জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
(জো টাসকার-এর লেখা সহ)
দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ্, অবিশ্বাস্য! সে কারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর-পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
পশ্চিমের ডায়েরি
“একটা ডাউন জ্যাকেট পরে গুটিশুটি মেরে রোদ আড়াল করে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে গত চারদিনে এই প্রথমবার একটু পানীয় গলায় দিতে পারলাম, বেঁচে যাব বোধ হয়। যেসব ছবিগুলো তুলেছিলাম, সবকটা এক্কেবারে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়, ওগুলোর মধ্যে একখানা অন্তত রেখে দেব নিজের কাছে, স্রেফ এই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম এটা মনে রাখার জন্য। আমার সামনে হিমবাহটা একটা সাদা মরুভূমির মতো ছড়িয়ে আছে, মনে মনে ভাবছি ওখানে লোকজন আছে। তার ওপাশে চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম দেয়াল, বিশাল একটা সিনেমার পর্দার মতো, যার ওপর কখনও কোনও ছবি পড়েনি।”
দুনাগিরিতে বেঁচে গিয়েছিল জো টাসকার, আর জীবন ফিরে পেয়েছিল ‘শাইনিং মাউন্টেন’-এর পশ্চিমদিকে পৌঁছে।
শরৎকালটা কেটে গিয়েছিল, ইতিমধ্যে আমিও পশ্চিম দুনিয়ায় ফিরে গিয়েছিলাম।
“এই চিঠিটা দেখেছ?” অফিসে ডেনিস গ্রে একদিন জিজ্ঞাসা করল। আমরা দুজনেই কাজ করতাম ম্যানচেস্টারের ব্রিটিশ মাউন্টেনিয়ারিং কাউন্সিলে। “কী চমৎকার একটা প্রচেষ্টা!” ও আবার বলে। আমি চিঠিটা তুলে নিয়ে দেখি, ডিক র্যানশ’র লেখা। ও সবে জো টাসকারের সঙ্গে গাড়োয়াল হিমালয় থেকে একটা অভিযান সেরে ফিরেছে। ওদের সাফল্যের পরিমাণটা চিঠির সামান্য ক’টা শব্দের মধ্যে থেকে ফুটে বেরোচ্ছিল।
প্রিয় ডেনিস,
আমরা দুনাগিরি চড়েছি। দক্ষিণ-পূর্ব গিরিশিরা ধরে ছ’দিন লেগেছে উঠতে। চূড়ায় যখন পৌঁছলাম, খাবার শেষ, বরফ গলিয়ে জল বানানোর জন্য জ্বালানিও শেষ। নেমে আসতে পাঁচদিন লেগেছে, দুর্ভোগও গেছে আমাদের। আমার কয়েকটা আঙুলে তুষারক্ষত হয়েছে, আর শিগগিরই দিল্লি থেকে ফ্লাইটে বাড়ি আসছি। জো গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে ফিরছে।
ইতি তোমার ডিক
পুনশ্চ: এভারেস্ট চড়ার জন্য পিটকে অভিনন্দন।
ভেতরে ভেতরে হিংসে হচ্ছিল, ধপ করে বসে পড়লাম। এর মধ্যেই ডেনিস স্থানীয় কোনও প্রেসের সঙ্গে কথা বলছিল, “সহনশীলতার চরম একটা নিদর্শন… স্রেফ ওরা দুটো লোক… স্বল্প বাজেট… ২৩,০০০ ফুট উঁচু শৃঙ্গ। সাম্প্রতিক দক্ষিণ-পশ্চিমদিক দিয়ে এভারেস্টের মাথায় ওঠার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।”
টাইপ রাইটারের খটখট, ডুপ্লিকেটিং মেশিনের পর্যায়ক্রমে ঘটঘট শব্দের মধ্যে কষ্ট করে কথাগুলো শুনতে হচ্ছিল। কাচের দেয়ালের ওপারে লাল ইটের অফিস-বাড়ি, এলোমেলো, পার্কিংয়ে ডাঁই করে রাখা গাড়ি, আর নিঃস্ব লোকেদের আস্তানা, আমি ওর ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম।
শূন্য চোখে সামনে চিঠির ট্রের দিকে চেয়ে ছিলাম। প্রবেশাধিকার সমস্যা, সমিতির বৈঠক, যন্ত্রপাতি সম্পর্কিত খোঁজখবর। ওরই মধ্যে সম্বর্ধনা আর নৈশভোজের নিমন্ত্রণ, এভারেস্ট আরোহণ নিয়ে বক্তৃতার অনুরোধ – সবকিছু মিলিয়ে হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা দাবি করছিল আমার কাছে। এত কিছু এসে হাজির যে আমার কাজের গুণাগুণ ঘেঁটে গিয়েছিল। আমার মাথার মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এভারেস্ট একটা বেফালতু একঘেয়ে ব্যাপার।’ আগেরদিন সন্ধ্যাতেই এভারেস্টের ওপর একটা স্লাইড শো দেখিয়েছি। মনে হচ্ছিল আমি নিজেই একপাশে দাঁড়িয়ে আমার কথাই শুনছি। একটা আরোহণের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেলে ওটার কথা বললে মনে হয় যেন অন্য কারও সম্পর্কে বলা হচ্ছে। শেষে ওই একইরকম কিছু প্রশ্ন উঠল, চূড়ায় ওঠার পর কেমন লাগে? আপনাদের কী কী খেতে হয়? পাহাড়ের ওপরে কীভাবে ছোটো বাইরে বড়ো বাইরে যান? নীচে নামাটা কি বেশি শক্ত? কতদিন লেগেছিল আপনাদের? এভারেস্টে ওঠার পর আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আপনার এখন সবকিছু করা হয়ে গেছে? সত্যি কী অসামান্য সাহস আপনার!
সাহস। সহনশীলতা। শব্দগুলো অফিসের মধ্যে ভেসে ভেসে আমার খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটাকে ব্যঙ্গ করতে লাগল। অর্থহীন। সাহস হচ্ছে সেইটা করতে পারা যা করতে তুমি ভয় পাও। যে লোকগুলো এত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রশংসা করে, তারা একপ্রকার অন্ধ, পর্বতাভিযানের এই বিশ্রী হৈ-হৈ নাটক লোকগুলোর সিদ্ধান্তকে একপেশে করে রাখে। স্বাভাবিক জীবনযাপনেই এমন অনেক ছোটো ছোটো নিদারুণ ঘটনা আছে যার মুখোমুখি হতে গেলে আরোহণের নিশ্চিত বিপদের মুখোমুখি হবার চেয়েও অনেক বেশি সাহস লাগে। সহনশীলতা। একটা উঁচু পাহাড়ে ওঠার চেয়ে শহরে কাজ করতে অনেক বেশি সহনশীলতা লাগে। ছোটবেলার স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে, গলা টিপে মেরে, পশ্চিমী সভ্যতার যাঁতাকলে পেষাই হতে হতে, রোজকার কাজে জুড়ে থাকতে অনেক বেশি সহনশীলতা লাগে। ‘সত্যিই বিরাট পর্বতারোহীরা।’ কিন্তু কী এই পর্বতারোহীরা? পশ্চিমের পেশাদার নায়ক? পালাতে চাওয়া পরজীবীর দল, যারা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার খেলে? একরোখা স্কুলছুটের দল যারা আলাদা কিছু করার কথা ভাবে? অসুখী আর আত্মম্ভরীর দল যারা নিয়মানুবর্তীতায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না?
“তুমি এটার উত্তর দেবে পিট?”
“ও হ্যাঁ। দুঃখিত।”
আমাদের অফিসের একজন সেক্রেটারি রিটা ফোনের রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরে আছে, “কারও একজনের দড়ি ছিঁড়ে গেছে, আর ম্যানুফ্যাকচারার বলছে ওটা ওদের দিক থেকে কোনও ত্রুটি নয়।”
“আচ্ছা আমি দেখে নিচ্ছি।” আমি বলি। শহরে হোক কি পাহাড়ে, সর্বত্র সহনসীমা তো একটা না একটা থাকবেই।
সেই সেপ্টেম্বরে এভারেস্ট অভিযানে আমি প্রায় মরতেই বসেছিলাম। শেরপা পারতেম্বা আর আমিই শেষ মাইক বার্ককে দেখেছি, চূড়া থেকে নামার সময় ঝড়ে ওকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। চূড়ায় ওঠার গিরিশিরাতেই ওকে হারিয়েছি আমরা, আর ওকে ছাড়াই নেমে আসার সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে হত। কিন্তু আমি ফিরে এসেছিলাম এমন একটা একক সিদ্ধান্ত আর অভিজ্ঞতা নিয়ে যা আমি কারও সঙ্গে ভাগ করতে অপারগ ছিলাম। ভেতরে ভেতরে অনেকটা পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমটা নামার মরিয়া চেষ্টা করার সময় আমার ভেতরে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গিয়েছিল। প্রায় দু-দুবার পথ হারাই, তুষারঝড়ের ভেতরে তুষার ধ্বসে পড়ে ছিটকে যাই, তবু ভেতরে ভেতরে মন শক্ত করেছিলাম, নামবই। আমার গায়ের জোর আর মনোবল লোহার মতো শক্ত ছিল। এক্কেবারে একলা, কিন্তু আমি কিছুতেই মরে যাব না। ছ’নম্বর শিবিরে পৌঁছনোর পর, আর তার পরের ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে টানা ঝড়ের সময় এই সহজসরল মনোভাবটা আর ছিল না। কিন্তু তারপরে এই আগের ঘটনাগুলো আমায় মনে করে রাখতে হয়েছিল।
এখন ম্যাঞ্চেস্টারে ফিরে এসে আমি নিতান্তই ক্লান্ত আর বিষণ্ণ হয়ে আছি। আমার জীবন জুড়ে এখন একটা ঘটনাই ছেয়ে আছে। এভারেস্টে, একটা বড়ো সুসংবদ্ধ অভিযানের সঙ্গে জড়িত থাকা শ’খানেক লোক আমাকে চূড়ায় ওঠার দিনটা উপহার দিয়েছিল। বাকি সময়টা পাহাড়ে থাকার সময় আমি কেবল উপরে উঠতে থাকা নিয়ন্ত্রিত ভিড়ের একটা অংশমাত্র ছিলাম, অপেক্ষায় থাকতাম কখন দলনেতা পরের নির্দেশটা দেবেন যে ঠিক কী করতে হবে আর কোথায় থাকতে হবে এবং তাও, যখন ব্রিটেনে ফিরে এলাম, সাধারণ লোকের কাছে আমি ওই অভিযানের চারজন নায়কদের একজন, বেঁচে ফিরে আসা আরোহীদের একজন। নিঃসঙ্গতার মধ্যে এসব তারিফ আমার অন্তঃসারশূন্য লাগত, আর এই হঠাৎ খ্যাতি, অল্পদিনের জন্য যদিও, আমায় খানিকটা অসুস্থই করে তুলেছিল। আমি কোনোমতে একটু একলা হতে চাইছিলাম যাতে এভারেস্টের ব্যাপারটা একটু হজম করতে পারি। আমি খানিকটা থিতু হতে চাইছিলাম যাতে সকালের ভেবে রাখা কথাগুলো সারাদিনে একটা আদল পেতে পারে, একটা কোনও মানে দাঁড়ায় ভাবনাগুলোর।
আমি এখন জনগণের সম্পত্তি আর অফিসের বাইরে এগারো সপ্তাহ কেটে গেছে; বেশ বুঝতে পারছি, কোনও সন্দেহ নেই, শেষ অভিযানের জন্য আমায় কয়েক বছরের পাওনা ছুটি দেওয়া হয়ে গেছে। ষোলোটা সমিতির সদস্য ছিলাম আমি। তবু আমার মনে হচ্ছিল একটা নতুন, দারুণ কোনও পরিকল্পনার দরকার, নতুন কোনও প্রকল্প। আমি দেখতে চাইছিলাম নিজেকে কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি, পাহাড়ের ওপরে নিজেকে ক্ষমতার কোন সীমা অবধি ঠেলে দিতে পারি। মাত্র চব্বিশ বছর বয়েসে অভিযান আর অ্যাডভেঞ্চারের করার মতো আমার সামনে কত কত পাহাড়ি এলাকা রয়েছে।
আমি যে জো টাসকার আর ডিক র্যানশ’র আরোহণটা নিয়ে বেশ ঈর্ষায় রয়েছি তা শুধু দুনাগিরির যে গিরিশিরা ওরা চড়েছে তার দুরূহতা আর সৌন্দর্যের জন্য নয়, তার কারণ কিন্তু এভারেস্ট অভিযানের বিপরীতে কেবলমাত্র ওদের দুজনের অভিযানের ব্যাপারটা আমি জানতাম বলে, অনেক বেশি নমনীয় আর অ্যাডভেঞ্চারের অনিশ্চয়তা ছিল ওতে এবং ওরা দুজনে মিলে অপরিহার্যতা এবং আত্মতুষ্টির চরমে পৌঁছেছিল।
শীত পড়ে গেছে, জো টাসকার অফিসে এল। শহরের বাইরে কাছাকাছিই থাকত ও। গ্রীষ্মের গোড়া থেকে ওকে দেখিনি, মাঝে মাঝে অভিযানের কাজকর্ম করার সময় ফোন-টোন করত।
“ডিক কেমন আছে, জো?”
“তিনটে আঙুলের মাথা কালো হয়ে গেছে, জানি না ওগুলো ও হারাবে কি হারাবে না! বেশ কয়েকদিন ও চড়তে-টরতে পারবে না। দিল্লির হাসপাতালে মাস তিনেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে ও।”
“একটা ঐতিহাসিক ঘটনা যা হোক। তুমি ফিরেছ কদ্দিন?”
“এই কয়েকদিন হল। গাড়িটা কাবুলে এসে দেহ রাখল আর আমায় সমস্ত মালপত্র একের পর এক বাসের মাথায় ডাঁই করে ফিরতে হল।”
কয়েক সপ্তাহ বাদে, ক্রিসমাসের সময়। বহুদিন ধরে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে সভাসমিতি, বক্তৃতা-টক্তৃতা করে আবার টেলিফোন টাইপ রাইটারের মধ্যে এসে বসেছি, শহরের মাথা খারাপ করা কাজের মধ্যে ন্যালাখ্যাপার মতো অবস্থা আমার। জো এসে টেবিলের উলটোদিকে বসল।
যেভাবেই হোক শাইনিং মাউন্টেন জো-র কাছে আর নেহাতই অলীক অবাস্তব ভাবনা হয়েই কেবল ছিল না।
ও বলল, “আগামী বছর চ্যাঙাব্যাঙের পশ্চিম দেয়াল আরোহণ অভিযান করার ব্যাপারে তোমার কী মত?”
চাইছিলাম ও এত জোরে জিজ্ঞাসা না করলেই ভালো হত, যে-কেউ শুনে ফেলতে পারে।
“হ্যাঁ, ভালোই তো। হ্যাঁ, ইয়ে, যেতেও চাই। কিন্তু সমস্যা একটাই, এভারেস্টের জন্য বহুদিন ছুটি নিয়েছিলাম। মনে হয় না আগামী বছরের অভিযানের জন্য আবার এতদিন ছুটি পাব।”
জো একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি আমি আমার আগ্রহ প্রকাশ করব, ভাবেনি। ও আমাকেই প্রস্তাবটা দেয়ায় বেশ খুশি হয়েই আমি একেবারে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
বি.এম.সি.-তে সেদিন ক্রিসমাস পার্টি, আর একটু বাদেই দেখি ওপর তলায় পাবে জো ডেনিসের সঙ্গে কথা বলছে। তার পরপরই ও আমায় এসে বলল, “ডেনিস তো খুবই উৎসাহী। ও বলেছে, ‘আমার ওপর ছেড়ে দাও, ভায়ারা’, – মনে হয় ম্যানেজমেন্ট কমিটি রাজি হলে তোমার ছুটি পেতে অসুবিধে হবে না।”
আমার মনে হল না রাজি হবে, কিন্তু কিছু বললাম না। আমি কাউকেই কথাটা বলিনি। জো-র পরিকল্পনা আমায় স্রেফ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
এখন আমার জীবনে দুটো নতুন জিনিস, জো টাসকার আর চ্যাঙাব্যাঙ। জো-র সঙ্গে এর আগে একসঙ্গে কোথাও চড়িনি, কিন্তু ওর সুখ্যাতি শুনেছি অনেক। ১৯৭১ সালে আল্পসে আমাদের প্রথম দেখা হয় – ড্রোইটস-এর উত্তর পার্শ্ব গিরিশিরায়। আমি আমার এক বন্ধু, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মার্টিন র্যাগ-এর সঙ্গে চড়ছিলাম। অন্ধকারের মধ্যেই আমরা মূল রাস্তা বরাবর চড়তে শুরু করেছিলাম, আর অবাক হয়েছিলাম দেখে যে কয়েকশো ফুট ওপরে আরও দুটো আলো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সকাল নাগাদ, পাহাড়ে আলো ফোটার সময়, আমরা ওদের পেরোনোর সময় দেখি ওরা দুজন ইংরেজ আরোহী, ওখানে রাতে বিভক করে ছিল – জো টাসকার আর ডিক র্যানশ’। ‘নামও শুনিনি আগে’ মনে মনে ভেবে আমরা দ্রুত আমাদের চড়া জারি রেখেছিলাম।
মার্টিন আর আমি নিজেদের নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলাম, কারণ তার আগের সপ্তাহেই আমরা ম্যাটারহর্নের নর্থফেস চড়ে ফেলেছি। ড্রোইটসে অবস্থাটা বেশ খারাপ ছিল, কিন্তু আমরা তখন যুবক আর অনভিজ্ঞ, ফলে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় চড়ছিলাম আমরা। চারদিকে ভীষণ শক্ত বরফ, বাধ্য হচ্ছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা বরফের মধ্যে স্টেপ কাটতে, ক্লান্তও হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু দেখি ওই দুজন ক্লাইম্বার ঠিক আমাদের পেছনেই। কোনোভাবেই ওদের ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছিল না। প্রায় সন্ধের মুখে মুখে আমরা আড়াআড়ি উত্তরদিকের দেয়ালে পৌঁছে গিয়েছিলাম, চেষ্টা করছিলাম একটু সহজ ওঠার রাস্তা, বরফ কম থাকবে, এমন রাস্তা খুঁজতে। ততক্ষণে বরফ পড়ছে আর আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যদি ওই দুজন আমাদের পেছনে না থাকত কিংবা যদি ফিরে যেত তাহলে হয়তো আমরা অনেক আগেই চড়া বাদ দিয়ে পিছু হটে যেতাম। পাহাড়ের ঢালে একটু বসার জায়গা অবধি ছিল না। আমি আর মার্টিন পালা করে একে অন্যের কোলে বসে গোটা রাত কাটালাম, ওদিকে জো আর ডিক কয়েকশো ফুট নীচে বিভক করে আমাদের থেকে সামান্য ভালো করে রাতটা কাটাতে পেরেছিল। পরেরদিন ঝড় আছড়ে পড়ল—অবিশ্রাম বৃষ্টি, ঝড়, বজ্রপাতের মধ্যে আমরা চারজন একসঙ্গে দল করে পরপর বাইশখানা পিচ দড়ির সাহায্যে নেমে এসেছিলাম আর্জেন্টিয়ার হিমবাহে। হিমবাহে পৌঁছেই অবশ্য আমরা আলাদা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম।
পরের চার বছর আর আমি জোকে দেখিনি।
ওই চার বছরে জো আল্পসে প্রচুর চড়াচড়ি করে ফেলেছে, মূলত ডিকের সঙ্গে এবং ধারাবাহিকভাবে। সত্যি বলতে কী, আরোহণে কোন রুটে কতটা নামডাক, কতটা খ্যাতি এসবের তোয়াক্কা না করেই জো চড়ে যাচ্ছিল আর এভাবে প্রচুর আরোহণ ওর ঝুলিতে জমা হচ্ছিল যার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখ করা যায় ১৯৭৪–এ গ্রান্ডে জোরাসেস (ফরাসি গ্রঁন্দ জুহাস)-এর পূর্ব ঢাল, আর ১৯৭৫-এর শীতে আইগার-এর পশ্চিম ঢাল।
ক্রিসমাসের পর আমি উত্তর ওয়েলসে আমার স্থানীয় ক্লাইম্বিং ক্লাব, মিনিড-এ চলে গিয়েছিলাম, ওখানেই কথায় কথায় চ্যাঙাব্যাঙের পরিকল্পনার কথা একটা বন্ধুকে বলে ফেলেছিলাম—আর সেটাই একটা সাংঘাতিক বোকার মতো ভুল হয়েছিল আমার। কেননা কথাটা আমার বান্ধবী শুনে ফেলেছিল, আর ও ওই প্রথম ব্যাপারটা শুনল। এর আগে এভারেস্ট আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর তারপর সে জায়গাটায় এবার চ্যাঙাব্যাঙ।
১৯৭৫-এর গোড়ার দিক, তখন আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি। আমি জো আর ডিককে সে বাড়িতেই একদিন নেমন্তন্ন করলাম খাবার জন্য। আমার মা ছিলেন পাহাড়ি পত্রিকার একেবারে পোকা, সমস্ত খবরাখবর রাখতেন। উনিই খাবারদাবার সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলেন একেবারে। জো বা ডিকের সঙ্গে আমার বাবা-মায়ের সেবারই প্রথম দেখাসাক্ষাৎ। ব্যাপারটা এমন লাগছিল, যে ওঁরা জোকে মেপে নিচ্ছিলেন, পরীক্ষা করে দেখছিলেন, যে মানুষটা ওঁদের ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে সে কেমন লোক। ডিকের তখনও চিকিৎসা চলছে, আর আঙুলগুলোর বেশ খারাপ অবস্থা। যে প্রশ্নটা করা হচ্ছিল না সেটা এরকম, দুনাগিরিতে ওই কঠিন পরিস্থিতিতেও জো-র তো আঁচড়টি লাগেনি, তাহলে পিটের সঙ্গেও কি এরকমই হবে? খাবার সময়টাতে ডিক যথারীতি শান্ত, চুপচাপ, ভদ্র—ও যেমন থাকে আর কি। জো কিন্তু সারাক্ষণ এভারেস্ট অভিযানের বহর আর তা কতটা প্রচার পেল তা নিয়ে খুঁচিয়ে গেল আর ব্যঙ্গ করে গেল। ও বলল, “আমার মতে এভারেস্ট চড়াটা আরোহণের নিরিখে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, বরং সাংগঠনিক দিক থেকে ঠিক আছে।”
আমার মনে হচ্ছিল জো খানিকটা বিরক্ত যে এভারেস্ট চূড়ায় আমি চড়েছিলাম, ও নয়। আলপাইন ধরনের আরোহণে জো-র দুনাগিরি শৃঙ্গ আরোহণ শুধু যে দুর্দান্ত কাজ ছিল তা-ই নয়, হিমালয়ের বুকে এইধরনের আরোহণের ভবিষ্যতকে ও কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ডেনিস গ্রের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ওর এই কাজটা এভারেস্টের ছিটেফোঁটা খ্যাতিও পায়নি। নিষ্পাপ ভাবনা—আমি এভারেস্ট নিয়ে একটু বেশিই স্পর্শকাতর হয়ে ছিলাম, জো-র উচ্চাশার উৎসগুলো আমার কাছে বন্ধ দরজার মতো ছিল, অজানা। যা হোক, এটা নিশ্চিত যে দুনাগিরি চড়ে ফেলার পর সন্তুষ্ট হবার বদলে মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে এখনও অনেকটা খিদে আছে, পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়নি ও।
খাওয়াদাওয়ার পর জো আমাকে চ্যাঙাব্যাঙের পশ্চিম দেওয়ালের স্লাইড দেখাল। ছবিগুলো ও দুনাগিরির শিখর থেকে আর রামানি হিমবাহে, ওদের বেস ক্যাম্পের সামান্য ওপর থেকে নিয়েছিল, যেখানে দুনাগিরি আরোহণ শেষ করে ফেরার সময় প্রথম জল পেয়েছিল। নেমে আসার সময় জো আর ডিক এতটাই অবসন্ন আর ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল যে ওরা আলাদা আলাদা হয়ে গিয়ে শেষ এক হাজার ফুট গিরিশিরার দু-দিক দিয়ে নেমে আসে আর দেয়ালের নীচে জো একটা টালমাটাল অবস্থায় এসে পৌঁছয়। সে-সময় অবশ্য এসব আরোহণ-টারোহন ওর মাথায় আসেনি। কেবল বাড়ি ফেরার দীর্ঘ যাত্রাপথে ওর মাথার মধ্যে আবছা একটা অভিযানের পরিকল্পনা পাকিয়ে উঠতে থাকে। স্লাইডের ছবিগুলো দেখে যেমন মুগ্ধ হলাম, তেমনি ভয়ও লাগল। পাহাড়ের ঢালটা ভীষণ খাড়া আর ওর গায়ে নিরবচ্ছিন্ন কোনও দুর্বল অংশ নেই, কেবল এক-দু’ জায়গায় একটু একটু তুষার অথবা বরফ রয়েছে, বাকিটা ফাঁকা, খালি গ্রানাইটের স্ল্যাব আর ওভারহ্যাং। এই-ই হল চ্যাঙাব্যাঙ।
জো আগেকার প্রজন্মের পর্বতারোহীদের মধ্যে পড়ে না – এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে দেখে হতবাক হয়ে গেছি সংবাদ মাধ্যমের কাছে বনিংটন, স্কট বা হাসটনের মতো পর্বতারোহীদের কীসব ভাবমূর্তি – কিন্তু এইবারে একজনকে পাওয়া গেছে যার সঙ্গে সমস্যাটার কথা আমি সমানে সমানে আলোচনা করতে পারি।
“তাহলে লাইনটা কোথায়?” আমি জিজ্ঞাসা করি।
জো একটু থমকে গেল। “ইয়ে, মানে এটা একটা দারুণ পাহাড়ের ঢাল, বেশ আকর্ষণীয় – মানে বলতে চাইছি এটা পুরোটাই তো একেবারে খাড়া উল্লম্ব হতে পারে না। কোথাও কোথাও এর ওপরে বরফ আর তুষার জমেও আছে। যাই হোক, যখন আপাতভাবে ফাঁকা মসৃণ একটা দেওয়ালের কাছাকাছি হবে, ওর গায়ে নানারকমের বৈশিষ্ট্য তোমার নজরে আসবে।”
ও বরফের ঢাল আর ছায়া ছায়া রেখাগুলো দেখাচ্ছিল, ওগুলো নিশ্চয়ই পাথরের দেওয়ালের খাঁজ বা ফাটল হবে। পর্দার ওপর আমাদের আঙুলগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওই সময়টা জো-র কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ও পরে লিখেও ছিল –
‘একটা দ্বিতীয় মতামত পাওয়া অবধি আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে এটা একটা শখের দিবাস্বপ্ন, নাকি সত্যিই সম্ভব এমন একটা প্রস্তাব। পিট যদি এই প্রকল্পটার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত, তাহলে উৎসাহ উদ্দীপনাটাই হারিয়ে যেত আর এই উদ্যোগটায় আমার ভরসা ক্রমশ কমতে থাকত। আমি এই ভাবনাটার ওপরে ওর একটা মতামত বার করে আনতে চাইছিলাম, কিন্তু এ ব্যাপারে ও একেবারেই ঘাড় পাতছিল না। আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে ওর প্রশ্নগুলো সন্দেহ থেকে নয়, আগ্রহ থেকে উঠে আসছিল – ভাবনাটার মধ্যে ও আসলে ঢুকে পড়েছে।’
আমি জানতাম, আমি যাবই। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম এমন একটা খ্যাপাটে অভিযানে গিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফিরতে পারব কি না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কী বলো, ডিক?”
“মনে তো হয় হয়ে যাবে।” ডিক বলল। কিন্তু ওর তো পরখ করে এটা প্রমাণের ব্যাপার ছিল না। আমার মনটা লাফ দিয়ে উঠল আর ভেতরে ভেতরে গোটা প্রকল্পটা গ্রহণ করে নিল।
আমি কেবল এবং কেবলমাত্র চড়তেই চাইছিলাম। ক্লাইম্বিং। এমন কিছু, যেটা একেবারে সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ হবে, যা এভারেস্টের কারণে জনতার যে সুখ্যাতি পেয়েছি সেই অনুযায়ী আমার আত্মসম্মানটা ঠিকঠাক বজায় রাখে। এভারেস্টে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমার আবেগ, অনুভূতিতে একটা বড়োসড়ো ফাঁক তৈরি হয়েছে যেটা ভরাট হওয়া প্রয়োজন। বি.এম.সি রাজি হয়েছিল, আমার পাওনা চার সপ্তাহের ওপর আরও অতিরিক্ত দু-সপ্তাহ ছুটি দিয়েছিল এই অভিযানের জন্য। গ্রীষ্মকালের অপেক্ষায় অধীর হয়ে ছিলাম, মাঝের লম্বা লম্বা মাসগুলোর সময় কেবল কাটিয়ে উঠতে হবে।
এর মধ্যে জো অভিযানের বেশিরভাগ কাজটা করছিল। প্রথম সমস্যা হল, এই প্রচেষ্টাটার জন্য ভারত সরকারের অনুমতি জোগাড় করা। লেকল্যান্ডের কিছু আরোহীরা ইতিমধ্যে দক্ষিণ ঢাল বরাবর চড়বে বলে অনুমতি নিয়ে রেখেছে। জো ওদের এবং ভারতীয়দের বোঝাতে লাগল যাতে আমাদের যেতে অনুমতিটা দেয়। দু-দলের কেউই প্রথমটা খুশি হয়নি। যাই হোক, ভারতে জো-র প্রভাবশালী বন্ধুরা ছিল, আর এদিকে ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনও প্রথবার চিঠিতে বলে দিয়েছিল, ‘আমরা মনে করি, দুজন আরোহীর দলের পক্ষে চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ করতে যাওয়া নিরাপদ হবে না।’ তা সত্ত্বেও বন্ধুদের দিয়ে তদ্বির করার ফলে শেষ অবধি আমাদের রওনা হবার ক’দিন আগে অনুমতিপত্র এসে পৌঁছল। দি মাউন্ট এভারেস্ট ফাউন্ডেশন আমাদের ভালো একটা টাকা সাহায্য করেছিল; কমিটির অনেক সদস্য অবশ্য ন্যূনতম চারজন সদস্যের দল হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিল। এগুলো জো-র কাছে ইন্ধনের মতো ছিল। কোনও বাধা পেয়ে কী করব কী করব ভাব যখন, তখনই এসব ঘটনা ওকে উৎসাহ জোগাত। বিশ্বাসে কালাপাহাড় ছিল ও, পর্বতারোহীদের দুনিয়ায় যে-সমস্ত ভাবনা, আচরণ বা কিংবদন্তি, ব্যক্তি বা প্রাচীন বিশ্বাসকে ঘিরে চালু ছিল, তার কোনও কিছুর ওপর ওর কোনও শ্রদ্ধা ছিল না।
আমি লেকল্যান্ড-এর টিমের টেড রজার্সের সঙ্গে দেখা করলাম। তখন ডার্বিশায়ারে স্ট্যানেজ এজ-এ এক সপ্তাহান্তে ক্লাইম্বিং চলছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা যদি পাহাড়ের অন্য দিকটাতে চড়ার জন্য যাই, অসুবিধে হবে? যাই হোক, ওরা প্রায় দু-বছর ধরে এই অভিযানের পরিকল্পনা করছিল। আমাদের অভিযানটা, অপরপক্ষে, একেবারে শেষমুহূর্তে ঢুকেছে। ওর উত্তরটা বেশ রক্ষণশীল ছিল।
ও বলল, “জো সাধারণত ওর রাস্তা বার করেই নেয়।”
ওদের অভিযানের উপদেষ্টা ছিলেন ক্রিস বনিংটন আর উনি টেডকে বলেছিলেন যে জো আর আমার পরিকল্পনাটাকে তিনি একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করেন। পরে অবশ্য একদিন ও ফের বলেছিল, “তবুও, যদি তোমরা উঠতে পারো, এটা হিমালয়ের সবচেয়ে কঠিনতম রুট হবে।”
বসন্তকালটায় জো আর আমি প্রায়শই বসতাম আমাদের অভিযানের পরিকল্পনাটা নিয়ে। জো একটা অস্থায়ী কাজে ঢুকেছিল, স্যালফোর্ডে খাদ্য মজুত করে রাখার এক হিমঘরে, রাতের বেলা কাজ। প্রতি রাতে ও একটা বিশাল হিমঘরে কয়েক ঘণ্টা থাকে, তাপমাত্রা থাকে -১৫ ডিগ্রি থেকে –২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। বাকি সঙ্গীরা আশ্চর্য হয়, তারা যখন ভালো শীতের পোশাক-আশাক পরে থাকে, জো বেশিরভাগ সময় খালি হাতে গ্লাভস ছাড়াই কাজকর্ম করে। কাজ বলতে ছোটো ছোটো বৈদ্যুতিক ট্রাকে হিমঘরের করিডোরের তাক থেকে হিমায়িত তরিতরকারি, মাংস, মাছ, আইসক্রিম, ক্রিম-কেক, চকোলেট এক্লেয়ার্স যাবতীয় বোঝাই করা, আধুনিক জীবনে যা যা প্যাকেটজাত খাবার দরকার হয় সব। এটা খুব একটা আকর্ষণীয় কাজ ছিল না, কিন্তু এতে করে দিনের বেলা ও বাড়িতে থাকতে পারত আর সারাদিন অভিযানের কাজকর্মগুলো করতে পারত। একটা ভাঙাচোরা গাড়িতে উদ্দাম গান চালিয়ে ঘুরে বেড়াত আর মাথার মধ্যে কেবল চ্যাঙাব্যাঙের চিন্তা আর মুখে কেবল ওর সঙ্গে যারা কাজ করে সেসব লোকেদের সব জটিল প্রেমের রগরগে গপ্প।
এর মধ্যে হাত ফাঁকা থাকলে আমি সময় করে চ্যাঙাব্যাঙ ও আশপাশ অঞ্চলে গাড়োয়াল হিমালয়ের নানান অভিযানের বিবরণ পড়তাম। আমি শুরু করেছিলাম বিল টিলম্যানের ‘নন্দাদেবী আরোহণ’ বইটা দিয়ে, ১৯৩৬-এ ভারতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহণের কাহিনি। আমার অদ্ভুত লাগত, মনে হত, আগে আমি এটা পড়েছি। তারপর আমি বুঝতে পারলাম, যে আগে আমি যে বইটা পড়েছি সেটা হল এরিক শিপটনের ‘নন্দাদেবী’, যেখানে ওর আর টিলম্যানের আগের বছরের অভিযানের কথা লেখা আছে, নন্দাদেবীর চারপাশ ঘেরা উঁচু পর্বতচূড়ার বাধা টপকে প্রথমবার নন্দাদেবীর পায়ের নীচে স্যাংচুয়ারিতে ঢুকে পড়ার অভিযান।
ওঁরাই প্রথম অভিযাত্রী, যাঁরা ওখানে পৌঁছেছিলেন, আর গল্পটায় সাংগ্রি লা-র মতো ব্যাপার ছিল, বহুদিন আগেকার, আমার অবচেতনের ঈশ্বরভূমি ছুঁয়ে আসার কথা যেন। আমি যখন বইটা পড়ি আমার বয়স তখন তেরো বছর। টিলম্যানের বইটা আমার স্মৃতি উস্কে দিল এবং আমি আবার বইটা পড়লাম, বিশেষ করে ওই জায়গাটা, যেখানে শিপটন নন্দাদেবী বেসিনের ভেতরের স্যাংচুয়ারিতে প্রথমবার পা রাখলেন।
‘প্রতিটা পদক্ষেপে আমি এমন নিবিড় রোমাঞ্চ অনুভব করতে পারছিলাম, কল্পনাপ্রবণ যে কেউ অনাবিষ্কৃত কোনও জায়গায় এসে পড়লে এমনটাই অনুভব করবে। প্রতিটা কোণেই নতুন রোমাঞ্চকর অজানা কিছু উন্মোচিত হচ্ছে, কেবল কষ্ট করে তাকানোর অপেক্ষা৬। ছেলেবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন ছিল যে, কোনও একটা এমন উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছব, ইচ্ছেমতো যেদিকে খুশি ঘুরে বেড়াব, আর প্রকৃতির অনাবিষ্কৃত জিনিসসব আবিষ্কার করব। এখন সেটা বাস্তব, প্রায় ভুলে যাওয়া ওই স্বপ্নটার চেয়ে কোনও অংশে কম মোহময় নয়।’
কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি বাজার মতো ঘুরঘুর করত, যেটা এইমাত্র থামল। এই হল বাস্তব আর মনোজগতের মধ্যেকার সূক্ষ্ম সম্পর্ক। গাড়োয়ালের এমন জাদুমন্ত্রে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধা পড়ে যাচ্ছিলাম।
এখনকার পর্বতারোহীরা এই অনুভূতিটা বোঝার কথা ভাবতেও পারবে না। এখনকার সীমানাটা আর পার না হওয়া গিরিখাত, তার ও-ধারের রহস্যময় উপত্যকা, ঈশ্বরের ভূমি নয়। এখন বহু-বহুবার হিমালয়ের নানান চূড়ায় ওঠা হয়ে গেছে তাদের শৈশবেই। এখন অভিযাত্রী পর্বতারোহীরা পাহাড়ের না-চড়া ঢাল কিংবা আগে চড়া হয়নি এমন গিরিশিরার দিকে নজর দেবে, যন্ত্রপাতি নিয়ে আসবে, কলাকৌশল নিয়ে আসবে, আর আনবে চড়ার ভঙ্গি যা গত চল্লিশ বছরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে, বড়ো হাতলের বরফ-কুঠার আর প্লেন টেবিলের যুগ শেষ। কতরকমের পদ্ধতি, কত বর্ণনা, কেবল পর্বতারোহীদের অন্তর্জগৎ অচিহ্নিত হয়ে রয়ে গেছে।
চ্যাঙাব্যাঙ প্রথম আরোহণ হয় ১৯৭৪ সালে, ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের যৌথ একটি অভিযানে, দলনেতা ছিলেন ক্রিস বনিংটন। হিমালয়ে সমস্ত চূড়ায় প্রথম অভিযাত্রীদের মতো এঁরাও সবচেয়ে সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন, চূড়ায় ওঠার সবচেয়ে সুগম রাস্তা, দক্ষিণ-পূর্ব গিরিশিরা।
জুন মাস নাগাদ জো আর আমি শুনলাম যে একটা ছ’জনের জাপানি অভিযাত্রী দল দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা ধরে চূড়ায় উঠেছে। ওরা চিরাচরিত পদ্ধতি অবলম্বন করে উঠেছিল—ছ’জন অভিযাত্রী ৮,০০০ মিটার ফিক্সড রোপ, ৩০০টা পিটন আর একশো কুড়িখানা এক্সপানশন বোল্ট ব্যবহার করে তেত্রিশ দিনে দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরাটা চড়েছিল। এই খবরটা, আমাদের কাছে অন্তত বেশ উৎসাহজনক ছিল। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম, অন্যান্য ব্রিটিশ ক্লাইম্বারদের মন্তব্য শুনে, যে চ্যাঙাব্যাঙ মূল পথটা ছাড়া অন্য রুটে চড়া একান্ত অসম্ভব। ক্রিস বনিংটন আমাদের পরিকল্পনাটা জাতীয় পর্বতারোহীদের সম্মেলনে পর্বতারোহীদের কাছে ঘোষণা করে দেওয়ায় নানান কথা-টথাও উঠছিল।
নিক এস্টকোর্ট বলেছিল, “তোমরা কখনোই ওই দেয়ালটা চড়তে পারবে না। বুঝলে ভায়া!”
ডেভ পিয়ার্স বলেছিলেন, “আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আমি এও মনে করি যে তোমরা যে চেষ্টা করবে ভেবেছ, সেটাই বিরাট ব্যাপার।”
আমরা প্রথম চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণের প্রতিটা ব্রিটিশ পর্বতারোহীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম।
দুগাল হাসটন বললেন, “তোমাদের সময় কমাতে হবে।”
জো ডুগ স্কটকে জিজ্ঞাস করেছিল, ওই ঢাল বরাবর ওঠার সম্ভাবনা কতটা, ও ভাবছিল খানিকটা আশ্বাস মিলবে হয়তো।
“সম্ভাবনার সীমার বাইরে হে খোকারা!”
“যা হোক, ওখানে যেতে তো হবে, গিয়ে দেখতে হবে।”
“হ্যাঁ। তা ঠিক বলেছ বাছারা। আমি হয়তো একটা অতিরিক্ত গরম জ্যাকেট নিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গে।”
আর ঠিক দু-দিন বাদে ও জোকে ফোন করল, যে ওও যেতে পারে কি না। আমরা দুজন মিলেই কেবল অভিযানটা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলাম। অতিরিক্ত লোক মানেই আরও মতামত আর সেই সঙ্গে কাজের লক্ষ্যচ্যুত হওয়া। কেবল আমরা দুজন থাকলে বিপদ আর সিদ্ধান্ত দুটোই জটিলতা না বাড়িয়ে আয়াসে সমাধান করতে পারব।
ল্যানবেরিতে পাদার্ন লেক হোটেলে এক রাতে বেশ পান-টান হয়েছে, ব্রায়ান হল টলমল পায়ে আসছিল। “আমার মনে হয়, তোমরা দুজন মিলে যে এরকম একটা রুটের পারমিশন পেয়েছ, বিরাট ব্যাপার সেটা। এতে করে বোঝা যাচ্ছে ভারতীয় পর্বতারোহণ সংস্থা অ্যাদ্দিনে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা শুরু করেছে। কিন্তু তোমাদের যদি কিছু হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যারা ছোটো আকারের অভিযানে যেতে চাইবে তাদের ব্যাপারটা ঘেঁটে যাবে।”
এর মধ্যে জো টাসকার জো ব্রাউনকে জিজ্ঞাসা করছিল ওর সাম্প্রতিক শৈলারোহণের অসুবিধে নিয়ে। ব্রাউন সদ্য সদ্য কারাকোরামে ২০,০০০ ফুটের ট্র্যাঙ্গো টাওয়ার চড়ে ফিরেছিল। ও যখন জোকে আমাদের পরিকল্পনাটা বলল, বর্ষীয়ান ব্রাউন অভিজ্ঞ শান্ত এবং প্রাজ্ঞ চোখটা কুঁচকে বলেছিল, “স্রেফ তোমরা দুজন? আমার কাছে নিষ্ঠুরের মতো লাগছে।”
সব মিলিয়ে মতামতগুলো এরকম দাঁড়াল, যে আমাদের সাফল্য পাবার কোনও সুযোগই নেই; কেবল আমাদের কাছের লোকেরা জানত যে ফিরে আসার আগে আমরা অন্তত একটা মরিয়া সৎ চেষ্টা করব।
ডন হুইল্যান্স যদিও উৎসাহজনক কথা বলেছিল। ও নিজে চ্যাঙাব্যাঙ-এ যাবে বলে ১৯৬৮ সালে পরিকল্পনা করেছিল। দলে ছিল আয়ান ক্লাউ, জিওফ বার্টলসের মতো ক্লাইম্বার। ডন আমাকে আর জোকে পশ্চিম ঢালের অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছিল। ও বিভিন্ন সূত্রে ওগুলো জোগাড় করেছিল। ছবিগুলোর একখানার দিকে দেখতে দেখতে ও ওর হোঁতকা আঙুলটা একটা আইসফিল্ডের মাঝামাঝি রেখে বলল, “শোনো, এটা তোমরা চড়ে ফেলতে পারবে ঠিকঠাক। শুধু তোমাদের এর তলায় পৌঁছতে হবে আর এর ওপর থেকে পাথরের দেয়ালটা চড়ে ফেলতে হবে।” ও ঘটনাটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে বলেছিল, “ভালো কথা,” ও বলেছিল, “তিনটে ঘটনা ঘটতে পারে। তোমরা ব্যর্থ হতে পারো, তোমরা চড়ে ফেলতে পারো অথবা তোমরা নাও ফিরতে পারো। তোমাদের শুধু স্থির করতে হবে যে তোমরা ফিরে আসবেই। আসবে না?”
এটা নিশ্চিত যে আমরা বিশেষ রকমের একটা আরোহণ করতে যাচ্ছি। অমরত্বের প্রত্যাশী আমরা ছিলাম না। আমাদের চারপাশের লোকেদের এই উপহার অতিক্রম করে যাবে এমনটাও নয়। আমাদের কেবল প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট দৃঢ়তা আর সংযত সুস্থির স্নায়ু। ছবি দেখে এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আমরা যদি কাজটা করতে পারি, কৃতসংকল্প হয়ে যাই, ওই দেয়ালে দিনের পর দিন লাগাতার চড়তে হলে আমাদের চড়ার যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে ও চরম মনোযোগ দিতে হবে। দেয়ালে চড়ে গেলে সেখানে আর আমরা আমাদের সঙ্গে অতিরিক্ত কোনও কিছু নিতে পারব না। আমাদের এক দুই করে পর্যায়ক্রম কোনও পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু আমরা সবরকম সম্ভাব্যতার কথা ভেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
প্রধান একটা সমস্যা ছিল বিভক করার। ঢালের ওপরে খুব একটা পাথরের বেরোনো অংশ ছিল না, থাকলেও অবশ্যই মাত্র কয়েক ফুটের বেশি চওড়া একটাও ছিল না। তো আমরা ওল্ডহ্যামের ট্রল মাউন্টেনের জিনিসপত্র দেখতে গেলাম। ওদের কাছে একটা বিন্দু থেকে ঝোলা হ্যামক ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার উঁচু রোদেলা দেয়ালগুলোতে ওই হ্যামক কয়েক বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছিল, কিন্তু উচ্চ হিমালয়ে এটা আগে কখনও ব্যবহার হয়নি। ট্রল আমাদের জন্য দুটো ক্যানোপি দেওয়া মডেল বানিয়ে দিয়েছিল। আমি আর জো ওগুলো লেক ডিস্ট্রিক্টে ল্যাংডেলের স্কাউট ক্র্যাগ-এ একরাতে ব্যবহার করে দেখলাম। আমরা অন্ধকার হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম, তারপর পাব থেকে আমাদের বার করে দিল যখন, সব্বাই শুয়ে পড়েছে, আমরা চুপি চুপি ময়দানে গিয়ে কষ্টেসৃষ্টে ওটার মধ্যে ঢুকলাম। খুব বাজে একটা রাত্তির, একটু বাদে আবার বৃষ্টি শুরু হল। ভোর হতে না হতে আমরা দ্রুত সব গুটিয়ে নামলাম, সচেতন ছিলাম যে মে মাসের গোড়ায় আমাদের পরনে অনেক উচ্চতায় ব্যবহার করার মতো ভারী গরম পোশাক, পায়ে দু-খানা জুতো। পথে আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল, উঠে আসছে।
“এত সকালে উঠে এসেছ, পিট।” ওরা বলল।
“হুম।”
জো আর আমি স্থির করলাম যে ল্যাংডেল এইসব জিনিসপত্র পরীক্ষা করার উপযুক্ত জায়গা নয়। এখানে বড্ড স্যাঁতসেঁতে, গরম আর ভিড়।
ভাবনাটা হুড়মুড় করে এল। হ্যামকগুলো পরীক্ষা করার জন্য এমন একটা জায়গা চাই যেখানে সত্যি-সত্যিই ঠান্ডা পড়ে। এর মধ্যেই এটার কী কী পরিবর্তন দরকার ভেবে ফেলেছিলাম, কিন্তু আসল পরীক্ষা করা দরকার শূন্যের নীচের তাপমাত্রায়, যাতে হ্যামকের দুই দেয়ালের মধ্যে স্লিপিং ব্যাগ কতটা উপযুক্ত সেটা দেখা যায়। জো যেখানে কাজ করে সেই হিমঘরটা কেমন হয়? ওর সঙ্গে যারা কাজ করে তারা ইতিমধ্যেই জোকে ছিটিয়াল ভাবে, সুতরাং আমরা খুব সন্তর্পণে ম্যানেজারের কাছে প্রস্তাবটা দিলাম। উনি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেলেন, কিন্তু রাজি হলেন, যদিও উনি একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। যা হোক, এক রাত্তির আমরা হ্যামক খাটিয়ে থাকতে পারি।
এর মধ্যে আমার বান্ধবী এইসব পাগলামির কার্যকলাপে তিতিবিরক্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। জো আমাকে ওর ব্যাচেলর ডেরায় নিয়ে তুলেছিল, বলেছিল ম্যাঞ্চেস্টরের সামাজিক বৃত্তে আমায় পরিচয়-টরিচয় করিয়ে দেবে। আমরা ছবি দেখতে গেলাম, তারপর পানশালায়, কয়েক পাত্তর বিয়ার গলায় ঢেলে জো-র দুই বন্ধুর বাড়ি থেকে মালপত্র তুলতে গেলাম। ওরা জোকে বেশ প্রশ্রয় দিত। অভিযানের ফাঁকে ফাঁকে ওর মালপত্র রেখে সাহায্য করত। বেরোনোর আগে আমরা হিমঘরের রক্ষীকে ফোন করলাম, ম্যানেজার হিমঘরে ঢোকার চাবি রেখে গেছেন কি না জানতে। শুনলাম উনি রেখে যাননি, হিমঘরের রক্ষীকে আমাদের পরিকল্পনা কিছু বলে-টলেও যাননি। রাত সাড়ে এগারটা বাজে, বিয়ার খেয়ে জো-র কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে, তত পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, আর প্রথমটা রক্ষী বিশ্বাসও করছিল না।
“কী, তোমরা এখানে রাতে শোবে, দশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের জমানো খাবারের মধ্যে ঝুলে ঝুলে?”
ক্রমশ, যা হোক ও ব্যাপারটা বুঝল অবশেষে, আর আমাদের চাবি না পাওয়াটার হিল্লে হল।
“আমার ওপর ছেড়ে দাও।” ও বলল।
সেদিনকার রাতের শিফটে ছুটি ছিল আর একমাত্র রাতের রক্ষী একলাই ছিল। আমরা ওকে একটা বিয়ার দিয়ে চুপচাপ থাকতে বললাম; ও আমাদের হিমঘরের বিরাট দরজাটা খুলে ধরল আমরা আমাদের যন্ত্রপাতি তার মধ্যে ঠুসে নিয়ে ঢুকে পড়লাম।
“আমি ঠিক সকাল ছ’টায় এসে খুলে দেব।” ও বলল, “যদি চাও এক কোনায় আইসক্রিমের ওপরের দিকটায় ঘুমোতে পারো।”
শুরুতে ভয়ংকর ঠান্ডা লাগছিল। হ্যামকে ঢোকার জন্য আমরা ধ্বস্তাধ্বস্তি করছিলাম। চিজ কেকের ক্রেটের ওপর দাঁড়িয়ে আইস-ললির প্যালেটগুলো ধরে কোনোমতে কায়দা করছিলাম। দ্রুত টন টন আইসক্রিম আটকে রাখা লোহার বিমের সঙ্গে হ্যামক আটকে নিলাম দড়ি দিয়ে, জুতো খুলতে গিয়ে বিশ্রিভাবে মাথার ওপরে পা-টা উঁচু হয়ে ঝুলতে লাগল। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা থিতু হতে পারলাম। তারপরে জো গোঙাতে লাগল। ওর হিসি পেয়েছে, অনেক বেশি বিয়ার খেয়ে ফেলেছিল ও। আমি দাঁত কেলিয়ে ওকে বললাম ছ’টা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। আমার এভারেস্টের ট্রেনিং ছিল, আমি জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্লাস্টিকের হিসি করার বোতল নিয়ে এসেছিলাম।
অপার্থিব একটা রাত। ভেতরের আলোগুলো জ্বলছিল আর হিমঘরের একটানা গুনগুন আওয়াজ। মাঝরাতে হঠাৎ হুড়দাড় আওয়াজে আমি জেগে গিয়েছিলাম। নিশ্চিত ভাবলাম হ্যামকটা ছিঁড়ে মাটিতে পড়েছে আর সমস্ত ক্রেটগুলো উলটে আমার ওপরে এসে পড়েছে। ভয়ের চোটে তড়িঘড়ি হ্যামক থেকে বেরোতে গিয়ে ছ’ফুট নীচে মাটিতে এসে পড়লাম, তখনও স্লিপিং ব্যাগের মধ্যেই। পড়ার পর বুঝলাম ওটা ফ্রিজারের আওয়াজ।
সকাল ছ’টায় জো বাইরে গিয়ে হালকা হয়ে রক্ষীর সঙ্গে বসে বসে গপ্প করছিল। দিনের প্রথম লোকটা এসে ভেতরে চলে গেল সাফাই করতে। ও সবক’টা গলিতে ওপরে নীচে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করছিল। আমি আমার উজ্জ্বল লাল রঙের হ্যামকটাতে তখনও স্থির হয়ে শুয়ে ছিলাম। ঝাড়ুদার লোকটি মাথার ওপরে বিশাল সাইজের সসেজের মতো আকার দেখে চুপচাপ চলে গেল। ও বাইরে গিয়ে রক্ষী আর জোকে গিয়ে বলল, “অ্যাই, আইসক্রিমের গলিটায় ওটা নতুন কীরকমের খাবার ঝুলছে?”
হিমঘরের আইসক্রিমের জায়গাটা থেকে বেরিয়ে বাইরের ধূসর সকালে বেরিয়ে এসে মনে হল, গরম চৌবাচ্চায় এসে ঢুকলাম।
ওই ঘটনার পর জো হ্যামক দুটো ট্রলের অফিসে নিয়ে গেল আর ও-দুটোকে পুরোপুরি অন্তরক পদার্থ দিয়ে মুড়ে দিতে বলল। ও একজন সেলাইকারীকে পটিয়ে হ্যামকে ওর সঙ্গে চড়িয়ে দেখে নিয়েছিল ওটা দুজনের ওজন নিতে পারবে কি না। এরই মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় কাজ করে, আমাদের এক বন্ধু, তার গবেষণার খানিকটা সময় ব্যয় করে অ্যালুমিনিয়ামের একধরনের লাঠি বানিয়েছিল, যেটা হ্যামকের মধ্যে আটকে নিলে হ্যামকের দেওয়াল দু-পাশ থেকে চেপে আসবে না। ম্যাঞ্চেস্টারের আরেকটা স্থানীয় সংস্থা মাউন্টেন ইকুইপমেন্টের পিট হাচিনসন খুব হালকা বিশেষভাবে তৈরি ডাউন জ্যাকেট আর স্লিপিং ব্যাগ বানিয়ে দিয়েছিল। ওগুলো ও স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়ো করে বানিয়েছিল, যাতে দরকারে আমরা জুতোসুদ্ধু ওর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারি। আমরা ওদের বলে দিয়েছিলাম ওজনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, জীবন-মরণের সমস্যা, সুতরাং আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী ওরা এমনই পাতলা কাপড় ব্যবহার করেছিল যার মধ্যে দিয়ে পালক বেরিয়ে আসবে না। চড়ার সময় আমাদের সঙ্গে ঝুলন্ত বোঁদা থাকবে! স্লিপিং ব্যাগের বাইরেও আবরণ হিসেবে আমরা কৃত্রিম ফাইবার ব্যাগ ব্যবহার করেছিলাম। বহুদিন অবধি এটা অন্তরক হিসেবে ঠিকঠাক কাজ করবে, কেননা রাস্তায় আর আমরা চড়ার সময়ে শুকিয়ে নেবার সুযোগ পাব না।
আরও দুটো রাত্তির হিমঘরের মধ্যে কাটালাম আমরা। যদি কেউ, ক্লাইম্বারদের কোনও একজন এর মাঝে জিজ্ঞেস করত, ‘কী ব্যাপার, শুনছি নাকি হিমঘরে প্র্যাকটিস করছ?’ আমরা জবাবে বলতাম, ‘ধ্যাত! ইয়ার্কি করছ নাকি?’
জো আর আমি খুব দেখেশুনে আমাদের চড়ার যন্ত্রপাতিগুলো নির্বাচন করছিলাম। এভারেস্ট অভিযানের একজন আলোকচিত্রী ইয়ান স্টুয়ার্ট জোকে একটা ওয়ান-পিস স্যুট আর একটা ডাবল বুট দিয়েছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম ফুল-বডি হারনেস ব্যবহার করব, কেননা খুব খাড়া পাথরে আমাদের অনেক ভারী জিনিস নিয়ে উঠতে হবে, নইলে ওটা ছাড়া ভারের চোটে উলটে যাবার সম্ভাবনা থাকবে।
দুর্ঘটনার সম্ভাবনাই আমাদের ভাবাচ্ছিল খুব বেশি।
“আমি জানি কেবল দুজন মাত্র লোকের ওখানে একা একা যাওয়ার পরিকল্পনাটা বেশ ভয়ের শোনাবে,” জো বলেছিল, “কিন্তু একবার চড়া আরম্ভ করলে দেখবে ওটা আল্পসের বড়ো কোনও রুটে চড়ার চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হবে না। তবু আমাদের জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
আমি চিন্তায় ছিলাম, আমি কোনোভাবে জোকে ঝুলিয়ে না দিই, আর ও-ও হয়তো একই বিষয় ভাবছে। রজার ও ডোনোভান-এর সঙ্গে সেন্ট্রাল আলাস্কান রেঞ্জে ১৯৭৪ সালে আমি একবার দুজনের দলে অভিযানে যাই। প্রাথমিকভাবে ওটা বেশ সফল হয়েছিল এবং রজার ও আমি মাউন্ট ড্যান বেয়ার্ডের দক্ষিণ ঢালে প্রথম আরোহণ করি। তারপরে আমরা মাউন্ট ম্যাকিনলে চড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু রজার অসুস্থ হয়ে পড়ায় ফিরে আসতে বাধ্য হই। প্রবল হতাশ হয়েছিলাম। একটা দুজনের দলের অভিযানে তোমাদের একজন যদি অসুস্থ হয় বা আহত হয়, তোমায় দান ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। কোনও গত্যন্তর নেই। আলাস্কা বা হিমালয় এতই দূরের পথ, এরকম হতাশজনক ঘটনা ঘটার জন্য যথেষ্ট। জো আর আমি সেজন্য যে-কোনো জরুরি চিকিৎসার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলাম।
জো অ্যান্ডি হিল নামে একজন ডাক্তারকে চিনত। ছোটোবেলার সেই চড়াচড়ির দিন থেকেই আর এই অ্যান্ডিই আমাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিসপত্রের জোগাড় করে দিল। ও অনেক ওষুধ দিয়েছিল আমাদের, ওগুলোর ওপরে কাগজ সেঁটে দিয়েছিল, একেবারে সাদা কথায় নির্দেশ দিয়ে যাতে বোকার হদ্দও বুঝতে পারে। যেমন, ‘কোমরে ব্যথা হলে দিনে তিনটে করে।’ ও আমাদের দুজনকেই সেলাই করা আর ইঞ্জেকশন দেয়া শিখিয়ে দিয়েছিল। আমরা স্থানীয় হাসপাতালের ক্যাসুয়ালটি ওয়ার্ডে গেলাম, নার্সদের তত্ত্বাবধানে একে অন্যের হাতে প্লাস্টার করা শিখলাম। আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম।
জো বুঝতে পারছিল না আমি অভিযানের সাংগঠনিক ব্যাপারটা নিয়ে কেন একেবারেই উত্তেজিত নই। আমি মাথা নাড়াতে নাড়াতে খুব ঘ্যাম নিয়ে বলেছিলাম, “আরে এটা এভারেস্ট অভিযান আয়োজনের মতো নাকি?” এরকমটা নয় যে এভারেস্ট অভিযানের আয়োজনে আমার খুব কিছু করার ছিল। কিন্তু এখন বি.এম.সি.-তে আমার কাজকর্ম গুটিয়ে আনার ব্যাপার ছিল। অধিগমনের সমস্যা, ফোনের উত্তর দেয়া, চিঠির উত্তর দেয়া, এর মধ্যে আমি যা করতে পারতাম তা হল মাঝেমধ্যে জোকে পরামর্শ আর উৎসাহ দেওয়া। আর সেই সঙ্গে ওটা সে-সময় স্মরণকালের মধ্যে ব্রিটেনের সবচেয়ে গরমকাল হতে চলেছিল, ফলে আমি চাইছিলাম যাতে খানিকটা পাথরে যদি চড়া-টরা যায়। জো-র হিমঘরের কাজটা এমনই যে ও প্রায় ডুমুরের ফুল হয়ে গিয়েছিল। সকলের যখন ফাঁকা সময় সে-সময়ই ওর কাজ, কারও সঙ্গে সামাজিক মেলামেশার সুযোগই প্রায় ছিল না। স্থায়ীভাবে আধজাগা অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিল ও। সপ্তাহের শেষে দিনের বেলাটা জেগে থাকার চেষ্টা করত আর তারপর রোববার রাত ১০টায় পড়িমরি করে কাজে ছুটত। নর্থ ওয়েলসে আর পিক ডিস্ট্রিক্টে কয়েকবার একসঙ্গে চড়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমি এও চেষ্টা করছিলাম পাথরে চড়াটা জো-র তুলনায় হালকাভাবে নিতে, আর এক-এক সময় ওর থেকে ভালো চড়ছিলাম। ফলে একসময় ঠিক করলাম কয়েকটা সপ্তাহ আলাদা আলাদা থেকে দেখব! আমি নিশ্চিত জানতাম, একবার বড়ো জায়গায় গিয়ে পড়লে জো নিজের রূপটা দেখাতে শুরু করে দেবে। জোও নিশ্চিত ছিল আমরা দুজনে মিলে ঠিক ভালোমতোই করব কাজটা।
মাঝেমধ্যেই আমরা সময় করে নিয়ে দুজন দুজনকে ঠাট্টা করতাম, ঠেস দিয়ে কথা বলতাম, যেটা অন্য লোক শুনে অবাক হত যে আমরা একসঙ্গে একটা অভিযানে যাচ্ছি। অন্যদিকে এটা একটা সুবিধেজনক খোলামেলা ঠাট্টার সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছিল যেটা সত্যিকার চাপের সময় এলে একটা সেফটি ভালভের কাজ করবে। আমাদের ভাবনাগুলো যদি আগেই বলে ফেলি তাহলে হতে পারে দুজনের মধ্যে যদি কোনও টানাপোড়েনও তৈরি হয় সেটা বিধ্বংসী হয়ে উঠবে না।
অনেক সময় এমন দেখা গেছে, যেমন গ্লেনকোতে একটা সপ্তাহের শেষে, আমরা দুপুর একটা নাগাদ, স্লিপিং ব্যাগে আরাম করে শুয়ে আছি, বাইরে বৃষ্টি, ভাবছিলাম চ্যাঙাব্যাঙে ওঠার জন্য তাগিদটা আমাদের মধ্যে কোত্থেকে আসবে, যদি সপ্তাহের শেষে স্কটল্যান্ডের বৃষ্টিভেজা দিনেই তাঁবু থেকে বেরোতে না পারি! আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, কারণ আমরা আওনাক ডাভ-এর পূর্ব ঢালে পৌঁছে দেখেছিলাম পাথরটা তত ভেজা নয়, চড়া যাবে, আমরা তিনটে রুটই চড়ে তড়িঘড়ি নেমে বন্ধ হবার আগেই ক্লাচেইগে ঢুকে পানশালায় বসে পড়েছিলাম।
আমি ট্রেনিং-এর জন্য দৌড়োনো শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে আমি ডার্বিশায়ারের নিউ মিলসে আমার বাড়িতে চলে এসেছিলাম। পিক ডিস্ট্রিক্টের একেবারে গায়ে সেটা, আর আমার বাড়ির পরে একসারি বাড়ি, তারপরেই খোলা প্রান্তর, মুরল্যান্ডের ঘাসজমি। প্রায়ই বিকেলের দিকে আলো যতক্ষণ থাকে আমি ওদিকটায় দৌড়তে যেতাম, অথবা স্থানীয় পাথর-চড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ওই এলাকার গ্রিটস্টোনের ধারটায় যেতাম। আমার পাথরে চড়ার খুব প্রিয় জায়গা ছিল গ্রিটস্টোন। ফলে যেন পুরোনো বন্ধুর কাছে ফিরে যাওয়া, তাই স্বস্তি পাবার জন্য আমি ওখানে গেলাম। দীর্ঘ গরম একটা দিন পার করে বিকেলের দিকে এই কসরত আমার মাথাটা পরিষ্কার করে দিত, কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য। আমার দরকার ছিল, বড়ো কোনও বাধার মুখোমুখি হওয়া, নিজের সমস্ত শক্তি আর প্রচেষ্টা কতটা একবগগা সেটা বুঝে নিতে, নিজের দক্ষতা আর একাগ্রতার একটা হিসেব নেওয়া।
শহুরে জীবনের হাজারটা ছোটো ছোটো চাপ আমার ওপর গেড়ে বসছিল। মাঝে মাঝে আমায় মিটিং-এর কাজে লন্ডনে আসতে হচ্ছিল। এরকম একদিন, দেখলাম আমার ট্রেনের সময় এখনও দেরি আছে, আমি গ্রিন পার্কে ঘোরাঘুরি করছিলাম সময় কাটাতে, একটা কাঠবাদাম গাছের নীচে বসে লিখেছিলাম, ‘জীবন কেমন শ্বাসরুদ্ধকর লাগছে, আর ঠেসে ধরেছে, যেন কাফকার ছোটো গল্পের ইঁদুরটা, সুড়ঙ্গের মধ্যে তাড়া করেছে কেউ। এটা উদ্দেশ্য আর জটিলতার একটা মিশেল বয়ে বয়ে আনছিল। একমনে একটা লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাওয়াটা অথবা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরাটা ক্রমাগত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। আমার মতো একটা চাকরিতে থাকলে সময় দ্রুত চলে যায়, হু হু করে বয়ে যায়। গাদা গাদা ফোন, ছোটো ছোটো সমস্যা, একগাদা কাগজপত্র পড়া, নিবন্ধ লেখা। নিজের একটা বাড়ি থাকলে, আমার মনে হয়, জীবনে আরও কিছু ঝামেলা বাড়িয়ে দেয়। তবু যদি আমি অস্থির হয়ে এগুলো নিয়েই ভাবতে থাকি, কাজ কম করি, সমস্যাগুলো নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেও থাকি, নিশ্চিতভাবে জীবনের উৎসাহ, জীবনের প্রেরণা চোরা স্রোতের মতো চোখের আড়ালে বইতেই থাকে।’
২২ আগস্টের দিল্লির একটা সস্তা ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিলাম। যাবার দিন যত এগিয়ে আসছিল, হিমালয়ে একটা বড়ো অভিযানে যাবার সবরকম চাপ অনুভব করছিলাম। আমি সত্যি সত্যিই ভাবছিলাম, ফিরে আসব তো? আমার নিউ মিলসের বাড়িতে আমি আর জো হুল্লোড়ে পার্টি দিলাম একটা, আর যারা যারা আমাদের অভিযানে সাহায্য করেছিল সব্বাইকে ডেকেছিলাম, এমনকি আরও যাকে যাকে মনে পড়ে তাদেরও। একটা মুহূর্তও যাতে ফস্কে না যায় এই ভয়ে সারারাত খানাপিনা চালিয়ে গিয়েছিলাম আর নেচেছিলাম যতক্ষণ না ভোর হয়। তারপর সবকিছু পরিষ্কার-টরিস্কার করে আমরা গাড়ি চালিয়ে লন্ডনে চার্লি আর রুথ ক্লার্কের বাড়িতে চলে এলাম।
চার্লি এভারেস্ট অভিযানের একজন ডাক্তার ছিল। ওর বাড়িটা একটা অদ্ভুত প্রশান্তির। আমরা লেকল্যান্ডের দলের সঙ্গে বেশ কিছু খাবারদাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, আরেকদল ট্রেকারের সঙ্গে কিছু দড়িদড়া, যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, আর বেশিরভাগ মালপত্রই উড়োজাহাজে দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আমাদের সঙ্গে পড়ে থাকল এটা সেটা আর নিজস্ব মালপত্র, ওগুলো এখন আমাদের সঙ্গের রুকস্যাকের মধ্যে ভরে নেওয়ার জন্য। চার্লি, কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুথ আর ওদের কুকুর, শেরিডান এলিয়ে বসে বসে আমাদের দেখছিল, আমরা ওদের বাড়ির পেছনের বাগানে রোদে বসে রুকস্যাক প্যাকিং করছিলাম। নিউ মিলের বাড়িতে আমার চারটে বন্ধু দেখা করতে এসেছিল। জোকে বিদায় জানাতে একজন যুবতী মহিলা এসেছিল লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে। ওখানে পৌঁছে পরিবেশটা বদলে গেল, চাপা একটা উত্তেজনা আর প্রত্যাশা। আমি বন্ধুদের কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একেবারে শেষমুহূর্তে পৌঁছেছি, এদিকে এরোপ্লেনে জায়গা প্রায় ভরে গেছে। অনেক এশিয়ান লোকেদের সঙ্গে লাইনে গুঁতোগুঁতি করার সময় খুব গরম লাগছিল, আমাদের গায়ে ডাউন জ্যাকেট আর পায়ে ডাবল বুট। ওগুলো পরে নিয়েছিলাম যাতে ব্যাগের ওজন খানিকটা কমানো যায়। যা হোক, শেষ অবধি প্লেনে আমাদের সিটের বন্দোবস্ত হল, আর আমরা নিরাপত্তা বাধা টপকে এলাম। কীরকম লাগছিল, ঠিক করে সবাইকে বিদায় জানানো হল না, দায়সারাভাবে বলা হল যেন, যেটা ঠিক আমাদের চরিত্রগত নয়।
ব্রিটেনের এই শেষ কয়েকটা দিন পরের কয়েক সপ্তাহ অবধি পুরোপুরি স্পষ্ট মনে ছিল আমার। হিমবাহের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার সময়, দীর্ঘ রাত্রিতে ঠান্ডায় শুয়ে থাকার সময় মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খেয়ে যেত।