গল্প-অ্যাংরি টমি ও অ্যানি-সৈকত ঘোষ-বর্ষা ২০২১

golpoanny o tomi

ইস্কুল থেকে ফেরার পথে অ্যানি দেখল, কুকুরটা ভট্টাচার্য্যকাকুর বাড়ির রোয়াকে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে কি না দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না, মটকা মেরেও থাকতেও পারে। এ এক মস্ত উপদ্রব হয়েছে। কোত্থেকে মস্ত বড়ো কুকুরটা এসে ঢুকেছে অ্যানিদের পাড়ায়! আর আস্তানা গাড়বি তো অন্য কোথাও গিয়ে গাড়, তা না, একেবারে ওদের বাড়ির গ্যারেজের সামনে এসে গ্যাঁট হয়ে বসেছে। ওখানেই থাকে সারাদিন, সারারাত। দিনের বেলায় এদিক ওদিক যায়, এর ওর বাড়ির সামনে থেকে এঁটোকাঁটা খায়। আবার এসে ঠিক ওদের গ্যারেজের সামনে বসে  থাকে। খুব বেশি হলে উলটোদিকের ভট্টাচার্য্যকাকুদের বাড়ির রোয়াক পর্যন্ত, ব্যস।

প্রথম যখন কুকুরটাকে বাড়ির আশেপাশে দেখা গেল, অ্যানি খুব একটা পাত্তা দেয়নি। রাস্তার কুকুর, তাও আবার নেড়ি। চেহারাও সেরকম আহামরি কিছু নয়। কুচকুচে কালো, তাতে সাদা বুটি। তবে আকারটা আর সাধারণ কুকুরের চেয়ে খানিকটা বড়ো। এরকম তো কতই আসে যায়, কে তার খেয়াল রাখে? কিন্তু দু-চারদিন পর থেকেই অ্যানি বুঝতে পারল ব্যাপারটা সিরিয়াস। কুকুরটা ওদের বাড়ির চারপাশেই ঘোরাঘুরি করে। অ্যানির দিকে তাকায় মাঝে মাঝে, তবে ওকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। সেদিন তো এক সাংঘাতিক কাণ্ড! মোড়ের রামুদার দোকান থেকে চিপস কিনে হেঁটে হেঁটে ফিরছে, ও-ব্যাটা ঠিক পিছু ধরেছে। কোনো মানে হয়! অ্যানি শুধু একবার বলেছিল, ‘যাহ্‌! ভাগ!’ তাতে ‘গররর’ বলে এমন ভয় দেখাল! অ্যানি আর খুব একটা ঘাটানোর সাহস পায়নি। একটা কালো বিচ্ছিরি দেখতে কুকুর, তার এত্ত দেমাক! ও বেজায় রেগে গিয়েছিল।

সেদিন স্কুল থেকে বাড়িতে এসেই কুকুরটাকে গেটের সামনে দেখে অ্যানি রেগে গেল। মাকে চিৎকার করে বলল, “মা! কুকুরটাকে বাড়ির সামনে থেকে তাড়াও, এক্ষুনি।”

মা বলল, “থাক না, ও তো কারো কোনো ক্ষতি করে না, বরং রাত্তিরবেলায় পাহারাদারির কাজ করে। মন্দ কী?”

“নো ওয়ে, আমি চাই না ও এ তল্লাটে থাকুক। ব্যস, এটা আমার কথা। ফাইনাল।”

“আই ক্যান ডু নাথিং ফর ইউ। আস্ক ইয়োর বাবা, ইফ হি ক্যান ডু এনিথিং।” মেয়ের চুলের ফিতে খুলতে খুলতে মা বলল।

অ্যানির খুব বিরক্ত লাগল ব্যাপারটা। অ্যানির সঙ্গে আজকাল মা-বাবা মাঝে মাঝেই ইংরেজিতে কথা বলে। বাবা বলে, “তুই তো বাংলা মাধ্যমের ইস্কুলে পড়িস, আজকাল সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। তুইও আমাদের সঙ্গে বল, চর্চা হয়ে যাবে।”

অগত্যা।

বাবা অফিস থেকে ফিরতেই অ্যানি হামলে পড়ল। বাবাও কুকুর ভয় পায়। ছোটবেলায় নাকি দু-দু’বার কুকুরের কামড় খেয়েছিল। দু-বার চৌদ্দটা করে মোট আটাশটা ইনজেকশন খেয়ে বাবার নাকি সারমেয়প্রেম চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। তাই হিল্লে একটা হবেই, এটা অ্যানির জানা।

“বাবা, আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ সামথিং আর্জেন্ট।”

“ইয়েস, মাই ডিয়ার। ডোন্ট হেসিটেট।”

“এই অসভ্য জানোয়ার, ইতরটাকে এলাকা ছাড়া করতে হবে। আই নিড ইয়োর হেল্প।”

বাবা চানাচুর দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিল। বাড়ির সামনে থাকা কুকুরটা নিয়ে অ্যানির অস্বস্তির বিষয়টা বাবার জানা ছিল। তাই অ্যানির কথা শুনে এক চামচ মুড়ি মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, “ঠিক তাই। কালই ভাগাব। তুই তো চুনোপুঁটি। আমি বাড়ির কর্তা, আমাকেও চোখ রাঙায়। একটু সম্মানটুকু দেয় না! ঘোর অন্যায়।”

আনন্দে অ্যানির চোখে জল চলে আসে। বাবার গলা জড়িয়ে বলে, “আমার বাবা সেরা বাবা।” তারপর খানিকটা দম নেয়। কী যেন ভাবে, তারপর বলে, “আচ্ছা বাবা, ওকে তাড়াবে কী করে?”

“তাই তো। আস্ক হেড অফিস। যদি কোনো এক্সক্লুসিভ আইডিয়া থাকে।”

হেড অফিস ওরফে অ্যানির মা তখন বাংলা সিরিয়াল দেখতে দেখতে চা-মুড়ি খাচ্ছিল। মেয়ে-বাপের কথা শুনে ‘ঢং’ বলে উঠে চলে গেল।

“হেড অফিস স্যারেন্ডার করেছে বাবা। তুমি প্ল্যান ভাবো।”

বাবা ভাবে। মেয়েও ভাবে। হঠাৎ তিড়িং করে লাফিয়ে বাবা বলে, “ইউরেকা! গট দ্য আইডিয়া।”

“পেয়েছ? পেয়েছ?” উত্তেজনায় কাঁপছে অ্যানি।

“ইয়েস।”

“হোয়াট!”

“গায়ে আগুন লাগিয়ে দেব।”

অ্যানি গোল গোল চোখে বাবার দিকে কটমট করে তাকায়। মেয়ের চোখমুখ দেখে বাবাও মিইয়ে যায়। তারপর কাতর স্বরে বলে, “নয়?”

“কিছুতেই নয়। আমি বাস্তুচ্যুত করতে দিতে রাজি, তাই বলে হত্যা? নৈব নৈব চ।”

“তবে তুই ভাব।”

অ্যানি ভাবে। বাবাও ভাবে। বাবা বলে, “বস্তায় ভরে তিস্তার জলে ফেলে দেব?”

“নো। এটাও জীবহত্যা। এসব গুন্ডাগিরি চলবে না।”

অনেক ভেবে-টেবে শেষপর্যন্ত ঠিক হল, গ্যারেজের গেটের সামনেটায় জল ঢেলে রাখা হবে। শীতের দিনে ভেজা জায়গায় নিশ্চয়ই কুকুরটি আর বসবে না।

এসব প্ল্যানিং যখন চলছে, এর মধ্যে দুটো মস্ত ঘটনা ঘটে গেছে। পরেরটা আগে বলছি। পাড়াপড়শিদের আদেখলাপনায় ও বাবা-মায়ের নীরব সমর্থনে কুকুরটির স্থায়ী আস্তানা হয়েছে অ্যানিদের গেটের সামনেই। সমবেতভাবে ওর নাম হয়েছে টমি। নামকরণ করেছেন স্বয়ং ভট্টাচার্য্যদাদু। উনি এ-পাড়ার বয়ঃজ্যেষ্ঠ, ওঁর কথা সবাই মানে।

প্রথম ঘটনাটা আরো সাংঘাতিক।

একদিন ধনেশকাকু আসেনি। ধনেশকাকু হল অ্যানির ভ্যানওয়ালা। রোজ ওর টোটো রিক্সাতেই অ্যানি ইস্কুলে যায়। আগে ভ্যান ছিল, এখন নতুন টোটো কিনেছে। তবে ওরা এখনো ধনেশকাকুকে ‘ভ্যানকাকু’ বলেই ডাকে।

যাই হোক, স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা মোটর সাইকেলে পৌঁছে দিয়েছিল। ফেরার সময় অ্যানি অন্য এক বন্ধুর টোটোতে ফিরছে। যেই না বাড়ির সামনে নেমেছে, অমনি সেই অ্যাংরি ডগ একেবারে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অ্যানির দিকে তেড়ে এল। অ্যানি একটা পাথর তুলেছে হাতে। ও মা! ভয়ডর নেই, আরো জোরে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে লাগল। ভাগ্যিস ভট্টাচার্য্যদাদু ছাদে ছিলেন, উনি টমি টমি বলে ডাকতেই কেঁউ কেঁউ করে সেদিকে ছুটে গেল। যাবার সময় মুখটা এমন করে অ্যানিকে দেখল, যেন বলতে চাইল, ওহে বালিকা, কেমন দিলাম!

যাই হোক, আগের কথায় ফিরে আসি। প্ল্যানমাফিক গ্যারেজের গেটে জল ঢালা হল। টমি মনঃকষ্টে গ্যারেজের সামনেটায় আসা বন্ধ করল ঠিকই, কিন্তু বাড়ির সামনে খোলা জায়গাটায় রাত কাটাতে শুরু করল। উফ্! কী বিটকেল কুকুররে বাবা, এ কি লাভ হল? ও তো এলাকাতেই রয়ে গেল! তবে অ্যানি একটা জিনিস লক্ষ করল, আজকাল কুকুরটা আর ওকে ভয় দেখায় না। বরং রামুদার দোকানে গেলে ল্যাজ নাড়তে থাকে।

একদিন অ্যানি সাহস করে একটা বিস্কুট ছুড়ে দিল। ও মা, সে কী আনন্দ! কৎ কৎ করে খেল। অ্যানি বুঝতে  পারে, ও বারান্দায় এলে টমিও ছুটে আসে। বিস্কুটের লোভে।

একদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে অ্যানি বাবাকে বলল, “জানো বাবা, টমি এখন আমার বন্ধু হয়ে গেছে? আমাকে বারান্দায় দাঁড়াতে দেখলে দৌড়ে ছুটে আসে। আমি বিস্কুট দিই। ও লোভে পড়ে আসে, না?”

“পশুদের লোভ নেই বাবু। লোভী হয় শুধু মানুষ। ও একটু পেটুক হতে পারে, হয়তো খেতে ভালোবাসে। তবে তুমি বললে না, ও তোমার বন্ধু হয়ে গেছে, সেই বন্ধুত্বের টান থেকেই হয়তো তোমার কাছে ছুটে ছুটে আসে। তোমার ওকে ভালো লাগে এখন?”

“হু। মায়া পড়ে গেছে।”

রাত গভীর হয়, বাবার গায়ের সঙ্গে আরো লেপটে আসে অ্যানি। “বাবা, আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।”

ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ধরছে এই আধা মফস্‌সল শহরটাকে। শুনশান একটা রাত্রি। গাঢ়। হঠাৎ একটা চাপা গোঙানির শব্দ। ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে অ্যানি।

বিছানায় উঠে বসতেই অ্যানি দেখল, বাবা দরজা খুলে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কেমন একটা খচরমচর শব্দ হচ্ছে। হয় চোর এসেছে, নয়তো কোথাও ভাম বেরিয়েছে। অ্যানি বারান্দায় বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়।

“কীসের শব্দ, বাবা?”

বাবা আঙুল দিয়ে দেখায়। রামুদার বাড়ির নারকেলগাছটার নীচ থেকে শব্দটা আসছে। কুয়াশার পরত আরো গাঢ় হয়েছে। আবছা অন্ধকারে দেখা গেল, টমি একটা ছেঁড়া কাগজের কার্টুনের বাক্সে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে।

“ওর খুব ঠান্ডা লাগছে, না বাবা?”

“হু। কেমন কাঁদছে দেখছিস না, কেঁউ কেঁউ করে।”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা করা যায় না!”

“যায়।”

বাবার নির্বিকার জবাবে পিত্তি জ্বলে গেল।

“আরে! যায়, তো করো। কিছু একটা করা যাক।” অ্যানি চিৎকার করে উঠল।

বাবা হাসল। তারপর অনেকটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘দিল্লি চলো’র ভঙ্গিমায় হাত তুলে বলল, “ফলো মি।”

তারপর সেই মাঝরাতে বাপে মেয়েতে হৈ হৈ কাণ্ড। তেতলার চিলেকোঠা থেকে খুঁজে-টুজে ভালো দেখে একটা প্যাকিং বাক্স জোগাড় করা হল। মায়ের আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজে দুটো পুরোনো বিছানার চাদরও পাওয়া গেল। তারপর প্যাকিং বাক্সে চাদর গুঁজে তৈরি হল গরম বিছানা। সেই বিছানা নিয়ে ওই ঠান্ডায় নীচে নামা হল।

বাড়ির সদর দরজার পাশে গ্যারেজের ছাউনির ঠিক নীচে বিছানা রেখে বাবা মোলায়েম স্বরে ডাকলেন, “টমি, টমি।”

টমি কী ভাবল কে জানে। খ্যাঁক করে গর্জে উঠল। বাবা একটু ঘাবড়ে গেলেন।

এবার অ্যানির পালা। “আয় আয়, তু তু।”

অভিমানী টমি মুখ ফিরিয়ে থাকে। একদিকে প্যাকিং বাক্স নিয়ে বাবা মেয়ে, অন্যদিকে অভিমানী একটি কুকুর। ওপরে ব্যালকনি থেকে মজা দেখছে মা।

সময় কেটে যায়। অবশেষে একটা সময়ে এসে টমির অভিমান ভাঙে। গুটি গুটি পায়ে লেজ নাড়তে নাড়তে অ্যানির সামনে এসে দাঁড়ায়। অ্যানির তখন সাহস হয়েছে। হাত বাড়িয়ে টমির মাথায় হাত রাখে। যদি কামড়ে দেয়? দেবে।

টমি অবশ্য কিছুই করে না। হাঁটু মুড়ে বসে লেজ নাড়তে থাকে, আর কেঁউ কেঁউ করতে থাকে। তারপর হঠাৎ নিজে গিয়ে প্যাকিং বাক্সটায় শুয়ে পড়ে। নরম বিছানায় আরামে আর কৃতজ্ঞতায় একবার ‘কোউউ’ করে হাঁক পাড়ে।

যাক, এবার নিশ্চিন্তি। বাবা আর মেয়ে, দুজনের মুখেই যুদ্ধজয়ের হাসি। ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসছেন মাও।

নরম বিছানায় বাবার গায়ের সঙ্গে লেপটে মেয়ে বলে, “বাবা, আদর করো।”

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা। বাবার বাহুডোরের নরম উষ্ণতায় ঘুমের বুড়িও এসে অ্যানিকে জড়িয়ে ধরে।

অলঙ্করণ- অংশুমান

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s