গল্প কঙ্কাল কান্ড চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২১

চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের আরো গল্প
আজব মানুষের গজব কাহিনী, ভগবানের বেটা বেটি, শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি, জ্বর গাছ, হরিদ্রাবৃত্ত

golpokonkal_kando

উকিলপাড়া, চিনাপাড়া আর যুগিপাড়া পাশাপাশি তিনটে পাড়া। কিছুদিন ধরে এই অঞ্চল জুড়ে চুরি-চামারির ঘটনা বেশ বেড়েছে। এই তো গত পরশু, চিনাপাড়ার সুমন্ত দাসের বাড়িতে ভালো রকম চুরি হয়ে গেছে।

সুমন্ত দাস আর তার পরিবার অবশ্য এখন আর চিনাপাড়ার  বাড়িটাতে থাকে না। নতুন ফ্ল্যাট কিনে অন্য জায়গায় চলে গেছে। এই বাড়িটা সুমন্ত দাসের ঠাকুর্দার করা। এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে কী হবে, পুরনো আমলের অনেক দামি দামি জিনিসপত্র আছে বাড়ির মধ্যে।

খুব ঘটা করে সিংহবাহিনীর পুজো হত এক সময়ে। প্রচুর পুজোর বাসন ছিল ওদের। চোর একেবারে চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেছে সব, এরকমটাই শোনা যাচ্ছে। খালি বাড়ি পেয়েছে, নিশ্চিন্তে চুরি করেছে ব্যাটা।

খবর পেয়ে সুমন্ত দাস এসে দুঃখ করেছে পাড়ার লোকেদের কাছে, “পুজোর বাসনকোসনগুলো নিজের কাছে নিয়ে গেলেই ভালো হত। ছোট ফ্ল্যাটে তো অত জায়গা নেই তাই অন্য ব্যবস্থা করব  ভেবেছিলাম। সব গেল।”

শুধু কি আর বাড়ির ভেতরেই  চুরি হচ্ছে? মোটেই না। রাস্তার ম্যানহোলের লোহার ঢাকনা, ট্যাপ কলের মুটকি, রাস্তার আলো, এমনকি একদিন তো ইলেক্ট্রিক ট্রান্সফরমার বক্স খুলে ভেতর থেকে কি একটা পার্টস চুরি করে নেওয়াতে গোটা এলাকা অন্ধকার হয়ে গেছিল। কম্পানির লোক এসে বলল, চোরের কীর্তি! ওই পার্টস তামার ছিল। অনেক দাম।

কী বেরসিক চোর রে বাবা! এই উদ্দন্ড গরমে চার পাঁচ ঘন্টা থাকা চরম কষ্টের। কোম্পানি পার্টস আনল, লাগাল, তারপর আলো এল। করার নেই কিছু।বাড়িতে চুরি হলে থানায় গিয়ে নালিশ লেখানো হচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় চুরি হলে আর কে যাবে থানায়!

আর এত এত চুরির কিনারা কি করতে পারবে পুলিশ? ধরতে পারবে চোর? তবে হ্যাঁ, চোর ধরা পড়ল। সে এক কান্ড বটে! এখন কথা হচ্ছে, সেই একমাত্র চোর যে ওই অঞ্চল জুড়ে চুরি করে বেড়াচ্ছিল নাকি অনেক চোরের একজন, সে-খবর জানা যায়নি।

ঘটনাটা উকিলপাড়ার। এক রাত্তিরে বিকট একটা আঁ আঁ আঁ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল  আশপাশের  বাসিন্দাদের। কার কী হল? কোনো বড়সড় বিপদ নিশ্চয়ই!  কেউ কেউ উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করল, কেউ কেউ আবার ভাবল, এটা চোরের চাল নয় তো?

শান্তি ঘটক বয়স্ক মানুষ। তিনি তার ছেলে জয় কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, “আমার মনে হল আওয়াজটা পেছনের সরকার বাড়ি থেকে এসেছে। ওদের কোনো বিপদ হল না কি কে জানে। তোর কাছে কি ওদের কারুর ফোন নম্বর আছে?”

মাথা নেড়ে ‘না’ জানিয়ে জয় বলল, “দেখে আসব গিয়ে?”

“চল, তাহলে আমিও যাই।”

বাড়ির বাকি লোকজনকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে বাবা আর ছেলে টুবলুদের বাড়ির দিকে চলল।

টুবলুর বাবার নাম শেখর সরকার। আর্মিতে আছেন উনি। এখন শ্রীনগরে পোস্টেড। বাড়িতে ওঁর স্ত্রী মালা আর ছেলে টুবলু থাকে। টুবলু ক্লাস সেভেনে পড়ে। ভালো একটা নাটকের দলে অভিনয় শেখে। পাড়ার বা স্কুলের অনুষ্ঠানে নাটক হলে টুবলু অবশ্যই থাকে কোনো না কোনো চরিত্রে।

টুবলুদের বাড়ি পৌঁছে শান্তিবাবু বোঝার চেষ্টা করলেন এখান থেকেই চিৎকারটা শোনা গেছিল কিনা। জয় ওসব ভাবনাচিন্তায় না গিয়ে সরাসরি হাঁক দিল, “টুবলু, অ্যাই টুবলু…আমি জয়দাদা, কোনও সমস্যা হয়েছে কি?”

জয়ের গলা পেয়ে দু-একটা বাড়ির আলো জ্বলে উঠল, তাদের কেউ বারান্দায় বেরিয়ে এল, কেউ বা দরজা খুলে গেটের সামনে দাঁড়াল।

জয় ডাকার আধ মিনুটের ভেতর সদর দরজার খুলে বেরিয়ে এল টুবলু। অদ্ভুত কিছু একটা পরে আছে, কোমর অবধি নামানো। স্যান্ডো গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে।

“কী রে, কিছু প্রবলেম?”

“ভেতরে এসো, বলছি।”

জয়ের মনে হল টুবলু খুব ভয় পেয়েছে। ভেতরের প্যাসেজটা অন্ধকার কিন্তু ঘরে আলো জ্বলছে। টুবলুর পিছু পিছু ঘরে ঢুকে তো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল বাবা ছেলের। মেঝেতে একটা লোক পড়ে আছে, হাতদুটো পিছমোড়া করে সাদা ফিতে দিয়ে বাঁধা। লোকটা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।

“কে রে?”

“চোর মনে হয় জয়দাদা।”

“অজ্ঞান হয়ে গেল কী করে? হাত কে বেঁধেছে, তুই?”

“হ্যাঁ, আমিই বেঁধেছি। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে পাশবালিশের দড়িটা খুলে নিয়েছি।”

“ওই দড়ি তো পাতলা। জ্ঞান ফিরলেই তো লোকটা তোকে অ্যাটাক করত।”

“হ্যাঁ, জানি তো। তোমরা যখন বেল বাজালে তখন আমি বাঁধছিলাম হাতটা। ঠিক করেছিলাম, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে হুড়কো লাগিয়ে দিয়ে সবাইকে ডাকব চিৎকার করে। তার আগেই তোমরা এসে গেছ।”

ততক্ষণে আশপাশের বাড়ির লোকজনও এসে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন থানায় খবরও দিয়ে দিয়েছে আর লোকটার হাত আর পা ভালো করে কাতার দড়ি এনে বেঁধে দিয়েছে। পাশের বাড়ির মলয় গুপ্ত জিগ্যেস করলেন, “তুই কি বাড়িতে একা নাকি? মা কোথায়?”

সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ ফোন আসে টুবলুর দিদার অবস্থা খুবই খারাপ জানিয়ে। টুবলুর মা মালা তক্ষুণি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। পরের দিন টুবলুর তিন তিনটে ক্লাস টেস্ট থাকায় টুবলু যেতে পারে না। ওর মা নিরুপায় হয়ে ছেলেকে একা রেখেই বেরিয়ে যান।

যাবার সময়ে মালাদেবী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ জানি না গিয়ে মাকে জীবন্ত দেখতে পাব কিনা। রাতে তো ফিরতে পারব না। পৌঁছে ফোন করে দেব। খুব সাবধানে জানলা দরজা সব বন্ধ করে শুবি। আমার সময় নেই তাই মলয়দাদের বলে যেতে পারছি না। দরকারে তুই একটু বলে দিস।”

মাথা নাড়ে টুবলু। মায়ের কান্না দেখে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বেশি লাগছে ভয়। জীবনে কোনোদিন একা থাকেনি টুবলু। এই প্রথম তাও আবার রত্তিরবেলা! ভাবতেই কেমন শীত শীত লাগতে শুরু করেছে।

মলয়জেঠুদের বলে কী হবে, ওদের বাড়িতে তো ইয়ং কেউ নেই যে এসে শোবে। খালি মলয়জেঠু আর মণিজেঠিমা থাকে। তাই আর বলতে যায়নি টুবলু।

ভীষণরকম অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। একে তো মা এই রাতে একা গেল তার ওপর টুবলুর বেজায় ভূতের ভয়। দুটো ভয় মিলে সাতদিন আগে খাওয়া খাবার পেটে থেকে উঠিয়ে আনবে মনে হচ্ছে।

সকালেই মালাদেবী রান্না করে রাখেন দুবেলার খাবার। রাতের খাবার তাই ফ্রিজে তোলা ছিল। ভাত আর চিকেন কারি বের করে  রেখে দিয়েছিলেন রাতের খাবার হিসেবে। পড়াশোনা শেষ করে  টুবলু  নিজের মতো খাবার নিয়ে  বাকিটা ফ্রিজে রেখে দিল।

এটুকু সময় মন থেকে ভয়ের চিন্তাটা চলে গেছিল। মা ফোন করে পৌঁছনোর খবর দিয়েছে। দিদাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদিকের চিন্তাটাও কমেছে।

টিভিতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড দেখতে দেখতে ডিনার সারল টুবলু। গ্লোবাল ওয়ার্মিং -এর ফলে মেরু ভালুকদের দুরবস্থা দেখাচ্ছিল। ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে ভালো লাগে ওর।খাওয়া শেষ হতেই ভয়টা আবার ফিরে এল। একবার ভাবল, সারা রাত টিভি চালিয়ে রাখবে। কিন্তু তাতে তো নিজেই ঘুমোতে পারবে না ও। আওয়াজ বন্ধ করে দিলেও আলো এসে তো মুখের ওপর পড়বে।  হঠাৎই একটা আইডিয়া এসে গেল ওর মাথায়।

আলমারি খুলে একটা পোশাক বের করল।  কিছুদিন আগেই স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যে নাটকটা করেছিল ওদের গ্রুপ, তাতে টুবলুর লেগেছিল এই কস্টিউমটা।

নেশা করার ফলাফল নিয়ে ছিল নাটকটা। টুবলু সেজেছিল নেশাড়ু। নানারকম আজেবাজে নেশা করে শেষে কঙ্কালসার হয়ে যাবার চরিত্র। সেজন্য কঙ্কালের কস্টিউম আর একটা চোখ গর্ত বেজায় বড় হাঁ করা মুখোশ কিনতে হয়েছিল।

টুবলুর মনে হল, ভূত নিশ্চয়ই নিজের গোষ্ঠীর কারুর ক্ষতি করবে না। তাই রাতে ওই পোশাকটা পরেই শোবে ঠিক করে নিল। মুখোশটা রাখল বালিশের পাশে যাতে অন্যরকম কিছু বুঝলেই মুখে লাগিয়ে নিতে পারে। ভূত যদি আসেও, আর একটা ভূত দেখে খুশিই হবে, ভয় দেখাবে না।

চোরেরা সারাক্ষণই তক্কেতক্কে থাকে, কোথায় বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, কোন বাড়িতে বুড়োবুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই ইত্যাদি খোঁজ খবর নেবার জন্য ঘুরে ঘুরে রেইকি করে ওরা।

টুবলুর মা যখন বেরিয়ে যায়, হেবো চোর আশেপাশেই ছিল।  মালাদেবী বেরিয়ে যেতেই ব্যাটা নানা দিক দিয়ে নজর রেখে বোঝে বাড়িতে বড়ো কেউ নেই। ঠিক করে নেয় এই বাড়িটাতেই ঢুকবে আজ রাতে। একতলা বাড়ি তাই ঢুকতে সুবিধে।

রান্নাঘরের  জানলার গ্রিল খুব সন্তর্পণে কেটে ভেতরে ঢোকে হেবো। একটা ঘরের জানলা দেখতে পেয়ে সেটারও গ্রিল কাটে। ঘুমিয়ে পড়েছিল টুবলু। খুট করে একটা শব্দ হতেই তড়িঘড়ি পাশ থেকে মুখোশটা নিয়ে মুখে দিয়ে নেয়। বুকের ভেতর যেন দামামা বাজছে। প্রচন্ড ভয় করছে।  মুখ বন্ধ করে  মড়ার মতো পড়ে থাকে বিছানায়।

ঘরে ঢুকে হেবো দেখে বিছানায় একটা কঙ্কাল শুয়ে আছে । বীভৎস হাঁ মুখ যেন এখুনি গিলে ফেলবে ওকে। আতঙ্কে মুখ দিয়ে  আঁ আঁ আঁ আঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসে, সামলাতে পারে না। শেষমেশ  অজ্ঞান হয়ে দড়াম করে পড়ে যায় মেঝেতে।

ভূত হলে আর একজন ভূতকে দেখে ভয় পাবে কেন? এ নির্ঘাত চোর! লাফিয়ে উঠে ঘরের আলো জ্বালে টুবলু। মুখোশ ফেলে তাড়াতাড়ি পাশবালিশের দড়ি খুলে হাতদুটো পেছনে বেঁধে ফেলে। জেগে দেলে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে।  তখনি ওর নাম ধরে কেউ ডাকছে কানে আসে।

এরপর তো হইহই ব্যাপার। যা যা হল সেগুলো পয়েন্ট করে না বললে, মহাভারত হয়ে যাবে।

১। থানা থেকে পুলিশ এসে হেবোকে ধরে নিয়ে গেল। অনেকদিন ধরে জ্বালাচ্ছিল ব্যাটা। সাহসিকতার জন্য পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে টুবলুকে একটা পুরষ্কার দেবে ঠিক করেছে।

২। উপস্থিত বুদ্ধির বহর দেখে বড়রাও অবাক। বাড়ির ছেলেমেয়েদের টুবলুর মতো উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করতে চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে।

৩। টুবলুর দিদা অনেকটা ভালো আছে এখন। পরেরদিনই মা ফিরে এসেছে। ছেলের কান্ড দেখে যারপরনাই খুশি তিনি।  চোরটা অজ্ঞান না হলে কী হত, সেটা ভেবে মাঝেমধ্যে একটু কেঁপে উঠছেন এই যা।

৪। টুবলুর নিজের ওপর আস্থা বেড়েছে অনেক। মানুষ সামলে দিয়েছে, ভূত হলেও সামলাতে পারবে মনে হচ্ছে এখন।

৫। পরের দিনের ক্লাসটেস্টটা ওকে আর দিতে হয়নি। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে স্কুলের স্যারেদের কানেও গেছিল। খুশি হয়ে আশি শতাংশ নম্বর এমনিই দিয়ে দিয়েছেন তারা।

৬। টুবলুর বাবা শেখরবাবু সব শুনে টুবলুকে  বলেছেন, আর্মি জয়েন করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে। এরকম সাহসী ছেলেই আর্মিতে প্রয়োজন।

৭। ঘরে ঘরে সবাই এখন কঙ্কালের কস্টিউম কিনছে।

অলঙ্করণ-জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প কঙ্কাল কান্ড চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s