এইলেখকের আগের গল্প কৃপণের বামমুঠি, দহনভার
রাস্তায় আসতে আসতে পারুলদি তাকে বুঝিয়েছিল, “তোকে যে-বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি দিদিমণিটা ভালো, বুঝলি। পছন্দ হলে তোকে মাথায় করে রাখবে। একটাই সমস্যা, মাঝেমধ্যে হঠাৎ মাথা গরম করে ফেলে। ওইটুকু মানিয়ে-সানিয়ে চলতে পারলে তোর আর কোনও চিন্তা নেই৷”
পারুলদি ভালো জানবে, কারণ সে এ-বাড়িতে একসময় প্রায় বছর খানেক কাজ করেছে। তবু আটতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে পারুলদি যখন বিশাল মেহগনি কাঠের দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজাল, সে দেখল তার বুক ঢিপঢিপ করছে। দিদির যদি তাকে পছন্দ না হয়!
একটা ঢিলেঢালা সবুজ কাফতান পরে মিষ্টি মতন দেখতে যে দিদিটা দরজা খুলল, তাদের দেখে তার মুখে হাসির আলো জ্বলে উঠল। বলল, “পারুলদি, তুমি? সঙ্গে এটি কে? এর কথাই বুঝি বলছিলে? এসো, ভিতরে এসো।”
ভিতরে ঢুকে পারুলদি অসংকোচে দামি সোফায় বসে পড়ল। তাকেও বসতে বলল, কিন্তু সে সংকোচ ভরে দাঁড়িয়েই রইল। দিদিটা উলটোদিকের সোফায় গিয়ে বসেছে। পারুলদি তার পিঠে হাত রেখে বলল, “হ্যাঁ গো দিদি, এর কথাই বলেছিলাম। গাঁয়ে আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। খুব লক্ষ্মী মেয়ে, ক্লাস এইট অবধি পড়াশুনোও করেছে। বাবা জুট মিলে কাজ করত, সে অনেকদিন হল বন্ধ। ঘরে বসে ছিল, তাই তোমার কাছে নিয়ে এলাম। এখন দ্যাখো তোমার যদি পছন্দ হয়।”
সে টের পেল, দিদিটা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার জ্যালজেলে পুরোনো জামা, একমাথা তেল না পড়া রুক্ষ চুল, ফাটা ফাটা হাত-পা—এসবই দেখছে। তার আফসোস হল, ইস্, যদি তার একটা ভালো পোশাক থাকত। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দিদিটা (সে পরে জেনেছে দিদিটার নাম পারমিতা) বলল, “তা কাজের ব্যাপারে একে কিছু বলেছ?”
পারুলদি এক মুখ হেসে বলল, “তুমি নিজেই বলে দাও না গো দিদি।”
দিদিটা এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, “অ্যাই মেয়ে, এদিকে আয়। তোর নাম কী?”
সে গুটি গুটি দিদির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, “আমার নাম ঈশ্বরী।”
“বাহ্, সুন্দর নাম।”
দিদিটা হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরেছে। সে টের পেল, দিদির শরীর থেকে মিষ্টি ও হালকা একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে। দিদিটা এবার বলল, “শোন, আমার রান্নার আর ঠিকে কাজ করার জন্য লোক আছে। তোকে ওসব কিছু করতে হবে না। তুই খালি বাবাইকে দেখবি। আমি সকালে বেরিয়ে গেলে ওকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসবি, আবার দুপুরে স্কুল থেকে নিয়ে আসবি। সারাদিন ওর সঙ্গে থাকবি, গল্প-টল্প করবি। বিকেলে একটু পার্কে নিয়ে যাবি। তারপর আমি সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে এলে তোর ছুটি। আবার রাতে খাবার-টাবার একটু গরম করে দিবি।”
সে বিশেষ কিছু না বুঝেই ঘাড় নাড়ল। পারুলদি ওদিক থেকে বলল, “ও পারবে গো দিদি, তুমি খালি একটু দেখিয়ে-টেখিয়ে দিও।”
দিদি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
এই সময় বেল বাজল। দিদি উঠে দরজা খুলে দিল। একটি মেয়ে, বোধ হয় বাইশ-তেইশ বছর বয়স, পরনে সস্তার সালোয়ার-কামিজ, হাতে একটা কালো পার্স, ঘরে ঢুকে তাদের একবার দেখল, তারপর ভিতরে চলে গেল। দিদি বলল, “একে আয়া সেন্টার থেকে দিয়েছে। মাস খানেক থেকে ওর কাছেই বাবাইকে রেখে যাচ্ছি। আমি অফিস থেকে এলে চলে যায়।” তারপর গলা তুলে বলল, “সন্ধ্যা, বাবাইকে নিয়ে একবার এসো।”
একটু পরে সন্ধ্যা বছর চারেকের একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে এসে দাঁড়াল। বাচ্চাটা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকেই দেখছে।
দিদি বলল, “সন্ধ্যা, এ হল ঈশ্বরী। ও এখানে থাকবে আর বাবাইকে দেখবে। তুমি আজকের দিনটা ওকে কাজ-টাজ সব দেখিয়ে দাও। তোমার টাকাটা আমি সেন্টারে পাঠিয়ে দেব। কিছু বেশিই দিয়ে দেব।”
মেয়েটির মুখে চকিতে একটা কালো ছায়া পড়ে সরে গেল। তারপর সে ঘাড় নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, দিদি।”
বাচ্চাটা ইতিমধ্যে কোল থেকে নেমে পড়েছে। কী ভেবে সে হাত বাড়াতে গুট গুট করে দিব্যি তার কাছে চলে এল। সে কোলে নেবে কি না ভাবছিল। তার আগেই দিদি হেসে উঠে বলল, “বাহ্, বাবাইর তোকে পছন্দ হয়ে গেছে দেখছি। খুব ভালো। তবে তুই রাস্তার জামাকাপড়ে ওকে কোলে নিস না৷ আগে ভিতরে বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে চান-টান করে নে। আজকে সারাদিন সন্ধ্যা তোকে বাবাইর কাজকর্ম সব বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দেবে৷ আমি একটু পরে বেরিয়ে যাব। আয় তোর ঘরটা তোকে দেখিয়ে দিই।”
দিদি তাকে যে ঘরটায় নিয়ে গেল, সেটা ঠিক সিনেমার ঘরের মতো সাজানো-গোছানো। ধবধবে সাদা চাদর আর বালিশ দেওয়া একটা সিঙ্গল খাট, মাথার ধারে একটা টেবিল। তাতে একটা ঘড়ি আর টুকটাক জিনিস রাখা। একদিকের দেওয়ালে আগাগোড়া কাঠের কাজ করা। একটা ড্রেসিং টেবল, একটা আলমারি সব ফিট করা আছে৷ সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম। দিদি দরজা খুলে তাকে দেখাল। সে দেখল, ভিতরে কাচের সেলফে তেল, সাবান, শ্যাম্পু সব রাখা আছে৷ দেখেই বোঝা যায় সব দামি দামি জিনিস। এসব কি তার জন্য? এই ঘরে সে থাকবে? তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না।
পারুলদি একটু পরে চলে গেল। একটু পরে সাজগোজ করে কাঁধে একটা চ্যাপটা কালো একটা ব্যাগ (সে পরে জেনেছে ওর মধ্যে দিদির অফিসের কম্পিউটার থাকে) নিয়ে দিদিও বেরিয়ে যেতে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। ওরই মধ্যে সন্ধ্যা বাবাইর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে একটা ডিমসেদ্ধ আর একটা কলা তাকে খাইয়ে দিল। হেসে বলল, “দেখে রাখো, কাল থেকে এই কাজটা তোমাকেই করতে হবে৷”
সন্ধ্যা মেয়েটি খারাপ নয়। তার সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গেল। বলল, “জানো, আমি দিদিকে বলেছিলাম আমি আয়া সেন্টারের কাজ ছেড়ে দেব, আমাকে বাবাইর জন্য রেখে দাও। লোকের নোংরা ঘাঁটতে আর ভালো লাগে না৷ কিন্তু দিদি রাজি হল না। বলল, তোমার ওই পারুলদির সঙ্গে কথা হয়েছে, জানাশোনা কাউকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসবে। তোমার কথাই বলেছিল।”
এরপর সন্ধ্যা বাবাইকে স্নান-টান করিয়ে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে দিল, দশটা নাগাদ নীচে নিয়ে গেল। সেও সঙ্গে গেল। অবাক হয়ে দেখল, দরজাটা টেনে দিতেই বন্ধ হয়ে গেল। একে নাকি এল লক না কী বলে। সন্ধ্যা বলল, “চাবি না নিয়ে কক্ষনও বেরিও না, তাহলে দরজা ভাঙতে হবে৷”
সারাদিন সন্ধ্যা আর বাবাইর সঙ্গে কেটে গেল। বিকেলে পার্কে গিয়ে দেখল সন্ধ্যার মতো আরও কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। সব বাচ্চাগুলো মিলে হুটোপুটি করে খেলছে।
সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দিদি বলল, “তুই সব দেখে নিয়েছিস তো? তাহলে কাল থেকে ওকে আসতে বারণ করে দিই?”
একটু ভয় ভয় করলেও সে ঘাড় নাড়ল। দিদি উঠে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো মোবাইল বার করে তার হাতে দিয়ে বলল, “এই নে, এটা তোর। আমি অফিস থেকে মাঝেমধ্যে ফোন করব। তোর যদি কোনও দরকার হয় তুইও আমাকে করতে পারিস, আমার নম্বর সেভ করা আছে। মোবাইল ইউজ করতে পারিস তো?”
তার নিজের ফোন নেই, কিন্তু বাড়িতে বাবার সস্তার একটা আছে। বাবা মাঝেমধ্যে তাতে পয়সা ভরে দেয়। সেটাই তারা সবাই ব্যবহার করে। সে ঘাড় নাড়ল।
কয়েকদিনের মধ্যেই সে সারাদিনের কাজে মোটামুটি সড়গড় হয়ে গেল। বাবাই খুব বেশি ঝামেলা করে না, খালি খাওয়ার সময় একটু গল্প-টল্প বলে খাওয়াতে হয়। ওটুকু তো সব বাচ্চাই করে। এছাড়া সকালে স্কুলে আর বিকেলে পার্কে খেলতে যাবার সময় তার মহা উৎসাহ, তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। দিদি চলে আসে সাতটা নাগাদ। দিদিকে চা-টা দিয়ে কিছুক্ষণ তার ছুটি। সে বাইরের ঘরে বসে টিভিতে সিরিয়াল-টিরিয়াল দেখে৷ ন’টা নাগাদ উঠে সে ফ্রিজ থেকে খাবার-দাবার বার করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে। প্রথমে বাবাইকে খাওয়ায়। খেয়েদেয়ে বাবাই শুয়ে পড়লে সে আর দিদি খেতে বসে। প্রথম দিন দিদির সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে তার খুব লজ্জা করছিল। দিদি ধমক দিয়ে তাকে বসিয়েছিল। ধীরে ধীরে তার লজ্জা কেটেছে। দিদি তাকে বলেছে, নিজেকে কাজের লোক ভাববি না, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবি। খাওয়াদাওয়ার পর সে এঁটো বাসন জল দিয়ে বেসিনে নামিয়ে রাখে। ডাইনিং টেবিলটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দেয়। তারপর নিজের ঘরে চলে যায়।
ফোনটা পেয়ে তার খুব সুবিধা হয়েছে। রোজ রাতে সে বাবার ফোনে ফোন করে মার সঙ্গে কথা বলে। দিদি বলেছে, “তুই যত ইচ্ছে ফোন করতে পারিস।”
বিকেলে পার্কে তার মতো আরও কয়েকজন মেয়ে তাদের বাড়ির বাচ্চাকে নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে। তবে এরা বেশিরভাগই পাশের বস্তিতে থাকে। সকালে কাজে এসে আবার সন্ধ্যায় চলে যায়৷ এদের কাছেই সে শুনেছে, দিদির বর জাহাজে চাকরি করে, অনেকদিন পর পর বাড়ি আসে। এদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় অমন সুন্দর সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে সারাদিন একা একা থাকে বলে এরা তাকে একটু হিংসেই করে৷
মাস গেলে দিদি তাকে মাইনে দিল। টাকার অঙ্কটা দেখে সে অবাক। তার মুখ-চোখ দেখে দিদি হাসছিল। বলল, “কী করবি মাইনের টাকা দিয়ে?”
সে আস্তে আস্তে বলল, “বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।”
তাদের গ্রাম সুন্দরবনে গোসাবার কাছে। বাস, নৌকা আর ভ্যান-রিকশা করে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। গেলে অন্তত দুটো দিন ছুটি নিয়ে যেতে হয়। তার খুব ইচ্ছে করছিল গিয়ে নিজের হাতে মাকে তার প্রথম রোজগারের টাকা দিয়ে আসে, কিন্তু এখনই ছুটির কথা বললে দিদি রাগ করবে কি না বুঝতে পারছিল না। দিদি নিজে থেকেই বলল, “এক কাজ কর। এই রবিবার সকালে তোর মাকে আসতে বল। এখানেই খাওয়াদাওয়া করবে, মেয়ে কোথায় আছে বাড়িটাও দেখে যাবে।”
সেইমতো মা চলেও এল। ফ্ল্যাট আর বিশেষ করে ঈশ্বরীর জন্য আলাদা ঘর দেখে তার চোখ ছানাবড়া। বার বার করে বলতে লাগল, “দিদিমণির সব কথা শুনে চলিস মা, তেনার যেন কোনও অসুবিধা না হয়।” খেয়েদেয়ে যাবার সময় দিদির দুই হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “পারুর কাছে শুনেছি তুমি খুব ভালো মেয়ে মা, আমার মেয়েটাকে একটু দেখো।”
মার কাণ্ড দেখে দিদি হাসছিল। বলল, “তুমি কিছু ভেবো না, ও আমার কাছে বাড়ির মেয়ের মতোই থাকবে।”
এইভাবে চলতে লাগল। বিকেলে পার্কে তাদের এখন একটা দল হয়ে গেছে। বাচ্চারা যখন খেলে, তারা নজর রাখে, আর ওর মধ্যেই টুকটাক গল্প চালিয়ে যায়। যে-যার বাড়ির গল্প। তার দিদির ব্যাপারে জানতেও অন্যদের খুব আগ্রহ। সে অবশ্য দিদি জানলে রাগ করতে পারে ভেবে বেশি কিছু বলে না। এরা তাও ছাড়ে না। বলে, “দেখিস বাপু, তোর দিদিকে সামলে চলিস। শুনেছি রাগলে নাকি মাথার ঠিক থাকে না৷”
এসব শুনলে তার বিশ্বাস হয় না, আবার ভয়ও করে। দিদি তো এমনিতে তাকে মাথায় করে রাখে। কোনোদিন রাগ হলে কি হঠাৎ তাকে ছাড়িয়ে দেবে?
তিন মাসের মাথায় সে কাজে একটা ভুল করল। বাবাই স্কুল থেকে এলে সে তার স্কুলের ড্রেস খুলে কাচতে নামিয়ে দেয়। একদিন তাড়াহুড়োয় পরে দেবে বলে সরিয়ে রেখেছিল, ভুলে গেছে। ইস্ত্রি করতেও দেওয়া হয়নি। দু-দিন পরে সকালে মাথায় হাত, স্কুলে যাবার কাচা ড্রেস নেই। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে দিদিকে ফোন করল। ফোনে সে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। দিদি তার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। বলল, “আমার বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে আলমারিটা খোল। ওখানে আরও দু-সেট ইউনিফর্ম আছে।”
ঘাম দিয়ে তার জ্বর ছাড়ল।
সেদিন রাতে মাকে ঘটনাটা বলায় মা খুব রেগে গেল। বলল, “পারুল এত ভালো কাজ জোগাড় করে দিয়েছে, তাও কাজে ভুল করিস। দিদি রাগ করলে কী হত!”
কিছুদিন পরে দিদির বর এল। ছুটিতে নয়, কলকাতায় হেড অফিসে কিছু কাজ জোগাড় করে দু-দিনের জন্য চলে এসেছে। বাবাইর জন্য অনেক খেলনা আর চকোলেট নিয়ে এসেছে। তাকেও একটা বিশাল ক্যাডবেরি দিল। বলল, “বাড়িতে নিয়ে যাস।”
এই দুটো দিন খুব হইহই করে কাটল। দিদি অফিস থেকে দু-দিন ছুটি নিয়েছে। একদিন তারা সবাই মিলে গাড়ি করে কোলাঘাট বলে একটা জায়গায় বেড়াতে গেল। সেখানে নদীর ধারে পিকনিক হল। আর একদিন তাকে বাড়িতে রেখে দাদা আর দিদি বাবাইকে নিয়ে রাতে বাইরে খেতে গেল, তার জন্য খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে এল। এত ভালো খাবার সে জীবনে খায়নি। ভাইটার কথা খুব মনে হচ্ছিল।
দাদা চলে যেতে আবার যে-কে-সেই। এরই মাঝে এক ফাঁকে সে বাড়িতে ঘুরে এল। দিদিকে ভয়ে ভয়ে বলেছিল। দিদি বলল, “তুই রবিবার গিয়ে সোমবার রাতে ফিরে আয়। সোমবারটা আমি ছুটি নিয়ে নেব।”
বাড়িতে তাকে দেখে বাবা আর ভাই খুব খুশি। মা অবশ্য খুঁতখুঁত করল। “দিদির অসুবিধা করে এখনই আসার কী দরকার ছিল? আমি তো প্রতিমাসে যাচ্ছিই।”
সে দেখল, তাদের বাড়ির সেই হতদরিদ্র চেহারাও কিছুটা বদলেছে। দরমার বেড়া অনেক জায়গায় ভেঙে গেছিল, সেগুলো সব সারানো হয়েছে, মানুষজন এলে দাওয়ায় বসার জন্য একটা বড়ো চৌকি কেনা হয়েছে। এমনকি জানালা-দরজায় মায়ের পুরোনো শাড়ি সরিয়ে গঞ্জের দোকান থেকে কেনা নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে।
সোমবার রাতে সে ফিরতে দিদি যেন নিশ্চিন্ত হল।
আরও কয়েক মাস কাটল। বাবাই এখন পাড়ার প্লে স্কুল ছেড়ে বড়ো স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এখন বাবাইর জন্য স্কুল বাস আসে। সে রোজ সকালে বাসে তুলে দিয়ে আসে আবার দুপুরে বাস থেকে নামিয়ে নেয়। দিদি এখন রোজ অফিস থেকে ফিরে বাবাইকে পড়াতে বসে। দাদাবাবুরও আবার আসার সময় প্রায় হয়ে এল।
এক রবিবার সকালবেলা দিদি তাকে নিয়ে বাইরের ঘরে ডাস্টিং করতে বসেছিল। এমনিতে ঠিকে কাজের মেয়েটিই ডাস্টিং করে দেয়, কিন্তু বাইরের ঘরে প্রচুর দামি আর শখের জিনিস থাকায় এটা দিদি ছুটির দিনে নিজেই করে। হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “এ কী! এখানে গণেশটা কোথায় গেল?”
টিভির পাশে একটা কাচের তাকে একটা গণেশের মূর্তি থাকে। খাঁটি রুপোর তৈরি৷ সে অবাক হয়ে বলল, “জানি না তো, এখানেই তো ছিল।”
দুজনে মিলে গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল, কোথাও নেই।
দিদির ভুরু কুঁচকে গেছে। বলল, “সরমা আর বেবি অনেকদিন ধরে কাজ করছে। ওরা চুরি করবে না।” তারপর হঠাৎ চোখ ছোটো করে বলল, “তোর মা কাল এসেছিল না?”
কথাটার মানে বুঝতে পেরে তার মুখ পলকের মধ্যে সাদা হয়ে গেল। সে কোনোরকমে বলল, “মা নেয়নি দিদি।”
দিদির মুখ-চোখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। সে ঠাস করে ঈশ্বরীর গালে একটা চড় মারল। দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে বলল, “মায়ে-ঝিয়ে মিলে ঘরের জিনিস সরাচ্ছিস? এক্ষুনি জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে!”
সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে দিদির পা জড়িয়ে ধরল। তার বুকের মধ্যে এখন ঢেঁকির পাড় পড়ছে।
হইচই শুনে বাবাই ছুটে এসেছে। বলল, “দিদিকে বকছ কেন, ওটা তো আমি নিয়েছি। আমার খেলনার বাক্সে আছে।”
দিদি তাকে ছেড়ে বাবাইকে ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল। হিসহিস করে বলল, “অসভ্য ছেলে, কতদিন বারণ করেছি না এ-ঘরের জিনিসে তুমি হাত দেবে না!”
ঈশ্বরী উঠে বসেছে। তার চোখের কোনায় কান্না লেগে রয়েছে। সে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। তারপর বাবাইকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “থাক দিদি, ওকে কিছু বোলো না।”
পারমিতা হেসে ফেলে বলল, “দ্যাখ দিকি, মিছিমিছি তোকে সন্দেহ করছিলাম।”
ঈশ্বরীর মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠে জলের আল্পনার মতো মিলিয়ে গেল। সে বলল, “ঠিক আছে দিদি।”
ছবি- মৌসুমী
জয়ঢাকের গল্পঘর
গল্পটি লেখকের কুড়িটি কিশোর কাহিনির সঙ্কলন ‘ভয়ের ভাক্সিন” নামের বই থেকে থেকে নেয়া। বইটি সম্বন্ধে জানতে ও জয়ঢাক প্রকাশনের বুকস্টোর থেকে অর্ডার দিতে নীচের ছবিতে ক্লিক করুন