চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের আরো গল্প
আজব মানুষের গজব কাহিনী, ভগবানের বেটা বেটি, শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি, জ্বর গাছ, হরিদ্রাবৃত্ত, কঙ্কাল কান্ড
ইতিহাস প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে অনীত খানিকক্ষণ ভেবলে বসে রইল। দশটা প্রশ্ন, যে-কোনো আটটা লিখতে হবে। আর আছে কুড়ি নম্বরের অবজেক্টিভ প্রশ্ন। এককথায় উত্তর দিতে হবে।
পেঁচার মতো একশো আশি ডিগ্রি ঘাড় ঘোরাতে না পারলেও প্রায় সেরকমভাবেই ক্লাসরুমটাকে একবার দেখে নিল অনীত। সকলেই লিখতে শুরু করে দিয়েছে। সুবোধ-স্যার গার্ড দিচ্ছেন। স্যারের চোখের দিকে তাকাতেই অনীত বুঝল, খুব মন দিয়ে তিনি অনীতকে লক্ষ করছেন। ভাবছেন হয়তো টোকার ধান্দা করছে ছেলেটা।
আসলে এই স্কুলের স্যারেরা অনীতকে তেমন চেনে না। মাস চারেক হল ও এসে ভর্তি হয়েছে স্কুলটাতে। তাই অনীত আদতে কেমন ছাত্র, স্যারেদের তা জানা নেই। আগে যে স্কুলে পড়ত সেখানে একই ক্লাসে বার তিনেক করে থেকে যাওয়াতে হেড-স্যার ওর বাবাকে ডেকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন এবং আর যে ওকে স্কুলে রাখা যাবে না, আড়ে-ঠারে সে-কথাও বলে দিয়েছিলেন।
অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরেই ওর বাবা বাড়ির অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে অনীতকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ওর মামাবাড়িতে। বড়ো মামা বেশ একটু গম্ভীর মানুষ। বাড়ির লোকজন সমঝে চলে ওঁকে।
অনীতের স্বভাব খারাপ নয় মোটেই। বড়োদের মান্য করে, সম্মান দেয়। ঝগড়াঝাঁটি করে না। লেখাপড়া না করা ছাড়া ওর বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নেই।
প্রকৃতিপ্রেমী ছেলে অনীত। ভালোবাসে গাছ, পাখি, ফুল, নদী, আকাশ। প্রজাপতি ওর বিশেষ পছন্দের পতঙ্গ। ফুলের ওপর প্রজাপতি বসা দেখতে পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে অনীত।
সব গাছই সবুজ, কিন্তু সেই সবুজের কত রকমফের! কোনও দুটো গাছের সবুজ এক নয়। এসবই চোখ ভরে, মন ভরে দেখে ও। আর ভালোবাসে গল্পের বই পড়তে। গল্পের বই বলাটা ভুল, হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে। কিছু কিনলে যদি কাগজের ঠোঙা দেয়, সেটাও পড়ে ফেলে অনীত। তবে হ্যাঁ, ছাপার অক্ষর অবশ্যই বাংলা হতে হবে। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার বইয়ে অনীতের কোনও আগ্রহ নেই।
যেটা একেবারেই ভালো লাগে না, সেটা হল পড়ার বই। কী যে বিরক্তিকর লাগে অনীতের তা বলে বোঝাতে পারে না কাউকে। একঘেয়ে জিনিস, কোনও রসকষ নেই, মোট্টে পোষায় না ওর। স্কুলে যায় বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাড়ি ফিরে সেই যে টেবিলে স্কুল ব্যাগ রাখে, আর তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকে না অনীতের। ফলে যা হবার হয়, পরীক্ষায় গোল্লা!
মামাবাড়িতে আসার পরপরই মামা যে স্কুলে পড়েছেন, সেই দত্তবাগান হাই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। প্রচুর গুলতাল মারতে হয়েছে স্কুল বদল করার কারণ বলতে গিয়ে। যাই হোক, পুরোনো ছাত্রের ভাগনে হিসেবে ভর্তি করে নিয়েছেন হেড-স্যার।
হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রথম পরীক্ষা বাংলা। গদ্য বিভাগে একটা প্রশ্ন ছিল, মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘চিঠি’ সংকলনটিতে তিনি কোন তিনজনকে চিঠি লিখেছিলেন?
অনীত উত্তরে লিখল, ‘যাকে যাকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মশাইয়ের চিঠি দেবার প্রয়োজন হয়েছিল, তাদেরকেই চিঠি দিয়েছিলেন। তখন তো আর ফোনের সুবিধে ছিল না যে দরকার হলেই ফোন করে নেবেন। স্মার্টফোন তো কল্পনার বাইরে। তখন চিঠিই ছিল ভরসা। তিনজন কেন, অনেকজনকে চিঠি লিখেছিলেন উনি।’
গদ্য-পদ্যের সব প্রশ্নেরই কমবেশি এরকমই উত্তর লিখল অনীত। কেবল রচনাটা লিখল খুব মন দিয়ে। প্রচুর গল্পের বই পড়ার কারণে ভাষার দখল ছিল অনীতের। আর যা কিছু মুখস্থ করার বাইরে, সেখানে কেরামতি দেখাতে ওস্তাদ ছিল অনীত।
ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল, ‘শের শাহ রাজ্যের উন্নতিতে কী কী প্রকল্প নিয়েছিলেন?’
অনীত লিখল, ‘নিজের রাজ্যের উন্নতির জন্য রাজ্যের যিনি সর্বেসর্বা তিনি অনেকরকম প্রকল্পই যে নেবেন, তাতে আবার বলার কী আছে। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি রাজ্যের উন্নতির জন্য প্রকল্প নেন না? রাস্তা বানাচ্ছেন, টিউব ওয়েল বসাচ্ছেন, রাস্তায় আলো লাগাচ্ছেন, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল বানাচ্ছেন, আরও কত কী করছেন। শের শাহও তেমনি সব করেছিলেন।’
এই হল অনীতের উত্তরপত্রের নমুনা। সবথেকে কাণ্ড ঘটিয়েছে অঙ্ক আর ইংরেজিতে। অঙ্কের প্রশ্নে চিরাচরিত চৌবাচ্চায় জল ভরা আর বেরোনোর একটা অঙ্ক থাকেই। এই প্রশ্নপত্রেও ছিল। আর ছিল ছেলের বয়েস বাবার বয়েসের অঙ্ক।
অঙ্কের খাতায় অনীত লিখল, ‘বাড়ির লোকের একটু সতর্ক হওয়া উচিত। সারা পৃথিবী জুড়ে জলের এত সমস্যা, সেদিন খবরে দেখাল, মাটির নীচে জলস্তর নেমে যাচ্ছে। এরপর আর জল পাওয়া যাবে না, খরা হবে। এই অবস্থায় কেউ চৌবাচ্চার কল খুলে রাখে? খুবই অন্যায্য কাজ। জল বেরিয়ে যাবার কলগুলো বন্ধ রাখলে মোটামুটি কুড়ি মিনিটেই চৌবাচ্চা ভরে যাবে।’
‘বাবার বয়েস কখনোই ছেলের বয়েসের থেকে বেশি হতে পারে না। এসব আজগুবি কথা যারা বলে, তাদের রাঁচি পাঠানো উচিত।’
ইংরেজি উত্তরপত্রে অনীত বাংলায় বড়ো বড়ো করে লিখল, ‘আমরা স্বাধীন ভারতে বাস করি। ইংরেজরা বিদেয় হয়েছে বহুকাল। তাই ওদের ভাষা কোনোমতেই ব্যবহার করা উচিত নয়। যারা আমাদের ওপর এত অত্যাচার করেছে তাদের ভাষা নিয়ে মাতামাতি করা কি ঠিক? এ ঘোর অন্যায়। আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা। আমি বাংলা ভালোবাসি, ইংরেজি পছন্দ করি না। এর বেশি আমার আর কিছু বলার নেই।’
ভূগোলের খাতাতেও একই ঘটনা ঘটাল অনীত। কোথায় কী খনিজ পাওয়া যায়, কোন দেশ কী আমদানি রপ্তানি করে, কোন দেশের জলবায়ু কেমন—এসব প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করে লিখে এল।—‘জলবায়ুর কোনপ ঠিকঠিকানা নেই এখন। ইউটিউবে দেখলাম কীভাবে কুমেরুর বরফ গলছে, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। এখন বিদেশেও বেশ গরম বেড়েছে। যেসব দেশ কোনও কালে ফ্যানই ব্যবহার করেনি তারা এখন এসি লাগাচ্ছে। কী অবস্থা বোঝাই যাচ্ছে।’
‘আমিদানি রপ্তানি নিয়ে ভ্যানভ্যান করেই-বা কী হবে। যে-দেশে যে ফলন বেশি হয়, তারা সেই ফসল অন্য দেশকে দেয়। এতে বাহবা নেবার কিছু নেই। বিনে পয়সায় তো আর আনছে না বা দিচ্ছে না, টাকার বিনিময়েই চলছে এসব। এ ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ফসল বেশি ফলুক বা কম, গরিব মানুষ খেতে পেল কি না সেটাই দেখা উচিত।’
জীবনবিজ্ঞানের খাতা খুলে তো অজিত-স্যারের চোখ কপালে। কী লিখেছে ছেলেটা! প্রথম পাতা জুড়ে বড়ো বড়ো করে লেখা, ‘গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তোলা চলবে না, সবাইকে শাকাহারি হতে হবে, তবেই জীবন বাঁচবে। জীবন বাঁচলে তবেই বিজ্ঞানের চর্চা হবে, তখন সফল হবে জীবনবিজ্ঞান।’
রেজাল্ট বেরোবার আগে টিচার রুমে হইহই! কে এই অনীত ভদ্র! স্যারেদের প্রত্যেকেই অনীতের খাতার লেখা পড়ে শোনাচ্ছেন আর হাসির হল্লা ছুটছে। হেড-স্যার এলেন।—“কী ব্যাপার? কোনও মজার ঘটনা ঘটেছে নাকি?”
“অনীত ভদ্র নামে একটি নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে না স্যার, সে একটি আস্ত পাগল!” অজিত-স্যার বললেন।
“কেন, কী করেছে সে?”
স্যারেরা অনীতের কীর্তিকাহিনি সব বললেন। হেড-স্যার সব বিষয়ের খাতাগুলো চেয়ে নিলেন। পড়তে শুরু করলেন এবং হো হো করে হাসতে লাগলেন। অন্যান্য স্যারেরা তো আগেই হাসছিলেন। সবক’টা খাতা পড়ার পর হেড স্যার কাঞ্চনবাবু স্যারেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা এই ছাত্রের বিষয়ে আপনাদের মতামত কী? একে পাশ করানো উচিত কি উচিত নয়?”
স্যারেরা সকলেই পাশ না করানোর পক্ষে মত দিলেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেড-স্যার বললেন, “আমার মত কিন্তু আলাদা। আমি বলি কী, অনীতকে পাশ নম্বরটুকু দিয়ে দেওয়া হোক। ছেলেটার মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং দখল আমার ভালো লেগেছে। বাকি বিষয় না-হয় নাই জানল, বাংলাটা তো জানে! সেটাই-বা আজকাল ক’জন ছেলেমেয়ে ভালোভাবে জানে? সবাইকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যারিস্টার হতে হবে এমন তো কোনও নিয়ম নেই। ওকে পাশ করিয়ে দিন আপনারা। অ্যানুয়াল পরীক্ষাতেও পাশ করিয়ে দেবেন।”
“স্কুলে না-হয় আমরা পাশ নম্বর দিয়ে ক্লাস টেন অবধি তুলে দিলাম, কিন্তু মাধ্যমিকে? সেখানে কীভাবে ওতরাবে অনীত?” সুফল-স্যার বললেন।
“মাধ্যমিক না-হয় নাই পাশ করল। টেন অবধি পড়ার সার্টিফিকেট তো থাকবে। তারপর দেখা যাবে।” বলেই আবার হেসে ফেললেন হেড-স্যার কাঞ্চন প্রামাণিক।
***
এসব ঘটনা তিন বছর আগের। হেড-স্যারের দয়ায় ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ার সার্টিফিকেট আছে অনীতের কাছে। মাধ্যমিক পরীক্ষাতে বসেইনি সে। শুধুমুধু ফেল করা রেজাল্ট নিয়ে করবে কী! স্যারেরাই বারণ করেছিলেন।
তাহলে তো অনীতের লেখাপড়া নিয়ে আর এগোনোর রাস্তাই নেই! ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার! মোটেই না। গল্পের বই পাগল অনীতের একটা চাকরি জুটেছে। হ্যাঁ, মাইনেও পায় সেই চাকরিতে। হুঁ হুঁ বাবা! স্কুল লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান করে দিয়েছেন হেড-স্যার কাঞ্চনবাবু। একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন অনীতকে। একটু বুক দুরদুর করছিল অনীতের। কী বলবেন স্যার কে জানে!
“স্যার, আসব?”
“হ্যাঁ, এসো অনীত। বোসো। তোমাকে যদি বলি এই স্কুল লাইব্রেরির দায়িত্ব নিতে, নেবে? দুলালবাবুর বয়েস হয়েছে, চোখে দেখতে পান না। ওঁকে এবার ছেড়ে দিতে হবে।”
অনীতের মনে হল দৈববাণী হচ্ছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
“কী হল অনীত? চাকরি কিন্তু এটা। ইয়ার্কি নয়! করবে?”
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অনীত হড়বড় করে বলে, “হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, করব। আমাকে কী করতে হবে বলে দেবেন স্যার, আমি মন দিয়ে করব।”
“লাইব্রেরি গুছিয়ে রাখতে হবে, বইয়ের যত্ন নিতে হবে যাতে পোকায় না কাটে, বই দেওয়া-নেওয়ার হিসেব রাখত হবে খাতায়, কেউ দেরি করে বই ফেরত দিলে ফাইন নিতে হবে আর যেটা তোমাকে করতে হবে সেটা হল, ক্লাস বুঝে ছাত্রদের বই বেছে দেবে এবং যা যা নতুন বই বাজারে আসছে তার খোঁজ রেখে রিকুইজিশন স্লিপ জমা দেবে আমার কাছে। আমি সেই বই আনিয়ে দেব। পারবে তো এতগুলো দায়িত্ব সামলাতে?”
খুশিতে ঝলমল করে উঠল অনীতের চোখমুখ। ঘাড়-মাথা হেলিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, আমি পারব।” বলেই এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে প্রণাম করল হেড-স্যারকে।
মাথায় হাত দিয়ে হেড-স্যার বললেন, “অনেক বড়ো হও।”
***
খুব ভালোভাবে কাজ করছে অনীত। প্রথম মাইনে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিল সে। বাড়িতে যারা ওকে লেখাপড়ায় অশ্বডিম্ব হবার জন্য তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত, তাদের আসিফচাচার বিরিয়ানি আর নবদ্বীপের লাল দই খাইয়েছে অনীত। তার থেকেও আনন্দের বিষয় হল, প্রচুর প্রচুর গল্পের বই পড়তে পারছে ও। স্বপ্ন যেন সত্যি হয়েছে। আহা! কী আনন্দ!
এ গল্প আবারও প্রমাণ করল, পুঁথিগত পড়াশোনাটাই সব নয়। জীবনকে চিনতে,বুঝতে দৃষ্টি অন্যদিকেও ঘোরানো উচিত। গল্পের বইকে আঁকড়ে ধরা উচিত। সকলের মতো চিরাচরিত ভাবনার পথ ছেড়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে হবে। তাতে লোকে হাসলে হাসুক,কুছ পরোয়া নেহি। নাই বা হল অনীত উকিল,ইঞ্জিনিয়ার,ডাক্তার, তবু তো সে স্কুলের লাইব্রেরিয়ান হতে পেরেছে। এতেই সে বিপুল খুশি,কত্ত বই পড়তে পারছে যে! হেড-স্যার কাঞ্চন প্রামাণিককে প্রণাম। তাঁর বিচক্ষণতাকে কুর্নিশ জানাই। খুব ভালো লাগল এই গল্প।
LikeLike