পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা– ফোচনের কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর , বাঘমামার বিয়ে, মাম্বোর শুঁড়
“ওয়াক থু! এসব আবার খাওয়া যায় নাকি? আমরা এসব মোটেই খাব না।” বলেই চারজন ছানা উঠে পড়ল খাবার ছেড়ে। বাঘিনীর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বাচ্চারা কিছু মুখে দিল না। মা এখন কী করে? কালকেই মিটিং করে পশুরাজ বলে দিয়েছেন, এখন থেকে জঙ্গলে শিকার করা বারণ। যতদিন না করোনা নামের কী এক জিনিস, সে যায় পৃথিবী থেকে, ততদিন সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং না কী ছাতার মাথা, তা মেনে চলতে হবে। সুতরাং শিকার করতে গিয়ে কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া চলবে না। তাহলে এখন সবাই খাবে কী? ‘কেন, গাছপালা!’ পশুরাজ সমাধান করে দিয়েছেন। বললেই হয় নাকি? সৃষ্টির শুরু থেকে বাঘ, সিংহ, শেয়াল, নেকড়েরা কোনোদিন ঘাসপাতা খেয়েছে নাকি? মহারাজ বললেন, “দ্যাখো, ব্যাপারটা যে সহজ নয় সেটা তো আমিও জানি, কিন্তু এখন উপায় কী? আগে তো করোনার হাত থেকে বাঁচতে হবে। আমার কাছে খবর আছে পৃথিবীর অনেক জায়গায় চিড়িয়াখানাতেও পশুরা করোনায় মারা যাচ্ছে।”
জঙ্গলে গাছে গাছে ‘শিকার করা বারণ’ পোস্টার লাগানো হয়েছে। ভুল করেও যেন কেউ কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে। এদিকে মাংসাশী পশুদের ঘরে ঘরে বাচ্চারা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মায়েরা পড়েছেন সমস্যায়। ইউটিউব দেখে তারা নানারকম নিরামিষ খাবার তৈরি করে দিচ্ছেন, কিন্তু বাচ্চারা সে খাবার মুখেও তুলছে না। পশুরাজের নিজের প্রাইড বা পরিবারেও একই অবস্থা। ওঁর তো অনেক গিন্নি, অনেক ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি। বাচ্চারা সব অনশন শুরু করেছে। পরিস্থিতি ক্রমশ বিগড়ে যাচ্ছে দেখে উনি সবক’টাকে ডেকে কড়া ধমক লাগালেন। ওঁর ওই বিশাল চেহারা, অত বড়ো কেশর আর ভারী গলার সামনে সকলে চুপ। ভয়ে ভয়ে ছানারা গাছ-পাতা, ফল মুখে তুলল। নাক-মুখ বিকৃত করে কোনোমতে খেতে লাগল অখাদ্য সব খাবার। পশুরাজ তারপর আদর করে কাছে ডেকে ওদের বোঝালেন, “দ্যাখো বাচ্চারা, এ এক কঠিন পরিস্থিতি। এই সময় সবচেয়ে জরুরি হল সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। পরিস্থিতির সঙ্গে যারা মানিয়ে নিতে পারে তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকে। এই মানিয়ে নেওয়াকেই মানুষরা নাম দিয়েছে এডাপটেশন।”
পরদিন জঙ্গলে একটা মিটিং ডেকে সকলকে এই একই কথা বললেন তিনি।
শুধু ছোটো কেন, বড়োদেরও করুণ অবস্থা। এক লেপার্ডমশাই ভোর রাত্তিরে একটা হরিণ মেরে এনেছিলেন। বাড়ি ফিরতেই গিন্নি সাংঘাতিক চেঁচামেচি, বকাবকি শুরু করেন। সেই হরিণকে তো ফেলে দিতেই হল, লেপার্ডবাবুও ভালো করে চান করে তবে গুহায় ঢোকার অনুমতি পেলেন। ভেতরে ঢুকতে আরও একপ্রস্থ বকুনি, “তোমার কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই? বাড়িতে ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে, তুমি কি বাড়িতে করোনা না এনে ছাড়বে না?”
শিকার বন্ধ হওয়ায় হরিণ, জেব্রা, জিরাফ, খরগোশ এরা খুব খুশি হয়েছিল। যাক, এবার কিছুদিনের জন্য অন্তত নিশ্চিন্ত। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টিকল না। এতদিন যারা ছিল প্রেডাটর, তারা এখন হয়ে গেল কমপিটিটর। ফলমূল-লতাপাতার জন্য এখন তারাও এসে লাইন দিচ্ছে। তবে সমস্যাটা ওদেরই বেশি। একে তো গাছপালা কী খাওয়া যায় না যায় ওরা অত জানে না, তারপরে যেখানেই যায় সেখানেই দেখে তৃণভোজীরা আগে পৌঁছে গেছে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে এক এক করে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতদিন যারা তাদের ভয় পেত, এখন তারা চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই আস্পর্ধা কি সহ্য করা যায়?
শুধু তো ফলমূল, ঘাস-পাতা সংগ্রহ করলেই হবে না, সেগুলোকে আবার রানিং ওয়াটারে ধুতেও হবে। রানিং ওয়াটার বলতে তো ওই একটা নদী আর দুটো ঝরনা। সেখানেও লম্বা লাইন হচ্ছে। শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বড়ো বড়ো পাতার চাহিদা বেড়েছে মাস্ক বানানোর জন্যও। খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে শুধু বাঘ-সিংহের মতো বড়ো মাংসাশী পশুদের নয়, যারা পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ ধরে খায় তাদেরও। আর শুধু তো খাওয়ার সমস্যা নয়, কোয়ারেন্টিন ব্যাপারটাও খুব কষ্টকর। একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা সব বন্ধ। ওই খাবার সংগ্রহ করার সময় যেটুকু দেখা, তাও দূর থেকে মাস্কের ভেতর থেকে কথা বলা।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট বাচ্চাদের। স্কুলগুলো সব বন্ধ, অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু শিকার ধরার ট্রেনিং কি আর অনলাইনে হয়? তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই, খেলাধুলো বন্ধ। বাড়িতে বন্দি থেকে তারা অস্থির হয়ে যাচ্ছে। দুষ্টুমি আরও বেড়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা নাজেহাল। সবারই মুখে এক কথা, ‘উফ্, স্কুলগুলো যে কবে খুলবে!’
তবে মানুষের মতো পশুরাও অভ্যেসের দাস। আস্তে আস্তে সবই অভ্যেস হয়ে গেল। আতঙ্কে আতঙ্কে একটা গোটা বছর কেটে গেল। এত সাবধানতার পরেও জঙ্গলে অনেকগুলো কেস ধরা পড়েছে। বেশ কিছু মৃত্যুও হয়েছে।
এদিকে গাছপালা খাওয়াটা এখন সবারই অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খেয়ে খেয়ে গাছপালার সংখ্যা ভীষণ কমে গেছে। বড়ো বড়ো বিশাল গাছেরা ঠিকই আছে, কিন্তু ছোটো গাছ, লতাপাতা প্রায় উধাও। ফলমূলেরও অভাব। জরুরি মিটিং ডাকলেন সিংহমশাই।
“বন্ধুরা, তোমরা সকলেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে খুব শিগগির আমরা খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে চলেছি। আমাদের অবিলম্বে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। নইলে করোনায় না মরলেও না খেতে পেয়ে নিশ্চয়ই মরে যাব।”
পরিকল্পনা মাফিক যে যার বাড়ির কাছে অনেকগুলো করে গাছের চারা বা ফলের বীজ পুঁতল। কয়েক মাস পরে সবুজায়ন প্রকল্পের সাফল্য চোখের সামনে দেখা দিল। সকলে বেজায় খুশি। নিজেদের হাতে গাছ পুঁতে সেই গাছকে বড়ো হতে দেখার যে কী আনন্দ তা ওরা প্রথম বুঝল।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা প্রফেসর হুক্কা-হুয়া ‘পেয়েছি, পেয়েছি!’ বলে চিৎকার করে, লাফিয়ে, আনন্দে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সে এক কাণ্ড। কী হল, কী হল করে সকলে ছুটে গেল প্রফেসরের ল্যাবরেটরির দিকে। একবছর ধরে কঠিন রিসার্চ করে প্রফেসর-সাহেব করোনার প্রতিষেধক বার করে ফেলেছেন। নোকো (নো করোনার শর্ট ফর্ম) ভ্যাক্সিনের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য সবচেয়ে আগে এগিয়ে এলেন হাতি পরিবারের দিদিমা। ওঁকে দেখে সাহস করে আরও প্রায় শ-খানেক পশুপাখি এগিয়ে এল। তিন দফা ট্রায়ালের পরে অবশেষে সেই শুভদিন এল। সম্মানে আর বয়সে, দুয়েই সবার চেয়ে বড়ো বলে পশুরাজ সিংহই সবার আগে নিলেন নোকোর প্রথম ডোজ। প্রফেসর হুক্কা-হুয়া নিজে দাঁড়িয়ে থেকে টিকাকরণ প্রক্রিয়ার তদারকি করছিলেন। এদিকে ওঁর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ওঁর ল্যাবে এখন শয়ে শয়ে নোকোর প্রোডাকশন চলছে। পৃথিবীর অন্যান্য জঙ্গল থেকেও টিকার আবেদন এসেছে। তবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে নিজেদের সবার টিকা নেওয়া হলে তবেই একমাত্র অন্য জঙ্গলে টিকা পাঠানো হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই জঙ্গলের সমস্ত পশুপাখির দুটো করে ডোজ নেওয়া হয়ে গেল।
জঙ্গলের সবচেয়ে বড়ো গাছের নীচে আবার মিটিং ডেকেছেন পশুরাজ। “বন্ধুরা, করোনাকে আমরা জয় করে ফেলেছি। গত কয়েক মাসে আমাদের কোনও নতুন কেস নেই আর এখন তো আমরা সকলেই প্রতিষেধক নিয়ে নিয়েছি। তাই এখন থেকে আবার আমরা আমাদের নিজেদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ফিরে যাব। অর্থাৎ, জঙ্গলে আবার শিকার শুরু।”
পশুরাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই হরিণ-টরিনের দল একে একে মিটিং ছেড়ে কেটে পড়তে লাগল।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
Fantastic . Chhoto der moner moto. Boro ra o khub enjoy korben.
LikeLike