জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই ধারাবাহিকের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব-৩
স্যার অরেল স্টাইন ছিলেন একজন ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক। ১৮৬২ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি ব্রিটিশ সময়কালে নানা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ভাষাবিদ এবং জরিপকারী। ডানহুয়াং গুহা থেকে উদ্ধারকরা পুথি এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ মধ্য এশিয়ার ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মের শিল্প ও সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অভিযান এবং আবিষ্কারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন খোটান, সেরিন্ডিয়া এবং আভ্যন্তরীণ এশিয়া বিষয়ক বই। সংস্কৃত থেকে রাজতরঙ্গিণীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তিনি। চিরকুমার অরেল স্টাইন ১৯৪৩ সালের ২৬ অক্টোবর কাবুলে দেহত্যাগ করেছিলেন। এই নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর তাকলামাকান মরুভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খোটান অভিযানের কথা।
পর্ব-৪
পাহাড়-চুড়োয়
১৭ জুলাই ঘুম থেকে উঠে তাঁবু থেকে বেরোতে না বেরোতেই ঝকঝকে আকাশ দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। আকাশে রত্তিভর মেঘ নেই। মুজতাগ-আতার বরফে ঢাকা চূড়া বিশাল আকাশের ক্যানভাসে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। আমি এই আবহাওয়াই চাইছিলাম। অতি উচ্চতায় যেতে পরিষ্কার আবহাওয়া খুব দরকার। বৃষ্টির জন্য সাব-সার্ভেয়ারের রাম সিংয়ের মাপজোকের কাজ বিশেষ এগোয়নি। কাজ শেষ করার জন্য ওর খানিক সময় প্রয়োজন ছিল। আমিও ঝাড়াই-বাছাই করে যতটুকু লাগবে ততটুকু পোশাক-আশাক আলাদা করে ব্যাগে ভরে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম পাহাড়ের উচ্চ ঢালে অভিযানের জন্য। লেকের কাছে চড়ে বেড়ানো কারম শাহ্ বেগের ইয়াকের দল থেকে দশটা ইয়াক ভাড়া নেওয়া হয়েছিল মালপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এদের কয়েকটার পিঠে আমাদেরও চাপতে হবে।
ই যাত্রার জন্য যতটুকু লাগবে ততটুকু মালপত্র প্যাক করে বাকি মালপত্র আমার তুর্কি চাকর মির্জার জিম্মায় করে দিয়েছিলাম। যে বেচারাকে কারম শাহের তাঁবু ঘরে রেখে গেছিলাম। লক্ষ করেছি, এই ক’দিনের টানা যাত্রায় ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওর খানিক বিশ্রাম দরকার। আমি আমার কুকুর ইওলিচকেও ওর কাছে রেখে গেছিলাম, কারণ অতি উচ্চতার বরফ সাম্রাজ্যে ওর পক্ষে চলাফেরা করা কঠিন হবে। যদিও দীর্ঘযাত্রার পরেও ওর ছটফটানিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।
দুপুরের খানিক আগে আমার কাশগরি চাকর সাদাক আকুন, হুঞ্জা আর পুন্যালের তিন দলসঙ্গীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ওরা কঠিন পাহাড়ি যাত্রায় কতটা দক্ষ এই যাত্রা তারও পরীক্ষা। দারুণ আবহাওয়া। ঝলমলে রোদ্দুর আর উদ্দাম হাওয়াও নেই। উপত্যকার সমতল অংশ ফুল আর ভেষজের গন্ধে ম-ম করছিল। ক’দিন আগে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় পাওয়া সুবাসির সামরিক আস্তানাটা পার হবার সময় জোরাল রোদে পোস্টটাকে প্রথম যা দেখেছিলাম তার থেকেও অবস্থাটা করুণ দেখাচ্ছিল। কতগুলো ঘর কোনোরকমে খাড়া হয়ে আছে। বিশাল সবুজ ঘাসজমি পার হয়ে ইয়াম্বুলাক হিমবাহের দিকে চলছিলাম আমরা।
আমাদের সামনে মুজতাগ-আতার পশ্চিম ও উত্তরপূর্ব দিক থেকে নেমে আসা দুটো গিরিশিরার দু-পাশে খাড়া উঠে যাওয়া দুই পাহাড় চূড়া। ডক্টর হেডিনের বর্ণনা থেকে এটা জেনে গেছিলাম যে মুজতাগ-আতার উচ্চতর ঢালে যাবার এটাই পথ। যদি এখান দিয়ে আরোহণ সম্ভব না হয় তবে ইয়াম্বুলাক হিমবাহের উত্তর প্রান্তের ঢাল বেয়ে উঠতে হবে। উপত্যকার শীর্ষদেশের কাছে দাঁড়িয়ে সামনের পাহাড়ি ঢালটিকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার ছোট্ট টেলিস্কোপটি চোখে লাগিয়ে উত্তরের পাহাড়ি ঢালটি ভালো করে দেখে মনে হয়েছিল উত্তর-চূড়া পর্যন্ত এটি নিরাপদ—অন্তত সেরকম কোনও বরফ-খাদ নেই। আর দক্ষিণের ঢাল খুঁটিয়ে দেখে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ও-পথে ওপরে ওঠা একরকম অসম্ভব। জমাট শক্ত বরফের ওপর অসংখ্য আঁকিবুঁকি, ফাটলে ভর্তি। বরফের ওপর আলগা পাথর বোঝাই। আর জায়গায় জায়গায় খানিক খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে কয়েকশো ফুট। উত্তরের ঢাল তুলনায় অতটা খাড়া নয় আর বরফও কম জমে আছে ওইদিকে। উত্তরের ঢাল ধরে ওঠাটা শুধু সহজ আর নিরাপদই হবে না, দ্রুত ওঠা যাবে বলেই আমার মনে হয়েছিল।
ডক্টর হেডিন উত্তরের যে ঢাল ধরে তিনবার মুজতাগ-আতায় আরোহণ করতে চেষ্টা করেছিলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ ওঁর লেখায় আছে। শুধু একটি বিষয় তাতে নেই। ১৮৯৪ সালের অভিযানের সময় ওই পথে ২০,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় খুব বেশি বরফ জমে ছিল না। কিন্তু টেলিস্কোপে যা দেখেছিলাম তাতে সন্দেহ নেই ১৭,০০০ ফুট থেকেই ও পথের পাথরের স্তর পুরু বরফে ঢেলে গেছে। সতিপ আলদি, আমার কিরগিজ পথপ্রদর্শক যিনি ডক্টর হেডিনের একটি অভিযানের সদস্য ছিলেন। তার মতে, গত দু-বছরের প্রবল তুযারপাতের ফলেই ওই ঢালের এই অবস্থা হয়েছে। পরিস্থিতি বিচার করে ডক্টর হেডিনের উল্লেখ করা পথ আমরা অনুসরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
১৭ তারিখ উপত্যকার উঁচু অংশে পশুচারণদারদের কতগুলো অস্থায়ী চামড়ার তাঁবু ঘরের পাশে আমরা তাঁবু খাটিয়েছিলাম। জায়গাটার নামও ইয়াম্বুলাক। অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে ওপরের বরফ-ঢাকা অংশে যাত্রা শুরু করার আগে, নিরাপত্তার খাতিরে আমি আমার আর আমার দলের লোকেদের জন্য কিছু অতিরিক্ত ইয়াক সঙ্গে নিতে চাইছিলাম। এতে করে ইয়াকদের ওপর কম চাপ পড়বে।
ইয়াক জোগাড় করতে খানিক সময় লেগে গেছিল। ১৮ তারিখ সকাল সাতটার সময় আমরা ইয়াম্বুলক থেকে রওনা দিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ইয়াম্বুলক হিমবাহের মোরেন ঢাকা অংশে পৌঁছে গেছিলাম। এক ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছেছিলাম উত্তর ইয়াম্বুলাক হিমবাহের নীচের অংশের গ্রেট মোরেনের কাছে। ওখানেই সমতল ভূমির শেষ। ওই জায়গায় তাঁবু লাগাতে বলে ওপরকার পরিস্থিতি বুঝতে আমি কয়েকজনকে নিয়ে ইয়াকের পিঠে চড়ে মোরেন বোঝাই ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। যেখানে তাঁবু খাটাতে বলেছিলাম সেই জায়গাটার উচ্চতাই ১৫,০০০ ফুটের ওপর। সদ্য জোগাড় করা অতিরিক্ত ইয়াকগুলো সঙ্গে নিয়েছিলাম। ওপরে উঠতে উঠতে ইয়াকগুলো রীতিমতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছিল। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না উচ্চতাজনিত কষ্ট বরফের রাজ্যের প্রাণীগুলোরও হচ্ছে। কোনও ভুল নেই বরফ আর আলগা পাথরভরা খাড়া পাহাড়ি পথে ইয়াকেরা নির্বিঘ্নে চলতে পারে। কিন্তু পিচ্ছিল খাড়া ঢালে পথ তৈরি করে নেওয়াটা সহজ ছিল না। প্রাণীগুলোকে নির্দিষ্ট দিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাঠি ব্যবহার করতে হচ্ছিল। ওদের মর্জির ওপর ছেড়ে দিলেই উলটোদিকে নীচের দিকে নামার চেষ্টা করছিল। আলগা পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে বরফে ঢাকা অংশে পৌঁছতেই ঘণ্টা খানেক লেগে গেছিল। জমি এখানে যথেষ্ট শক্ত। আরও এগিয়ে যেতে নরম তুষার পেয়েছিলাম। প্রথম প্রথম নরম অল্প গভীর তুষারের ওপর দিয়ে এগোতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। আধমাইলমতো এগোতেই ক্রমেই বরফের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছিল। ১৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে ইয়াকের পিঠ থেকে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছিল। সকালে যেই ছাড়া ছাড়া মেঘগুলোকে নীচ থেকে সুন্দর লাগছিল, সেগুলোই আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরছিল। যেখান পর্যন্ত আমরা ইয়াকের পিঠে চেপে পৌঁছতে পেরেছিলাম, সেখানেই একটি শিবির স্থাপন করা যেতে পারে বলে মনে হয়েছিল। ওখানে পাহাড়ের ঢাল খুব বেশি খাড়া ছিল না। তাঁবু খাটাতে কোনও অসুবিধাও ছিল না। কিন্তু ভেবে দেখেছিলাম, ওই উচ্চতায় তাঁবু খাটালে তার পরের লম্বা আরোহণের জন্য সেটা খুব একটা কাজের হত না।
সামনের উচ্চতার কথা মাথায় রেখে আমার সঙ্গের দুই হুঞ্জা মালবাহককে আরও উপরে উঠে বরফের অবস্থা বুঝে এমন একটা সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে বের করতে বলেছিলাম যেখানে তাঁবু ছাড়াই আমরা রাত কাটাতে পারি। ওরা এইসব বিষয়ে ভীষণ দক্ষ। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকায় আমি আর না এগিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েই ফটো-থিওডোলাইট যন্ত্রটি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলাম।
ক্রমাগত চারপাশে জড়ো হওয়া হালকা মেঘ আর জোরে বইতে থাকা হাওয়া আমাদের সময় নষ্ট না করার সতর্কবাণী দিচ্ছিল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানকার দৃশ্য মোহিত করে রেখেছিল। হাইপসোমিটার জানাচ্ছিল যে জায়গাটার উচ্চতা ১৬,৮২০ ফুট। এখান থেকে ইয়াম্বুলাক হিমবাহের উপর আর নীচের দুই অংশই দেখা যাচ্ছিল। দু-পাশের পাথরের উঁচু দেওয়াল হিমবাহটিকে আঁকড়ে রেখেছে যেন। মুজতাগ-আতার দুই চূড়ার মাঝের অংশ ভরাট করে নেমে আসা হিমবাহের শিখরদেশ তাজা বরফে ঢাকা। হিমবাহের ওপরের অংশে হাঁ করে আছে বিশাল বিশাল বরফের ফাটল। ধবধবে সাদা বরফের মাঝে বরফ ফাটলের সবজে রঙের ছোঁয়া। সে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। আমাদের উলটোদিকে পাথরের দেওয়াল সোজা উঠে গেছে প্রায় মুজতাগ-আতার দক্ষিণ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া পর্যন্ত। বরফের স্তূপ পাথরের দেওয়ালের মাথায় জমে।
হালকা মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মারলেও প্রবল হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। সে কারণেই ফটো-থিওডোলাইটের সূক্ষ্ম যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে সময় লাগছিল। ইয়াকের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের সঙ্গে আসা দুই কিরগিজ ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে বলে জানিয়েছিল। আমার কাজ শেষ হবার আগেই আমিও উচ্চতাজনিত অসুস্থতা টের পাচ্ছিলাম। ইয়াকদের দেখভালকারীদের থেকে এখানকার টপোগ্রাফিক্যাল কোনও তথ্য যে পাওয়া যাবে না তা বুঝে গেছিলাম। আমার হুঞ্জা কুলিদের দেখা পাবার আশায় থেকে থেকে ওপরের বরফ-ঢালের দিকে তাকাচ্ছিলাম । যত বেলা গড়াচ্ছিল ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওরা ফিরে এল। পাহাড়ু হয়েই জন্মানো শক্তপোক্ত ওয়ালি মুহাম্মদ এবং গুনকে বিধ্বস্ত লাগছিল। পেঁজা তুষারের মধ্যে দিয়ে তারা উঠেছিল হিমবাহের অনেকটাই ওপর পর্যন্ত। অনেক ওপরে একটা ছোটো হিমবাহ পাশের পাহাড়ের ঢাল থেকে এসে মিশেছে এই হিমবাহে। ওরা ওই পর্যন্ত পৌঁছে আর এগোয়নি।
ওদের কথা শুনে এটা আমার পরিষ্কার মনে হয়েছিল যে আগের দিন যা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক—এই গিরিশিরা পর্বতের আনুমানিক ২২,০০০ ফুট উঁচু চূড়া পর্যন্ত গেছে। লক্ষ করেছি, হিমবাহের টুকরো টুকরো বরফ ফাটলগুলো উত্তরের গিরিশিরার খানিক নীচ পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ওয়ালি মুহাম্মদ আর গুনের বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে এটি একটি ট্রান্সভার্স হিমবাহ।
দুজনেই ওপরে ভীষণ ঠান্ডা বলে জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওপরে প্রবল শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল ওদের। হিমবাহের কিনারা ঘেঁষেই ওর এগিয়েছিল। কিন্তু এমন একটাও জায়গা পায়নি যেখানে রাত কাটানো সম্ভব। এমনকি ছোটো তাঁবু খাটানোর অবস্থাও নেই। সবখানেই তুষার ভীষণ গভীর। এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এই পথ দিয়ে মুজতাগ-আতার শীর্ষে পৌঁছানো খুবই কঠিন। যা করতে হবে তা হল চূড়ার পৌঁছানোর জন্য ওপরে এক রাত কাটানোর পরিকল্পনা বিসর্জন দেওয়া। আমার লোকেরা যেখান পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেখানে গিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা। সবচাইতে চমকপ্রদ হল ১৮৯৪ সালে এ-পথ ধরেই ডক্টর হেডিন ইয়াকের পিঠে চড়ে কুড়ি হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এর অর্থ, সেই সময় হিমবাহটির এরকম অবস্থা ছিল না। পাশাপাশি এটাও ডক্টর হেডিন বলেছিলেন, শীর্ষে পৌঁছানো পুরোটাই নির্ভর করছে পরিষ্কার আবহাওয়া আর শারীরিক সক্ষমতার ওপর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আবহাওয়া ঠিক থাকলে আমার হুঞ্জা সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে ওরা খানিক আগে যে-পথ দিয়ে এগিয়েছিল, কাল সে-পথ ধরে ওপরে চড়ব।
ঝাঁপিয়ে পড়া হিংস্র ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে আমরা দ্রুত নামতে শুরু করেছিলাম নীচে আমাদের তাঁবুর আশ্রয়ের দিকে। পৌঁছে দেখি মোরেনের ধার ঘেঁষে আমার তাঁবু খাটানো রয়েছে। আর কারাসু থেকে রাম সিংও এসে গেছিল। যখন আমি তাঁবুতে ঢুকেছিলাম তখনই আকাশ মেঘলা ছিল। পরদিন ভোর সাড়ে তিনটের সময় যখন ঘুম থেকে উঠে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি থম মেরে আছে চারপাশ, পরিষ্কার ঝড়ের ইঙ্গিত। খানিক সময়ের মধ্যেই প্রবল হাওয়ার সঙ্গে তুষার ঝড়তে শুরু করেছিল। পুরু পশমের জ্যাকেট পরে কপাল কুঁচকে দেখছিলাম ঝড়ের তাণ্ডব। ভেবেছিলাম পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। কিন্তু ছ’টা নাগাদ ঝড় থেমে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল। ডক্টর হেডিনের বর্ণনা হুবহু মিলে যাচ্ছিল। উনি লিখেছিলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই ভোরের দিকে তুষার ঝড় আছড়ে পড়ে এই মহান পর্বতের কোনও না কোনও দিকে।’ ইয়াকগুলো তৈরিই ছিল, সকাল সাতটা নাগাদ সূর্যের মুখ দেখা দিতেই আমরা যাত্রা শুরু করতে বলেছিলাম। কিরগিজগুলো যেতে চাইল না। গতকালই টের পেয়েছিলাম ওরা সেরকম কোনও কাজের নয়। অগত্যা আমার হুঞ্জা সাঙ্গোপাঙ্গরা—পুন্যালি আর্দালি আজব খান, সাব-সার্ভেয়ার রাম সিংকে নিয়ে আমি পাহাড় চড়া শুরু করেছিলাম।
এবার আর অতিরিক্ত ইয়াকগুলো সঙ্গে নেওয়া হয়নি। ঘণ্টা খানেক চলার পর গতকাল যেখানে এসেছিলাম সেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। বেগে হাওয়া চললেও আকাশ পরিষ্কার ছিল। আমরা উঠতে শুরু করেছিলাম ওপরপানে। ক্রমশ বেড়ে চলা তুষারে ঢাকা ঢাল বেয়ে উঠতে ইয়াকগুলো যথারীতি বেগড়বাই করেছিল। ঘাড় নাড়তে নাড়তে এগোচ্ছিল এক-পা দু-পা করে। জন্তুগুলোর পিঠে বসে ওদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুবই সমস্যার কাজ ছিল। বার বার ওদের পিঠ থেকে নেমে পড়ে নাছোড় প্রাণীগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে বরফ-ঢালের ওপরদিকে তুলতে হচ্ছিল। গতকাল যেখানে পৌঁছেছিলাম সেখান থেকে ইয়াকগুলো নিয়ে ঘণ্টা খানেক কসরত করে মাত্র ৫০০ ফুট মতো পথ এগোতে পেরেছিলাম। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ইয়াকগুলো নিয়ে আর এগোন ঠিক হবে না। ওখানেই ছেড়ে রেখে গেছিলাম ওদের। তুষারপাতে বরফের পরিমাণ বেড়ে গেছিল। নয় নয় করেও পাঁচ ফুটের ওপরে তুষার জমে ছিল। আমাদের আল্পাইন স্টিকগুলো বরফের নীচের পাথর-স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিল না। আগেরদিন এ-পথে আসা আমার হুঞ্জা সঙ্গীদের বরফের ওপর রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ হারিয়ে গেছিল সকালের তুষারপাতে। পাথরের খাড়া পাঁচিলের ধার ঘেঁষা যে পথ দিয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম, তার ওপরে জমে থাকা বরফ দেখে মনে হচ্ছিল এগুলো সাম্প্রতিক শীতেতেই জমছে। প্রবল শক্ত হয়ে যায়নি বরফগুলো। শুধু পাথরগুলোকে আঁকড়ে রেখেছে। একদিক থেকে আমরা নিরাপদেই ছিলাম। উলটোদিকের পাথরের দক্ষিণ দেওয়ালটি বেয়ে যত বেলা বাড়ছে ততই ওপরের দিক থেকে ছোটো ছোটো ধ্বস নামতে শুরু করেছে।
নরম তুষারের ওপর দিয়ে আরোহণ মোটেই সহজ কাজ নয়। প্রতি পদক্ষেপে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিলাম আমরা। আর আগে চলতে থাকা সঙ্গীর পায়ের দাগের ওপর পা না ফেলে, একটু এদিক-ওদিক পা ফেললেই কোমর সমান বরফে সেঁধিয়ে যাচ্ছিলাম। একদিক থেকে বাঁচোয়া, উচ্চতাজনিত অসুস্থতার লক্ষণ কারও মধ্যে এখনও দেখা যায়নি। যদিও উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁপ ধরছিল দ্রুত, খানিক পরপর দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিতে হচ্ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার গতিও বাড়ছিল, সঙ্গে শুরু হয়েছিল হালকা তুষারপাত। মাঝে-মাঝেই ওপরের ঢাল থেকে গড়িয়ে আসছিল ছোটো ছোটো বরফের গোল্লা। দুপুরের আগে আগে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলাম যেখানে পাশের পাথরের দেওয়াল থেকে খানকয়েক পাথরের খোঁচ বেরিয়ে ছিল। আর পাথরগুলো ছিল বরফশূন্য, শুকনো। আমরা ওখানেই খানিক বিশ্রাম আর সামান্য খাওয়াদাওয়া সেরে নেবার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। ইয়াম্বুলাক হিমবাহটা চওড়া সাদা ফিতের মতো দুই পাথরের দেওয়ালের মাঝ দিয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। অবাক হয়ে গেছিলাম এটা দেখে যে আমরা পৌঁছে গেছি প্রায় ১৯,০০০ ফুট উচ্চতায়। আর এই দীর্ঘ আরোহণের পরেও ক্লান্তি বা খিদে আমাদের কাবু করতে পারেনি।
আবার হালকা তুষারপাত শুরু হয়ে গেছিল। খানিক পর তুষারপাত বন্ধ হতেই আমরা আবার চড়তে শুরু করেছিলাম। আজব খানের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছিল। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও। ডক্টর বেলিউর পরামর্শ মাথায় ছিল। ওকে খানিক পটাশের গুঁড়ো খেতে দিয়েছিলাম। আমিও খানিক নিয়েছিলাম। দুপুর দেড়টা নাগাদ রাম সিংও শরীরে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছিল। আর না এগিয়ে ওখানেই থেকে গেছিল ও। প্রবল বাতাস পাহাড়ের ওপরের অংশকে ঢেকে থাকা মেঘের চাদর সরিয়ে দিয়েছিল। ওখানে থেকেই রাম সিং চারপাশের উঁচু পাহাড়গুলোকে নিয়ে ওর সার্ভের সূক্ষ্ম ‘প্লেন-টেবিল’-এর কাজগুলো সেরে নিয়েছিল। মিনিট কুড়ি যেতে না যেতেই দুঁদে পর্বতারোহী আজব খান ক্লান্তিতে ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পেরে পা পিছলে পড়ে গেছিল। ভাগ্য ভালো কোনও অঘটন ঘটেনি। ও আর এগোতে চায়নি। আমার অনুমতি নিয়ে নীচে নেমে গেছিল। আমার সঙ্গে শীর্ষে যাওয়ার দলে অবশিষ্ট ছিল ওয়ালি মুহাম্মদ, গুন আর দুই হুঞ্জা কুলি। পাহাড়ের মাথায় চড়ার জন্য ওরা উত্তেজনায় ফুটছিল। জমা তুষারের পরিমাণ বেড়েই চলছিল। পাহাড়-চুড়ো ঘিরে থাকা মেঘ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে শীর্ষে পৌঁছে কোনও জরিপের সুযোগ পাব না। আবহাওয়া দ্রুত বদলাচ্ছিল। বলে দিচ্ছিল যে আর এগোনো ঠিক হবে না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি সামনের শৈলশিরার একটা অংশকে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে স্থির করে নিয়েছিলাম। আড়াইটে নাগাদ শৈলশিরার মাথায় পৌঁছে খানিক বসেছিলাম। পাথরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে নীচের দিকে নেমে যাওয়া বিশাল হিমবাহটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম একদৃষ্টে।
ঝড়ো হাওয়ায় হাইপসোমিটারের জন্য জল গরম করা ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। বরফের মধ্যে গর্ত করে হাওয়া আটকে খানিক জল গরম করার মতো জায়গা করা হয়েছিল। কুকিং কেক জ্বালিয়ে, তার ওপর পাত্রে বরফ চাপিয়ে খানিক জল পেতে তাই দিয়ে হাইপসোমিটারে জায়গাটার উচ্চতার মাপ পাওয়া গেছিল। প্রায় কুড়ি হাজার ফুট। ঘণ্টা ছয়েক টানা আরোহণের পরেও আমাদের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ঠিকই ছিল। চুড়োয় উঠতে কোনও অসুবিধা হত না। কিন্তু বাতাসের বেগ যেমন বাড়ছিল তেমনি আলোও পড়ে আসছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পড়ন্ত আলোয় আর এগোনো ঠিক হবে না। নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আগামীকাল সব ঠিক থাকলে আবার চেষ্টা করা যাবে এটা ভেবে নিয়েছিলাম। চুড়োয় পৌঁছতে না পারলেও যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তাতে মন ভরে গেছিল। পশ্চিমদিকের মেঘ সরে গিয়ে পুরো রেঞ্জটা নিজেকে মেলে ধরেছিল আমাদের সামনে। আমাদের মাড়িয়ে আসা তুষারের বুক থেকে উঠে আসছিল একটা মৃদু সুগন্ধ।
সামনের দিকে সোজা ধু-ধু করছে পামিরের বিস্তৃত অঞ্চল। উপত্যকার পর উপত্যকা। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ‘পৃথিবীর ছাদ’কে। এই উচ্চতা থেকে না দেখতে পেলে পৃথিবীর ছাদের বিশালতাকে উপলব্ধি করতে পারতাম না। দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে চিকচিক করছিল বরফে ঢাকা পাহাড়-দৈত্যরা। ভেবেছিলাম ওদের চিনতে পারব। না! সিন্ধু উপত্যকার রক্ষাকর্তাদের চিনতে পারিনি। উত্তরের কয়েক গগনচুম্বীকে মানচিত্রের কল্যাণে শুধু চিনতে পেরেছিলাম, মাউন্ট কাফম্যান আর ট্রান্স-আলাই রেঞ্জের কিছু বরফ-শিখরকে। ওই চূড়াগুলোর শীর্ষদেশ অবশ্য মেঘে ঢেকে ছিল।
এই অদ্ভুত অসাধারণ দৃশ্য প্রবল ঠান্ডা আর ঝড়ো বাতাসে বেসামাল—শুধু আমাকেই নয়, আমার সঙ্গীদেরও স্তব্ধ করে দিয়েছিল। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সুবিশাল সমৃদ্ধ চারণভূমি। সঙ্গোপনে পড়ে থাকা সুবিস্তৃত চারণভূমি সম্পর্কে ছোট্ট হুঞ্জা উপত্যকার মানুষদের সম্ভবত কোনও ধারণা নেই। আমি আমার হুঞ্জা সঙ্গীদের বিস্ময় আর উত্তেজনা বেশ অনুভব করতে পারছিলাম। সাহসী আর একইভাবে নম্র পাহাড়ি হুঞ্জাদের ঠোঁটের অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছিল ওদের মনের না বলা কথা। পশুর দল নিয়ে চারণের প্রতীক্ষায় অনাবিষ্কৃত ভূমি। ওদের কথাবার্তায় কানজুটিদের কথা উঠে আসছিল। কানজুটিরা এখন শান্তির সপক্ষে। এখন শান্তিতে ওই অঞ্চলে পশুর দল চরাতে নিয়ে যাওয়া যাবে। ওয়ালি মুহাম্মদ ওর বাবার কথার স্মৃতিচারণ করছিল। কীভাবে একবার তাঘরমার চারণদারদের এক বিশাল পশুরপালকে কিরগিজরা আক্রমণ করে লুটে নিয়েছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল এই পাহাড়ের পাদদেশেই, যেখানে রয়েছে আমাদের শিবির। অবশ্য এখন সরকার খুব কড়া। কনজুটিরা লুটপাট করার সাহস দেখায় না। আমি সুখের দিনের সেই স্বপ্ন নিয়ে মুখে কোনও মন্তব্য করিনি। কিন্তু আমার অন্তর থেকে নীরবে ওদের জন্য শুভকামনা জানিয়েছিলাম। প্রশাসন যদি দক্ষিণ থেকে উত্তরে তাদের আধিপত্য ঠিক ঠিক বজায় রেখে নজরদারির কাজটি চালিয়ে যায় তবে সন্দেহ নেই হুঞ্জারা অক্সাস থেকে কাশগড় সীমান্ত পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারবে।
সন্ধে ছ’টা নাগাদ যখন ওপরে ওঠার সময় যেখানে খানিক খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রাম নিয়েছিলাম, সেই পাথরের খোঁচের কাছে পৌঁছে দেখি পাথরের খাড়া ঢালের ধারে হিমবাহের কোল ঘেঁষে তাঁবু খাটিয়ে রেখেছে রাম সিং আর আজব খান মিলে। ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। কোনোক্রমে তাঁবু খাড়া করা। প্রবল হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল তাঁবুগুলো। তাঁবুর ভেতর ঢুকে ফরফর আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল যেন উথালপাতাল মাঝ-সমুদ্রে জাহাজের কেবিনে আছি। তাঁবুতে ঢুকেই যে-কাজটা আমায় প্রথমে সারতে হয়েছিল তা হল রাম সিং আর আজব খানের খানিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ওদের মাথাব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব ছিল। অতি উচ্চতাজনিত রোগের লক্ষণ। তাঁবুর বাইরে দুই হুঞ্জা কুলি সঙ্গে আনা ভেড়ার মাংস নিয়ে মেতে ছিল। ওদের হাসির শব্দ আর কথাবার্তা কানে এলেও ওদের আলোচনার বিষয় যে কী ছিল বুঝতে পারিনি। সামান্য খেয়ে খানিক সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বাতাসের হিংস্র শব্দ আর ইয়াম্বুলাক হিমবাহের অন্য কিনারা থেকে ভেসে আসা ঘনঘন তুষারধ্বসের ভয়াবহ আওয়াজে স্বস্তিতে ঘুমোতে পারছিলাম না। হালকা তুষারপাতও হয়েই চলেছিল। একদিক থেকে খানিক নিশ্চিন্তে ছিলাম, হিমবাহের যে-প্রান্ত ও যেখানে আমরা তাঁবু খাটিয়ে আছি সে জায়গাটা তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ। ভোর ছ’টায় ঘুম ভাঙতে বাইরে বেরিয়ে দেখি ইঞ্চি দুয়েক তাজা বরফ জমেছে কালকের বরফের ওপর। মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। আবহাওয়া পরিষ্কার হবার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না। কিন্তু পরিষ্কার আবহাওয়া আমাদের কপালে ছিল না। তাঁবুর বাইরের হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় প্রবল বাতাসে আমরা কেঁপে উঠছিলাম। বেলা বাড়লেও আবহাওয়া ভালো না হওয়ায় আমাদের শীর্ষে আরোহণের ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে তাঁবু গুটিয়ে নীচের দিকে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম। শীর্ষ আরোহণের জন্য অতিরিক্ত দিন বরাদ্দ করার সুযোগ আমার কাছে ছিল না।
২০ জুলাই সন্ধে নাগাদ আবার ইয়াম্বুলাকের ঘাসজমিতে কিরগিজদের চামড়ার কুঁড়ের পাশে গিয়ে তাঁবু খাটিয়েছিলাম। পরদিন সকালে আমি রাম সিংকে সঙ্গে করে জরিপের সরঞ্জাম নিয়ে চড়েছিলাম কাম্পার-কিশলাক হিমবাহের উত্তরদিকে মুজতাগ-আতা থেকে নেমে আসা শামালদা নামের এক শৈলশিরায়। চারপাশে উদ্দাম গতিতে বয়ে চলা প্রবল কনকনে ঠান্ডা বাতাসে বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ উঠছিল। পাহাড়ের উলটোদিক মেঘ আর কুয়াশায় ঢেকে। ওইরকম পরিস্থিতিতে ফটো-থিওডোলাইট নিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন ছিল। মেঘ আর কুয়াশার চাদর মাঝে মাঝে সরে গিয়ে উপত্যকার পরিষ্কার ছবি ফুটিয়ে তুলছিল আমাদের চোখের সামনে। যেন একটি রিলিভো মানচিত্র, উঁচুনীচু হয়ে থাকা রেখাচিত্র। জায়গাটার উচ্চতা ছিল ১৪,৭৫০ ফুট। আমাদের সামনের অঞ্চলটি কারাকুল লেকের উত্তর-পূর্বের সুউচ্চ চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। দীর্ঘ সময় শৈলশিরার মাথায় হওয়ার সঙ্গে লড়াই করে শিবিরে নেমে এসেছিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের শিবির লেকের দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে গেছিল আমার লোকেরা। শিবিরে পৌঁছে দেখি কিরাকাশদের একটি দল সঙ্গে দশটা ঘোড়া নিয়ে হাজির হয়েছে। মিস্টার ম্যাকার্টনি কাশগর থেকে নতুন করে পরিবহণের ব্যবস্থা করে পাঠিয়েছেন। আমার মন আনন্দে নেচে উঠেছিল ওদের সঙ্গে পাঠানো একরাশ চিঠি পেয়ে। ইউরোপ থেকে রাশিয়ার সমরকন্দ পোস্ট হয়ে কাশগর থেকে সে চিঠি পৌঁছেছিল আমার কাছে। একটা চিঠির পোস্ট করার তারিখ ছিল ২৪ জুন। প্রমাণ হয়ে গেছিল রেলওয়ে মুজতাগ-আতার ঢালকে বাইরের দুনিয়ার কাছে নিয়ে এসেছে।
২২ জুলাই আকাশ আবহাওয়া আচমকাই পরিষ্কার হয়ে গেছিল। মহিমাময় সুবিশাল পাহাড়ের দৃশ্য চোখের সামনে নিখুঁতভাবে ফুটে থাকায় দিনটি কাজের মধ্যেও দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। উত্তর-পূর্বের হিমবাহ আবৃত উত্তুঙ্গ পাহাড়শ্রেণি যা আমাদের ম্যাপে ‘কঙ্গুর’ নামে উল্লেখিত, যার কোনও স্থানীয় নাম বা আলাদা করে কোনও পরিচিতি নেই, সেও তার শরীরের ওপরকার মেঘের ওড়নার আবরণ ঘণ্টা খানেকের জন্য সরিয়ে রেখেছিল। আমাদের যন্ত্রপাতি ও অঙ্কের হিসেব অনুযায়ী হিমবাহের ওপরের অংশের কঙ্গুর-দেবে এবং কোকসেলের সর্বোচ্চ পাহার-চূড়ার উচ্চতা যথাক্রমে ২৩,৬০০ এবং ২৩,৪৭০ ফুট। কাছাকাছি উচ্চতার প্রতিদ্বন্দ্বী পর্বত মুজতাগ আগা ২৪,৩২১ ফুট।
কাশগর থেকে আসা পনি-চালকদের কাছ থেকে একটা কথা জানতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল, যে আমাদের কারা-তাশ যা কালোপাথর নামেও পরিচিত, সেই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে এগোতে হবে না। এই পাহাড়ের ফাঁক যা দক্ষিণে ‘বরফ পাহাড়ের পিতা’কে অন্য পাহাড়শ্রেণি থেকে আলাদা করেছে। এই কঠিন যাত্রার পরিবর্তে আমরা গেজ গিরিসংকট দিয়ে যেতে পারব। যদিও আমি ইয়ামানিয়ার নদীর জল টইটম্বুর অবস্থার কথা ভেবে এই পথের কথা মন থেকে আগে সরিয়ে দিয়েছিলাম।
গেজ গিরিসংকটের পথে
২৩ জুলাই সকালে একদিকে আমি আমার কাশগর যাত্রার জন্য তৈরি হয়েছিলাম, আর অন্যদিকে একটা ছোট্ট তাঁবু নিয়ে রাম সিং তৈরি হয়েছিল বুলুনকুলের দিকে কারতাস গিরিপথ পর্যন্ত তার জরিপের কাজ শেষ করতে। দুজন যাব দু-দিকে। আমি যাব উত্তরে আর সে যাবে উত্তর-পূর্বে। সপ্তাহ খানেক পর অবশ্য সে কাশগরের পথ ধরে আমাদের দলে যোগ দেবে আবার। যাতে কোনোভাবেই রাম সিংয়ের এতদিনকার কাজ নষ্ট না হয় বা হারিয়ে না যায় তাই আমি ওর জরিপ করা প্রতিটি নকশার ছবি তুলে নিয়েছিলাম। দুর্ঘটনা বা চিনা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না! এখান থেকেই আমার দুই হুঞ্জা চাকর ও আজব খান বিদায় নিয়ে ফিরে গেছিল তার নিজের বাসস্থানে। যথেষ্ট পরিমাণে মজুরি ও বকশিস পেয়ে তারা বেজায় খুশি হয়েছিল। এখান থেকে বিদায় নিয়েছিল করম শাহ্ বেগও। যাত্রা শুরুর আগেই আমার মন খুশিতে ভরে উঠেছিল ভারত থেকে সারিকোল হয়ে আসা আমার চিঠিপত্রের গাঁটরি পেয়ে। এতে শুধু চিঠিপত্রই ছিল না, গিলগিট থেকে ছয় সপ্তাহ আগে লাহোরে অর্ডার করা কিছু ছোটোখাটো অথচ জরুরি জিনিসপত্রও ছিল। কিছু সরঞ্জাম যেগুলোর অভাব অভিযান শুরু হবার খানিক পরপরই টের পেয়েছিলাম।
রাম সিংয়ের মালপত্র বুলুনকুলের দিকে রওনা দিতে না দিতেই আমি কারাকুলের পশ্চিমে হাজার দেড়েক ফুট উঁচু এক পাহাড়ের মাথায় চড়ে ফটো-থিওডোলাইট নিয়ে আমার কিছু অসমাপ্ত জরিপের কাজ শেষ করতে লেগে পড়েছিলাম। অভিযানের মালপত্র নিয়ে আমার দলবল রওনা হয়ে গেছিল। কোক-তুমশুক পাহাড়ের মাথা থেকে চারপাশের অনন্যসুন্দর দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিলাম। পাহাড়ের তলদেশের লেকের পান্না-সবুজ জলের ঢেউয়ের মাথাগুলো সূর্যের আলো পড়ে অভ্রের মতো ঝকঝক করছিল। টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে লেকের ঠিক উলটোদিকে নজর করতেই দেখি রাম সিং থিওডোলাইট যন্ত্র নিয়ে কাজ করে চলেছে। উত্তরের দিকে বাসিককুলের ছোটো ছোটো হ্রদগুলোর ঘন সবুজ জল পরিষ্কার আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল হ্রদের কিনারার কালচে পাথরের স্তূপগুলোকে। উপত্যকার লেকগুলোকে ঘিরে প্রাকৃতিক ক্ষয়ে গড়ে ওঠা বৃত্তাকার পাথুরে খাড়া দেওয়ালগুলোকে। এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার কেউ নেই, জনশূন্য চারদিক। বিকেল তিনটে নাগাদ আমি ছবি তোলা শেষ করে দ্রুত পাহাড়-চুড়ো থেকে নেমে এসেছিলাম কারাকুল থেকে জন্মানো এক ছোটো পরিষ্কার জলের স্রোতের পাশে। তারপর বাসিককুল হ্রদের উত্তর কিনারা ধরে কারাকুলের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলাম। এই প্রথম অনুভব করেছিলাম ‘আই অফ দ্যা সি’—সমুদ্রের চোখের মোহময় রূপের মোহ। গ্রীষ্মের শান্ত পড়ন্ত বেলায় হ্রদের কিনারার ঘাসের গালিচা খানিক বিশ্রামের জন্য টানছিল। কিন্তু আমার কাছে সামান্য এই বিশ্রাম করার ফুরসত ছিল না। প্রকৃতির মোহের সব টান ছিঁড়ে ফেলে এগিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল। খানিক পরেই গাছপালার অস্তিত্ব সরে গিয়ে এসেছিল পাথুরে মরু অঞ্চল, ‘দশত’। উপত্যকার পাথুরে মরু-ঢাল বেয়ে আমি এগোচ্ছিলাম। কাছের দক্ষিণ-পশ্চিম হিমবাহ থেকে নেমে আসা ‘এককিবেল-সু’ নদী বয়ে চলেছে উপত্যকার বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই আর পাথরভরা চওড়া অংশ জুড়ে। কারাকুল থেকে মাইল চারেক যাবার পর খানিক কসরত করে নদী পার হতে হয়েছিল। নদীর গভীরতা ছিল চার থেকে পাঁচ ফুট। নদী পার হয়ে হিমবাহের সামনে ছড়িয়ে থাকা পলি-পাথরভরা জমির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম। এই পাথরের টুকরোগুলো একসময় পূর্বদিকের বিশাল হিমবাহে মিশে নেমে এসেছিল। বরফ গলে যেতে শুধু পাথরগুলো পড়ে আছে। নদীর পাড়ের ঘাস আর গুল্মগুলো কাঁটার মতো ধারালো। ছোটো ভেষজ গুল্মগুলো কমবেশি কারাকুলের মতো হলেও এর গন্ধ অনেক বেশি জোরালো।
রাত আটটা নাগাদ আমি বুলুনকুলের চাইনিজ পোস্টের কাছে নদীর এক বাঁকের কাছে ঘাসে ভরা জলাভূমির পাশে খাটানো আমার শিবিরে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। এই অঞ্চলের আম্বান বা সামরিক অধিকর্তা রং-কুল এবং রাশিয়ান পামির সংলগ্ন গিরিপথগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। শিবিরে পৌঁছে যা খবর পেলাম তাতে মনে হল আম্বান আমার আগামী যাত্রাপথে সাহায্য করবেন বলে মনে হচ্ছে না। যদিও তিনি খানিক জ্বালানি আর একটা ভেড়া উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। এই অঞ্চলের কাছাকাছি থাকা এক কিরগিজ পশু চারণদার ওসমান বেগের কথা তাশকুরঘান থেকেই জেনে এসেছিলাম। সে এই অঞ্চলে খুবই প্রভাবশালী। আমাকে বলা হয়েছিল ওর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে গোপনে দেখা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পরদিন সকালে আম্বানের মনের ভাব পরিষ্কার হয়ে গেছিল। টের পেয়েছিলাম করম শাহ্ বেগের দলবল, যারা কারাকুল থেকে আমার মালপত্র এখানে বয়ে নিয়ে এসেছিল, তারা তাদের ঘোড়াসহ পালিয়ে গেছে। কাশগর থেকে আসা কয়েকটা ঘোড়ায় এত লটবহর চাপিয়ে এগোনো অসম্ভব। এছাড়া কাশগর থেকে আসা পশুদলের একটা বড়ো অংশ রাম সিংয়ের সঙ্গে ছিল। উপায়ান্তর না দেখে আমি আম্বানের কাছে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম। তিনি ভদ্রতার ধার না ধেরে উত্তর করেছিলেন, তিনি কিছু করতে পারবেন না। বুঝে গেছিলাম যা করার আমাকেই করতে হবে। ডক্টর সোভেন হেডিনের কথা মনে পড়েছিল। বুলুনকুলে উনি আরও খারাপ ব্যবহার পেয়েছিলেন। ‘এখানকার কঠিন আবহাওয়া ওদের মেজাজ-মর্জি খারাপ করে দেয়’ এই বলে উনি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
আমার সৌভাগ্য বলতে হবে, আম্বান আমাকে কোনও সাহায্য না করলেও কোনও বাধাও দেননি। দোভাষীকে দিয়ে ওঁকে বোঝাতে কালঘাম ছুটে গেছিল যে আমার যাত্রার পরিবহণের ব্যবস্থা করে দেওয়া ওঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। উনি কী বুঝছিলেন জানি না। কিন্তু বেলা ১১টা নাগাদ ডাকপিয়নদের সহায়তায় আর কিরগিজ থেকে আমার সঙ্গে আসা পশুগুলোর পিঠে খানিক বেশি বোঝা চাপিয়ে আমার এগোনোর জন্য কাজ চালানো গোছের একটা ব্যবস্থা করে নেওয়া গেছিল। সে যাই হোক, আমি যাত্রা শুরুর আগে আগের রাতে আম্বান উপহার-স্বরূপ যে ভেড়াটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এত সব কাণ্ডের পর সৌজন্য উপহার স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। যে কিরগিজকে দিয়ে উপহারটি ফেরত পাঠিয়েছিলাম, সে সব বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিল আর কি!
আবহাওয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল আকাশ। ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে চেপে বসছিল শরীরে। দেখতে দেখতে পাহাড়-চূড়া থেকে উপত্যকার নীচু পর্যন্ত মেঘে ছেয়ে গেছিল। নিস্তব্ধ চারদিকে হতাশ করা আবহাওয়া। শুধু মেঘের চাদরে মোড়া নদীর বুক থেকে ভেসে আসছিল জল বইবার শব্দ। বুলুনকুলের প্রায় পাঁচ মাইল উত্তরের এক বাঁকের মাথায় এক হিমবাহের ঘোলা জল এসে মিশেছে এককিবেল-সু নদীতে। এই জলের ধারা গেজ-দাররা নামে পরিচিত। এই ঘোলা জলের ধারার পাশ দিয়ে খানিক এগোতেই এসেছিল একটি ছোটো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারকোনা সৈন্যাবাসে ডজন খানেক সৈন্য ছিল। ‘ম্যাচলক’ বন্দুক নিয়ে এখানে এদের কার্যকারিতা কতটা অনুমান করা মুশকিল। দিনের বাকি পথ আমরা নদীর ডান ধার ধরে এগিয়েছিলাম। গিরিসংকটটি এখানে খুবই সংকীর্ণ। আর হাঁটতে হয়েছিল ছোটো ছোটো আলগা পাথরের ওপর দিয়ে।
বিকেল সাড়ে ছ’টা নাগাদ জাঙ্গুরুক গিরিখাত ধরে এইদিনের হাঁটার সবচাইতে বিপদজনক অংশটি পার হয়েছিলাম। দু-পাশের পাহাড়-চূড়াগুলো থেকে কয়েক হাজার ফুট খাড়াই পাথরের দেওয়াল নেমে এসেছে সোজা গিরিখাতের মাঝে। সরু গিরিখাতে জমে থাকা এবড়ো-খেবড়ো পাথরের স্তূপগুলো প্রচণ্ড ধারালো। একটা পাথরের গা বেয়ে চলার রাস্তা আচমকা বাঁক নিয়েছে। মনে পড়ে যাচ্ছিল হুঞ্জার সেই বিপদজনক ‘রাফিকের’ কথা। যেখানে একবার পা হড়কালেই সোজা স্থান হত বহু নীচের নদীর বুকে। তুলনায় এখানে খাড়া পাথরের মাঝে বাঁকটা নিরাপদে পার হবার জন্য ফুট চারেক মতো চওড়া করে গড়ে তোলা হয়েছে। পথের এই ভয়াবহ অংশটা যখন আমরা পা টিপে টিপে পার হচ্ছিলাম, তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। নিরাপদে এই অংশটা পার হওয়ার পরপরই খানিক সমতল জায়গা পেয়ে আমরা রাত কাটানোর জন্য তাঁবু খাটাতে শুরু করে দিয়েছিলাম। দূরে পাহাড়ের গায়ের অন্ধকার আল্পাইন গাছের মাথা ছাড়িয়ে বরফে ঢাকা পাহাড়-চূড়াগুলো ঝকঝক করছিল। আকাশ জুড়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সোনারঙ ধরা একখণ্ড মেঘ। ভাবছিলাম পুবের ওদিকের সম্পূর্ণ ভিন্ন অঞ্চলে আমার জন্য কী না কী অপেক্ষা করেছে। খানিক সময়ের মধ্যেই উপত্যকার পুবদিকের সমভূমি থেকে একটা ধুলোর ঝড় ধেয়ে এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। রাতে গরমও লাগছিল বেশ।
২৫ জুলাই সকালে আমরা যেখানে আগের রাতে আস্তানা গেড়েছিলাম, তার খানিক দূরে গিয়ে খরস্রোতা নদীটিকে পার হয়ে ওর বামদিকে যেতে হয়েছিল। জায়গাটার নাম ইলেগোরাম। দু-পাশের খাড়াই পাথরের দেওয়ালের ফুট পঁয়তাল্লিশ ফাঁকের মধ্যে দিয়ে নদী ভীষণ গতিতে বয়ে চলেছে। জলতল থেকে খানিক ওপরে সংকীর্ণ, প্রবল-স্রোতা নদী পারাপার করার জন্য ছিল ফুট ছয়েক চওড়া এক কাঠের সেতু। ফলে নদী পার হতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। সেতুর দু-পাশ রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল। শুধু তাই নয়, পুরো সেতুটি উজ্জ্বল হলুদ রঙ করা ছিল। চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতার এক অসাধারণ নিদর্শন। এই ব্রিজ না থাকলে মানুষ বা পশু কারও পক্ষেই এখানে নদী পারাপার করা সম্ভব হত না। মাইল তিনেক গিয়ে আবার একইরকম একটা সেতু পার হয়ে নদীর ডানদিকে যেতে হয়েছিল আমাদের। খানিক এগিয়ে দক্ষিণদিকের এক হিমবাহ থেকে নেমে আসা অন্য একটি জলের ধারার ওপরকার অনুরূপ একটি সেতু জলের তোড়ে ভেসে না গেলে আমরা নদীর বাম তীর ধরেই স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যেতে পারতাম। ওইখানে নদীর যা স্থিতি, তাতে নদী পার হওয়া অসম্ভব ছিল। ফলে আমাদের তিন মাইল মতো পথ এগিয়ে গিয়ে কোকসেল হিমবাহের ওপর চড়তে হয়েছিল যেখান থেকে নদীটির জন্ম।
পুরো উপত্যকাটির তলদেশ হিমবাহ বাহিত বিশাল বিশাল পাথরে বোঝাই। ফলে আমাদের পাথরের ফাঁক দিয়ে চক্কর কাটতে কাটতে এগোতে হচ্ছিল। ভীষণ ক্লান্তিকর ছিল এই যাত্রাপথ। অবশেষে হিমবাহের প্রান্তে নদীর মুখের কাছে পৌঁছে ঘোড়াগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে তুলতে হয়েছিল নদীতল থেকে প্রায় শ-দেড়েক ফুট উঁচুতে বরফের স্তূপের ওপর। আমাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, এখানে বরফের ওপর পুরু হয়ে মাটি আর ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো বোঝাই হয়ে ছিল, ফলে পা ফেলার ধাপ বানাতে অসুবিধা হয়নি। আধঘণ্টার চেষ্টায় আমরা প্রথম ঘোড়াটাকে হিমবাহের ওপরে তুলে নিরাপদে নদীর উলটোদিকে নামাতে পেরেছিলাম। নদীর পূর্বদিকের পাথরে ভরা কিনারা থেকে লম্বা হিমবাহের শেষ মাথায় যে শঙ্কু আকৃতির সুবিশাল পর্বতটি দাঁড়িয়ে, তার উচ্চতা ২৩,৪৭০ ফুট। কোকসেল বা সারগুলুক পিক নামে চিহ্নিত এই পাহাড়-চূড়াকে কাশগর থেকেও দেখা যায়।
চক্কর কাটতে কাটতে এগোতে হচ্ছিল বলে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছিল। উটল কারাউলে যখন আমাদের মালপত্রগুলো পৌঁছতে শুরু করেছিল, তখন বিকেল হয়ে গেছে। এখান থেকেই গেজ উপত্যকার শুরু। ক্লান্ত ঘোড়া বদলে এখান থেকেই নতুন ঘোড়া নেওয়ার কথা। কিন্তু ওখানকার লোকেরা জানিয়েছিল যে পশুর দল এখনও চারণভূমি থেকে ফেরেনি। কী আর করা। ওখানেই নদীর ধারের অসাধারণ সুন্দর ছোটো ছোটো নুড়িভরা কিনারায় আমাদের তাঁবু খাটাতে হয়েছিল। সন্ধেবেলা প্রবল ধুলোর ঝড় শুরু হয়েছিল। ধুলোয় ঢেকে গেছিল চারদিক। জায়গাটার উচ্চতা ছিল আট হাজার ফুট। তবুও খুব গরম লাগছিল।
২৬ জুলাই ঘুম থেকে উঠে শুনলাম, যে-পশুর দল আসার কথা ছিল, তারা আসেনি। শুধু তাই নয়, বুলুনকুল থেকে আসা লোকগুলো আমার মালপত্র ফেলে রেখে পশুর দল নিয়ে পালিয়ে গেছে, আর কারাকুল থেকে চাইনিজ ডাক নিয়ে এগোনো লোকগুলোও কোন অজানা কারণে উধাও হয়ে গেছে।
এরকম নির্জন জায়গায় আমাদের যে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে পড়তে হবে, এ-কথা ভাবিনি। ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় ছিল না। বালি এবং পাথরের মাঝে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরম বেড়ে উঠছিল। সাতিপ আলি নামের এক কিরগিজকে আমি কারাকুল থেকে দলে নিয়েছিলাম। কোনও উপায় না থাকায় ওকেই পাঠিয়েছিলাম কোকসেল উপত্যকার খানিক উঁচু অংশে গিয়ে চারণদারদের সঙ্গে কথা বলে পশুর দলের ব্যবস্থা করতে। যদিও জানতাম, ও কোনোভাবেই আগামীকাল সকালের আগে কোনও ব্যবস্থা করতে পারবে না। দুপুর দুটো নাগাদ খানিক স্বস্তি এসেছিল দূর থেকে একদল ব্যবসায়ীকে চারটে ঘোড়ার সঙ্গে এগিয়ে আসতে দেখে। কারাকুল ছাড়ার পর এই প্রথম কোনও ভ্রমণকারীর দেখা পেয়েছিলাম। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম ওদের ঘোড়ার পিঠে আমাদের মালপত্রগুলো চাপিয়ে এর পরের সামরিক ঘাঁটি কৌরিক-কুরঘানে পৌঁছে দিতে। ঘোড়ার পিঠ থেকে ওদের মালপত্র নামিয়ে আমাদের মালপত্র চাপিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম আমরা। অনেকটাই বেশি মালপত্র চাপাতে হয়েছিল। কিন্তু হাঁটার পথটা ছিল খুব ভালো। প্রায় দশ মাইল রাস্তা ধীরে ধীরে নেমে চলা। উপত্যকা যতই চওড়া হতে শুরু করেছিল, ততই দৃশ্য মনোরম হচ্ছিল। আমরা কোক-মৈনাকের নদীর ডানদিকে আসার পর প্রথমবার এই অঞ্চলের চাষজমির দেখা পেয়েছিলাম। কৌরিক-কুরগানে যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম তাতে মন ভরে গেছিল। এতক্ষণ পর্যন্ত এই অঞ্চলে পেয়ে আসা ব্যবহারের ঠিক উলটো। কয়েকজন কিরগিজ বৃদ্ধ রঙচঙে সুন্দর কোট পরে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের আগামী দু-দিনের যাত্রাপথের জন্য সঙ্গে সঙ্গে পশুদলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আগামী যাত্রাপথ খুব একটা সহজ নয় বলে কয়েকজন পুরুষকে সঙ্গে যাবার হুকুম দিয়েছিলেন। সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত ঘোড়া নিতেও বলেছিলেন। কৌরিক-কুরঘান গেজের অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক ঠান্ডা। সন্ধেবেলা হালকা বৃষ্টিতে মাটি ভিজে যাবার পর একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে উঠেছিল গুল্মে ভরা আমার তাঁবুর চারপাশ থেকে। মন আর শরীর দুটোই চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল গন্ধে।
নয় গিরিপথে
কৌরিক-কুরগান থেকে সমভূমির নীচের দিকে যাবার পথ অন্য সময়ে নদীর ধার ধরে হলেও গরমকালের এই সময় বন্যাজনিত কারণে সে-পথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। তখন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই পথ টোকুজ-দাওয়ান নামে পরিচিত। যার অর্থ ‘নয় গিরিপথ’। এই গিরিপথের প্রথমটি বেশ কয়েক মাইল খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে চলার পর এসেছিল। পাহাড়ের গায়ে অজস্র ঝোপঝাড় আমাকে সিন্ধু নদের ধারের দৃশ্য মনে করিয়ে দিয়েছিল। গিরিপথের মাথায় পৌঁছানোর পর আমি এক দৃশ্য দেখে ভীষণ খুশি হয়ে পড়েছিলাম। অদ্ভুতভাবে পথটি গিয়েছে গাছে ছাওয়া ওট ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে। জায়গাটির উচ্চতা ন’হাজার ফুটের ওপর। কৌরিক-বেল নামের জায়গাটিকে রুক্ষ পাথরের সাম্রাজ্যের মাঝে মরূদ্যান মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটি এই অঞ্চলের হিল স্টেশন হতে পারে। কয়েক মাইল পথ ধীরে ধীরে নামতে নামতে একটা বাঁক নিয়ে উপত্যকার উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নিয়েছিলাম।
ইতিমধ্যে আশেপাশের দৃশ্য আমূল বদলে গেছিল। গিরিখাতের পাথরভরা বুক থেকে সবুজের ছোঁয়া হারিয়ে গেছে। গিরিখাতের দু-পাশের খাড়া পাথরগুলোর রঙ ধূসর-লালচে। পাথরগুলো চরম আবহাওয়ার কারণে ক্ষয়ে ক্ষয়ে অসাধারণ সব আকার পেয়েছে। বৃষ্টি, জমে ওঠা বরফের ধীরে ধীরে গলে যাওয়ার কারণে আমাদের পাথুরে চলার পথও বৈচিত্র্যময় ছিল। প্রায়শই আমাদের চলতে হচ্ছিল নীচের দিক ক্ষয়ে থাকা ঝুলন্ত পাথরের ওপর দিয়ে। একজায়গায় এসে পথ থমকে দাঁড়াল একটা খাড়া পাথরের তলায়। একটা সরু সুতোর মতো জলের ধারা থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে পাথরের পায়ের কাছে বালির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আট ফুটের মতো উঁচু এই পাথর না চড়তে পারলে কোনোভাবেই এগোনো সম্ভব ছিল না। এই বিশাল পাথরের নীচের অংশটা এত খাড়া ছিল যে মালপত্রসহ ঘোড়াকে টেনে তোলা অসম্ভব ছিল। কাজেই ঘোড়ার পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে সেগুলো সঙ্গের লোকজনেরা পিঠে করে তুলেছিল পাথরের মাথায়। এই পাথরের ওপর ঘোড়াগুলোকে টেনে তোলা অসম্ভব বুঝে দলের লোকজনরা খানিক দূরের কতগুলো পাথরের খোঁচ খুঁজে বের করেছিল, যেগুলো মারাত্মক বিপদজনক ও খাড়াই হলেও পাথরের উচ্চতাগুলো কম হওয়ায় পাহাড়ি ঘোড়াগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে কোনোক্রমে ওপরে তোলা গেছিল। অনেক কসরতের পর আমরা কোনও অঘটন ছাড়াই পৌঁছতে পেরেছিলাম দ্বিতীয় গিরিপথের শীর্ষে। ওখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বহু দূরের বরফ-ঢাকা শৃঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছিল। প্রায় সাড়ে দশ হাজার ফুট উচ্চতা খুশ-কিশ্লাক উপত্যকার উচ্চতম বিন্দুর। রুক্ষ, শুকনো বালিপাথরের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে প্রায় মাইল তিনেক যাবার পর আমরা একটা ঝরনা পেয়েছিলাম। পরিষ্কার জল। সারাবছর জল থাকে এই ঝোরায়। গরমে দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে সবাই এখানে খানিক বিশ্রাম নেয়। ঘোড়াসুদ্ধু আমরা সবাই হাঁপ ছেড়েছিলাম পানীয় জলের ছোঁয়া পেয়ে।
২৮ জুলাই হেঁটে আমরা গেজ গিরিসংকটের তাশমালিকের বিশাল মরূদ্যানে পৌঁছেছিলাম। খুব সকালে হাঁটা শুরু করে আমরা একদিনে দু-দিনের রাস্তা পার হয়েছিলাম। ভোরবেলার খানিক সময়ের জোরালো হাওয়া চারপাশের গুমোট ভাব আর মেঘগুলোকে সরিয়ে দিয়েছিল। আকটিকেন-বেল গিরিপথের মাথায় পৌঁছে আশেপাশের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। স্বর্গ বোধহয় একেই বলে! সুদূর পশ্চিমে মুজতাগ-আগা আর গেজ-দারার বরফ-শৃঙ্গের মাঝের আকাশ জুড়ে একের পর এক পাহাড়-চূড়া। এর মধ্যে সরগুলুকের শঙ্কু আকারের চূড়াকে তার আকৃতির জন্য স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল। পুবে ইয়াঙ্গি-হিসার, ওপাল এবং তাশমালিক সমভূমির সবুজে ছাওয়া চাষের ক্ষেত কার্পেটের মতো বিছিয়ে। সব ছাড়িয়ে দিগন্তের হালকা হলদে আভা বুঝিয়ে দিচ্ছিল মরুভূমির খুব কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। যদিও সে-সময় আমাদের সামনে ছিল নানা রঙে রাঙানো পাথুরে সাম্রাজ্যের গোলকধাঁধা। নীলাভ-ধূসর থেকে টেরাকোটা। প্রখর সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল পাথরের শরীর। এটি ছিল এমন একটি দৃশ্য যা আমার স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবে। এরপর কয়েক ঘণ্টা ধরে তালন্তিক, সারভাই-বেল এবং টোপালু-বেল গিরিপথ একের পর পার হবার সময়ও প্রকৃতির এই শোভা নানাভাবে আমাদের চোখের সামনে ছিল। এই গিরিপথগুলো মোটের ওপর সমতলই ছিল আর যাত্রাপথও ছিল মসৃণ। ধীরে ধীরে নামতে নামতে আমরা পৌঁছেছিলাম কিজিল জিলগায়। কিজিল জিলগা যার অর্থ ‘লাল-উপত্যকা’। সার্থক নামকরণ। চতুর্দিক ঘিরে লালচে-বাদামি পাহাড়। প্রায় ছয় মাইল পথ একটা শুকিয়ে যাওয়া নালার ওপর দিয়ে হেঁটে আবার পৌঁছেছিলাম গেজ নদীর ধারে। প্রায় মাইল খানেক চওড়া গেজ নদী এখানে অজস্র ধারায় ভাগ হয়ে দুরন্ত গতিতে বয়ে চলেছে।
নদীর ধার ধরে মাত্র মাইল দেড়েক দূরত্ব ছিল যাকে খানিক রাস্তা বলা যায়। তারপর নদীর স্রোতে ভেসে এসে জড়ো হওয়া নুড়ি-পাথরের স্তূপের ওপর দিয়ে আমাদের এগোতে হচ্ছিল। আলগা তীক্ষ্ণ পাথরের ওপর দিয়ে চলা ভীষণ কঠিন, মানুষ-পশু সবার কাছেই। গরমটাও ছিল অস্বস্তিকর। ছায়াতেও থার্মোমিটারে টেম্পারেচার দেখাচ্ছিল ৮৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। গিরিখাতের শেষ প্রান্ত থেকে যে রাস্তাটা সামনের দিকে এগিয়েছিল, সেটা ছিল খুব খাড়াই। ৩০ ডিগ্রিরও বেশি চড়াই। এখানে পশুদের মালপত্রের বোঝা ছাড়াই উঠতে কষ্ট হয়। আর আমাদের সঙ্গের ঘোড়াগুলোর পিঠ তো মালপত্র বোঝাই ছিল! শাগিলদিক দাওয়ান গিরিপথের শীর্ষে উঠে আমরা আবার নীচের দিকে নামতে নামতে পৌঁছেছিলাম মূল উপত্যকায়। কিন্তু উপত্যকায় পৌঁছেই টের পেয়েছিলাম সে-পথ কম ভয়াবহ নয়। বড়ো বড়ো পাথরে ভর্তি উপত্যকার তলদেশ। আশা ছিল এই পথ হয়তো সমতল হবে। আমি সময় নিয়ে ভীত ছিলাম। পাথরের মাঝ দিয়ে চক্কর কাটতে কাটতে সময় চলে যাচ্ছিল। কারাকুল থেকে সঙ্গে আসা ঘোড়াগুলো দীর্ঘ ক্লান্তিকর দুরারোহ যাত্রার পর একের পর এক ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল। কৌরিক-কুরঘানের মানুষ ও তাদের দেওয়া গাইডের অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। ওরাই সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত ঘোড়া নিয়ে এসেছিল। সেই অতিরিক্ত ঘোড়াগুলোর পিঠে ক্লান্ত ঘোড়াগুলোর মালপত্র সরানোর পর আমরা এগোতে পেরেছিলাম। সামনেই ছিল আর ইয়ামালা বা কেপেক পাস। এই গিরিপথের শীর্ষে পৌঁছতে আমাদের দু-হাজার ফুটেরও বেশি চড়াই ভাঙতে হয়েছিল। গিরিপথের মাথায় পৌঁছে আমি আমাদের দলের অনেক আগে চলতে শুরু করেছিলাম। কারণ, আলো থাকতে থাকতে তাশমালিকে পৌঁছে আশপাশটা একটু বুঝে নিতে চাইছিলাম। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ যেখানে পৌঁছেছিলাম, সেটা ছিল সমতল হলেও পাথরে ভরা। খানিক নদীর পাড় ধরে হেঁটে একটা খালের ধারে পৌঁছেছিলাম। খালের পাশ দিয়ে খানিক এগোতেই পৌঁছেছিলাম বিস্তৃত এক চাষজমিতে। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই দেখি সবুজ চাষজমি। ফসলে বোঝাই। হিমবাহ থেকে নেমে আসা জল নালা কেটে জমিতে ফেলে তার উর্বরতা বাড়ানো হয়েছে অনেক। তখনও অনেক লোক কাজ করছিল জমিতে। দিনের পর দিন পাথরের মরুভূমি পার হয়ে এসে জীবনের চিহ্ন দেখে মনটা ভরে গেছিল।
তাশমালিক সমভূমিতে
যখন তাশমালিকের প্রথম বাড়িটার কাছে পৌঁছেছিলাম তখন আলো পড়ে এসেছিল। মাটির দেওয়াল দেওয়া বাড়ির উঠোনজোড়া বাগান নিভু নিভু আলোতে দারুণ সুন্দর লাগছিল। গ্রামের রাস্তার দু-ধারে উইলো আর পপলার গাছের সারি। আমি বেগের বাড়ির খোঁজ করছিলাম। একেই আগে খবর পাঠিয়েছিলাম আমাদের জন্য নতুন ঘোড়ার দলের ব্যবস্থা করে রাখতে। গাধার পিঠে চেপে একজন বয়স্ক ‘দিহকান’ (চাষি) যাচ্ছিলেন। তাঁকে বেগের কথা জিজ্ঞেস করতে সানন্দে আমাকে বেগের বাড়ি নিয়ে চললেন। একের পর এক বাড়ি আর বাগানের পার হয়ে যায়, বেগের বাড়ি আর আসে না। মাইলের পর মাইল রাস্তা পার হয়ে যায়। খুব ক্লান্ত লাগলেও ধৈর্য ধরা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। আমার মনে ছিল না যে পূর্ব তুর্কিস্তানে অনেকগুলো ছোটো ছোটো গ্রাম আর বিস্তৃত চাষের জমি নিয়ে একটা অঞ্চল হয়, আর সেই পুরো অঞ্চলের নাম একটাই হয়। বাস্তবে এটি একটা ছোটো জেলা। আর এই জেলার অধীনের সব জায়গার নাম ওই একটাই হয়। প্রায় ঘণ্টা চোদ্দ ধরে নাগাড়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে আর পায়ে হেঁটে আমার তখন সঙ্গিন অবস্থা। অবশেষে বেগের বাড়ি পৌঁছে শুনলাম সে এখন এখানে নেই, কাশগরে গেছে। বুঝলাম আমাদের ক্লান্ত ঘোড়ার দল নিয়েই এগোতে হবে। বৃদ্ধ আমাকে অন্ধকারে কয়েক মাইল পথ তার নিজের গাধার পিঠে চেপে এসে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছিল যেখানে শিবির গেড়েছিল আমার লোকেরা। সব মালপত্র নিরাপদেই পৌঁছলেও সবক’টা ঘোড়া ক্লান্তিতে ধুঁকছিল। আমার তাঁবু খাটানো হয়েছিল সদ্য কাটা ‘বেদা’ গুল্মের ঝোপের পাশে। এই লুসার্ন বা বেদা গুল্ম মূলত পশুকে খাওয়ানো হয়। এর ঔষধিগুণও প্রচুর। সুন্দর গন্ধ এই গাছের। যখন হাত-মুখ ধুয়ে একটু পরিষ্কার হবার সুযোগ পেলাম তখন রাত দশটা বেজে গেছে। মাঝরাতে খাওয়া সেরে তাঁবুতে ঢুকে বিশ্রাম নিতে পেরেছিলাম খানিক।
২৯ জুলাই খুব ভোর হতে না হতেই সবাই উঠে পড়েছিল। কাশগর পৌঁছানোর জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এখান থেকে কাশগর আর মাইল পঞ্চাশ দূরে। আমি চাইছিলাম পারলে সেই দিনই কাশগর পৌঁছে যেতে। এদিকে সমস্যা শুরু হল ঘোড়া নিয়ে। কৌরিক-কুরঘান থেকে আসা ঘোড়ার সঙ্গের লোকেরা কাশগর যাবার জন্য রাজি হচ্ছিল না। স্বাভাবিক, কারণ তাদের আমাদের এই পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের সমস্যার কথা জানতে পেরে অযাচিতভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন চাইনিজ পোস্টের ডাক বিভাগের দায়িত্বে থাকা আলিয়া বেগ। ভোর ছ’টার মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটা চাঙ্গা ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঘোড়ার ব্যবস্থা হয়ে যেতে আমাদের সব মালপত্র চাপানো হয়ে গেলে, আমি এগিয়ে চললাম কয়েকটা ঘোড়াকে সঙ্গে করে। আমার মন খুশিতে ভরে ছিল, কারণ, জানতাম কাশগরে আমার জন্য ছাদওয়ালা ঘর অপেক্ষা করছে। ধূসর কুয়াশায় আকাশ ঢেকে থাকলেও পশ্চিমের উঁচু পাহাড়গুলোর আভাস হালকা টের পাওয়া যাচ্ছিল। ওই পাহাড়ের কাছেই ওপাল। বিস্তীর্ণ চাষের ক্ষেত সমৃদ্ধ অঞ্চল, আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। ওখানে পৌঁছতে সবার আগে পার হতে হবে গেজের এক উপনদীকে। এখানে ওই নদীর নাম ইয়ামানিয়ার। এই অঞ্চলের সেচের জলের প্রধান উৎস এই নদী। সমতল জুড়ে অগণিত ধারায় ছড়িয়ে এই নদী। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা নদীর জল অধিকাংশ জায়গায় চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর। এই নদী পার হবার জন্য বিশেষ সতর্কতা না নিলেই বিপদ ঘটে যেতে পারে মুহূর্তে। এই নদী পার করাবার জন্য পথের নির্দিষ্ট জায়গায় আছে প্রশিক্ষিত গাইড। এরা জানে কোথায় নদীর জল কম আর কী করে নিরাপদে নদী পার হওয়া যায়। ঘণ্টা খানেক পথ চলার পর এদের সাহায্যে মালপত্রসহ হাঁটু-জল পার হয়ে নদী টপকে অন্য পাড়ে পৌঁছাই। তারপর সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল এগিয়ে চলি তরতরিয়ে। একটি ছোটো চিনা সেনা আবাসের কাছে পৌঁছে আমার ডাকের ঘোড়া পালটাতে হয়েছিল। কিন্তু এখানে অনেকটা সময় নষ্ট হয় ডাকবাহকদের নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে। কারা আমাকে নিয়ে কাশগর যাবে এই নিয়ে চলেছিল ঝগড়া। খানিক পর দেখলাম আমার মালপত্র চারটে ভাগে ভাগ করে, চারটে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে একজন করে ঘোড়সওয়ার তার ওপর চেপে বসেছে। আমার মনে হয়েছিল ব্যবস্থাটা ভালোই, ফলে আমি কোনও আপত্তি করিনি। এতে লাভই হয়েছিল, কাশগর পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত আর বিশেষ কোথাও থামতে হয়নি।
ওপাল হল অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে একটি সমৃদ্ধ কৃষি অঞ্চল। বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, চাষের ক্ষেত আর ফল বাগানের মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পথের দু-পাশে সার দেওয়া পপলার আর উইলো গাছের সার। সবুজে ছাওয়া চারদিক। পেছনে ফেলে আসা নির্জন রুক্ষ শুষ্ক বরফ, বালি-পাথরের ঠিক বিপরীত। মনমাতানো দৃশ্য। জমিতে তরমুজ পাকছে। বাড়ির সামনের বাগানগুলো ভরে আছে নানা সবজিতে। ছোটো ছোটো নালা দিয়ে পলিসহ জল পৌঁছচ্ছে চাষের ক্ষেতের প্রতিটি কোনায়। পরিশ্রম আর সঠিক পরিকল্পনার ছাপ চারদিকে। রাস্তার ধারের দোকান থেকে কয়েকটা আপেল আর খানিক খেজুর কিনেছিলাম। একজায়গায় দাঁড়িয়ে ওগুলো দিয়ে খানিক টিফিন সেরেছিলাম। বেশ কয়েক মাস পর ফলের স্বাদ পেয়েছিলাম।
আরও ঘণ্টা দেড়েক পর আমরা ওপালের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছিলাম। ওপালের উর্বর মরূদ্যান ছেড়ে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে শুরু হয়েছিল তুর্কিস্তান মরুভূমির ঊষর পথে যাত্রা। বরফের রাজ্য ছেড়ে বালির সাম্রাজ্যে। জনশূন্য গিরিখাত ছোটো ছোটো তামারিস্ক ও ওই জাতীয় গুল্মে ভরা। অবাক লাগছিল, ভরদুপুরেও এমন কিছু গরম লাগছিল না। তাপমাত্রা ৯৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। পুবদিক থেকে বয়ে আসা হাওয়া শরীরের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। কিন্তু সূর্যের আলো এত জ্বলজ্বল করছিল যে সানগ্লাস না পরে থাকতে পারিনি। একের পর এক বালির টিলা আসা শুরু হতেই আমার সঙ্গের ঘোড়াওয়ালারা এক অদ্ভুত সুরে সবাই মিলে গান গাইতে শুরু করেছিল। ওই নির্জন বালির রাজ্যে ওই সুরেলা কণ্ঠগুলো যেন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এক মায়াবী জগতে। বিকেল তিনটে নাগাদ মরু রাস্তা ছেড়ে টোকুজাক মরূদ্যানে পৌঁছেছিলাম। সাইবাগ নামের একটি জায়গায় রাস্তার ধারের ছোট্ট সরাইখানার পাশে পপলার গাছের একটি বনের পাশে ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ি রেখে বেশ কিছু পর্যটক বিশ্রাম নিচ্ছিল। সরাইখানায় স্তূপীকৃত ছিল তরমুজ আর জালাভর্তি জল।
খানিক আগে পেছনে ফেলে আসা পথের দৃশ্য আমার মন জুড়ে ছিল। একের পর এক সবুজে মেখে থাকা ছোটো ছোটো গ্রাম। রাস্তার দু-পাশে সার দেওয়া পপলার, মালবেরি, এপ্রিকট আর নানা ফলের গাছ। বাদামি মাটির দেওয়াল দেওয়া বাড়ির নিকনো উঠোন জুড়ে সবজি আর ফলের বাগান। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোদে পোড়া ইটের সমাধিসৌধ, ভাঙা মসজিদ—এক-একটি নির্ভেজাল গ্রাম। মাঝে-মাঝেই গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে আমার ঘোড়াওয়ালার যখন এগোচ্ছিল, বাড়ি থেকে শিশু আর মহিলারা বেরিয়ে এসে বাড়ির দরজায় দাঁড়াচ্ছিল। প্রাপ্তবয়স্ক কোনও লোককেই টোকাজুকের এই সরাইখানা তথা বাজারের আগে পর্যন্ত বসে থাকতে দেখিনি। যে কয়েকজনকে দেখেছি তার সবাই কোনও না কোনোভাবে চাষের জমির কাজে ব্যস্ত ছিল।
এখনও পর্যন্ত রাস্তায় সেরকম কোনও ধুলো না পেলেও এবার সেটা নজরে এসেছিল। এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যে পথ দিয়ে এসেছি সেগুলো ছিল গ্রামের পথ। কিন্তু এখন এসে পৌঁছেছি হাই-রোডে। রাস্তা এখানে যথেষ্ট চওড়া। ঘোড়া আর গাধায় টানা কাঠের গাড়ি ‘আরাবস’ থেকে ওঠা ধুলো মেঘের মতো ঢেকে রেখেছিল চারধার। আমি তাড়াতাড়ি কাশগর পৌঁছতে চাইছিলাম। বিকেল পাঁচটার সময় সাদাক আখুন আমাকে বলেছিল যে কাশগর আর খুব বেশি দূর নয়।
আমি জানতাম কাশগর পৌঁছতে একটা নদী পেরোতে হয়। কিন্তু ঘণ্টা খানেক ঘোড়া ছোটানোর পরও কোনও নদীর দেখা না পাওয়ায় খানিক হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। খানিক এগিয়ে রাস্তার এক বাঁক পার হতে একটা নদী এসেছিল। সামান্য জল ছিল তাতে। কিন্তু কোনও বড়ো দেওয়াল বা মিনার নজরে না আসাতে বুঝেছিলাম এটা সেই নদী নয়, যা শহরের পাশ দিয়ে গেছে। এটা ছিল অন্য একটা নদী, আক-সু (হোয়াইট স্ট্রিম)। কাশগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীরই একটা শাখা। এই নদীকে তেলউইচিকও বলে। দু-পাশে ধানের ক্ষেত। পড়ন্ত আলোয় আর ছুটতে না চাওয়া বেদম হয়ে যাওয়া ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি হয়ে আরও মাইল তিনেক যাবার পর এসেছিল কিজিল-সু (রেড স্ট্রিম) যার প্রতীক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ। সত্যিকারের লালচে জলের ধারা পার হয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলাম। গলির মধ্যে মহিলারা অদ্ভুত গড়নের টুপি পরে দল বেঁধে আড্ডায় মশগুল।
মূল শহরের উঁচু পাঁচিল যখন দেখা দিল তখন রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বিশাল উঁচু মাটির পাঁচিল আমাকে ভ্রমণ-সংক্রান্ত নানা বইতে দেখা মধ্যযুগীয় পুরোনো দুর্গের ছবি আর যুদ্ধের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। পাঁচিলের বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। নিস্তব্ধ চারদিক। শহরে প্রবেশের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছিল। সাদাক আখুন আমাকে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে বাঁদিকে নিয়ে পপলার গাছে ছাওয়া একটা রাস্তা দিয়ে নিয়ে টিমটিমে আলো জ্বলতে থাকা একটা বাড়ির গেটের সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। ওটাই মিস্টার ম্যাকার্টনির বাড়ি, আমার আগামী কয়েকদিনের আস্তানা। অনেক রাতে হলেও আমার পৌঁছানোটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। আমি দরজা খুলে চওড়া পাথর বিছানো রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই মিস্টার এবং মিসেস ম্যাকার্টনি আমাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন। নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন ওদের দারুণভাবে সাজানো অতিথিশালায়। পরিষ্কার হয়ে পোশাক পালটে ডাইনিং রুমে পৌঁছে মনে হয়েছিল আমি এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে নয়, আছি ইউরোপের কোনও বিলাস বাংলোয়।
ক্রমশ