জয়তী রায়ের আগের গল্প- চোখ, গজুমামা জিন্দাবাদ, আলোর কৌটো , আলো আসবে, গজুমামা ও গুহা রহস্য
গজুমামার গল্প বলতে বসলে কত কথা যে মনে পড়ে যায়। একটা অদ্ভুত সময়, যখন স্মার্টফোন ছিল না। ঘাসের সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, ফড়িং জলপিপি রোদ্দুর মেঘ আলোছায়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হত। দিদিমা আকাশের দিকে মুখ তুলে হাতের আড়াল থেকে সুজ্জি দেখে ঠিক বলে দিত—এহন যাইও না বাপু। বাতাস দিব জোরে।
কোথায় বাতাস? ছিমছিম দুপুর। বাগানভর্তি সুপুরি, নারকেল, আম, জাম, কাঁঠালগাছের দল শান্ত ছাত্রের মতো মাথা নীচু করে চুপ করে রয়েছে; দিঘির গেরুয়া জলে সূর্যের আলো পড়েছে সোজা স্থির, একটুও কাঁপন নেই, বাতাস কই? বলতে বলতে হু হু হাওয়ার মাতন লেগে যেত চাদ্দিক জুড়ে; দুদ্দাড় করে দৌড়ে ঘরে ঢুকত সবাই, কোথা থেকে দাপুটে কালো মেঘ দস্যুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত আকাশের গায়ে, শুরু হয়ে যেত বৈশাখী ঝড়। কী করে বলল দিদিমা? খুট করে টেপা-গুগল ছিল না তখন, মন-গুগল ছিল ভারি শক্তিশালী—ঠিক বুঝে নিত প্রকৃতির হালহদিস।
স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি মানেই নৈহাটি মামার বাড়ি—হরেক মজা, হরেক গল্প, সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা গজুমামা। আমরা জানতাম সে আছে। উঠোনের কোণে কামিনীগাছের নীচে এসে দাঁড়ায়, যখন আমরা গল্প করি।
তিন্নি শুনে বলেছিল, “গুল মারিস না মুনিয়া। জ্যান্ত ভূত? হি হি হি হি।”
তিন্নি আমাদের নতুন বন্ধু। বড়বেলার বন্ধু। ছোটবেলার খবর রাখে না। সে না-হয় না-ই রাখল, তাই বলে হি হি হি?
আমি ক্লাস নাইন, ভাই দীপু ক্লাস ফাইভ। চোদ্দ বছর আর দশ বছর। বেশ জীবন। চলবলে ছলবলে জীবন। পড়া নিয়ে চাপ নেই, দেওয়াল পত্রিকার লেখা নিয়ে অবশ্য গাট্টা খেতে হয় দাদা-দিদির কাছে, সে একপ্রকার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। ফি-বছর নৈহাটি যাওয়া হয় না তেমন। দিদিমা মারা যাওয়ার পরে কমে গেছে মামার বাড়ি যাওয়া। টেলিফোনে খবর আদানপ্রদান হয়। দিব্য আছে, মামার বড়ো ছেলে তপনের বিয়ের কথা চলছে। সুন্দর টেনশনহীন জীবনে হঠাৎ করে তিন্নি নামক একটি বিচ্ছু ঢুকে যাওয়ায় আমরা, মানে আমি আর ভাই দীপু যাকে বলে মনমরা হয়ে গেলাম। নিম-তেতো ঝাল লংকা নুন ছাড়া মাংসের ঝোলের মতো জীবন হয়ে দাঁড়াল!
তিন্নি তুখোড় ছাত্রী, তেমনি সুন্দর চেহারা, টেনিস খেলে। সবচে’ ভয়ংকর কথা হল, নিউ আলিপুরে থাকে। নিউ আলিপুরে থাকা ইংলিশ মিডিয়মে পড়া মেয়েরা কিন্তু সেই আটের দশকে বেশ সাহেবি কেতার ছিল। ছোটো ফ্রক, স্টাইল করে কথা, সেলুনে কায়দা করে চুল কাটা—এইসব নিয়ে তিন্নি আমাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে চলে আসত। পোর্টিকোহীন বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিশোরী অপর্ণা সেন স্টাইলে নেমে এসে চক্ষু চড়কগাছ করে দিত। নিউ আলিপুরের পরি আমাদের বাড়ি উড়ে আসার কারণ, বাবার কাছে অঙ্ক ক্লাস নেওয়া। তিন্নির বাবা মিস্টার তথাগত চ্যাটার্জি প্রতাপশালী ব্যবসায়ী। তো, তিনি একদিন বলেছিলেন, ‘অঙ্ক যদি শিখতে হয়, অনিমেষের কাছে যেতে হবে। আমাদের হিন্দু স্কুলে অনিমেষ একমাত্র, যে অঙ্ক জানে।’
বাবা মোটেই টিউশন করান না, আমাদের নিয়েও নিয়মিত কখনও বসেননি। তবে এটা ঠিক, বাড়িতে অঙ্ক নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আমরা কখনও বিষম খাইনি। অঙ্কের প্রতি বাবার ভালোবাসা ঠিক কবিতার মতোই। ছোটো থেকে দেখেছি, ফুলের বাগান করতে করতে, মাটি আর সারের পরিমাণ নিয়েও অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছেন; বাথরুমে চৌবাচ্চা ছিল, সেখানে দিব্য শিখে গেলাম একটি চৌবাচ্চা তিনটি নল দিয়ে যথাক্রমে ১০, ১২, ১৫ ঘণ্টায় পূর্ণ হতে পারে, তিনটি নল একসঙ্গে খুলে দিলে চৌবাচ্চার অর্ধেক পূর্ণ হতে কত সময় লাগবে?
উত্তর হল ২ ঘণ্টা। তো, এইরকম সরল অঙ্কের জীবনে বারান্দায় রাখা ল্যান্ড ফোন ঝনঝন করে বেজে উঠে অনিমেষ আর তথাগত নামের দুই পুরোনো বন্ধুর মিলন ঘটিয়ে জানান দিল, তথাগত ব্যস্ত নিজের পারিবারিক ব্যাবসায়। মেয়ে তিন্নি নাইনে পড়ে, ভবিষ্যতে সায়েন্স নিয়ে পড়তে চায়, অঙ্ক যদি অনিমেষ দেখিয়ে দেয় ইত্যাদি। বাবা রাজি হলেন। রবিবারের মাঝ সকালে তিন্নির উদয় এবং অঙ্ক এবং লাঞ্চ চলতে চলতে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে যাওয়া—মোটামুটি এইরকম একটা রুটিনে অভ্যস্ত হতে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। বাবা-মা তো অহরহ বলে চলেছে, বাপ রে, বড়োলোকের মেয়ে। এট্টুও নাক উঁচু নয়। কাকিমা বলে জড়িয়ে ধরে, বাড়ি যেতেই তো চায় না।
দাদা-দিদি বলে, ‘কত্ত বই পড়ে রে। মুনিয়া, দেখে শেখ।’
কত আর দেখব! জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। টর্পেডোর মতো স্পিডে কাজ করে। ফট করে লিখে ফেলল তিব্বত ভ্রমণকাহিনি দেওয়াল পত্রিকার জন্য। আবার হইহই পড়ে গেল। ভ্রমণকাহিনি! তাও আবার তিব্বত! বাড়ির চোখের মণি, মাথার হিরে হয়ে ওঠা মেয়েটা যে কত বিচ্ছু, তার খবর রাখতাম শুধু আমরা দুটি নিরীহ প্রাণ। বিচারের আশা ছেড়ে শোষিত হতে থাকলাম বলা যায়। তিন্নি ভুলভাল গল্প বলে আমাদের বোকা বানায়। যেমন একদিন বলল, “জানিস, ছোটবেলায় আমি বোবা ছিলাম।”
“বোবা?”
চোখ গোল করে সিল্কি চুলে ঝাপটা দিয়ে তিন্নি বলল, “একদম বোবা। কত ডাক্তার, কত ওষুধ, শেষে একদিন রাত্তিরে সে এল।”
এইটুকু বলে মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক করতে বসে তিন্নি। সব অঙ্ক নির্ভুল, আমরা বেকুবের মতো অঙ্ক ভুল করি। তিন্নি করুণা করে বলে, “জানা অঙ্ক ভুল করলি?”
“ঝামেলা না পাকিয়ে বলবি কে ওই সে?”
বই গোছাতে গোছাতে নির্লিপ্ত মুখে তিন্নি বলে, “স্পিচ থেরাপিস্ট।”
এরকম আরও কত, বলে শেষ করা যাবে না। তবে একদিন যেটা বলল, সেটা শুনে আমাদের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। ওর সিমলার কাকু নাকি উড়তে পারে।
“দূর! গুল দেওয়ার জায়গা পাস না? উড়ন্ত মানুষ? ইল্লি আর কি।”
পরোটা চিবিয়ে আলুর দমের বাটি চেটে পাজি বলে কিনা, “পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উড়ে যায় কাকু, গরিব-দুঃখীর কষ্ট দূর করে আসে।”
“কেউ জানে না?” রাগী গলায় বলে ভাই।
“নাহ্! কেউ না।”
“তুই দেখেছিস?”
তিন্নি সিনেমার কায়দায় মাথা নাড়িয়ে সুর করে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। আমিও যাই সিমলায়, না-হলে কাকু উড়ে উড়ে আমায় দেখতে আসে।”
“পারিসও তুই।”
“বিশ্বাস করলে করবি, না-হলে করবি না।”
“দেখাতে পারবি?”
মিটমিটে মুখ করে তিন্নি বলে, “চল সিমলা। তোদের সন্দেহ যখন তোরা চল, কাকুর কী দায় পড়েছে?”
“এই তো বললি উড়ে উড়ে কলকাতা আসে।”
“সে তো আমার জন্যে। তোদের জন্য কেন আসবে?” তিন্নি সিল্কের ফ্রক উড়িয়ে বলে, “আমার কাকু দি বেস্ট। কত্ত গল্প জানে জানিস? উড়ে উড়ে এসে কলকাতার ঘরে এলিয়েনের গল্প বলবে। আফ্রিকার মানুষখেকো আদিবাসীদের গল্প বলবে।”
মাথা বনবন করে ঘুরিয়ে ভালোমানুষের মতো মুখ করে তিন্নি অঙ্ক করে ফেলে ঝটপট।
***
দিনের পর দিন অপদস্থ হতে ভালো লাগে? কিন্তু করব কী? আমাদের উড়ন্তকাকু নেই, সিমলায় যাওয়ার উপায় নেই—তিন্নির মতো বুদ্ধিও মনে হয় নেই। হেরে যেতে যেতে মরিয়া হয়ে একদিন ভাই বলে ফেলল, “আমাদের গজুমামা আছে।
তিন্নি চোখ পাকিয়ে বলল, “সে কে?”
ভাই মহা উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নাড়িয়ে গজুমামার কীর্তি-কাহিনি বলতে লাগল, তিন্নি মন দিয়ে শুনতে লাগল। আমি বেশ বুঝেছি, এই যে মন দিয়ে শুনছে, এইবার পাকড়াও করবে। পাজির পাজি বুদ্ধির জাহাজ এই মেয়ে। যা ভেবেছি ঠিক তাই। তিন্নি আয়েশ করে বসে একটা করে তির ছুড়তে লাগল—‘মোটা চেহারার ভূত?’ ‘হাফ প্যান্ট পরে?’ ‘সে এখনও আসে?’
আমি জোরালো গলায় বললাম, “আসে। কামিনীগাছের নীচে এসে দাঁড়ায়।”
বাইরের ঘরের বড়ো ঘড়িটার পেন্ডুলামের মতো দুলে দুলে হাসতে থাকে তিন্নি। থামতেই চায় না।
গজুমামাকে এমন অপমান? মোটা ভূত? আমরা রাগে গজগজ করলে কী হবে, তিন্নি তো হেসে কুটিপাটি, ভূত নাকি মামা? হিহি হিহি।
***
তপনদাদার বিয়ের নেমন্তন্ন এসে গেল। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ। বাবা তিন্নিকে দশদিনের ছুটি দিলেন, অমনি সে দুম করে বলে বসল, “আমিও যাব বিয়েতে।”
হইহই করে তার বাবা বলে বসলেন, “যাক, ঘুরেই আসুক। এমনি তো বিদেশ ছাড়া যায় না কোথাও। দেশের মধ্যে ওই কাকুর বাড়ি সিমলা। নৈহাটি দেখে আসুক।”
ভাই আর আমার মুখ শুকিয়ে গেল, তিন্নি বিয়ে দেখবে? মোটেই না। নৈহাটিও দেখবে না। দেখবে কী, সে আমরা জানি। ভাই ভয়ে ভয়ে বলল, “দিদি রে, গজুমামা এখনও আছে তো?”
আমি বললাম, “অনেকদিন হয়ে গেল রে দীপু, এই নিয়ে কথা তো বলিনি!”
রাগে-দুঃখে-অভিমানে চোখে জল আসে। গজুমামা আছে কি নেই এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায় কাউকে? সেন্টিমেন্টের ব্যাপার। কত্তদিন পরে একটা বিয়েবাড়ি, তাও আবার মামার বাড়ির মজা—সব মাথায় উঠল। প্যাঁচার মতো মুখ করে চললাম আমরা নৈহাটি আর সঙ্গে ওই পাজির পা ঝাড়া মিচকে তিন্নি।
দুই
শীতের মনোরম সকালে ট্রেনে চেপে বসলাম। তবু ওই… খিচখিচ একটা সঙ্গেই চলল। মনে মনে ভাবলাম, যাক গে যাক। বাবা বলেন, অতিথি নারায়ণ। কিন্তু বাবা তো জানেন না, এই অতিথি দুর্জন। নারায়ণ আর দুর্জন কি এক হল?
মামার বাড়ি ঢুকে আর কিচ্ছু মনে রইল না। কত্ত লোক। কত্ত আদর। উরে বাবা। কী সাংঘাতিক সাজানো হয়েছে। চেনা যাচ্ছে না তো! মামার বাড়ি ঘিরে বিশাল উঠোন, উঠোন ঘিরে সারি সারি গাছ। এখন বাড়িটার মধ্যিখানে উঠোন জুড়ে প্যান্ডেল। চারদিকে টুনি লাইট। লোকজন, কাচ্চা-বাচ্চা, হইহই। বড়ো মামা বারান্দায় ফরাসপাতা চৌকি জুড়ে শুয়ে শুয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মজলিশ করে বসে পান খাচ্ছেন, ঘনঘন চা আসছে, থেকে থেকে হাঁক পাড়ছেন—অ্যাইও, অ্যাইও। কাকে ডাকছেন, কেন ডাকছেন কেউ বুঝতে পারছে না।
এককোণে শতরঞ্চি পেতে বসে আছে সানাইওয়ালা। কাজ ভালোই চলছে। গোটা পাড়ার লোক দৌড়ে বেড়াচ্ছে কাজে। আপন-পর ভেদাভেদ নেই। তারা এদিকে দৌড়ে যাচ্ছে, ওদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। ঘনঘন শাঁখ বাজছে, উলু পড়ছে। একদিকে মসৃণ বড়ো মাটির উনুনের উপর বিশাল কড়াই; ঝাঁঝরি হাতা দিয়ে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। বিয়ের এখনও পাক্কা দু-দিন বাকি, এখুনি এত! ভাই বলছে, “লুচি, ছোলার ডাল, জিলিপি। ইয়াহু।”
ইয়া বড়ো কাতলা মাছ এনে ফেলা হল উঠোনে। মাছের নাকে নথ, পরনে শাড়ি—সে যাবে কনের বাড়ি। মা কোথায় মিশে গেছে কে জানে! নিজের দাদার ছেলের বিয়ে, খুশিতে মা আটখানা। তিন্নি কোমরে হাত দিয়ে চাদ্দিক দেখে প্রথমবার অবাক মুখ করে বলল, “না এলে মিস করতাম, বুঝলি!”
দিদিমার ঘরে আমাদের তিনজনের থাকার ব্যবস্থা হল। সে-ঘরের বাহার কত। কারুকার্য করা বিরাট পালঙ্ক। তিনজনে হেসে-খেলে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া যাবে।
হালকা নেটের মশারি চাঁদোয়া করে লাগানো। পাট পাট তক তক বিছানায় লেসের বর্ডার দেওয়া সাদা জামা পরে থাকা মাথার বালিশ, পাশবালিশ। গরম তুলোর নরম লেপ পরিপাটি গুছিয়ে রাখা। ঘরের একদিকে আছে কাঠের পাল্লা দেওয়া খোলা জানালা। সামনে দাঁড়ালে দেখা যায় উঠোনের একটা অংশ—আকাশ আর কামিনীগাছ। আড়চোখে তিন্নির দিকে তাকিয়ে পাল্লা বন্ধ করে দিলাম। শীতের দিনে জানালা বন্ধ থাকতেই পারে। দরকার নেই এখন কামিনীগাছ দেখার। আবার না-হলে শুরু হয়ে যাবে উলটোপালটা। আর এই বাড়িতে ওইসব বললে রক্ষা থাকবে না।
তিন্নি তো উড়ে বেড়াতে লাগল। একে তো অমন ফুটফুটে, তার উপর মিষ্টি ব্যবহার—গ্রামের লোক ভাবল যেন মেমসাহেব এসেছে। আর মেয়ে তো সর্বগুণধরী। সে পটাং করে আলপনা দিচ্ছে তো সন্দেশ দিয়ে ময়ূর বানিয়ে দিচ্ছে, আবার মামার মজলিশে বসে উড়ন্তকাকুর গল্প বলে ফেলছে। কাকু উড়ে উড়ে আমেরিকা যায়, আফ্রিকা যায়, বিলেত যায়। সেখানে কী কী আছে, সেইসব বর্ণনা ছবির মতো করে বলে তিন্নি। কাজেই লোক শুনবে তো বটেই।
***
বিয়ে-বৌভাত সব মিটে গেল ভালোভাবে। দাদা-বৌদি অষ্টমঙ্গলায় যাবে। আমরাও কলকাতা ফিরব। উপহার পেয়েছি অনেক। সেগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। তিন্নির বাবার জন্য মিষ্টি বেঁধে দেওয়া হল। আর একটা রাত। তারপরেই কলকাতা। আবার অঙ্ক, আবার তিন্নির মিচকে হাসি… সত্যি! কবে যে মুক্তি পাব এই পড়াশুনোর জেলখানা থেকে। ভাবতে ভাবতে দেখি মিচকে হাসির শব্দ কানের গোড়ায়। ভুল শুনলাম না তো? তিন্নি সারাদিন বেজায় ব্যস্ত। প্যান্ডেল খুলে নেওয়া বাড়িতে উৎসবের আমেজ এখনও আছে। বারান্দায় আড্ডা হচ্ছে জমিয়ে। টুকটুক সিঁদুর লাগানো নতুন বৌদি পর্যন্ত মুগ্ধ বিস্ময়ে তিন্নির গল্প শুনছে। ভাই নিজেও আছে। কী আর করবে? সকলেই যখন বারান্দায় তখন নির্জন ঘরে মিচকে হাসে কে? তাকিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তাই, এই মিচকে হাসির পেটেন্ট নেওয়া আছে। কোনও পেত্নীর ক্ষমতা নেই একে কেড়ে নেবে! গম্ভীর গলায় বললাম, “গুছিয়ে নে। কাল দুপুরে ট্রেন।”
তিন্নি এক লাফে সামনে এসে বলল, “তাই নাকি? যেন তুই একলাই জানিস!”
“এ আবার কেমন কথা? ক্ষেপে গেলি নাকি?”
ঘরের মধ্যে এক পাক ঘুরে নিয়ে তিন্নি বলে, “ক্ষেপে আমি যাইনি, তুই এখন যাবি।”
আমি এবার সত্যি ভয় পেলাম। এই মেয়েটার মতলব বুঝব আমি? গোঁজ হয়ে বললাম, “তুই এখন যা। রাত হচ্ছে। গুছিয়ে নিতে হবে।”
“একটা কথা বল তো মুনিয়া, গজুমামা পালিয়ে গেল? এত লাইট, এত লোক! তাকে তোরা নেমন্তন্ন করিসনি? হিহিহি।”
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। এই ভয়টাই করছিলাম। ভেবেছিলাম ভুলে গেছে। হায় হায়। সূর্য ভুল করে পশ্চিমদিকে উদয় হতে পারে, দাদা গাট্টা মারা ভুলে যেতে পারে, কিন্তু তিন্নি? কিচ্ছু ভুলবে না। কিচ্ছু না। আমি কোণঠাসা বেড়ালের মতো চাপা গলায় বললাম, “তিন্নি! চুপ করবি!”
“কেন রে? ভয় করছে? দেখ, তোর গজুমামার বাড়িতেই আমার উড়ন্তকাকু জিতে গেছে। এবার থেকে আর একবারও ওই নাম করবি না। অক্কে? চললাম।”
ঝড়ের মতো চলে গেল মেয়েটা। আমার এত দুঃখ হল, এত অপমান—এই চোদ্দ বছরের জীবনে কোনোদিন হইনি। সত্যিই তো, একবারও গজুমামার কথা মনে পড়েনি। কেউ বলেওনি। কেন? নতুন বৌ বাড়িতে এল, সে সকলকে চিনল জানল, এমনকি তিন্নির উড়ন্তকাকুর কথা শুনল, আর বাদ রইল গজুমামা?
উপরের ঘরের বিছানায় চুপ করে বসে রইলাম। চারদিকে নতুন প্যাকেট খোলা। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল উঠোন। কী সুন্দর চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ ঘাসে। পাশের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে গল্প-হাসির টুকরো আওয়াজ। তিন্নির গলা—“কাকু, তারপর কী করল জানো…”
নাহ্। কেউ মুনিয়ার খোঁজ করছে না। অভিমানে চোখ ভরে এল। ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, আধো অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে শিশিরে ভিজে যাচ্ছে কামিনীগাছ। চোখ জলে ভরে এল। মনে মনে বললাম, ‘গজুমামা, সকলে এখন উড়ন্তকাকুর ম্যাজিক গল্প শুনছে। কামিনীগাছের নিচে একলা দাঁড়ানো তুমি তো দেশ-বিদেশ যাওনি। উড়তে পারো না। আমরা হেরে গেলাম গজুমামা। আমরা হেরে গেলাম।’ বিচ্ছিরি মনখারাপ হলে ঢোঁক গিলতে কষ্ট হয়। ওইরকম একটা কষ্ট বুকে নিয়ে মশারি গুঁজে শুয়ে পড়লাম।
তিন
রাত কত হবে? ঘরে ঘুটঘুট অন্ধকার। কী জানি কেন ভেঙে গেল ঘুম। যেন বাধ্য হলাম চোখ মেলতে। অবোধের মতো তাকিয়ে আছি মশারির চালের দিকে। দিদিমার পালঙ্কে শুয়ে আছি। ঘরে কীসের যেন গন্ধ… ফুলের গন্ধ? মিষ্টি গন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেউ আছে ঘরে। খাট নড়ে উঠল একবার। প্রাণপণ চোখ বুজে ভাবছি ভাই কোথায়, তিন্নি কোথায়। লেপের মধ্যে হাতড়ে ভাইকে ধরার চেষ্টা করতে দেখি জায়গাটা খালি। আমি ওদিকে হাত বাড়ালাম। তিন্নি? জায়গাটা খালি। তিন্নি নেই।
গা ছমছম করছে আমার। ও কী! ঘরের জানালা হাট করে খুলে দিল কে? চাঁদের আবছা আলোয় দেখছি, ভাই দাঁড়িয়ে খোলা জানালার সামনে। ভয় ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম, “দীপু!”
মুখে আঙুল দিয়ে তাকিয়ে ইশারায় ডাকল ভাই। আমি লাফ দিয়ে মশারি উঠিয়ে জানালার ধারে পৌঁছে যেতে ভাই আঙুল দিয়ে বাইরে উপরের আকাশ দেখাল। এ কী দেখছি! এ কী? ভয়ে পেটের ভিতর গুড়গুড় করতে লাগল। ঠান্ডা হাত দিয়ে ভাইকে চেপে ধরে কোনোমতে বললাম, “দীপু, ওটা কী?”
সাদা জোছনায় ভেসে যাওয়া উঠোনের উপরে উড়ছে তিন্নি। যেন কেউ ধরে আছে ওর কোমরের কাছে আর প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে ভেসে আছে ও। কী অদ্ভুত দৃশ্য! ভাসতে ভাসতে জানালার কাছে আসতে নাকে এল ফুলের মিষ্টি গন্ধ। তিন্নি কাঁদছে। উড়তে উড়তে কাঁদছে আর বলছে, “আমাকে ছেড়ে দিতে বল। নামিয়ে দিতে বল।”
“তুই কি উড়ন্তকাকুর সঙ্গে আছিস?” উত্তেজনায় বলে উঠলাম আমি।
তিন্নি হাঁকুপাঁকু শূন্যে সাঁতার কাটতে কাটতে বলল, “কেউ নেই। উড়ন্তকাকু নেই। গুল মেরেছিলাম।”
“তবে তুই উড়ে বেড়াচ্ছিস কী করে?”
ভাই হাসি হাসি মুখে বলল, “গজুমামা নিয়ে গেছে। উড়ন্তকাকু নেই, কিন্তু গজুমামা আছে। তিন্নি দিদি, তুমি সরি বলে দাও। গজুমামা তোমায় নামিয়ে দেবে।”
ঝাঁপিয়ে এল মিষ্টি গন্ধ। যেন বুকে জড়িয়ে ধরল আমাদের। আহা! জুড়িয়ে গেল শরীর। কী আনন্দ! কী আনন্দ! মন ভালো হলে পৃথিবী সুন্দর হয়ে যায়। দুর্জন হয়ে যায় নারায়ণ।
গজুমামা এই ম্যাজিক জানে। মন ভালো রাখার ম্যাজিক। তাই গজুমামা জিন্দাবাদ।
অলঙ্করণ- অর্ক পৈতণ্ডী