটা গাবা ডিভাইস টিমের এরিয়া চব্বিশে বসিয়ে দিয়েছিলাম। এখন অন্তত সাতদিন টিম নম্র হয়ে থাকবে এবং পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। টিম জেগে ওঠার পর তাকে হিপনোটাইজ করতে তাই আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।”
বেঞ্জামিন উঠে এসে অংশুমানের হাতদুটো জোরে ঝাঁকিয়ে দিল, “ব্র্যাভো আনশু, ব্র্যাভো! আর পৃথিবীর প্রথম সফল কমপ্লিট ব্রেন প্রতিস্থাপনের জন্য তোমাকে অসংখ্য অভিনন্দন।”
দু-দিন পরে ইউরোপের সমস্ত সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় নর্দান আয়ারল্যান্ডের কুখ্যাত টেররিস্ট গ্রুপের আত্মসমর্পণের খবরটা বড়ো বড়ো হরফে প্রকাশিত হল।
অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়