গল্প-তেতলার বারান্দা- তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-বসন্ত ২০২১

দুপুরবেলা বাড়িটা একেবারে চুপচাপ। আমাদের দোতলার ফ্ল্যাটে অবশ্য এখন শুধু কুসুমপিসি আর আমি। বাবা অফিসে চলে যান সেই সকালে, আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে। মা একটা স্কুলে পড়াতে যান এগারোটায়, ফিরতে ফিরতে চারটে বেজে যায়। আমি স্কুল-বাসে করে একটায় ফিরলে কুসুমপিসি আমায় খেতে দেয়। তারপর নিজে খেয়ে মাদুর পেতে ঘুমিয়ে পড়ে। আমায় বলে, “খুকি, এইখানেই থাকো। একটু শুয়ে নাও দিকি, কোথাও যাবে না কিন্তু।”

কুসুমপিসি আমায় জন্মাতে দেখেছে কিনা, তাই আমায় খুকি বলে।

এই বাড়িটা আমার একটুও ভালো লাগে না। কোনো বন্ধু নেই, কাউকে চিনি না, স্কুলটাও অনেকটা দূর। আমাদের পুরোনো বিশাল বাড়িটা এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এবার থেকে ফুলজেঠুরা, রাঙাকাকারা, বড়দা-মেজদারা, আমরা সব আলাদা আলাদা জায়গায় থাকব। আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে, হয়ে গেলেই ওখানে চলে যাব আমরা, মানে মা-বাবা আমি আর কুসুমপিসি। ঠাকুমা আর বড়োপিসি দেওঘরে বাড়ি কিনেছেন, ওখানেই থাকবেন, আমরা বেড়াতে যাব। দেওঘর বেশ ভালো জায়গা।

দুপুরবেলা আমার মনখারাপ হয়। হোম-ওয়ার্ক করি একটু, বই পড়ি, পাজল করি, গেমস খেলি, খেলনা নিয়ে খেলি, কিন্তু একা একা পুতুল কিচেন সেট নিয়ে খেলে মজা হয় না। ও-বাড়িতে ছোড়দি, মিঠি, বেলি, মীরু সবাই ছিল। তাছাড়া আমার ঘরে অত জায়গাও নেই এখানে।

আমি খেলনা-টেলনা নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে আসি। দোতলায় শুধু আমরা, তেতলাটা বন্ধ, কেউ থাকে না। ওখানে ফ্ল্যাটের দরজাটায় আর পাশের বারান্দার দরজাটায় মস্ত তালা লাগানো। আর দোতলার ল্যান্ডিংয়ের পাশের দরজা খুলে বারান্দায় যাওয়া যায়। আমার মাথা অবধি উঁচু রেলিং, তাই বাবা বলেন সেফ, কিন্তু ওতে চড়া বারণ। আর মা বলেন, বারান্দায় না যাওয়াই ভালো। যাক গে, আমি রেলিংয়ের ওপর চড়তে চাইও না। ফাঁক দিয়ে বাইরেটা দেখি। কিচ্ছু দেখার নেই, সামনের চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো যাচ্ছে খুব জোরে, উঁচু বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি, শপিং সেন্টার, কাচের দরজা দেওয়া গম্ভীর সব দোকান। ঝকঝকে ফুটপাথ দিয়ে লোকজন হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে। গাছপালা নেই। ল্যান্ডিংয়ে ফিরে দেওয়াল ঠেস দিয়ে বসে আমি একটু খেলি, একটু বই পড়ি।

সেদিন দুপুরে কুসুমপিসি ঢ্যাঁড়সের তরকারি আর চিকেনের ট্যালটেলে স্টু রান্না করেছিল বলে আমার মেজাজ খারাপ হয়েছিল। একতলার রাধিকা আর পল্লবী দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের ভাষায় মানে তামিলে ডাকল, “ওয়ান্টু এঙ্কালু টানভিলাইয়া টুঙ্কাল?” বা ওইরকম কিছু। ওটার মানে বোধ হয়, ‘আমাদের সঙ্গে খেলবে?’ কিন্তু আমি মাথা নেড়ে না বললাম।

খেলনা, পুতুল, বই নিয়ে ল্যান্ডিংয়ের জানালাটার নীচে বসলাম। তারপর হঠাৎ চোখ তুলে দেখি, তিনতলায় ওঠার সিঁড়িটার বাঁকে আমার বয়সী একটা মেয়ে বসে হাসি হাসি মুখে আমায় দেখছে। হাঁটুর নীচ অবধি লম্বা ঢোল্লামতো ফুল ছাপা একটা ড্রেস পরে আছে, গলায় চওড়া কলার, কবজি অবধি হাতায় কুঁচি দেওয়া। মাথার চুলে লম্বা দুটো বিনুনি, লাল রিবন বাঁধা। কেমন যেন ছবি ছবি দেখতে। আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি একটু ইতস্তত করে উঠে গেলাম। বলতে যাচ্ছিলাম, ‘হাই,’ তার আগেই ও বলল, “আমার নাম মল্লিকা। তোমার নাম কী ভাই?”

“আমার নাম গৌতমী। তোমায় আগে দেখিনি তো! তিনতলায় নাকি কেউ থাকে না।”

“না। কিন্তু আমি আসি তো মাঝে মাঝে। আচ্ছা, তুমি এরকম ছেলেদের মতো প্যান্ট পরে আছ কেন গো? চুলগুলো এত ছোটো ছোটো কেন?”

কী বলব বুঝতে না পেরে বললাম, “এরকমই তো সবাইকার। তোমার মতো জামা পরতে কাউকে দেখিনি তো।” তারপরে বললাম, “এখানে তোমরা কবে এলে, মানে কখন?”

মল্লিকা সে-কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “কই, তোমার খেলনা দেখাও তো।”

আমি টুক করে নেমে গিয়ে আমার জিনিসগুলো নিয়ে এলাম। মল্লিকা সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। আমার বার্বিডল, কথা বলা পুতুল, কিচেন সেট, ছোট্ট পিয়ানো, স্ক্রিনওলা অঙ্ক শেখার আর ছবি দেখার কথা বলা খেলনা দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়েছে মনে হল।

“তোমার এরকম টয় নেই বুঝি?”

মল্লিকা মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্‌, আমার বৌ-পুতুল ছেলে-পুতুল আছে, তাদের জামাকাপড় পুঁতির গয়না আছে, রান্নাবাটির এইটুকু-টুকু বাসন আছে।”

আমার খুব অবাক লাগল। কিন্তু বললাম, “এসো আমার খেলনা নিয়ে খেলি।”

তেতলার ল্যান্ডিংয়ে বসে খুব জমিয়ে খেললাম আমরা। ওর এক-একটা কথা শুনে এত মজা লাগছিল! ও নাকি টিভি কখনো দেখেনি, সেল ফোন কী জানে না। মুভি দেখে কি না জিজ্ঞেস করতে প্রথমে বোঝেনি। তারপর বলল, একবার ‘বায়স্কোপ’ দেখেছিল। ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু ওকে খুব ভালো লাগছিল আমার।

মার আসার সময় হয়ে গেছে বলে উঠে পড়লাম। মল্লিকা বলল, কাল আবার এইখানে খেলব আমরা। আর বলল, কাউকে যেন না বলি ওর কথা। বললে আর ও আসতে পারবে না। ভাবলাম, ওদের বাড়ি বোধ হয় খুব কড়া। আমার স্কুলের বন্ধু শ্রাবন্তীর মতো, ওকে ওর মা-বাবা খেলতেই দেয় না কারো সঙ্গে।

এমনিভাবে দুপুরবেলা খেলতাম আমরা। গল্প করতাম। আমি ওকে বলতাম স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা, সিনেমা দেখার কথা। হাঁ করে শুনত। ওর পুতুলের বাক্স আনত, তাতে কাপড়ের পুতুল, সেলাই করা মুখচোখ, ফ্রক পরা নীল চোখ কাচের পুতুল, ওদের জামা, পুঁতির গয়না, তেঁতুল-বিচি (আগে কখনো দেখিইনি, কেমন লালচে কালো)।

ওকে বলতাম, “তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে এসো, টিভি দেখব, কম্পিউটারে গেম খেলব।”
ও মাথা নাড়ত। “না গো, তা হয় না।”
“আইসক্রিম খাবে? কেক? আজ ফ্রিজে কালকের পিৎজা আছে।”
“ওসব আমাদের খেতে নেই যে।”
“মল্লিকা, তুমি স্কুলে পড়ো না?”
ও চুপ করে থাকত।

একদিন কুসুমপিসির মোবাইলটা চুপিচুপি নিয়ে এসেছিলাম মল্লিকাকে দেখাতে। ওমা, ওটা কেমন অফ হয়ে গেল নিজে থেকেই। কিছুতেই চালু হল না। কী জানি বাবা!

ওকে আমি বলছিলাম, আমরা আগে যে বাড়িতে সবাই মিলে থাকতাম, সেটা এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। চুপ করে শুনল। তারপর বলল, “এই বাড়িটা না, আগে সবটা আমাদের ছিল। তোমাদের বাড়িটার মতো সব্বাই মিলে থাকতাম। জেঠু-কাকারা, দাদু-ঠাম্মা, ভাইবোনরা সবাই। তারপর কী যে হল, এখন আর কেউ নেই।”

“কোথায় গেল সবাই? অন্য কোথাও?”
“কী জানি।”
“তুমি তাহলে কোথায় থাকো? কাদের সঙ্গে?”
মল্লিকা ছলছল চোখে বলে, “আমি জানি না। এইসব জিজ্ঞেস করলে আমায় চলে যেতে হবে আবার।”
“না না, যেও না। কিন্তু তুমি কি এখানে একা একা থাকো? কী করে আসো? মানে, আমরা তো ছোটো তাই না? মা আমাকে একা একা কোত্থাও যেতে দেন না।”

মল্লিকা জানালাটা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। দেখি ওর চোখের কোণে জল। ভারি মায়া হয়। আমি তাড়াতাড়ি ওর হাতটা ধরে বলি, “তুমি কষ্ট পেও না মল্লিকা, আমি আর তোমায় কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না। তুমি বরং তোমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির গ্রামের সেই গল্পগুলো বলো।”

ওই গল্পগুলো ভীষণ ইন্টারেস্টিং লাগে আমার। মল্লিকা বলে, চড়কের মেলা বসে সেই গ্রামে, নাগরদোলা আর বেলুন-বাঁশি আসে। তেলেভাজা আর মাটির পুতুল আর চিনির মঠ বিক্রি হয়। সার্কাসের তাঁবু পড়ে শীতকালে। তখন বাঘের ডাক শোনা যায়। খুব ভোরে উঠে ঠান্ডা খেজুরের রস খেতে হয়। সেই গ্রামে অন্ধকার হলেই শেয়াল ডাকে। রাক্ষসীতলার মাঠ দিয়ে সন্ধ্যা হলে কেউ যেতে চায় না, ওখানে নাকি ভূতেদের দেখা যায়। পুরোনো মন্দিরে মানুষজন পুজো দিতে আসে চাল-কলা আর জবা ফুল নিয়ে, মা কালীর কাছে চাইলে নাকি সব পাওয়া যায়। জঙ্গলে বেদেরা এসে সাপ ধরে।

এসব আমার কেমন রোমাঞ্চকর ফেয়ারি টেলসের মতো লাগত। কিছুটা বুঝতাম আবার কিছুটা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত।

একদিন আমি বললাম, “জানিস মল্লিকা (ততদিনে আমারা তুই-তুই করে কথা বলি), ভাগ্যিস তুই আছিস, নইলে আমার যে কী একা একা লাগত।”

মল্লিকা আমার একটা বার্বিডলের গলায় ওর নিজের বাক্সের একটা নীল-লাল পুঁতির মালা পরাতে পরাতে বলল, “জানি, তাই তো আসতে পারলাম।”

কথাটা একটু কীরকম যেন লাগল। কিন্তু মল্লিকার অনেক কথাই একটু অদ্ভুত। বললাম, “বাইরেটা কী বিচ্ছিরি, শুধু উঁচু উঁচু বাড়ি আর রাস্তায় গাড়ি চলছে, গাছ-টাছ কিচ্ছু নেই।”

মল্লিকা ঘাড় হেলিয়ে আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বলল, “আছে তো। অনেক গাছ। অত বাড়িও নেই।”
বললাম, “দূর, কী যে বলিস।”
মল্লিকা বলল, “আয় দেখাচ্ছি।”

আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তেতলার বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খুলল। অবাক হয়ে দেখলাম তালা-টালা কিচ্ছু নেই। আর বারান্দায় গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। সামনের রাস্তাটা মোটেই চওড়া নয়, কেমন যেন এবড়োখেবড়ো। লোকজন হাঁটছে, ঠেলাগাড়ি, সাইকেল-রিকশা (দেওঘরে দেখেছি), ছবিতে দেখা হুডওলা একটা গাড়ি ভেঁপুর মতো হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। রাস্তার খানিকটা পেছনে একটা খুব বড়ো পুরোনো বাড়ি, থামগুলো কেমন চটা-ওঠা, গেটের ওপর দু-দিকে ভাঙাচোরা সিংহের মূর্তি। মনে হল একটা মুভিতে এরকম দেখেছিলাম। রঙিন কাচ দেওয়া জানালাগুলোও ভেঙে গেছে অনেক। আর কত্ত গাছপালা চারদিকে, কী সবুজ!

মল্লিকা বলল, “দেখেছিস গৌতমী, ওটা দত্তদের বাড়ি। ওরা না, জমিদার ছিল। আর ওই দেখ, ওটা হচ্ছে হাঁস-পুকুর, দ্যাখ কতো হাঁস!”

সত্যিই যেখানে শপিং মলটা থাকার কথা, সেখানে একটা মস্ত পুকুর। অনেক হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে, এখান থেকেও ওদের প্যাঁক প্যাঁক দিব্যি শোনা যাচ্ছে। ও-পাশে সিঁড়িতে কারা যেন। কেউ কেউ পুকুরে চান করছে, কেউ জল নিচ্ছে। ছোটো ছোটো বাড়িঘর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে। রাস্তার ও-ধারে ছোটো ছোটো ঝুপড়িমতো দোকান। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বললাম, “মল্লিকা, দোতলার বারান্দা থেকে এসব দেখা যায় না তো! অন্যরকম। এটা কী করে দেখছি রে!”

“দুটোই আছে তো! আমি দেখালাম তোকে, তাই এটা দেখলি।”

মল্লিকা আবার আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। কেমন যেন মাথা ঘুরছিল। মল্লিকা হেসে বলল, “অত ভাবছিস কেন! সবকিছুই তো একেক সময় একেকরকম, তাই না?”

মুহূর্তের জন্য মনে হল মল্লিকা যেন আমার থেকে অনেক বড়ো একটা মেয়ে, বড়দি কিংবা ছোটো পিসির মতো। তারপরে আবার সব আগেকার মতো।

দোতলার দরজা থেকে কুসুমপিসি ডাকছে, “খুকি! কোথায় তুমি!”
খেলনা পুতুল-টুতুল বাক্সে গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। দেখি মা এসে গেছেন। বললেন, “কোথায় ছিলি?”
“ওই তো, সিঁড়ির ওপরে। খেলছিলাম।”
“একা একা?”
ঢোঁক গিলে বললাম, “হ্যাঁ তো।”

মা আর কিছু বললেন না। খুব খুশি খুশি আর এক্সাইটেড লাগছিল মাকে। আমাদের নতুন বাড়ি নাকি রেডি। আজ বুধবার, শনিবার আমরা চলে যাব। আমাদের বেশিরভাগ ফার্নিচার গুদোমে রাখা ছিল, সেসব ওখানে চলে গেছে। কাল-পরশু মা ছুটি নিয়েছেন, সবাই মিলে প্যাক করা হবে। কাল থেকে স্কুল থেকে ফিরে নিজের জিনিস গোছাতে হবে আমায়, খেলা-টেলা চলবে না। আমি ভাবলাম, তাহলে আমি মল্লিকার সঙ্গে দেখা করব কী করে! গুড বাই বলতেও পারব না! মা সারাক্ষণ থাকবেন, কুসুমপিসি ঘুমোবে না, আমাকে কেউ বেরোতেই দেবে না তো।

শুক্রবারে দারুণ হই-হট্টগোল হচ্ছে। লোকজন এসে খাট-আলমারি-ড্রেসিং টেবিল নামাচ্ছে, কুসুমপিসি বাসন-টাসন বাক্সে তুলছে, বাবার হাত থেকে পড়ে ফুলদানি ভেঙে গেছে… দুপুরবেলা সেই সময় আমি চুপিচুপি বেরিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে পা দিয়েছি, মা ঠিক ধরে ফেললেন।

“কোথায় যাচ্ছিস গৌতমী?”
“ওই ওখানে।”
“কী আছে ওখানে! সব তো বন্ধ, তালা দেওয়া।”
“ন্না…” হঠাৎ কেঁদে ফেললাম, “ওখানে মল্লিকা আছে, একবার বলে যাব না ওকে!”
“মল্লিকা আবার কে? রাধিকা-পল্লবীদের কেউ?”
সবটা বললাম। মা বিশ্বাস করলেন না। ওপরে নিয়ে আমায় দেখালেন, ফ্ল্যাটের দরজায় বারান্দার দরজায় পুরোনো মস্ত মস্ত তালা, ধুলো-ঝুল পড়েছে।

আমি বলেই যাচ্ছিলাম মল্লিকার কথা, ওর সঙ্গে রোজ দুপুরে খেলার কথা… কিছুতেই থামতে পারছিলাম না। ইস, মল্লিকা তো আমায় বলেছিল কাউকে না বলতে ওর কথা, কিন্তু আমি…

মা আমায় নীচে নিয়ে এলেন প্রায় জড়িয়ে ধরে। বাবা কম্পিউটার-ল্যাপটপ সব একটা বড়ো বাক্সে সাবধানে প্যাক করছিলেন। মা ডাকলেন বাবাকে, আমার ঘরে এলাম তিনজনে। জিনিসপত্র সব তোলা হয়ে গেছে, শুধু আমার খাটটা আছে। মা আমায় বসিয়ে বললেন, “দ্যাখো তো মেয়েটা কীসব বলছে।”

মনে হল মা ভীষণ উদ্বিগ্ন। বাবা সবটা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “ওরকম কি হয় মা? তোমার বন্ধু নিশ্চয় নীচে থেকে আসত।”

“না না, নীচে তো শুধু রাধিকারা থাকে। আর ফ্রন্ট ডোর তো লকড থাকে, দারোয়ানকাকু বসে থাকে। মল্লিকা তিনতলাতেই থাকে মাঝে মাঝে, ও বলেছে। আর কত গল্প বলেছে। আমায় তিনতলার বারান্দা দিয়ে দেখিয়েছে, সামনে দত্তদের ভাঙা জমিদার বাড়ি, আর হাঁস-পুকুর, কত গাছপালা, সামনে পানের দোকান, মিষ্টির দোকান আর রাস্তায় সাইকেল-রিকশা…।”

মা বললেন, “আচ্ছা হয়েছে, এবার একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক তো। ইস, গা-টাও একটু গরম হয়েছে দেখছি।”

আমার হঠাৎ ঘুম পাচ্ছিল। মা-বাবাদের নীচু গলার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়েই পড়লাম।

তারপরে তো আমরা নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। খুব সুন্দর বাড়িটা, গোলাপি রঙ, পিছনে একটু বাগান। মল্লিকার কথা আর বলিনি, মা-বাবারা জিজ্ঞেস করলেও না। শুধু দেখেছিলাম, আমার বার্বিডলটার গলায় সেই নীল-লাল পুঁতির মালাটা যেটা মল্লিকা পরিয়েছিল।

ও-বাড়িতে প্রথমদিনে রাত্তিরে ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। তেতলার সেই ল্যান্ডিংয়ে বসে যেন আমি আর মল্লিকা খেলছি আগের মতো। আমি বলি, ‘মল্লিকা, তোকে বলে আসতে পারিনি, সরি রে।’

মল্লিকা ওর লম্বা বিনুনি দুলিয়ে বলে, ‘তাতে কী?’

‘আর কি তোকে দেখব না?’

মল্লিকা ওর পুতুলকে একটা সবুজ শাড়ি পরাতে পরাতে একটু ভেবে বলে, ‘কী জানি। যদি তোর আবার খুব একা একা লাগে, মনখারাপ হয়, তাহলে হয়তো আসব, কেমন? এখন আয় খেলি।’

স্বপ্নের মধ্যেই খুশি খুশি লাগে। আরো গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ি।

শীর্ষচিত্র-ইন্দ্রশেখর, ভেতরের ছবি- শিমূল

জয়ঢাকের গল্পঘর

10 thoughts on “গল্প-তেতলার বারান্দা- তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-বসন্ত ২০২১

  1. খুব সুন্দর গল্প। মল্লিকার পুতুলগুলো এখনও গ্রামের কুমোর পাড়ায় মেলে। কিন্তু বেশি কেউ সেসব বাড়ির বাচ্চাদের কিনে দিতে আগ্রহী নন। ছোটবেলাটাই অনেক পাল্টে গিয়েছে। পাল্টে গিয়েছে জীবনযাত্রা। যাপন পদ্ধতি।

    Like

  2. বড়ো ভালো লিখেছো গো। একটু বয়স্ক গ্ৰামে বড়ো হওয়া মানুষ খুব ভালোভাবে তোমার গল্পের সঙ্গে রিলেট করতে পারবে। ছোটবেলায় ওগুলোই আমাদের খেলনা ছিল।

    Like

  3. আপনার কাহিনীতে এতগুলো সময়চিত্র আর ভিন্ন চরিত্রের মিশেল মেলে যে পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে যেতে হয়। কত সুন্দর ভাবে এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি মিলেমিশে একটি জীবনের খণ্ড মুহুর্তে এনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে হয় শেষ হয়েও শেষ নাই। কাহিনী চলছে, শুধু এই মুহুর্তে এইটুকুই হয়তো সামনে এলো…

    Like

  4. ভারি মিষ্টি গল্প। লীলা মজুমদারের গল্পের মতো খুব ভালো ভূত। ❤️🙏

    Like

Leave a reply to Sarmistha Ghose Cancel reply