ধারাবাহিক অভিযান-খোটানের বালুসমাধিতে(৩য় পর্ব)-অরেলস্টাইন-অনু-অরিন্দম দেবনাথ-বর্ষা ২০২২

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই ধারাবাহিকের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২

obhijjaankhotancover

স্যার অরেল স্টাইন ছিলেন একজন ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক। ১৮৬২ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি ব্রিটিশ সময়কালে নানা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ভাষাবিদ এবং জরিপকারী।

ডানহুয়াং গুহা থেকে উদ্ধারকরা পুথি এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ মধ্য এশিয়ার ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মের শিল্প ও সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অভিযান এবং আবিষ্কারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন খোটান, সেরিন্ডিয়া এবং আভ্যন্তরীণ এশিয়া বিষয়ক বই। সংস্কৃত থেকে রাজতরঙ্গিণীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তিনি।

চিরকুমার অরেল স্টাইন ১৯৪৩ সালের ২৬ অক্টোবর কাবুলে দেহত্যাগ করেছিলেন।

এই নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর তাকলামাকান মরুভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খোটান অভিযানের কথা।

পর্ব-৩

আফগান ভূমিতে

obhijaankhotan81 (8)

একটা দুধসাদা হিমবাহ তার লম্বা জিভটা বাড়িয়ে নিশ্চল হয়ে থেমে রয়েছে কয়েকশো মিটার উত্তরে। গিরিপথের উত্তরদিকের প্রান্ত দিয়ে খানিক নামতেই পৌঁছে গেছিলাম আফগান ভূমিতে। এই দুর্গম পাহাড়ি কন্দরের নিঃসীম নির্জনতায় ওই ভূমিতে আমার প্রবেশের অনুমতি আছে কি না তা দেখার কেউই ছিল না। প্রায় আধ-মাইল নরম তুষার-ঢাকা পথ পার হয়ে পৌঁছেছিলাম শক্ত মাটিতে। একটা ছোট্ট ঝোরার ধার ঘেঁষে খানিক যাবার পর দেখেছিলাম ওটা গিয়ে মিশেছে একটা বড়ো পাহাড়ি স্রোতে। ওই দূরের হিমবাহ থেকে নেমে এসেছে ঝোরাটা। এই পাহাড়ি স্রোতটাই নদী হয়ে সোজা চলে গেছে ওয়াখান উপত্যকায়।
ওখান থেকে আটশো ফুটের মতো ওপরে উঠতেই চোখের সামনে ধরা দিয়েছিল এক অসাধারণ দুনিয়া। বহু নীচে আবই-পাঞ্জা নদী উপত্যকার বুক চিরে ফেনা তুলে এগিয়ে চলেছে গম্বুজময় সমাধি-ভূমি বোজাই গুম্বাজ আর সরহদের দিকে। যে হিমবাহ থেকে এই নদীর উৎপত্তি, সেই হিমবাহটিও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ফটো-থিওডোলাইট যন্ত্রটি নিয়ে ঘণ্টা খানেক কাজ করার পর আমার মনের মধ্যে পুরো অঞ্চলটার একটা ছবি গেঁথে গিয়েছিল। লর্ড কার্জন ঠিকই ধরেছিলেন, আবই-পাঞ্জা নদীর উৎস খানিক দূরের ওই হিমবাহগুলো।
উঁচু পাহাড়গুলো পশ্চিমের ওয়াখান আর বাদাখশানের আভাস দেখতে না দিলেও মন প্রশান্তিতে ভরে গেছিল। সেই ছোটবেলা থেকে মনে মনে স্বপ্ন দেখে আসা তুষার-মরু ব্যাক্টরিয়া আর উচ্চ অক্সাস উপত্যকার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ছোটবেলায় অক্সাসের স্রোত ধরে তার উৎসে পৌঁছে যাবার স্বপ্ন দেখতাম। প্রাচীন ইরানের সব বর্ণময় অধ্যায় ঘুমিয়ে আছে এইসব নদীর কিনারায়। সেই আদিকাল থেকেই এইসব নদীর উর্বরতাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এক-একটি সমৃদ্ধ জনপদ। জন্ম দিয়েছিল নানা সংস্কৃতির। আর এইখানে, নদীর উৎসের কাছে, ক্লান্তিহীন নীরবতা বরফ আর পাথরের মাঝ ঘাপটি মেরে আছে। এই নির্জন জায়গাটি ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। যখন ফিরে আসছিলাম তখন সন্ধার ঠান্ডার আলো আমার পথ জুড়ে ছিল। তবে ঘোর অন্ধকার হয়ে যাবার আগেই ক্যাম্পে ফিরে এসেছিলাম।

obhijaankhotan81 (1)

ক্যাম্পে ফিরেই দেখলাম আমার জন্য বেশ কিছু চিঠি এসেছে। হুঞ্জার উজির, কিলিক থেকে এক বিশেষ বার্তাবাহকের হাত দিয়ে চিঠিগুলো আমায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেছিল। বেশ কিছুদিন ধরে আমি চিঠিপত্রগুলো পাবার জন্য অধীর আগ্রহে ছিলাম। উনি সঙ্গে রয়টারের কিছু খবরের টেলিগ্রামও পাঠিয়েছিলেন; সেগুলো পড়া হয়ে গেলে কাশগরে নিয়োজিত রাজনৈতিক এজেন্ট মিস্টার ম্যাকার্টনিকে হস্তান্তর করতে অনুরোধ করেছিলেন। টেলিগ্রামগুলো পড়ে জানতে পেরেছিলাম পিকিং লিগেশনের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছে আর উত্তর চায়নার বোহাই সমুদ্রের ধারে তিয়েন-সিনে যুদ্ধ লেগেছে। চায়নার পশ্চিমের গহন অঞ্চলে বসে মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে ঘটে যাওয়া খবরগুলো জানতে পেরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। আমার নিজেকে খানিক ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল, কারণ এই যুদ্ধের খবর কাশগরের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে সম্ভবত কয়েক মাস লাগবে। আশা করি এই খবর এসে চাইনিজ তুর্কিস্থানে পৌঁছে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তুললেও তা আমার অভিযানে কোনও বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।
তেসরা জুলাই আমি কক-তোরক-এ পৌঁছে সাব-সার্ভেয়ার রাম সিংকে নিয়ে ভারী মালপত্রের বোঝা ইয়াকের পিঠে চাপিয়ে হাঁটা লাগিয়েছিলাম তিঘরমান-সু পর্যন্ত বিস্তৃত ঘাসজমির উপত্যকার দিকে। ওখানে পৌঁছে মহম্মদ ইউসুফের লোকজনের বানানো দুটো চামড়ার কুঁড়ে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘আক-উইস’ বলে, তাতে আমরা ঠাঁই নিয়েছিলাম। গরমকালে চারণদাররা এই কুঁড়েতে থেকে ভেড়া আর ইয়াক চড়ায় এই বিস্তৃত ঘাসজমিতে।

obhijaankhotan81 (5)

পরদিন ভোরবেলায় মিনটাকা রুটের দায়িত্বে থাকা সারিকোল হেডম্যান কারাকাশ বেগ আমাকে উপত্যকার আরও ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য হাজির হয়েছিল। প্রায় মাইল ছয়েক হাঁটার পর মিনটাকা পাসের দোরগোড়ায় পৌঁছতে কারাকাশ বেগের কাছে একটা খবর নিয়ে হাজির হয়েছিল একজন। এক রাশিয়ান উত্তরের পাইক পাস দিয়ে কাছেই এসে পৌঁছেছে। এইধরনের কারও আসার খবর আগে থেকে ছিল না। শুনে আমিও খানিক উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম। খানিক বাদেই দেখা হয়েছিল আগন্তুকের সঙ্গে। ব্যাভারিয়ান ফুট গার্ডের লেফটেনেন্ট এফ। এক জার্মান তরুণ। রেলপথ ধরে রাশিয়ার ফারগানা এসে, সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে এখান পর্যন্ত এসেছে। গিলগিট হয়ে ছুটি কাটাতে ভারতে যেতে চায়। ছেলেটি জানত না যে হুঞ্জা রুট ধরে ভারতে যেতে ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি লাগে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া এই পথ ইউরোপিয়ান ভ্রমণকারীদের জন্য বন্ধ। আমার মুখ থেকে পথের বিবরণ শুনে বলতে নেই, সে চমকে উঠেছিল। এই পথ ধরে কাশ্মীরে পৌঁছতে যে অনেক সময় লাগে, ছেলেটি তা জানত না। এই পথ ধরে যে ভারতে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় তা বুঝতে পেরে, আমার লোকেদের পরিবেশন করা খাবার খেতে খেতে আমাদের সঙ্গে কাশগর পর্যন্ত যেতে মনস্থির করে ফেলেছিল। চাইলে ও আমার টেন্টে থাকতে পারে, আমার এ-কথা শুনে ও সঙ্গে সঙ্গে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, আর আমাদের সঙ্গে এ-পথে আমাদের শেষ গন্তব্য উজাদভাই পর্যন্ত গিয়েছিল। পথে যেতে যেতে, খাওয়ার সময় এই তরুণ সামরিক অফিসারটি রাশিয়ান পামিরের উপর তার দশদিনের যাত্রাপথের অনেক অভিজ্ঞতার কাহিনি আমাকে শুনিয়েছিল। ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ধৈর্য ধরে তার বিবরণ দেবার দক্ষতা যে যথেষ্ট প্রশংসার যোগ্য, তাতে সন্দেহ নেই। বাভারিয়ান আল্পসে ভ্রমণের জন্য সে যা পোশাক সঙ্গে এনেছিল তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে প্রথমে কষ্ট পেতে হয়েছিল খুব। যদিও ধীরে ধীরে পামিরের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ার জন্য খানিকটা সামলে নিয়েছিল। তারপর কিরগিজদের কাছ থেকে একটা লম্বা ঝুলের পশমের কোট কিনে অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছিল। আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে ঘোড়া ভাড়া করার বিষয়টা সে কীভাবে সামলেছিল। ভাষা সমস্যা এখানে ভীষণ প্রবল। সারা পথে ছেলেটি পামিরস্কি পোস্টের রাশিয়ান দুর্গ ছাড়া আর কারও আতিথ্য পায়নি। খানিক কিরগিজরাও সাহায্য করেছিল। এই সামান্য সাহায্যেই ও এতটা পথের যাত্রা সামলে নিয়েছিল। ওর সঙ্গে যে দুটো ঘোড়া ছিল, সে দুটোও দুর্গম পথের ধকলে প্রায় মরো মরো অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। ছেলেটির কোমরের দু-পাশে দুটো গুলিভর্তি রিভলভার ঝোলানো ছিল। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর বুঝেছিল যে ওই দুটো এখানে প্রদর্শন করার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই সে-দুটো খুলে সে তার ঝোলায় চালান করে দিয়েছিল। আল্পসের মতো পামিরে পর্যটকদের জন্য কোনও সরাইখানা বা বিশ্রামাগার খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে নিরাপত্তার জন্য এই অঞ্চল গর্ব করতেই পারে।
উত্তর আর দক্ষিণের নানা ঘটনাবলির তুলনা করে আমাদের সন্ধেগুলো ভালোই কেটেছিল। কারাকাশ বেগ ও তার সাথীরা আমাদের এই আড্ডায় অংশ নিয়েছিল আর দুজনের গল্প উপভোগ করেছিল। আর যাই হোক, কারকাশ বেগ এটা বুঝে হাঁফ ছেড়েছিল যে রুশ সামরিক অফিসারটি তাদের ‘বোঝা’ হয়ে উঠবে না।
৫ই জুলাই আমরা প্রায় পনেরো মাইল পথ চলে ঘুজকবাই (প্রাচীন ম্যাপে এই জায়গাটার উল্লেখ ছিল উজাদভাই নামে) পৌঁছেছিলাম। এখানে উপত্যকাটি উত্তরের দিকে মুড়েছে ও যথেষ্ট চওড়া। দু-পাশের পাহাড়ের রেঞ্জের মাথার বরফের পরিমাণ খুবই কম। আমরা দাঁড়িয়ে তাগদুম্বাসের গুরুত্বময় বিস্তৃত মালভূমিতে যা প্রাচীনকাল থেকেই ‘পৃথিবীর ছাদ’ নামে পরিচিত। এখান থেকেই জার্মান তরুণটি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য পথে রওনা দিয়েছিল তাশকুরঘানের দিকে। ছেলেটি যাতে স্বচ্ছন্দে কাশগর পৌঁছতে পারে তার জন্য এতটা পথ চলতে যা যা দরকার, যেমন টিনজাত খাবারদাবার ইত্যাদি ওকে আমার ভাঁড়ার থেকে খানিক দিয়ে দিয়েছিলাম। এমনকি এম. শের মহম্মদকে দিয়ে একটা চিঠি করিয়ে দিয়েছিলাম যাতে রাস্তায় বদলি ঘোড়া পেতে কোনও অসুবিধা না হয়। তাছাড়া এই চিঠি স্থানীয় চিনা কমান্ডেন্টকে দেখালে তার এগিয়ে যেতে কোনও সমস্যা হবে না। নির্বিঘ্ন যাত্রার জন্য এই সুপারিশ পত্র ওর প্রয়োজন ছিল।

তাশকুরঘানের পথে

৬ই জুলাই ঘুজকবাই থেকে রওয়ানা হবার পর থেকে পথ ছিল পলিমাটি সমৃদ্ধ মালভূমির ওপর দিয়ে। খুঞ্জেরাব পাস থেকে নেমে আসা একটি নদী খরস্রোতে বয়ে যাচ্ছিল মালভূমির বুক চিরে। এই জলস্রোতটি তাগদুম্বাস দরিয়ার কাছে দিয়ে শাখা মেলে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে কারেওয়ে মালভূমি অঞ্চল জুড়ে। এই উপত্যকাটির সঙ্গে কাশ্মীরের মিল প্রচুর। প্রায় মাইল পাঁচেক নির্জন মালভূমি দিয়ে চলার পর আমরা পৌঁছেছিলাম দফদারে। দূর থেকেই নজরে এসেছিল অনেক রঙদার সুন্দর পোশাক পরা বেশ কিছু মানুষের সমাবেশ। কাছে পৌঁছতেই একদল ওয়াখিস আর কিরগিজ সম্প্রদায়ের মানুষ আমাকে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়েছিল। শুনলাম ওরা আমার জন্যই অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছিল। আরও একটি দল এসেছিল নদীর ও-পাড়ের পিসলিং বসতি থেকে। ওয়াখিদের লম্বাচওড়া সুদর্শন চেহারার পাশে ওদের বেঁটেখাটো গড়ন একটা বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। পিসলিং গ্রামের মানুষগুলোর উচ্ছল আর প্রাণবন্ত হাসিতে ঝরে পড়ছিল প্রাণের অন্তঃস্থলের ভালোবাসা আর আন্তরিকতা। দফদার থেকে খানিক এগোতেই এই অঞ্চলের প্রথম আবাদির চিহ্ন নজরে এল। দূরের বড়ো জলের স্রোত থেকে ছোটো ছোটো নালা কেটে জল নিয়ে এসে ফলানো হয়েছে ওট ও বার্লি। চাষাবাদ করা এখানে যে এক বড়ো সংগ্রাম, তাতে সন্দেহ নেই। চাষাবাদ মানেই স্থায়ী বসবাসের প্রমাণ। এখানে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বিগত দশ বছরের এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস—কানজুটিদের আক্রমণ বন্ধ আর শৃঙ্খলার বাতাবরণ সৃষ্টি।

obhijaankhotan81 (2)

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সংকীর্ণ বরফাচ্ছাদিত অতি-উচ্চতার একের পর এক নির্জন উপত্যকা আর ‘পাস’ অতিক্রম করে আসার পর অনেক মানুষজন আর বসতির ছোঁয়া পেয়ে একটা সুন্দর অনুভূতি হচ্ছিল। চারপাশের পাহাড়ি ঢাল থেকে নেমে আসা জলের উপস্থিতি মালভূমির যেখানেই আছে সেখানেই গজিয়ে উঠেছে ফুল আর ভেষজ গাছের গালিচা। মনমাতানো সুগন্ধে বাতাস মাতোয়ারা হয়ে আছে। খানিক বিশ্রামের জন্য পথিমধ্যে ঘান নামের একটা জায়গায় থামতে মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর ছাদে নই, গ্রীষ্মকালে বসে আছি হাঙ্গেরির ফুলে ছাওয়া সমভূমি ‘পুসতা’তে। একদল টাট্টু চরে বেড়াচ্ছিল আশেপাশে। দূর থেকে ওদের খুনসুটি উপভোগ করেছিলাম দারুণ।
obhijaankhotan81 (6)

হালকা ফুসফুসে মেঘ নীল আকাশের বুকে পাহাড়ের মাথাগুলোকে ছায়া দিতে ছাতার মতো জমে ছিল। সবে দুপুর, আমার অনুমান মতে আমরা প্রায় আঠারো মাইল পথ পার হয়ে এসেছি। সব পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উত্তরের বরফের গম্বুজ হয়ে থাকা পাহাড়ের নাম মুজ-তাগ-আতা ‘বরফ পর্বতের পিতা’, যাকে দর্শনের জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। ইয়ুরগাল গুম্বাজের নদীর ধারে আমাদের তাঁবু খাটিয়েছিলাম। তাপমাত্রা যথেষ্ট আরামপ্রদ ছিল। যদি না হাওয়া চলে তবে এই সময় আবহাওয়া এখানে খুবই মনোরম থাকে।
আমি ও আমার লোকজন তাশকুরঘানের কাছাকাছি পৌঁছে খানিক আরাম করতে পরদিন খুব সকালেই যাত্রা করার জন্য তৈরি হয়ে গেছিলাম। আকাশ পরিষ্কার থাকায় সাতসকালে উপত্যকার উত্তরে অনেক পাহাড় ডিঙিয়ে ‘বরফ পর্বতের পিতা’ মুজতাগ-আতার শান্ত রূপ নিষ্কলুষভাবে দেখা যাচ্ছিল। কয়েক মাইল ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাথুরে পথ ধরে চলার পর আমরা পৌঁছেছিলাম ‘দশত’-এ। আমার গাইড রশিদ বেগ, তাশকুরঘানের মিং-বাশি (হাজার পুরুষের প্রধান) ওর স্বাভাবিক নীরবতা ভেঙে আমাকে বহু দূরে একটা সাদামতো বস্তু দেখিয়েছিল। আমাদের সেদিনের লক্ষ্য। ওটা ছিল নদীর দক্ষিণে পাহাড়ের মাথায় তাশকুরঘানের দুর্গ। খানিক সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেছিলাম একটি সবুজ ছাওয়া অঞ্চলে। একের পর এক ছোটো ছোটো সেচ-নালায় ভরা জায়গাটা। এই নালা বেয়ে জল পৌঁছেছে খানিক দূরের তাশকুরঘানের বিপরীতে অবস্থিত তুঘলনশহর গ্রামের চাষের জমিতে। উর্বর জমি ফসলে ভরে আছে কঠোর পরিশ্রম আর পর্যাপ্ত জলের ছোঁয়ায়।
জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বই হোক বা আশেপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশই হোক, যতই দুর্গটার কাছে এগোচ্ছিলাম ততই আবেগতাড়িত হয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ, এখানেই একপ্রকার আমার দীর্ঘ যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে শুরু হতে চলেছে আমার অভিযানের মূল অধ্যায়, আমার অভীষ্ট গবেষণার কাজ। নদীর ভয়াবহ প্রবল স্রোত এড়িয়ে দুর্গে পৌঁছানোর কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই। তাই আমাদের পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে হয়েছিল উপত্যকার পূর্বদিকের তলদেশে, যেখান থেকে তাশকুরঘান উপত্যকার শুরু। এখান থেকে দুর্গে যাওয়ার পথেরও শুরু। নদী পার হওয়ার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। সমতলে পৌঁছে ঘাসজমি চিরে প্রায় আধ ডজন শাখায় বিভক্ত হয়েছে নদী এখানে। জলের গভীরতা ঘোড়ার প্রায় জিন ছুঁই ছুঁই। তার ওপর তার গতিবেগও যথেষ্ট। যাই হোক, ভিজে সপসপে হয়ে নদী পার হয়েছিলাম নিরাপদেই। মালপত্র দেখার দায়িত্ব যারা আমাকে খানিক আগে গিরিপথ ধরে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল, সেইসব গ্রাম প্রধানদের হাতে ছেড়ে আমি ছুটেছিলাম পাহাড়ের তলদেশের দিকে, যার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি।
মুন্সি এম. শের মুহাম্মদ আমার জন্য চামড়ার তৈরি তাঁবু যাকে এঁরা ‘ইয়ার্ট’ বলে, তার কাছে অপেক্ষা করছিলেন। আগে চামড়ার তৈরি এই তাঁবু-ঘরটা মেজর এফ. ই. ইয়ংহাসব্যান্ড ব্যবহার করতেন। উনি ছাড়াও আরও কিছু আমারই মতো অভিযাত্রী এই তাঁবুতে থেকেছেন। এখানে এসে জানতে পেরেছিলাম, চাইনিজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার মুজতাগ-আতার পশ্চিমে আসা নিয়ে কোনও আপত্তি তোলেননি। খানিক শঙ্কায় ছিলাম, সেটা দূর হয়েছিল।

obhijaankhotan81 (9)

কম যায়, তবুও আমি পৌঁছানোর আগেই গিলগিটে মি. ম্যাকার্টনির জন্য চিঠিপত্রের বোঝা নদীর বাম ধার ধরে রওনা হয়ে গেছিল। আমি ভেবেছিলাম ইউরোপের জন্য কিছু চিঠি ওঁনার ডাকের সঙ্গে পাঠাব। কী আর করা, ওই যাত্রায় চিঠিগুলো পাঠানো সম্ভব হয়নি। না, সম্ভব হয়েছিল। ইউরোপে হলে হয়তো সম্ভব হত না। আমি দ্রুত চিঠিপত্র লেখার কাজ সম্পন্ন করতেই এক বিশেষ বার্তাবাহক আমার চিঠিপত্রের বোঝা নিয়ে ছুটেছিল রওনা হয়ে যাওয়া ডাকবাহককে আমার গুচ্ছের চিঠি ধরিয়ে দিতে।

তাসকুরঘানে

৮ জুলাই আর তার পরের দিনটা তাসকুরঘানেই থাকব বলে ঠিক করা ছিল। আগামীযাত্রার জন্য নতুন করে পরিবহণের ব্যবস্থা ও খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করা ছাড়াও এখানকার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে স্বল্প সময়ে যতটা বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ ও তার নথিবদ্ধকরণ খুব জরুরি ছিল।
তাসকুরঘানের পার্বত্য অঞ্চলে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনতম জনপদের অন্যতম স্থান সারিকোল। এই অঞ্চলের পাহাড়ি পথ বাণিজ্যপথ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। পশ্চিমের ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে এসে ব্যাবসা করত চিরাচরিত ধ্রুপদী কায়দায়। পশ্চিমের পণ্যের বিনিময়ে চিনে উৎপাদিত পণ্যের বিনিময় হত। স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে আলাপচারিতায় যা জানতে পেরেছিলাম, তা স্যার হেনরি রলিনসনের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একদম মিলে যায়। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই তাসকুরঘান—‘পাথরের মিনার’ ছিল এই অঞ্চলের ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র। ঠিক একই কথা বলেছিলেন বিশিষ্ট ভূগোলবিদ টাইরের মারিনাস। সেরিকের পশ্চিম সীমান্তে চিনা ব্যবসায়ীদের সবচাইতে বেশি আধিপত্যের বড়ো বাণিজ্যস্থল তাসকুরঘান। প্রকৃতি নিজেই শুধু এই জায়গাটিকে সারিকোল উপত্যকাগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেনি, বরং প্রাচীন ও একসময়ের বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মধ্য এশিয়ার বিশাল অংশকে সুদূর পশ্চিম ও পুবের সঙ্গে যুক্ত করেছে এই স্থানটি। এখান থেকেই পথ গিয়েছে কাশগরে, খোটানে। পথ গিয়েছে তুর্কিস্থান থেকে চিনের অভ্যন্তরে। পামিরের সঙ্গে যোগাযোগের দুটি পথ এখান থেকে শুরু হয়েছে। তাগদুম্বাস উপত্যকা বা আপার অক্সাসে যেতে হলেও এই তাসকুরঘান না ছুঁয়ে উপায় নেই। এখান থেকে নাইজা-তাশ পাস হয়ে যেতে হয় আকসু উপত্যকায়। গ্রেট পামিরের শিগনান ও বাদাখশানে পৌঁছানোর পথও তাসকুরঘান হয়ে।
আমার মন ভরে গেছিল তাসকুরঘানের পথে ঘুরে বেড়িয়ে। কারণ, এই তাসকুরঘান হয়েই মহান চৈনিক পরিব্রাজক ইউয়েন-সাং ভারতে পৌঁছেছিলেন। ওঁর পরিভ্রমণ করা প্রাচীন পবিত্র ভারতীয় বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলো দেখার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল যে! ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইউয়েন-সাং, কি-প্যান-টু জেলার মধ্য দিয়ে যে পথ হয়ে বাদাখশান থেকে খোটান গিয়েছিলেন, সে-পথ অনেক আগেই স্যার হেনরি ইউল চিহ্নিত করেছিলেন। এগুলো এখন সবই আধুনিক সারিকোলের অন্তর্গত। হিউয়েন সাং ও তাঁরও আগের এক চিনা তীর্থযাত্রী সুং-ইয়েন (৫০০ খ্রিস্টাব্দ) এই অঞ্চলের পুরোনো রাজধানী সম্পর্কে যে বর্ণনা করেছিলেন, তা যে তাসকুরঘানই ছিল তাতে দ্বিমত নেই। ‘একটা খাড়া পাহাড়কে ঘিরে উত্তরমুখে বয়ে গেছে সীতা নদী’—‘সীতা নদী’—ইয়ারকন্দ নদীর তাগদুম্বাস শাখা, ঠিক যেমনটি চৈনিক তীর্থযাত্রীরা বর্ণনা করেছিলেন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরের মধ্যে সেই খাড়া পাহাড়ের মাথায় গড়ে উঠেছিল বর্তমান আধুনিক চিনা দুর্গটি।
নদীর পাশ ঘেঁষা পাহাড়ের মাথায়, পাথরের ওপর আলগা পাথরের ওপর পাথর চাপিয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাইল লম্বা উঁচু দেওয়াল তৈরি করে চতুর্ভুজাকার জায়গাটিকে ঘিরে সুরক্ষিত করে তার মধ্যে চাইনিজ দুর্গটি বানানো হয়েছিল। প্রাচীন দুর্গের শুকনো ইটের পুরু দেওয়ালের গায়ে প্লাস্টারের প্রলেপ। এর ভিত যে যথেষ্ট শক্তপোক্তভাবে তৈরি করা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। শুধু অদ্ভুতরকমের নিস্তব্ধতা আর জনশূন্যতায় মুড়ে পুরো অঞ্চলটি। দুর্গের আশেপাশে পাথরে তৈরি কিছু ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলে দিচ্ছিল এই দুর্গের কাছে বাসস্থান বানিয়ে থাকাটা মোটেই সুখকর ছিল না, বিশেষ করে চাষি সম্প্রদায়ের কাছে। মূলত জলের কারণে। সারিকোলে যুদ্ধের বাতাবরণ শেষে শান্তির উদয় হতে চাষযোগ্য অঞ্চলে একের পর এক গ্রামের পত্তন হয়েছে আর শক্তির কাছাকাছি অঞ্চল যেমন দুর্গের আশপাশ জনশূন্য হয়ে গেছে। ১৮৯৫ সালে ভয়ংকর ভূমিকম্পে দুর্গের আশপাশ ও ভেতরের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়লে, সেগুলো মেরামত করে আর কেউ থাকতে আসেনি। ভূমিকম্পে দুর্গ শহরের অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত দেওয়াল আর মেরামত হয়নি। জায়গায় জায়গায় বিশাল ফাঁক হয়ে রয়েছে দেওয়ালগুলোতে। নিঃসন্দেহে প্রাচীন কোনোকিছুকে যদি বারংবার মেরামত করা হয়, তাতে প্রাচীনত্বের স্বতন্ত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পূর্বে বেশ কয়েকবার কোথাও কোথাও পুনর্নির্মিত হলেও ২৫ ফুটেরও উঁচু পাথরের দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার বলে দেয়, এ এক অতি প্রাচীন স্থাপত্য।
এই দুর্গ ও এই অঞ্চলের অন্যান্য ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তূপের বিশেষ করে দুর্গের প্রাচীরের উত্তর অংশের ও-ধারের প্রাচীনত্ব ও নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য সার্ভের প্রয়োজনতা ছিল। এই সার্ভে করার জন্য কূটনৈতিক সতর্কতা দরকার ছিল। কারণ, চিনা কমান্ড্যান্ট বা তার অধীনের লোকজন আমাদের উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে। শের মুহাম্মদের অভিজ্ঞতা এই সমস্যা দূর করতে কাজে লেগে গেছিল। আমি সাব-সার্ভেয়ারের সঙ্গে জায়গাটায় ঘুরতে গিয়ে কাজ শুরু করার জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করছি যতক্ষণ না সৈন্যবাসের সকলে দুপুরের খাওয়া সেরে একটু গা এলিয়ে দেয়। যখন আমরা সার্ভের কাজটা নিঃশব্দে শুরু করছিলাম, সেই মোক্ষম সময়ে শের মুহাম্মদ গিয়ে পৌঁছেছিলেন সৈন্যবাসের চিনা কমান্ডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে। ঝানু কূটনীতিবিদের মতো আমার যাত্রা ও কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে এত দক্ষতার সঙ্গে তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে তিনি বা তাঁর অধস্তন কেউই আমার দুর্গের ভেতর বা আশেপাশের কাজে কোনোরকম বাধা দেননি।
সীমান্তের এই সৈন্যবাসে যা আমার নজরে এসেছে, তাতে পুরো সৈন্যবাহিনীটিকে আমার নিরীহ ও খানিক অলস বলে মনে হয়েছিল। দু-একজন নীল সুতির উর্দি পরা সৈন্য আমার তাঁবুর পাশে খানিক ঘুরঘুর করছিল আমরা কী করছি তা দেখার জন্য। নিছক কৌতূহল আর কি! ফার্সি, তুর্কি বা ওয়াখি—স্থানীয় কাউকেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। মুন্সি শের মুহাম্মদ জানিয়েছিলেন, এই অঞ্চলে প্রায় আট বছর কাটিয়েছে এরকম সৈন্যদেরও আশেপাশের ভাষা সম্পর্কে প্রায় কোনও প্রাথমিক জ্ঞানই তৈরি হয়নি। স্থানীয়দের সঙ্গে এই কারণেই সৈন্যদের কোনও বাক্যালাপ হয় না। একদিক থেকে দেখতে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে সৈন্যদের মাখামাখি না করাটা সামান্য কয়েকজন সৈন্য সহায় দুর্গের চিনা সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। এরা শুধু এখানে থেকে নিয়মরক্ষার্থে দুর্গের দেখভাল করে। বাকি স্থানীয় যত সমস্যা, তার নিষ্পত্তির ভার স্থানীয় প্রধানদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল ওরা। বর্তমানে এই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে খাজনা আদায়ের পরিমাণ খুবই কম। চিনারাও তাঁদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও এককালীন বাণিজ্যের কর্তৃত্বের জায়গাগুলোতে নামকাওয়াস্তে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রেখেই সন্তুষ্ট।
চিনা দুর্গাধ্যক্ষ ‘আম্বান’ সবেমাত্র কাশগর থেকে ছুটি কাটিয়ে অসুস্থ অবস্থায় ফিরে এসে নিজের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। আমার ওঁর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও মুন্সির পরামর্শে ওঁর অসুস্থতার কারণেই দেখা করার পরিকল্পনা বাতিল করেছিলাম। খানিক খারাপই লাগছিল, এত প্রাচীন জায়গায় এক সাম্রাজ্য শক্তির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নষ্ট করতে হল বলে। হয়তো অনেক কিছু জানা যেত ওঁর কাছ থেকে। অবশ্য সারিকোলের প্রধান করিম বেগ সহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। শের মুহাম্মদের তুলনা নেই। সে আমার চামড়ার তৈরি কিরগিজকে প্রায় দরবার কক্ষ বানিয়ে তুলিয়েছিল। করিম বেগ আমাকে সারিকোলের পুরোনো দিনের ইতিহাস আর পরিবর্তিত অর্থনীতি থেকে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ধারা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। যা আমাকে এই অঞ্চলের জীবনের স্পন্দনের অনুভূতির ওঠাপড়া বুঝতে সাহায্য করেছিল। এই অঞ্চলের বনেদি বা উচ্চকোটির শ্রেণির মধ্যে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল যারা এই অঞ্চলের আসল ভূমিপুত্র। এদের অধিকাংশই ওয়াখি অভিবাসীদের বংশধর। এছাড়া এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে আছে চিত্রালী ও কানজুটি উদ্বাস্তু পরিবারের উত্তরসূরিরা। আর সিঘনান থেকে এসে বসতি গাড়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। মনে হয় চতুর্দিক থেকে এসে মিলিত হওয়া পথের কেন্দ্রবিন্দু সারিকোলে বাণিজ্যের কারণেই হোক বা নিছক কৌতূহল বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে হোক, যাঁরাই এসেছিলেন তাঁদেরই এই অঞ্চলে থেকে যাবার বাসনা হয়েছিল। মনোরম আবহাওয়াও এর অন্যতম কারণ হতে পারে। ফলে ধীরে ধীরে তৈরি হয় ওয়াখি, ফার্সি আর তুর্কিদের এক মিশ্র জনজাতির বসতি।
আমার সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁদের একটাই চাহিদা ছিল আমার কাছে—ওষুধের। কারও বয়সের ভারে চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে; কারো-বা ছেলের কুষ্ঠ হয়েছে; কারও হাঁটুতে অসহনীয় যন্ত্রণা। অদম্য ইচ্ছে থাকলেও এঁদের ওষুধ দিয়ে কষ্ট লাঘব করার কোনও উপায় আমার ছিল না। কয়েকজনকে খানিক ওষুধ দিয়ে আর বাকিদের খাদ্যাভ্যাস বদলানোর খানিক উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছিল। শের মুহাম্মদ অনেক কসরত করে ওঁদের বুঝিয়েছিল যে আমি হাকিম নই। এদের জন্য মনের মধ্যে অসহায়তার একটা ব্যাথা গুমরে উঠছিল।
১০ জুলাই তাসকুরঘান ছেড়েছিলাম। এখানে নতুন করে পরিবহণের ব্যবস্থা আর আগে যাত্রার জন্য সমস্ত রেশনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সমুদ্রতল থেকে ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় ওট আর ডাল ছাড়া কিছুই জন্মায় না। তাই শাকসবজি জাতীয় কিছুই জোটানো যায়নি। শের মুহাম্মদ সামনের পথের দুর্গম যাত্রার কথা ভেবে আশেপাশের গ্রামে খুঁজেপেতে, সত্যি বলতে গেলে প্রায় লুট করে অজস্র ডিম সংগ্রহ করিয়ে আমার ‘শেফ’ সাদাক আখুনের জিম্মায় সঁপে দিয়েছিল। আমার দলের অভিযানের খাদ্য জোগাতে স্থানীয় খাদ্য ভাণ্ডারের জোগান প্রায় শেষ হয়ে গেছিল। দুর্গাধ্যক্ষ আমাকে আগামীযাত্রার শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা অনুরোধ করে পাঠিয়েছিলেন—গোটা ছয়েক ডিমের। ওঁর জন্য ওষুধ বানাতে ওই ডিমের প্রয়োজন ছিল। আমি সানন্দে ওঁকে ডিম পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

তাগহারজা সমভূমি

প্রায় মাইল তিনেক যাবার পর আমরা পৌঁছেছিলাম তাগদুম্বাস নদীর বাম তীরের তিজনফ গ্রামে। গ্রামটি প্রায় দুর্গের মতো। প্রথমেই যা আমার নজর কাড়ল, তা হল মাটি-পাথরে তৈরি গম্বুজাকৃতি অসংখ্য কবর। নদী এখানে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে সিন্দাহের গিরিসংকটে প্রবেশ করে খানিক যাত্রার পর উপত্যকার মাঝবরাবর প্রবাহিত হয়েছে। আশেপাশে সবুজের নামমাত্র চিহ্ন নেই। চারপাশের পাহাড়গুলোয় কালচে ভাব। খানিক পেছনে ফেলে আসা সবুজের সমারোহের অদ্ভুত বিপরীত দৃশ্য।
তাঘরমা-সু ধরে শীতে যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক। মুজতাগ-আতার পশ্চিম ঢাল থেকে বেরিয়ে আসা তাগদুম্বাশ নদী এখানে যথেষ্ট গভীর। প্রবল স্রোত ঠেলে সে-নদী পার হওয়া অসম্ভব। যদিও শীতকালে নদীর জল জমে বরফ হয়ে গেলে তার ওপর দিয়ে অনায়াসে হেঁটে পার হয়ে যাওয়া যায়। তাই খানিক পথ বদলে তিজনফ থেকে অনেকটা উত্তর-পশ্চিমে গিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত নীচু পাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। দুটি নদীর চলার পথের ফলে এখানে একটা খোঁচ তৈরি হয়েছিল। শুশ বা কুম-দাওয়ান যা ‘স্যান্ডি পাস’ নামেও পরিচিত। তার ১২,০০০ ফুট মতো উচ্চতা থেকে তাসকুরঘান উপত্যকার দক্ষিণদিকের একটি বিস্তৃত অঞ্চল দেখা যায়।
দূরের তুষার-ঢাকা পাহাড় চূড়াগুলোর প্রায় সবক’টাই মেঘের আড়ালে। দক্ষিণের কুয়াশা-ঘেরা অংশ ভারতের সীমান্ত। মুজতাগ-আতার বিশাল বরফ-ঢাকা সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি পশ্চিম ও দক্ষিণ জুড়ে। দূরত্ব ও মেঘ-কুয়াশা মাখামাখি হয়ে থাকায় নাঙ্গা পর্বত, রাখিপোশি বা গডউইন অস্টিনের (কে২) রূপ ওখান থেকে অধরাই থেকে গেছিল। এই স্থানটির খানিক দক্ষিণে তাঘহারাজ সমভূমি, যার গড় উচ্চতা ১৪,০০০ ফুট। তারও দক্ষিণে চির তুষারাবৃত পাহাড়শ্রেণি। স্থায়ী তুষারের আস্তানা। তাদের গড় উচ্চতা ১৭০০০ ফুটের কম নয়।
অবিশ্বাস্য লাগছিল যে ভারতের সমতল থেকে আমি পৌঁছে গেছি এমন একটি সমতলে যার চারপাশে আকাশ ছুঁতে চাওয়া বরফে ঢাকা পাহাড়রাজি, অগণিত হিমবাহ আর গভীর গিরিখাত। অবর্ণনীয় দৃশ্য আমাকে মোহিত করে দিয়েছিল। শুশ থেকে প্রায় হাজার ফিটের মতো নীচের দিকে নামার পর আমরা পৌঁছেছিলাম তাঘরমাতে। অনেকটা সবুজহীন পথ পার হয়ে এসে আবার খানিক সবুজের ছোঁয়া পেয়েছিলাম। সঠিক সেচের ফলে বার্লি আর ওটের সবুজ কচি পাতায় ভরে চাষের ক্ষেতে। মুজতাগ-আতার দিকে যদি চোখ না পড়ে তবে মনে হবে যেন কোনও সমতলের শস্যক্ষেতের পাশে আছি। শুধু চামড়ার পোশাক পরা কিরগিজ রাখাল আর ঘাসে মুখ ডুবিয়ে মুখ নাড়াতে থাকা ইয়াকের দল বুঝিয়ে দেয় স্থানটির উচ্চতাজনিত অবস্থান। সাফসগোস, যেখানে আমরা তাঁবু খাটিয়েছিলাম, সেটি সারিকোল অঞ্চলের তাঘরমা সমভূমির অন্যতম গ্রীষ্মকালীন অস্থায়ী বসতিগুলির একটি। এখনও পর্যন্ত শিশু ও মহিলাসহ তিনটি সুদর্শন কিরগিজ পরিবারের দেখা পেয়েছি। সবসময় পর্যাপ্ত দুধ ও ক্রিমের জোগান দিতে প্রস্তুত এরা।
১১ জুলাই সকালে হাওয়া প্রায় চলছিল না। ফলে ঠান্ডা কম লাগছিল। শুধুমাত্র মুজতাগ-আতার চূড়া ছিল মেঘের আড়ালে। উচ্চ সমতলভূমির উন্মুক্ত ঘাসজমি ধরে খচ্চরের পিঠে চেপে যেতে চারপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্যকে দু-চোখ ভরে উপভোগ করছিলাম। খানিক চলার পর একের পর এক নজরে এসেছিল ঘুলান, সারিক-তাশ এবং বের্জাশ (বা বারদাশত)-এর পাসগুলোয় যাবার পথ। এগুলো সবই রাশিয়ার অংশ। আকাশ পরিষ্কার থাকায় হিমবাহের সীমানা ছাড়িয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ড দেখা যাচ্ছিল পরিষ্কার। সরলা নামের ছোট্ট গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময় মাটির দেওয়াল ঘেরা একটি চাইনিজ সামরিক ছাউনি চোখে পড়েছিল। এই ছাউনির কাজ ছিল ছোটো ছোটো সারিকোলি গ্রামগুলোর ওপর নজরদারি করা, যাতে রাশিয়ানরা এই অঞ্চলে ঢুকে পড়ে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে না পারে। এই অঞ্চলে এই গ্রামের মানুষগুলো মূলত চাষাবাদ করে থাকে।
সরলা গ্রামের চাষের ক্ষেতের চৌহদ্দি ছাড়াতেই নজরে এসেছিল বালিময় জমিতে ইতিউতি গুল্মের গুচ্ছ। বেশ কয়েকটি অস্থায়ী চামড়ার কুঁড়ে দেখতে পেয়েছিলাম। তাদের বাসিন্দা কিরগিজ পশুপালকরা চেহারায় গাট্টাগোট্টা হলেও মুখে হাসি লেগেই ছিল। কুকিয়ার গ্রামের পর পথ গেছিল একটি পাথরভরা চওড়া নালার মধ্য দিয়ে। নালার পুব-পশ্চিমে পাথরের নীচু দেওয়াল। পাথর স্তূপীকৃত দেওয়ালগুলো দেখে মনে হচ্ছিল বহু প্রাচীন এই পাথরের স্তূপগুলো। পূর্বদিকের পাথরের দেওয়াল টপকে যে দৃশ্য সরাসরি নজর কেড়ে নিয়েছিল, তা হল দূরের তুষার-ঢাকা কারাকোরাম পর্বতরাজি। দুপুর পার হতে না হতেই উদ্দাম হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো আমরা কিরঘিজদের একটি ছোট্ট বসতি খুজাগে পৌঁছে গেছিলাম। গ্রামের লোকেরা আমাদের শিবির তৈরির জন্য সাগ্রহে জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিল। তাঁবু খাটতে না খাটাতেই শুরু হয়ে গেছিল টিপটিপে বৃষ্টি। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা। আমি আমার লম্বা পশমের কোটটা গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলাম, যেটাকে সারিকোল উপত্যকায় প্রবেশের পর থেকে ব্যাগে ভরে রেখেছিলাম। হাইপসোমিটারে জায়গাটার উচ্চতা দেখাচ্ছিল ১১,৬০০ ফুট।
পরদিনের যাত্রাপথটি সংক্ষিপ্ত ছিল, তাই সকালটাকে অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিলাম। রাম সিংয়ের সঙ্গে সামনের উঁচু পাহাড়টার মাথায় উঠে গেছিলাম। পুবদিকে আমাদের সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে কারাকোরামের শৃঙ্গরাজি। হালকা মেঘ ভিড় করেছিল পাহাড়-চূড়া ঘিরে। আবহাওয়া পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছিল। আকাশে ছাড়া ছাড়া মেঘ থাকলেও তাঘরমা উপত্যকার দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল তাশকুরঘানের দক্ষিণ-পূর্বের চূড়াগুলো। আমাদের মাপজোকের কাজ করতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। যদিও পুবদিকে মুজতাগ-আতা আর সন্নিহিত হিমবাহগুলো ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকায় পুরোপুরি আমাদের দৃষ্টির আড়ালে ছিল।
বেশ খানিকটা সময় পাহাড়ের মাথায় কাটিয়ে ক্যাম্প সাইটে নেমে এসে উত্তরের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলাম আমরা। সামান্য পথ পেরোনোর পর খাইন্দি নামের এক উপত্যকায় পৌঁছেছিলাম একটা সরু রাস্তার মধ্য দিয়ে। এখানে একটি ছোট্ট মাজার রয়েছে। কোনও সাধুর কবরস্থল। মুজতাগ-আতার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কিরগিজ চারণদাররা মাঝে-মাঝেই পশুর দল নিয়ে এখানে চলে এসে দিন কয়েকের জন্য আস্তানা গাড়ে কচি ঘাসের জন্য। কিছু পাথর স্তূপ করে রাখা মাজারের পাশে। তার ওপর অভিস-পলি যা মার্কো পোলো ভেড়া নামে পরিচিত, তার শিং বসানো।

obhijaankhotan81 (7)

এছাড়া মাজার ঘিরে কিছু খুঁটির ওপর রঙিন কাপড়ের টুকরো পতপত করে উড়ছিল। এইধরনের রঙিন কাপড়ের পতাকা উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বাস, সাধুর আশীর্বাদ-ছোঁয়া বাতাস যেখানেই বয়ে যাবে সেখান থেকে অশুভ শক্তি বা রোগবালাই দূরে থাকবে।
দু-ঘন্টার বেশি ক্রমশ সরু হতে থাকা একটি জলের ধারার পাশ দিয়ে আলগা নুড়ি-পাথরের ওপর দিয়ে চলে আমরা পৌঁছেছিলাম কারাসুতে। এটি একটি ছোট্ট সামরিক রাশিয়ান পোস্ট বা ‘কারাউল’। ঘাঁটিতে মাত্র তিনজন সৈন্য ছিল। মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা খানকয়েক মাটির ঘর। যার প্রায় সবগুলোই খালি। মাটির পাঁচিল মনে হয় রক্ষণের জন্য নয়, হাওয়া আটকানোর জন্য দেওয়া। আমার চাকরেরা ওই ঘরগুলোর ভেতরে দ্রুত রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করে ফেলল। জায়গাটার দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রশস্ত সমতল উপত্যকা ক্রমশ নীচের দিকে নামতে নামতে পৌঁছেছে কুলমা উপত্যকায়।
কারাসুর তৃণভূমির লাল-সাদা ফুলে ছাওয়া কার্পেট দেখে আমার তাসকুরঘানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ঠিক একইরকম প্রাকৃতিক কার্পেটের দেখা পেয়েছিলাম ওখানে। পরদিন ১৩ই জুলাই সকাল থেকেই আবহাওয়া বিগড়ে ছিল। ঘোলাটে হয়েছিল চারদিক। মেঘ আর কুয়াশায় ঢেকে ছিল আশপাশ। হাইপসোমিটার বলছে জায়গাটার উচ্চতা ১২,১০০ ফুট। যতটা ঠান্ডা হবে ভেবেছিলাম ততটা ঠান্ডা ছিল না। সকাল সাড়ে ছটায় ৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। মনেই হচ্ছিল যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আবহাওয়া খানিক ভালো হবার অপেক্ষায় সাব-সার্ভেয়ার রাম সিংকে ওর কাজের জন্য এখানে রেখে আমরা ন’টার সময় সামনের গন্তব্যের জন্য রওয়ানা দিয়েছিলাম। কিন্তু পনি আর ইয়াকের পিঠে মাল চাপাতে বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল। মনে হয় ওরা খারাপ আবহাওয়ার পুর্বাভাস টের পেয়েছিল। একটা খচ্চর তো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ওর পিঠ থেকে আমার কাগজপত্র বোঝাই একটা বাক্স ফেলে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। রওনা হবার খানিক পরপরই চারপাশ কাঁপিয়ে তুষারঝড় আছড়ে পড়েছিল আমাদের ওপর। এগোনোর গতি শুধু কমেই গেছিল নয়, এগোনোও বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দূরের কিছু নজরে আসছিল না। শুধু তাঘরমা-সুর জলের ধারা নজরে আসছিল। ওই জলের ধারাকে পাশে রেখে কোনোক্রমে পা টিপে টিপে আমরা এগোচ্ছিলাম। প্রায় দু-ঘণ্টা চলার পর আমরা গিরিপথের শীর্ষদেশ উলুগ-রাবাতের কাছে পৌঁছেছিলাম। বৃষ্টি খানিক ধরে এসেছিল। চারপাশ আঁধার-ঘন হয়ে থাকলেও টের পেয়েছিলাম, শুধু আমরা নই, আরও কেউ এখানে আছে। তীক্ষ্ণ আওয়াজ ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছিল নানাদিক থেকে। আওয়াজ কর্তারা মুখ বাড়িয়েছিল তাদের খুদে মাটির ঢিবি থেকে। হিমালয়ের মারমটের দল। এই পাসের রক্ষকরা। এর আগেও এদের সঙ্গে দেখা হয়েছে গিরিবর্ত্মের বিপদজনক অংশে। প্রতিবারই এরা আওয়াজ তুলে সতর্ক করেছে যেন।
Himalayan,Marmot,On,The,Way,To,Pangong,Lake,In,Ladakh,

সাড়ে এগারোটা নাগাদ গিরিপথের মাথায় পৌঁছেছিলাম। সমুদ্রতল থেকে ১৪,০০০ ফুট উঁচুতে কতগুলো পাথর স্তূপীকৃত করে রাখা। পরম আত্মার বিশ্রামস্থলের প্রতীক। হিমালয়ের প্রায় সব অংশেই বিশ্বাস আর রীতিগুলো অনেকটাই একইরকম। ডান-বাম কোনোদিকের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না ঘন কুয়াশার জন্য। পাহাড়ের উঁচু অংশটা দৃষ্টির জন্য অধরা করে রেখেছিল প্রকৃতি। শুধু সামনের খোলা প্রান্তর যা ক্রমশ নেমে গেছে সুবাশি হয়ে কারাকুল লেকের দিকে, তা খানিক দেখতে পারছিলাম। ক্রমশ ঢালু হতে থাকা পথ ধরে খানিক এগোতে না এগোতেই আবার মুষলধারে বরফ মেশানো বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আগের থেকেও ভয়াবহ বৃষ্টির তেজ। চলতে গিয়ে প্রথম একটা পশুপালকদের ডেরা ‘আউল’-এর পাশ দিয়ে যখন পার হচ্ছি তখন ভিজে একদম চুপসে গেছি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম প্রায়। আবহাওয়া ভালো হবে এই অপেক্ষায় না থেকে উপত্যকার চিনা সামরিক পোস্ট সুবাশির দিকে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়েছিল। ওখানে পৌঁছতে পারলে আশ্রয় আর প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার আশা থাকবে। বৃষ্টি মাথায় করে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বহু প্রাচীন একটি কিরগিজ কবরখানা আর পাথরে তৈরি গম্বুজাকৃতি ধর্মীয় স্থানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছিলাম।

দুপুর দুটো নাগাদ চিনা পোস্টটি নজরে এসেছিল। আমার মন আনন্দে নেচে উঠেছিল আশ্রয় পাবার আশায়। একটি ভাঙাচোরা পাথরের পাঁচিলের ভেতর কতগুলো আধভাঙা ঘর। বেশ কিছু সার সার মাটির বাড়ি। সৈন্যদের থাকার জায়গা। সবমিলিয়ে এটাই এখানকার সামরিক আখড়া। আমি পৌঁছতে না পৌঁছতেই এই পোস্টের সবাই—সব মিলিয়ে মোট আটজন—হাজির হয়েছিল। তাদের কমান্ড্যান্ট এক ছোটোখাটো চেহারার কর্পোরাল। আমাকে তারা খাতির করে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল তাদের সবচাইতে ভালো ঘরটায়। সত্যি বলতে কী, তাদের ভালো ঘরটাও ছিল ভাঙাচোরা অবস্থায়। মাথার ওপরকার চালের একটা ফুটো দিয়ে আলো এসে ঘরটাকে খানিক আলোকিত করে। সেটাও বৃষ্টির কারণে বন্ধ করে রাখা ছিল। গর্তের ঠিক নীচে ঝোলা একটা জ্বলন্ত টিমটিমে কুপির আলোয় নজরে এসেছিল, ঘরের মধ্যে একটা উঁচু শোবার জায়গা। কুপির ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে ছিল। আমরা বড়ো ঘরটার এক কোনায় গিয়ে বসেছিলাম গরম চায়ের জন্য। আমার ছোট্ট টেরিয়ারটা ঘরে ঢুকে খুব আরাম পেয়েছিল। সে ঠান্ডায় বেদম কাঁপছিল। গায়ের জল ঝেড়ে এক লাফে শোবার জায়গায় উঠে স্তূপ করে রাখা লেপের মধ্যে গিয়ে সেঁধিয়ে গেছিল। সেখানে আগে থেকেই একটা বেড়াল শুয়ে ছিল। ঠান্ডায় কাতর বেচারা বেড়াল দেখেও কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। বরং গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছিল ওর পাশে। মেজাজ ঠিক থাকলে কী করত কে জানে?
সৈন্যদের আন্তরিক আতিথেয়তা, নাকি তাদের চেহারার প্রফুল্লতা—কোনটা আমার ভালো লেগেছিল বলতে পারব না। শুধু এটা বলতে পারি, এইরকম জায়গায় ছোটো সামরিক ছাউনিটা মোটের ওপর আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সৈন্যদের বেশিরভাগই ছিল লম্বা আর পেটানো চেহারার। তুর্কিতে কথা বলতে অনেকটাই সাবলীল এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমান। বৃষ্টি ধরে আসাতে ওদের ছবি তুলব বলাতে ওরা দ্রুত প্যারেডের পোশাক পরে নিয়েছিল। নীল ভেলভেটের প্যান্ট, লাল কাপড়ের টিউনিক, তাতে কালো মখমলে সেলাই করা চিনা অক্ষর। মাথায় টুপি, পায়ে চামড়ার উঁচু বুট। নিখুঁত সামরিক পোশাক। তাদের কাঁধের এনফিল্ড কারবাইনগুলোতে ‘টাওয়ার’ লেখাটা জ্বলজ্বল করছিল। ইতিমধ্যে উলুগ-রাবাতের উত্তরের কিরগিজ পশুপালকদের প্রধান কারম শাহ বেগকে আমার পৌঁছানোর খবর পাঠানো হয়ে গেছিল। তিনি আমাকে স্বাগত জানাতে এসে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি থেমে যেতে আমি মালপত্র নিয়ে ওদের সঙ্গে সুবাশির সামরিক পোস্ট থেকে দু-কিলোমিটার দূরে কারম শাহ বেগের চামড়ার তাঁবু কিরগিজে গিয়ে উঠেছিলাম। আমার চাকরদের জন্য একটা তাঁবু খালি করে দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। বৃষ্টি থেমে যাওয়াতে আমি আমার তাঁবুটা একটা বালিভরা জায়গায় লাগিয়েছিলাম। জায়গাটা বালিময় হওয়াতে বৃষ্টি হলেও জল শুষে যাবে। তাঁবুর পাশ দিয়ে কারাকুল লেকের দিকে বয়ে গেছে বৃষ্টির জলে পরিপূর্ণ অসংখ্য ছোটো ছোটো জলের স্রোত। মাইল দেড়েক দূরের লেকের চকচকে জল আবহাওয়া ভালো থাকলে এখান থেকেই দেখা যেত।

obhijaankhotan81 (4)

পরদিন ১৪ জুলাইও সকাল থেকেই আবহাওয়া খারাপ ছিল। তাই সেদিন আর না এগিয়ে বিশ্রাম নেওয়া ঠিক করেছিলাম। আমি দিনটা কাজে লাগিয়েছিলাম মুজতাগ-আতার পশ্চিম ঢালের নানা তথ্য সংগ্রহে। এছাড়াও যেসব সারিকোলি কুলি ও ভারবাহী পশুর মালিকরা তাসকুরঘান থেকে আমার সঙ্গে এসেছিল, তাদের পাওনা হিসেব করে মিটিয়ে দিতে। অভিযানের প্রথম থেকেই নানা জায়গা থেকে আসা এইসব লোকেদের কয়েকজনের নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ নিতে শুরু করেছিলাম।
দুপুরের দিকে বৃষ্টি খানিক ধরে এসেছিল। আমি কারম শাহ বেগের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলাম কারাকুল ও বাসিককুল লেক খানিক দেখে নিতে। পাহাড়ের উচ্চদেশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। এই অঞ্চলে সপ্তাহেরও বেশি থেকে এই লেকগুলো ও তার আশেপাশের অঞ্চল ঘুরে ডক্টর সোভেন হেডিনের অসাধারণ বর্ণনাময় বইয়ের দৌলতে এই জায়গাটা সম্পর্কে খানিক স্পষ্ট ধারণা ছিলই। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কারাকুলের পশ্চিম তীরে বেড়াতে বেড়াতে লেকের গ্র্যান্ড মোরেইনের সম্পূর্ণ গঠনটি নজরে এসেছিল। হিমবাহ বাহিত নুড়ি-পাথর জলের ধারার সঙ্গে নেমে এসে জমা হতে হতে গড়ে তুলেছে এই লেকগুলোকে।

মুজতাগ-আতাতে

লেকের পশ্চিম ধারের ঢাল ধরে হাজার চার-পাঁচ উঁচুতে খাড়া হয়ে থাকা টিলা আর পাথরের স্তূপের মাথায় জমে থাকা আঁধার করা কালো মেঘ, লেকের ছায়াসঙ্গী মুজতাগ-আতার হিমবাহের প্রতিচ্ছবি মুছে দেওয়ায় লেকটিকে এক নিঃসঙ্গ-নির্জনতার এক করুণ আবরণে মুড়ে ছিল যেন। এই লেকের আসল সৌন্দর্যের পরিস্ফুটন ওই গগনচুম্বী বরফের ছোঁয়ায় নিহিত।
আমরা ঘুরতে ঘুরতে যেখানে ডক্টর সোভেন হেডিন ক্যাম্প করেছিলেন, কারাকুলের পুবদিকের সেই জায়গায় উপস্থিত হয়েছিলাম। ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে কতটা হিসেব করে তিনি তাঁর ক্যাম্পের জায়গা নির্বাচন করেছিলেন। এখান থেকে এর আশেপাশের জায়গা ঘুরে দেখাটা খুব সহজ। আমার গাইড কারম শাহ বেগ, ডক্টর হেডিনের এখানকার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কতটা কী জানাতে পারবে তা সম্পর্কে আমার সংশয় ছিল। কিন্তু আমার যাযাবর কিরগিজদের স্মৃতির সংশয়কে ভুল প্রমাণ করে কারম শাহ তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় এই লেকের ধার ও মুজতাগ-আতার আশেপাশে আস্তানা গাড়া যাযাবর পরিবারগুলো অধিকাংশই এখান থেকে তাদের শিবির গুটিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছিল। ডক্টর হেডিনের বন্ধু ও অন্যতম সফরসঙ্গী তোগদাসিন বেগ এখান থেকে অনেক দূরের রাশিয়ান পামিরে মারা গেছেন। তাঁর সফরকালের অন্যান্য ভ্রমণসঙ্গীরাও চারণভূমির অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় রীতি কতটা শক্তিশালী হলে যে ঘটনাক্রম একের থেকে একে ছড়িয়ে পড়ে টিকে থাকে তা এই ঘটনায় শিক্ষণীয়। ছ’টা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরতে না ফিরতেই আবার শুরু হয়েছিল অঝোরে বৃষ্টি। মানে পাহাড়ের মাথায় তুষারপাত। আমার যাত্রাকে মন্থর করে দিতে যথেষ্ট। পরের দিন ১৫ জুলাই আমার ডায়েরির পাতা প্রমাণ করে আমার আশঙ্কা একদম ঠিক ছিল।
‘সারারাত ধরে বৃষ্টি আর তুষারপাত হয়েছে। কুয়াশা আর মেঘে ঢেকে আছে সবদিক। তাঁবুতে বসে নোট আর চিঠি লেখা ছাড়া কিছু করার নেই। এই চিঠিগুলো তাসকুরঘানে পাঠাতে হবে, সেখান থেকে এগুলো ‘ডাকে’ যাবে ভারত আর ইউরোপের নানা প্রান্তে। বৃষ্টির মধ্যেই সকালে কারম শাহ বেগ দেখা করতে এসে আমার তাঁবুর ভেতর এক কোনায় বসে জানতে চেয়েছিল আমার আগামী যাত্রা পথের জন্য সে কী করতে পারে। তার চোখমুখে একটা বিষাদভাব ফুটে ছিল। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না বুলুনকুলের চিনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমাকে সাহায্যের কোনও নির্দেশ না আসায় সে ভয় পাচ্ছে। সে চাপা সুরে গোপন কথা ফাঁস করার মতো করে বলেছিল যে, যদি না আমি চায়নার মূলভূমির দিকে অগ্রসর হতাম তাহলে সে আমার যাত্রার জন্য যা যা লাগবে সব ব্যবস্থা করে দিত। কারণ, চাইনিজরা সব বিষয়েই ভীষণ সন্দেহবাতিক। ইয়াম্বুলাক হিমবাহ এবং মুজতাগের ঢাল দেখার জন্য সে ইয়াক আর যোগ্য লোক সঙ্গে দিয়ে দেবে, কিন্তু নির্দেশ ছাড়া কাশগরে যাবার জন্য ইয়াক ও কুলি পরিবহণের ব্যবস্থা করে দিলে সে আম্বানের কোপে পড়তে পারে। এমনকি কারাসুতে সাব-সার্ভেয়ার রাম সিংকে তার লটবহর সহ আনার জন্য ইয়াক পাঠানোও তার পক্ষে ঝুঁকির। বেগের কথাগুলো আমাকে চিনাদের যাযাবর কিরগিজদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো ধারণা দিয়েছিল। কী আর করা! আমি আমার সঙ্গে তাসকারঘুন থেকে আসা সারিকোলি বেগকেই কারাসুতে পাঠালাম কিছু একটা ব্যবস্থা করে রাম সিংকে নিয়ে আসার জন্য। পাশাপাশি কারম শাহ বেগের একটা লোককে বুলুনকুলের আম্বানের কাছে পাঠানো হল আমাকে চিনে যাবার জন্য স্থানীয় পাসপোর্ট যা তাসকুরঘানের সামরিক পোস্ট থেকে দেওয়া হয়েছিল তা দেখিয়ে কারম শাহ বেগকে আমার আগামী যাত্রার যাবতীয় ব্যবস্থার অনুমতি দিতে।
‘দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি একটু ধরলে দেখলাম উপত্যকার কয়েকশো মিটার ওপরের অংশ থেকে পাহাড়ের ঢাল টাটকা তুষারে ঢাকা। দেখে বুঝলাম, আমার মুজতাগ-আতা ভ্রমণের আশু কোনও সম্ভবনা নেই। তবে যা করতে হবে, তা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই করতে হবে। সন্ধে নাগাদ বৃষ্টি পুরো বন্ধ হলে আমি হাজির হলাম বেগের চামড়ার তাঁবুতে। সে আমাকে স্বাগত জানিয়ে আমার কার্যকলাপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। অনুমতি না এলে কী সাহায্য করতে পারবে তাতে সন্দিহান হলেও আমার আপ্যায়নের খামতি রাখেনি। তাঁবুর মাঝখানে একটি বড়ো কড়াই ‘কাজান’-এ দুধ ফুটছিল। বেগের স্ত্রীদের একজন বেঁটে জুনিপার ‘টেরেসকেন’ গাছের ছোটো ছোটো কাঠের টুকরো গুঁজে আগুনটাকে জিইয়ে রাখছিল। সুন্দর পোশাক পরা হাসিখুশি মহিলার বয়স নেহাত কম নয়।
‘দুধ যখন ফুটছিল তখন আমি বিশাল তাঁবুঘরটা ভালো করে দেখছিলাম। তাঁবুর ভেতরটা যথেষ্ট গরম ও আরামদায়ক। বাইরের ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে রূপের ঠিক বিপরীত। তাঁবুর দেওয়াল আর ছাদের অংশ রঙিন উলের হাতে কাজ করা কাপড়ে সাজানো। তাঁবুর দেওয়ালের নীচু অংশ থেকে শুরু করে পুরো ঘরটার মেঝে চামড়ায় ঢাকা। থাক থাক ভাঁজ করা জামাকাপড়। সন্দেহ নেই এগুলো এই কঠিন আবহাওয়ায় অপরিহার্য। ঘরের খানিকটা রঙচঙে উল আর পশমের সুতোয় সুন্দর কাজ করা পর্দা দিয়ে আড়াল করা। এটা ঘরের মহিলাদের জন্যই করা হয়েছে। সেই পর্দা সরিয়ে মহিলারা একবার ঢুকে আবার বেরিয়ে আসছিল হাতে কাপসহ নানা পাত্র নিয়ে। ঘরের ঠিক মধ্যিখান যেখানে আগুনটা জ্বলছে, সেটা বাদ দিলে পুরো মেঝেটা জুড়ে ইয়াকের রোমশ চামড়া বিছানো। আমার বসার জন্য ঘরের একপাশে ইতিমধ্যেই আন্দিজান কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে সুন্দর বিশাল চাইনিজ কাপে করে কড়াই থেকে তুলে যে গরম ঘন দুধ পরিবেশন করা হয়েছিল তা ছিল দারুণ মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমাকে ঘিরে বসে থাকা বেগের আত্মীয় ও প্রতিবেশীদেরও সেই দুধ দেওয়া হচ্ছিল কাঠ ও লোহার পাত্রে। দুধ কিরগিজদের অন্যতম প্রধান খাদ্য। আর এর উপকারিতা তাঁবুঘরে উপস্থিত সব বয়সের পুরুষ ও নারীর চেহারার জৌলুস দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
‘চলে আসার সময় কারম শাহ একটা বিশাল চেহারার ভেড়া এনে হাজির করল—ওটা আতিথেয়তা হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। আমি সানন্দে এটা গ্রহণ করতেই পারতাম। কারণ আমি লক্ষ করেছি যে আমার লোকেরা মাংসের জন্য ওটাকে কেনার তাল করছিল। কারম শাহও নিশ্চয় ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম কিরগিজরা টাকার ব্যপারটা ভালোই বোঝে। টাকা ছাড়া এরা কিছু ছাড়তে চায় না। আমি ভেড়াটা উপহার হিসেবে গ্রহণ করলেও কারম শাহকে জানাতে ভুলিনি যে এই উপত্যকা ছাড়ার আগে আমিও ওর জন্য কিছু দিয়ে যাব।
‘বেশ রাতের দিকে যখন আমি তাঁবুতে আমার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত তখন কারম শাহ এসেছিল। বেশ উত্তেজিত ছিল। জানাল বুলুনকুল থেকে এক চাইনিজ অফিসার এসেছে আমার যাত্রার যাবতীয় আয়োজনের অনুমতি নিয়ে। কারম শাহকে দেখে বুঝতে পারছিলাম যে ওর মন থেকে একটা গ্লানির বোঝা নেমে গেছে। এত দ্রুত যে সমাধানবার্তা এসে পৌঁছবে এটা আমি আশা করিনি। কারম শাহ জানিয়েছিল, কাল সকালে অফিসার আমার সঙ্গে দেখা করে অনুমতিপত্র হাতে দেবে।’
রাতভরে আবহাওয়া অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছিল। ১৬ তারিখ সকালে কারম শাহ বুলুনকুল থেকে আসা আম্বানের প্রতিনিধি আর সুবাসির সেই পরিচিত কমান্ডারকে নিয়ে দেখা করতে এল। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছিল তাই তাঁবুর বাইরে বসতে কোনও অসুবিধা ছিল না। আমার দলের লোকেরা সুন্দর সুন্দর চাইনিজ চায়ের কাপভর্তি চা এনে হাজির করেছিল। কোথা থেকে যে এত সুন্দর পাত্রগুলো ওরা জোগাড় করেছিল জানি না! আমাকে অফিসার জানালেন, যে-পথেই কাশগর যেতে চাই, আমার পরিবহণের ব্যবস্থা পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। কাশগর যাবার সংক্ষিপ্ততম পথ হল গেজ গিরিসংকট ধরে। কিন্তু সে-পথে নদীর ওপরকার সেতুগুলো নদীর জলস্রোতে ভেসে গেছে। শরৎকালের আগে সে-সব সেতু ঠিক হবার কোনও সম্ভবনা নেই। আর অন্য পথটি হল মুজতাগ-আতাকে উত্তরদিকে থেক ঘুরে কারাতাশ গিরিপথ হয়ে। কিন্তু সে-পথ বড়ো কঠিন। বরফে অবরুদ্ধ প্রায়। আমি বলতে দ্বিধা করিনি যে দুটোর যে-কোনো একটা পথ ধরে আমাকে এগোতেই হবে। তবে যে-পথ ধরেই যাই না কেন, আমার অভিযানের মূল যা লক্ষ্য, সেই জরিপের কাজ করতে-করতেই যাব।
আমি চাইনিজ প্রতিনিধিদের পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি কী করব। কথাবার্তা শেষে ওরা চলে যেতে আমি ফটো-থিওডোলাইট যন্ত্র নিয়ে লেকের পূর্বদিকের কারাকি পাহাড়ের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। বৃষ্টি না হলেও মেঘ পাহাড়-চুড়োর আশেপাশে ঝুলেছিল। আর প্রবল হাওয়ায় মেঘগুলো অবস্থান বদলাচ্ছিল দ্রুত। ইয়াকের পিঠে চড়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে অভীষ্ট জায়গায় পৌঁছলেও ঝড়ের মতো বইতে থাকা ঠান্ডা বাতাস আমার মোটা জামাকাপড় পরে থাকলেও শরীরকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আর মেঘগুলোও দ্রুত ঘুরতে থাকায় মাপজোকের কাজও ঠিকমতো করতে পারছিলাম না। উত্তরপূর্বের সুউচ্চ পাহাড়-চূড়ার ঢাল জুড়ে থাকা একের পর এক সুবিশাল হিমবাহ ধরা দিচ্ছিল দৃষ্টিতে। মুজতাগ-আতার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। ওদিকেই আছে একাকিবেল-সু। ওই বিস্তৃত উপত্যকা পুষ্ট হয়েছে ওই ঢালের জলে। তিনটে নাগাদ মেঘের ঢাকনা সরে গিয়ে পুরো পাহাড়ের দৃশ্যপট খুলে গেল। আমার কাজের জন্য যা প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পুরস্কার। ঠান্ডায় বেঁকে শক্ত হয়ে যাওয়া নিঃসাড় আঙুল দিয়ে ফটো-থিওডোলাইটের কাঁটা ঠিক করতে গিয়েই খুলে গেছিল ওটা। কী আর করা! সঙ্গে আনা আমার অন্য একটা পুরোনো আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে হচ্ছিল। এই যন্ত্র দিয়ে কাজ করতে গেলে যন্ত্র সম্পর্কে অনেক দক্ষতা প্রয়োজন। তাই দ্রুত কাজ সারার জন্য খানিক চেষ্টায় ফটো-থিওডোলাইটের খুলে যাওয়া কাঁটাটা ঠিক করে নিতে পেরেছিলাম গিলগিটে মিসেস ডাবলিউর দেওয়া মাথার চুল ব্যবহার করে। এর জন্য ওঁর অশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। গিরিশিরা থেকে নামার সময় কাঁপতে কাঁপতে নামছিলাম। এত ঠান্ডা!
আমার ছোট্ট তাঁবুতে ফেরার পর খানিক আরাম পেয়েছিলাম। আমার ‘স্টরমন্ট মারফি আর্কটিক স্টোভ’ জ্বালানি কেক দিয়ে জ্বালিয়ে তাঁবুর উষ্ণতা বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। এই জ্বালানি কেকগুলো লন্ডনের ‘মিলিটারি ইকুইপমেন্ট কোং’ থেকে জোগাড় করেছিলাম। যে-কোনো অভিযানের জন্য এই জ্বালানি কেকগুলো খুবই কাজের। আমার আট বর্গফুটের তাঁবুর উষ্ণতার স্বাচ্ছন্দ্যে আমি মাঝরাত পর্যন্ত আমার খবরাখবর জানিয়ে দূরের বন্ধুদের জন্য চিঠি লিখেছিলাম।

ক্রমশ

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s