গল্প-পাগলা দাজুর বাঁশি-শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য-শরৎ ২০২২

শিবশংকর ভট্টাচার্যর সমস্ত গল্প

golpopagladashurbaanshi (1)

আমাদের জুঠিদিদি একবারও নিজের চোখে দেশ দেখেনি। বুড়াদাদার কাছ থেকে একশো বচ্ছর আগেকার কত কত গল্প শুনে দেশ জেনেছে। বাবা বলতেন, ‘একশো নয় রে, আরও কত বছরের পুরোনো কথারা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এসেছে আজকের দিনে। জুঠির বুড়াদাদা হল ওর বাবার বাবার বাবা। তার বয়েস এখন একশো পঁচিশ হল! সে বলছে তার চেয়েও বুড়োবুড়িদের কাছ থেকে শুনে। ও-গল্পের কি গাছপাথর আছে? জুঠি তো আবার একশোর বেশি ভাবতেও পারে না। ওর কাছে অনেক মানে হল একশো, ব্যস। তবে কানে শোনা অথবা বইতে পড়াও একরকমের দেখা। জুঠি ওর মতো করে ওর দেশ দেখেছে বৈকি।

কাজেই জুঠিদিদি বলত, ‘আমরা হাঁ করে শুনতাম। সে-দেশের কথায় নীল পাহাড় আছে যার চুড়োয় সাদা বরফ। তার তলায় ঘন বনজঙ্গল। হাতির পেটের মতো মোটা আকাশছোঁয়া গাছ আছে। বনে আছে বাঘ, ভালুক, অজগর সাপ যার মাথায় মণি। আর আছে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়সওয়ার, পোষা চিতাবাঘ, ভূত-পেত্নী, দেও। শালগাছের মতো মোটা সাপ আস্ত হরিণ গিলে শুয়ে থাকে, তখন তার গায়ে হাত দিলেও কিছু বলে না। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ থাকলে ঝরনার কাছে যেতে নেই কারও। পরির দল সেখানে চান করতে নেমে আসে। দূর থেকে রাতের আকাশে সাদা ধোঁয়ার মতো তাদের নেমে আসার পথ দেখলেই জানা যায় সে-কথা, কাছে গিয়ে দেখার সাহস নেই কারও। পশুপতিনাথ ঠাকুরকে আর দুর্গামাঈকে পূজা করা হয় মোষ বলি দিয়ে। বলি না পেলে ঠাকুর রাগ করেন। ক্ষেতে ফসল ফলে না। খরা অথবা বন্যায় সব উজাড় হয়ে যায়।

দিদি দুঃখী গলায় বলত, “মোষের ওপর মা দুগ্‌গার অত রাগ কেন? বলি দিলে ব্যথা লাগে না?”

জুঠিদিদি বলত, “তোমরা তো মাছ খাও, ছাগল খাও। লাগে না ওদের?” রেগে গিয়ে বলত, “হাতির মাংসও তো খায় আমাদের দেশে। হাতির পায়ের তলার মাংস ভারি নরম।”

ছিঃ! ওরা বুঝি রাক্ষস? রাগ হত আমার। সারাটা দিন ওর গল্পগুলো মনের মধ্যে স্রোতের মতো বইতে থাকত। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম মোষ বলি হচ্ছে। ছোট্ট একটা বাচ্চা মোষকে মেরে ফেলেছে। অনেক দূরে বনের মধ্যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওর মা চোখের জল ফেলছে।

বাবার অফিসের দরজায় টুলের ওপর বসে থাকে সাংবীরপুনদাদা। খাকি হাফ প্যান্ট, জামা, কোমরে কালো চওড়া চামড়ার বেল্টে কুকরি ঝুলছে, মাথায় কালো টুপি। বুকের ওপর আড়াআড়ি গুলিভরা বেল্ট, দোনলা বন্দুক হাতে। অত কিছু লাগাবার পরও কুঁচকনো চামড়া আর পাকা চুলে বুড়োটে ভাব। হাসলে অবশ্য ওকে ছেলেমানুষ মনে হয়। জুঠিদিদির বাবার বন্ধুও।

সেই সাংবীরপুনদাদার বৌ এল একদিন। ছোট্টখাট্টো সুন্দর দেখতে, সারা গায়ে পেতলের গয়না সোনার মতো ঝকঝক করছে। মায়ের কাছে এসে কত কী বকবক করতে লাগল। একটুও না বুঝে মা তাকে আদর-টাদর করে বসতে দিলেন। জুঠিদি অমনি কাছে যেতে ওকেও আদর করে বললেন, “বোস এখানে। কী বলে বুঝিয়ে দে।”

আমাদের জন্য কত কী খাবার নিয়ে এসেছে পুঁটুলি ভরে। জুঠিদিদি বলল, “এই দ্যাখ, আমার দেশের লোক। বলেইছি, খুব সুন্দর দেখতে হয়।”

অনেকক্ষণ হাসাহাসি আর গপ্পো-টপ্পো করে আমাদেরই বাড়ির একটা ঘরে ওকে থাকতে দিলেন মা। পাহাড়ে জুঠিদিদিদের ঘরের পাশেই নতুন ঘর তৈরি হলে ওখানে সংসার পাততে যাবে বৌ। বুড়ো সাংবীরপুনদাদা খুশি খুশি মুখে আমাদের মিষ্টি খাইয়ে গেল।

দিদি চুপিচুপি বলল, “জুঠিদিদিরও বিয়ে হয়ে যাবে এবার।”

জুঠিদিদি শুনে হেসেই খুন। বলল, “দূর! আমি বিয়েই করব না। আমার বুড়াদাদাকে দেখবে কে?”

দিদি বলল, “কেন, তোমার বাবা দেখবে!”

“আরে তারও তো বয়েস হয়েছে! তাছাড়া বনের চৌকিদারি ছেড়ে সে কী করে দেখবে?”

“তোমার বাবা তো আর বনের কাজ করে না এখন, পেনসিল পায় বলেছ তুমিই!”

“কাজ চলে গেলেও বনের চৌকিদারি যায় না। মরে যাওয়ার আগে বন পাহারা ছাড়ে না কেউ।”

“মাইনে না পেলেও?”

“আরে তোরা তো ছেলেমানুষ, কীই-বা বুঝিস! মাইনে তো পেটে খেতে পাবার জন্য। বন পাহারা সম্মানের ব্যাপার। কোনটা কম? তাছাড়া মাইনে না পেলেও কাউকে না খেয়ে মরতে দেখিনি বাপু। তোরাও তো মাইনে পাস না। চৌকিদারি অনেক বড়ো জিনিস। সবার ভাগ্যে জোটে না। আমায় তো মেয়ে বলে সরকার চৌকিদারি দিল না। তা বলে বন পাহারা দেব না! জানিস, আমার বুড়াদাদা, দাদা, বাবা সবাই চৌকিদার ছিল। আমাদের দেশে সবচেয়ে ইজ্জতের কাজ হল চৌকিদারি। সবাই কত মানে!”

“ও কী কথা! তুমি তো বলো দেশের রাজাকে সবাই বেশি মানে। বন পাহারা কি তার চেয়েও বড়ো?”

“ওরে রাজা হল দেশের মাথা। আর বনের রাজা হল চৌকিদার। শুধু চাকরি হলেই হয় না। কত কী জানতে হয় ওদের, জানিস? গাছপালা, মাটি-জল, জীবজন্তু—এই সবের কাছের মানুষ হতে হয়। আমার বুড়াদাদার বড়ো ভাই ওদের ভাষা জানত। তবু তার চৌকিদার হওয়া হল না।”

“কেন হল না জুঠিদিদি?” আমরা ঘনিয়ে বসলাম। জুঠিদিদি রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড় তুলে গোছাতে গোছাতে দুঃখী গলায় বলল, “ওর যে মাথার ঠিক ছিল না।”

জুঠিদিদির অনেক কাজ। এত কাজ করতে মা বারণ করলেও করে। দুপুরবেলা দাদা আর দিদি স্কুলে যায়, আমি আর বোন জুঠিদিদির পিছু পিছু ঘুরে বেড়াই।

শীত গিয়ে গরম এসে গেল। পাহাড়ের গাছে গাছে নতুন পাতারা জন্মাল। নতুন বৌকে নিয়ে গেল সাংবীরপুনদাদা। পাহাড়ের ওপর নতুন ঘর তৈরি হয়েছে ওদের। পাশেই জুঠিদিদিদের বাড়ি। নতুন বাড়ি গিয়ে বৌ ভয় পেয়েছে। জুঠিদিদি হাসতে হাসতে এসে বলল মাকে। বৌয়ের ঘরের পাশেই বাঁশঝাড়। পাকা বাঁশের গায়ে পোকারা ফুটো করেছে, ঝোড়ো বাতাসে সেখানে বাঁশির মতো শব্দ হয়। সাংবীরপুনদাদার বৌ ভেবেছে, অন্ধকার রাতে পেত্নী কাঁদছে।

golpopagladashurbaanshi (2)

মা বললেন, “এত হাসির কী আছে জুঠি? রাত্তিরে ঘুম ভেঙে ওরকম শব্দ শুনলে আমিও পেত্নীর কান্না ভাবতাম।”

জুঠিদিদি হাসি থামিয়ে নীচু গলায় বলল, “হ্যাঁ, যে যেমন ভাবে, শোনে। কেউ শোনে ভূত-পেত্নীর আওয়াজ, কেউ বলে পাগল দাজু বাঁশি বাজাচ্ছে।”

বোন ছোট্ট ছোট্ট হাতে জুঠিদিদির জামার কোণ ধরে বলল, “ভূত কেন রাত্তিরবেলা বনে থাকে? ওদের ভয় করে না?”

দিদি হাসতে লাগল—“শোনো কথা পুঁচকেটার! জুঠিদিদি, দাজু কে রে?”

হাতের কাজ ফেলে আমাদের পাশে বসেছে জুঠিদিদি। নজর ওর যেন অনেক দূরের শিলং পাহাড়ের দিকে, আকাশের নীল যেখানে পাহাড়ের নীলের সঙ্গে মিশে গেছে। উদাস হাওয়ার মতো ওর গলার স্বর।

জুঠিদিদির বুড়াদাদার বড়ো একটা ভাই ছিল। দাদাকে ওরা বলে দাজু। ছোটো থেকেই অন্যদের থেকে আলাদা ছিল সে। সবাই বলত পাগলা দাজু। বনের জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে পারত সে। তাদের কথা বুঝতেও পারত। কম বয়সে পাগল হয়ে দেশ না ছাড়তে হলে সে-ই হত বনের চৌকিদার।

সে ছিল পাগলাটে দেখতে। লম্বা, রোগা আর মাথায় কাগের বাসার মতো চুলের বোঝা। পাতলা সোনালি দাড়িগোঁফও ছিল তার মুখে। যদিও সে-দেশের পুরুষমানুষদের দাড়িগোঁফ তেমন দেখাই যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য ছিল তার চোখ দুটি। সে-চোখের নজরের তল নেই। এমনিতে ভারি শান্তশিষ্ট স্বভাব। কেউ কিছু বললে মন দিয়ে শুনত, কিন্তু কোনও জবাব দিত না। জঙ্গলের মাঝখান থেকে খুঁজে খুঁজে রোদে সেঁকা পাকা মুলি বাঁশ কেটে এনে বাঁশি তৈরি করে রাখত সে। সরু মোটা নানান মাপের বাঁশির পাঁজা যত্ন করে তোলা থাকত তার কাঠের ঘরের স্লেট পাথরের টালিতে ছাওয়া চালার খাঁজে। এক-এক সময় হাতে থাকত এক-একটা বাঁশি। নিরালায় একা একা বসে কী যে সুন্দর সুর বাজাত সে! যেন এ দুনিয়ার চেনা কোনও সুর নয়। মাঝে মাঝে দিনের পর দিন কোনও হদিস থাকত না পাগলা দাজুর। চালায় গোঁজা বাঁশির পাঁজায় তখনও কেউ হাত দেবার সাহস পেত না। একা তো সে-ই নয়, আরও কোনো-কোনো ছেলে জানত বাঁশি বাজাতে, তবে তার মতো কেউ নয়।

কাছে বসে কেউ তার বাঁশি বাজানো শুনতে পায়নি। গাঁ-ঘরে কতক্ষণই-বা দেখা যেত তাকে! না খেয়ে না দেয়ে সারাদিন বনে বনে ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ ছিল। রাত গহন হলে কখনো-কখনো কান পাতলে শোনা যেত বাঁশির আওয়াজ। জানোয়ারের ভয়ে গাছের ওপর রাত কাটানো দু-একজন কাঠুরে অবশ্য দেখতে পেয়েছে তাকে বনের ভেতর দিয়ে নির্ভয়ে হেঁটে যেতে, কোনও পাথরের ওপর বসে বাঁশি বাজাতে। আশ্চর্য সে সুর! বনের সমস্ত শব্দ মিশে আছে তাতে। থামলেও সে-সুর বাজতেই থাকে মনের মধ্যে। এমনই ছিল জুঠিদিদির বুড়াদাদার পাগলা দাজু।

কেউ জানে না এ-বিদ্যে সে পেল কোথা থেকে। কোনও কালে কেউ তাকে বাঁশি বাজাতে শেখায়নি। গাঁ-ঘর ছেড়ে যায়ওনি কোথায় যে শিখবার সুযোগ পাবে। ভাইকে সে বলেছিল, বনের কাছ থেকে, নদী-বাতাসের কাছ থেকে এ-বিদ্যে তার আপনিই শেখা।

কেউ শিখতে চাইলে মুচকি হেসে চুপ করে থাকত সে। বেশি পীড়াপীড়ি করলে উঠে চলে যেত। রাগ ছিল না তার শরীরে। কিন্তু এমন কিছু ছিল কম কথা বলা মানুষটার মধ্যে, কেউ তাকে আর ঘাঁটাতে সাহস করত না। বনের চৌকিদাররাও না।

বিকেলের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে নীলাচল পাহাড় আর লাল-পাহাড়ের গায়ে। দুই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো পড়েছে কালাপাহাড়ের গায়ে। জুঠিদিদি বাড়ি চলে গেল।

এ-সময় ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের দিক থেকে। আমাদের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে গোসালা পাহাড়ের খাঁজের লাল পথটার দিকে চেয়ে দেখতে পাই নীল একটা ফুটকির মতো জুঠিদিদির ঘরে যাওয়া। দূর থেকে এদিকে ফিরে সে হাত নাড়ে। তারপর বড়ো কালো পাথরটার আড়ালে চলে যায়। দূর থেকে রেলগাড়ির ধোঁয়া উড়তে দেখি। ঝিকঝিক শব্দে টের পাই তার চলন। স্টিমারের ভোঁ সন্ধের আকাশে কাঁপুনি ধরায়। পড়তে বসার সময় হয়।

পুজো দেবে সাংবীরপুনদাদার বৌ। ওর ঘর থেকে ভূত তাড়ানোর জন্য পুজো। রাত নিঝুম হলে ঘরের পাশের ভূতের বাঁশি বাজে। জুঠিদিদি রেগে গেছে। বার বার করে বলেছে, ভূত নয় মোটেই, ফুটো বাঁশে বাতাস খেলে গেলে বাঁশির মতো বাজতে পারে। ওর কথা শোনেনি কেউ। পুজোর ভোগ রান্না হচ্ছে—খিচুড়ি আর পায়েস। মা এত খাড়া পাহাড়ে উঠতে পারেন না। আমি আর দিদি গেলাম পুজোর প্রসাদ খেতে। ঘরের বাইরে উঠোনে পুজো হচ্ছে। জুঠিদিদি আমাদের দুজনকে গোসালা পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল। দুপুরবেলা এখানে কোনও শব্দ নেই। বড়ো কালো চ্যাটালো পাথরটার ওপর কাঠগোলাপ গাছের ঠান্ডা ছায়া, ঝরা ফুলে ছেয়ে আছে। এখান থেকে নীচের শহরটাকে রোদে মেলে দেয়া রঙিন শতরঞ্জির মতো মনে হয়। পুজোর জায়গাটাও দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে পাতা কাঁপিয়ে বাতাসের ঝরঝর শব্দ আর পাখির ডাক, আর সব চুপচাপ।

জুঠিদিদি বলল, “গাছেরাও কথা বলে, জানিস! সবাই শুনতে পায় না। কেউ কেউ বুঝতে পারে। আমার বুড়াদাদার সেই পাগল দাদা সে-ভাষা জানত। বলতেও পারত। বুনো জন্তুদের ভাষাও জানত।

“অনেক বছর আগে দেশজুড়ে একবার ভুঁইদোল হল। মাটির অনেক তলায় যখন ভূত আর রাক্ষসদের মধ্যে লড়াই হয় তখনই ভুঁইদোল হয়, কে না জানে। অনেক বাড়িঘর ভেঙে পড়ল, পাকাবাড়িগুলোও বাদ গেল না। পাহাড়ে ধ্বস নামল কত জায়গায়। বড়ো বড়ো নদী চলার পথ বদলে নতুন পথে বইতে লাগল। মাটি ফেটে আগুন বের হল পাতাল থেকে। নদনদী, পাহাড়-পর্বত সব তোলপাড় হয়ে ভয়ংকর অবস্থা! কত মানুষ যে মরে গেল হিসাব নেই। জঙ্গলের জানোয়ারেরা পাগলের মতো বন ছেড়ে বেরিয়ে এল মানুষজনের বসতির মধ্যে। হাতি, গণ্ডার আর বুনো মহিষের পায়ের চাপে কত গাঁয়ের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে গেল। বাঘের থাবা আর সাপের কামড়েও লোক মরল অনেক। সেই সময় বুড়াদাদার দাজু একা এসে দাঁড়াল বনের ধারে। ঝোড়ো বাতাসে তার উড়ু উড়ু চুলদাড়ি, হাতে মুলি বাঁশের বাঁশি।

“ভুঁইদোল থেমে গেলে পরিষ্কার নীল আকাশে গোল সোনার থালার মতো চাঁদ উঠল। ঠান্ডা বাতাসে মাটি জুড়োল, পাহাড় শান্ত হল। চাঁদের আলোয় পাগলা দাজু চলেছে বনের দিকে। সবাই অবাক হয়ে দেখল তার বাঁশির আওয়াজ কানে যেতেই লোকালয় ছেড়ে সার সার ছোটোবড়ো জানোয়ারেরা আবার বনের দিকে ফিরে চলেছে তার পিছু পিছু। দাজুর বাঁশির সুর তাদের শান্তি দিয়েছে, বনে ফেরার ডাক শুনিয়েছে। একটুও পাগলামোর লক্ষণ নেই তাদের কারও।

“ওর এইরকম ক্ষমতার কথা জানতে পেরে দেশের রাজা দাজুকে ডেকে পাঠালেন। খাতির করে ইনাম দিতে চাইলেন, জমি-জায়গা দিয়ে ঘর করে দিতে চাইলেন। নিলই না সে! রাজার দরবারে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত মুখে বলল, রাজা যদি কথা দেন শিকার করা ছেড়ে দেবেন, তবেই সে খুশি। টাকাপয়সা, জমি, ইনাম কিচ্ছু চাই না তার।

“ওর কথা শুনে রেগে গেলেন রাজা। কথা তো দিলেনই না, উলটে পাগল বলে বকাবকি করলেন। রাজার কথা শোনেনি বলে দেশসুদ্ধ লোক, এমনকি তার আপন গাঁয়ের লোকেরাও যখন তাকে দুষতে লাগল, তখন সে সত্যিকারের পাগল হয়ে গেল। কারও সঙ্গে কথা বলত না, স্নান-খাওয়া ছেড়েই দিল, চোখের চাউনি পালটে গেল। তাকে চেনা লোকেরাও আর চিনতে পারত না। সে যেন দুনিয়া ছাড়া কেউ।”

“তারপর?” জুঠিদিদিকে হঠাৎ আনমনা হতে দেখে আমরা ওর হাত ধরে নাড়া দিলাম।—“তারপর কী হল বলো না!”

“তারপর একদিন সে যে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। কেউ বলে আরও গভীর বনে গিয়ে জানোয়ারদের রাজা হয়েছে, কেউ-বা বলে মরে গেছে। আর কখনও তাকে দেখতে পায়নি কেউ।

“তবে কোনো-কোনো ঝড়ের রাতে, অঝোর বৃষ্টির দিনে অথবা গরমকালের নির্জন দুপুরে দূর থেকে কারো-কারো কানে আসত বাঁশির সুর। গাঁয়ের যারা তাকে চিনত তারা বলাবলি করত, বনের ভেতর লুকিয়ে থেকে বাঁশি বাজাচ্ছে পাগলা দাজু। যারা তাকে জানত না তারা বলত, বাঁশির সুর না ছাই, বনের ভেতর হাওয়া বইলে ওইরকম শব্দ শোনা যায়। কারও মনে হত ভূতের মায়াবী কান্না।”

আমি আর দিদি মনের কষ্টে কথা বলতে পারছিলাম না অনেকক্ষণ। জুঠিদিদিও চুপ করে বসে ছিল পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে।

“কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে বার করতে পারল না? বনের ভেতর কত কষ্ট। একা একা মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে থাকতে হয়। খাওয়া নেই, চান নেই, ঘুম নেই। গরমের সময় বন তেতে ওঠে, সাপেরা ছোবল মারতে পারে। কতবার আগুন লেগে যায় গাছে গাছে ঘষা খেয়ে। কালবৈশাখী বড়ো বড়ো গাছ উপড়ে ফেলে। বৃষ্টির দিনে পাহাড়ি নদীতে বান ডাকে, ধ্বস নেমে আসে গাছপালা তছনছ করে। জোঁকের দল কিলবিল করে ঝোপঝাড়ে। শীতে বরফ পড়ে জমিয়ে দেয়, শরীর ফেটে রক্ত পড়ে। ওর কোনও বন্ধু ছিল না? খোঁজও করল না ভালো করে! পাগল বলে ওকে ভুলে গেল সবাই!” দিদির চোখ ছলছল করতে লাগল।

জুঠিদিদি রেগেই গেল।—“খোঁজেনি মানে! ওকে খুঁজতে গিয়ে গাঁয়ের কত কমবয়সি ছেলে নিখোঁজ হয়ে গেল বনের ভেতর, খোঁজেনি! তার মধ্যে ক’জন অবশ্য মগের মুলুকে পৌঁছে ব্যাবসা করে বড়োলোক হয়ে ফিরেছিল অনেকদিন বাদে। তারা ফিরে এসে বলেছে পাগলা দাজুর খোঁজ নাকি পায়নি। তারপর কত বছর পার হল। পুরোনো রাজা সরে গিয়ে তাঁর ছেলে রাজা হয়ে বুড়ো হয়ে গেল। শিকার উঠে গেল দেশ থেকে। তবুও দাজু ফিরে এল না। এখনও ওকে খোঁজে সবাই। ছোটোরা শুকনো পাতার গায়ে কাজল দিয়ে ‘দাজু ফিরে এসো’ লিখে বনে ছড়িয়ে দিত। সেই পাতার চিঠি শুখার সময় ঘূর্ণিবাতাসে চক্কর খেতে খেতে আকাশে উঠে বনের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যেত না? সে-চিঠি দাজু দেখতে পায়নি বলতে চাও?

“আমার এই বুড়াদাদা কতবার বনের গভীরে গিয়ে বড়ো বড়ো গাছের গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করে লিখে এসেছে—দাজু তুমি গাঁয়ে ফিরে এসো। তোমায় না দেখলে সবাই কত কষ্ট পায়। গাছের মন বোঝো তুমি, আমাদের মন বোঝো না? চালের বাতায় তোমার বাঁশিগুলো ঘুণ ধরে শেষ করে ফেলল, আবার নতুন করে বাঁশি বানাতে হবে না? তোমার পোষা হরিণের ছানা হয়েছে, দেখবার লোক নেই। গাছের খোঁড়লে ধনেশ, বন-কবুতরেরা কত ডিম পাড়ছে রোজ, ছানা হচ্ছে। সেই মা-হারা ছোট্ট চিতাবাঘ ‘শম্ভু’ বড়ো হয়ে তোমার খোঁজে বনে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ফিরে এসো। আমাদের বাড়িতে কত নতুন লোক বেড়েছে! ছোটো ছোটো বাচ্চারা জন্মেছে। তারা তোমার কথা শুনেছে। তোমায় দেখতে চায়। বুড়ি-মা কত কাঁদে। ফিরে এসো।”

“তবুও আসেনি!”

“সব চিঠি নষ্ট হয়ে যায়। গাছের গায়ে খোদাই করে লেখা সে চিঠি নষ্ট হবার নয়, সে-লেখা মুছে ফেলা যায় না। গাছ যত বড়ো হয়, লেখা তত পাকা হয়ে ফুটে ওঠে। বেঁচে থাকলে সে-লেখা তার নজরে পড়েনি বলতে চাও? মরেই গেছে বুড়াদাদার পাগল ভাই।”

চোখে বোধহয় কুটো পড়েছে, কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগল জুঠিদিদি।—“বনের জানোয়ারেরা মারেনি তাকে। সবাই জানত সে জানোয়ারদেরও বন্ধু ছিল। মানুষ না বুঝলেও ওরা ঠিক ওর ভালোবাসা বুঝত।”

এমন সময় গাছপালা ঝোপঝাড় কাঁপিয়ে ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেল। কতরকম পাখির দল একসঙ্গে ডেকে উঠল আর আমাদের মাথার ওপর ঝরে পড়ল একরাশ কাঠগোলাপ ফুল। কান পেটে স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেন বাঁশির সুর তুলেছে কোথায়।

“ও কিছু নয় রে। পোকা ধরা বাঁশের ফুটোয় বাতাস বইছে।” উঠে দাঁড়াল জুঠিদিদি। ওর এক চোখে হাসি, এক চোখে জল।

অলঙ্করণ-শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

3 thoughts on “গল্প-পাগলা দাজুর বাঁশি-শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য-শরৎ ২০২২

  1. এমন মায়াভরা গল্প কতদিন পড়িনি! মনে থেকে যাবে।

    Like

  2. এমন চোখের সামনে ছবি দেখা গল্প অনেকদিন পড়িনি। রেশ থেকে যাবে সাথে।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s